আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রথম আলো জাতিকে কী দিয়াছে?

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

কিছুদিন আগে ব্লগে এবং ফেসবুকে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের একটি লেখার লিঙ্ক শেয়ার করছিলাম। তখন লিঙ্কের সঙ্গে এ বাসনাও রাখছিলাম যে, কখনো সুযোগ পাইলে মতি ভাইয়ের প্রবন্ধ নিয়া আলোচনা ফাঁদবো। কাজে কর্মে সে সুযোগ মিলে নাই। ফলে আলোচনা হয় নাই।

কিন্তু এর মধ্যে প্রথম আলোর কিছু সমালোচনা করছি নানা ইস্যুতে। এইসব সমালোচনার সূত্রে বন্ধুদের অনেকের ধারণা হইছে, আমি প্রথম আলোর ঘোরতর বিরোধী একজন লোক। চান্স পাইলে কড়া ভাষায় এর সমালোচনা ফেঁদে একে এক হাত দেইখা নেওয়াই আমার উদ্দেশ্য। সেদিন ফেসবুকে এক বন্ধুর বক্তব্য পড়ে তো আঁতকে উঠলাম রীতিমতো। উনি আমার বিরোধিতার সঙ্গে খ্যাতিলাভের বাসনাকে সম্পর্কিত করে ব্যাখ্যা করলেন।

গত ছয়-সাত বছরের সংক্ষিপ্ত সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা থেকে মেইনস্ট্রিম সাংবাদিকতা সম্পর্কে অল্প কিছু অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। মেইনস্ট্রিম মিডিয়া বিষয়ে আমার বিশেষ আগ্রহ আছে। এর ভেতরের কর্মী হিসাবে যেমন এর বাইরের নাগরিক হিসাবেও তেমন। ফেসবুক, ব্লগ ইত্যাদিকে অল্টারনেটিভ মিডিয়া টুল হিসাবে গণ্য করে সেইগুলাতে কোনো নিউজ, কোনো প্রেজেন্টেশন, কোনো ইস্যুতে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার অবস্থান নিয়ে আমার বা আমাদের অনেকের সমালোচনা থাকতে পারে। সে আলোচনা আমরা করি, অনেকে করি না।

অনেকে ঢালাও বিরোধিতার মধ্য দিয়া ব্ক্তব্য জানাইতে চাই, অনেকে বিষয় ধরে আলোচনা করতে পছন্দ করি। সব আলোচনাই আমার তীব্র কৌতুহলের বিষয়। আমি বিষয় ধরে আলোচনা করতে ভালোবাসি। কিন্তু মোটাদাগে প্রথম আলো মানে বাংলাদেশে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার বিকাশকে আমি কোন চোখে দেখি সেইটা কোথাও বলে রাখার প্রয়োজন আছে। এইখানে আমার অবস্থা অনেকটা রাধার মতো।

মেইনস্ট্রিম মিডিয়া আমার কাছে শ্যাম। আর তার বিরোধিতা অর্থাৎ অলটারনেটিভ মিডিয়া হলো কূল। ......................... বাংলাদেশে যারা আপোষহীন বিপ্লবী, সংস্কারক, অলটারনেটিভ দার্শনিক, অ্যাকটিভিজমের কাণ্ডারি তাদের প্রতি মোটাদাগে আমার কিছু অনাস্থা আছে। আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমাদের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দলগুলোর মধ্যে যে দলটিকে আমি সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করি সে দলে কি আমি কখনো যোগ দিব? উত্তর না। সবচেয়ে সঠিক হইলেও এই দলটি বিকশিত হয় নাই।

পার্টি হিসবে গড়ে ওঠে নাই। সবেচেয়ে বিপ্লবী নেতৃত্ব দলটিকে গড়ে তুলতে পারে নাই। যার দর্শন ও কর্ম পদ্ধতি আমার সবেচেয়ে পছন্দ তার প্রতিষ্ঠানটি ভাল নয় মোটে। সেখানে আমি কখনো কাজ করবো না বা করার বাসনা পোষণ করবো না। আমাদের সমাজের যারা প্রতিষ্ঠান বিরোধী, বিপ্লবী, পরিবর্তনের নায়ক তাদের মোটাদাগের বৈশিষ্ট্য হলো-- *প্রতিষ্ঠান বিরোধী/বিপ্লবীরা কোনো ধরনের পত্রিকা দাঁড় করাইতে পারেন নাই।

* বিপ্লবীরা কোনো পার্টি দাঁড় করাইতে পারেন নাই। *সংস্কারকরা কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন দাঁড় করাইতে পারেন নাই। বিরোধিতার দর্শনের শেষ পরিণতি ব্যর্থতাই কি না মাঝে মাঝে ভাবি আমি। উল্টোদিকে, বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকায়ে দেখি যারা কম-বেশি আপোষ করেন, কিছুটা বিপ্লবী এবং অনেকটা কর্মোদ্যগী, মধ্যপন্থী মানসিকতার ব্যক্তি তাদের সাফল্যটা চোখে দেখার মতো। বাংলাদেশীরা নিজেদের উদ্যোগে বিশাল প্রতিষ্ঠান গড়তে পারে।

সে প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবশালী করে তুলতে পারে এবং ব্যাপক মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে এমন উদাহরণ আমাদের সামনে আছে। ড. মুহম্মদ ইউনুসের গ্রামীন ব্যাংক. ফজলে হাসান আবেদের ব্রাক, মতিউর রহমানের প্রথম আলো এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি উদাহরণ হিসাবে। এরকম বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের উদাহরণ দেওয়া যাবে। অকর্মণ্য বিপ্লবীরা যে প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করেননি। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে তুলনীয় কোনো সংগঠনও তারা তৈরি করতে পারেননি।

................. প্রথম আলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মিডিয়া। স্বাধীনতার আগে পরে কোনো মিডিয়াই প্রথম আলোর অর্জনকে ছুঁতে পারে নাই। আমাদের সমাজে এর সর্বব্যাপ্ত প্রভাব-প্রতিপত্তির কথা মনে হলে শিউরে উঠতে হয়। হয়তো আনন্দবাজারের অর্জনের কাছে এটি সামান্য। কিন্তু বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়া পরিপ্রেক্ষিতের কথা মনে রাখলে মিডিয়ায় প্রথম আলোই স্বাধীনতার পর আমাদের বড় অর্জন।

অত্যন্ত অল্প সময়ে এটি একটি টীম হিসেবে গড়ে উঠেছে। দ্রুত মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। যারা গত এক দুই দশকে সংবাদপত্রের হোঁচট খেয়ে চলার ইতিহাস খেয়াল করেছেন তারা স্পষ্ট জানবেন, প্রথম আলো যে অন্য দশটা পত্রিকার মতো পরিণতি বরণ করে নাই তার মূল কারণ মতিউর রহমানের ম্যাজিক। ১. প্রথম আলো বোধহয় স্বাধীনতার পর প্রথম একটি সফল পত্রিকা যা কোনো রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে প্রকাশিত হয় নাই।

পত্রিকা দিয়েই পত্রিকার ব্যবসা করার উদ্দেশ্য থেকে এটি প্রকাশিত হয়েছিল। এবং এটি সে কাজে সফল হয়েছে। ফলে, এটি একটি ভাল ইনভেস্টমেন্ট এবং ফল হিসেবে লাভ জনক ব্যবসা। ২. প্রথম আলো বাংলাদেশের পত্রিকাগুলোর মধ্যে টীম স্পিরিটের দিক থেকে সবচেয়ে সংহত পত্রিকা। এক দশকে নানা সমস্যা সত্ত্বেও এটি মুখ্য টীমটিকে ধরে রেখেছে।

৩. সাংবাদিকদের মূল্যায়ন বেতন-ভাতা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম আলো যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছে। যা সংবাদপত্রের সার্বিক অবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। প্রথম আলোর আগে কোনো পত্রিকার ধান্দাবাজ সাংবাদিক ব্যতিরেকে কেউ গাড়িতে ওঠার কথা চিন্তা করতে পারতো না। ৪. সংবাদ পরিবেশন, ভাষা ও উপস্থাপনার ক্ষেত্রে সর্বসাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয় সাধান করে বিকশিত সাংবাদিকতার যে ধারা তৈরি হয়েছিল অন্য পত্রিকাগুলোর মাধ্যমে প্রথম আলো তাকে চূড়ান্তভাবে ধারণ করেছে। সংবাদপত্রের ঘাড়ে চেপে বসা পুরানা বহু ভূতকে তাড়িয়ে দিয়েছে।

৫. সফল পত্রিকা হওয়ার পরও মালিকের ধান্দাবাজির হাতিয়ারে পরিণত হয়নি। ৬. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর ছাড়া বাকী সময় মোটামুটি ভাবে কোনো রাজনৈতিক শক্তির পকেটে ঢুকে পড়েনি। ৭. কিছু কিছু নীতির ক্ষেত্রে প্রথম আলো মোটামুটি স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে পেরেছে। .......................... একবার শুনেছিলাম, মানুষের কী করা উচিত এইটা জানতে নাকি বাইবেল পড়বে হবে। আর মানুষ কী করে সেইটা জানার জন্য নাকি সংবাদপত্র পড়তে হয়।

কিন্তু প্রথম আলো এক পত্রিকা যেখানে মানুষ কী করে আর মানুষের কী করা উচিত দুইই থাকে। একই সঙ্গে এটি বাইবেল ও সংবাদপত্র। প্রথম আলো মূলত কি বিক্রি করে এ প্রশ্ন করলে আমার উত্তর হবে নৈতিকতা। অথচ এর বিক্রি করার কথা ছিল সংবাদ। প্রথম আলো সংবাদ বিক্রি করে বটে কিন্তু নৈতিকতার মোড়কে মুড়িয়ে।

শুরু থেকে এর বিকাশের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে, এটি ম্যানুফ্যাকচারার অফ এথিকস হিসেবে বেড়ে উঠেছে। মানুষের সেবা, দুস্থদের পাশে দাঁড়ানো, ভালর সঙ্গে থাকা এইসব ধর্মীয় কাজের মধ্য দিয়ে প্রথম আলোর বিকাশ হয়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত এটি গান্ধীবাদী নিজেকে বদলানোর ধর্মীয় অবস্থানে গিয়ে ঠেকেছে। একটি পত্রিকা যদি নৈতিকতার বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়, আর যদি সেটি বাংলাদেশের মতো দেশে ঘটে তবে চিন্তার অনেক কারণ আছে। কারণ, আমি লক্ষ্য করি, প্রথম আলো ভেতরে ভেতরে শিক্ষিত প্রগতিশীল মধ্যবিত্তের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

এখানেই পত্রিকাটির মূল সমালোচনা। বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসাবে নৈতিকতার বিশাল বাজার আছে। কিন্তু আধুনিক সময় অতিক্রম করার পর একটি পত্রিকা নৈতিকতা বেচবে কি না এটি আরেক নৈতিক প্রশ্ন। ........................... বাংলাদেশে পত্রিকার পাঠক বাড়ছে। পত্রিকাও প্রকাশিত হচ্ছে অনেক।

মানহীন অনেক পত্রিকাও পাঠক পাচ্ছে। তাতে মনে হয়, এদেশে দুই লাখ পত্রিকা চালানো কোনো ব্যাপার না। কিন্তু দুইলাখ সার্কুলেশন নিয়ে প্রথম আলোর মতো সর্ববিস্তারী প্রভাব তৈরি করা ভীষণ কঠিন। মতিউর রহমান একটি প্রতিষ্ঠান, একটি সংগঠন, একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছেন। সামনের দিনে হয়তো এর আরও বিকশিত রূপ আমরা দেখতে পাবো।

সে বিকাশ হয়তো সুখকর কোনো বিষয় হবে না। কারণ প্রথম আলোর কোনো প্রতিযোগী নেই। অদূর ভবিষ্যতে হবেও না। সো ছোট ছোট সমালোচনা দিয়ে একে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে।

(কী একটা অগোছালো লেখা লিখলাম!)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।