আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমরা ৭২ এর সংবিধানে ফেরত যাবো নাকি যাবো না? - যারা ৭২ এর সংবিধান ও বর্তমান সংবিধান এর মধ্যে বিরোধ কি তা ভালো ভাবে বোঝেন না, তাদের জন্য এই পোস্ট।

FB -- nahid.djmc@gmail.com

আমরা ৭২ এর সংবিধানে ফেরত যাবো নাকি যাবোনা? চেষ্টা করেছি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে ৭২ এর সংবিধান ও তার পরবর্তী পরিবর্তিত রুপ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে। আমি কোন ডিসিশন দেইনি আতেল এর মত। আপনাদের সামনে তুলে ধরলাম সমগ্র ব্যাপারটা। সম্পূর্ণ পোস্টটা পড়ে আপনি নিজেই নিতে পারবেন ডিসিশন। অন্যের মতামত এর উপর নির্ভর করতে হবে না।

৭২ এর সংবিধান ও বর্তমান সংবিধান এর পার্থক্য বুঝতে হলে আপনাকে সংবিধানের কিছু বেসিক দিক জানতে হবেঃ যথাঃ ক)সংবিধানের গঠন (এটা না বুঝলে বুঝবেনই না কোথায় কি কি পরিবর্তন এসেছে নান সময় এ। ফলে আমার এই লেখাটি পড়ে আপনার কোনই লাভ হবে না। যাস্ট অন্য মানুষের মুখে এতদিন শুনে যে ফল পেয়েছেন, তার বাইরে কিছু হবে না। সুতরাং কষ্ট করে হলেও অঅমাদের সংবিধান এর গঠনটা বুঝবেন। আমি খুব সহজ করে উপস্থাপন এর চেষ্টা করেছি।

) খ)সংবিধান পরিবর্তন এর পর্যাক্রমিক ইতিহাস(এটা খুব খুব ইম্পর্টান্ট। কারন তা না হলে সংবিধান এর কিছু পরিবর্তন এর কারন আপনি বুঝবেন না। ) গ)সংবিধানের পরিবর্তন সমূহ এবং এ কারন। ঘ)সংবিধান ৭২ এ ফেরত গেলে কি কি পরিবর্তন আসবে বর্তমান সংবিধানে। এবার মূল আলোচনা শুরু করছি।

ক)সংবিধানের গঠনঃ ‌সংবিধান মূলত হয় ২ ধরনের। লিখিত আর অলিখিত। আমাদের দেশ এর সংবিধান লিখিত। পৃথিবীর অনেক দেশের সংবিধান ই অলিখিত। যেমনঃ বৃটেন, স্পেন প্রভৃতি।

লিখিত সংবিধান আছে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি রাষ্ট্রের। এইবার এই লিঙ্কে যান, Click This Link বাংলঅ সংবিধান একটি ডাউনলোড করে নিন। কারন লেখাটি বুঝতে হলে আপনাকে সংবিধান এর কিছু ব্যাপার হাতে কলমে জানতে হবে। আর তাছাড়া আমি চাইনা, আমার লেখা পড়ে আপনি বিভ্রান্তবোধ করেন। ডাউনলোড করে নিন।

তারপর ডাউনলোডকৃত সংবিধানটির সাথে আমার লেখা মিলিয়ে মিলিয়ে পড়তে থাকুন। প্রথমে আমাদের সংবিধান এর বেসিক গঠনটা আপনাকে বুঝতে হবে। আমাদের সংবিধান এ মোট ১৫৩টি অনুচ্ছেদ রয়েছে, যা ১১টি বিভাগে বিভক্ত। প্রতিটি বিভাগ কতগুলো সুনির্দিষ্ট ব্যাপার নিয়ে আলোচিত হয়েছে। একটু নিচে খেয়াল করুন।

বিভাগ আলোচিত বস্তু প্রথম বিভাগ প্রজাতন্ত্র (অনুচ্ছেদ নং ০১-০৭) দ্বিতীয় বিভাগ রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি (অনুচ্ছেদ নং ০৮-২৫) তৃতীয় বিভাগ মৌলিক অধিকার(অনুচ্ছেদ নং ২৬-৪৭) চতুর্থ বিভাগ নির্বাহী বিভাগ(অনুচ্ছেদ নং ৪৮-৬৪) পঞ্চম বিভাগ আইনসভা(অনুচ্ছেদ নং ৬৫-৯৩) ষষ্ট বিভাগ বিচার বিভাগ(অনুচ্ছেদ নং ৯৪-১১৭) সপ্তম বিভাগ নির্বাচন(অনুচ্ছেদ নং ১১৮-১২৬) অষ্টম বিভাগ মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রন(অনুঃ ১২৭-১৩২) নবম বিভাগ (ক) বাংলাদেশেরকর্মবিভাগ(অনুচ্ছেদ নং ১৩৩-১৪১) নবম বিভাগ (খ) জরুরী বিধানবলী(অনুচ্ছেদ নং ১৪১ক - গ) দশম বিভাগ সংবিধান সংশোধনী(অনুচ্ছেদ নং ১৪২- ) একাদশ বিভাগ বিবিধ(অনুচ্ছেদ নং(অনুচ্ছেদ নং ১৪৩-১৫৩) ১টা উদাহরন দিয়ে বুঝিয়ে দেই কিভাবে সংবিধানটা পড়বেন আপনি? যেমনঃ সংবিধান এর ১ম বিভাগের নাম "প্রজাতন্ত্র"। এই বিভাগটি প্রজাতন্ত্রের ব্যাপারে ৭টি অনুচ্ছেদ এর মাধ্যমে ৭টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছে। এই ৭টি অনুচ্ছেদের নাম যথাক্রমেঃ প্রজাতন্ত্র, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানা, রাষ্ট্রধর্মরাষ্ট্র, ভাষা, জাতীয় সঙ্গীত, পতাকা ও প্রতীক, প্রতিকৃতি, রাজধানী, নাগরিকত্ব প্রভৃতি ব্যাপার নিয়ে আলোচিত হয়েছে। এবার আপনার ডাউনলোডকৃত সংবিধান এর সাথে নিচের কিছু ব্যাপার মিলিয়ে নিন। তাহলে সহজেই বুঝতে পারবেন সংবিধান এর কোথায় কিভাবে কি বলা হয়েছে।

যেমন ১ম অনুচ্ছেদে নাম "প্রজাতন্ত্র"। এখানে আমাদের দেশের নাম বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, "বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা "গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ" নামে পরিচিত হইবে"। আবার, ৩য় অনুচ্ছেদ এর নাম "রাষ্ট্রভাষা"। এই অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, "প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা"। আবার ৬নং অনুচ্ছেদের নাম, "নাগরিকত্ব"।

এই অনুচ্ছেদের ২টি উপধারা। ২টি উপধারাতেই নাগরিকত্ব নিয়ে ২টি বেসিক নির্দেশনা আছে। যথাঃ "(১) বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। " এবং "(২) বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন। " সংবিধান মিলিয়ে পড়েছেন? না পড়ে থাকলে সংবিধান মিলিয়ে উপরের অংশটি পড়ুন আরেকবার।

এবার একটি ব্যাপার খেয়াল করুন। সংবিধান এর ১৫৩নং ধারার নিচে চলে যান। দেখবেন "প্রথম তফসিল" বলে একটি অংশ আছে। এই "তফসিল" জিনিসটি কি? একেবারে সহজ ব্যাপার। কোন ধারার যদি এক্সটেনশনের দরকার পড়ে বা কোন ধারার যদি বিস্তৃত পরিধির দরকার পড়ে তাহলে এই "তফসিল" দ্বারা তার এক্সটেনশন করা হয়।

যেমন, "চতুর্থ তফসিল" টি খেয়াল করুন। আপনার ডাউনলোডকৃত সংবিধানটির একদম নিচের দিকে। পেয়েছেন? না পেয়ে থাকলে খুজুন, পেয়ে যাবেন। এই "চতুর্থ তফসিল" এর নিচে লেখা আছে "১৫০ অনুচ্ছেদ"। তার নিচে লেখা আছে "ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানবলী"।

এখন ব্যাপারটি কি? আপনারা অনুচ্ছেদ নং ১৫০ এ চলে যান। খেয়াল করুন অনুচ্ছেদ নং ১৫০, "ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী"। এখানে বলা আছে, "এই সংবিধানের অন্য কোন বিধান সত্ত্বেও চতুর্থ তফ্সিলে বর্ণিত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী কার্যকর হইবে। " এইবার নিচে নেমে আবার চতুর্থ তফসিলে চলে যান। এইবার "চতুর্থ তফসিল" টা খেয়াল করুন।

এই তফসিলে বলা হয়েছে, ১৫০ নং এর এক্সটেনশন। অর্থাৎ অনুচ্ছেদ নং ১৫০এ বর্ণিত "ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী" কিভাবে হবে তা লেখা আছে এই "চতুর্থ তফসিল" এ। আমি কি আপনাকে বোঝাতে পারলাম কিভাবে "সংবিধান" পড়তে হয়? যারা বুঝেছেন তাদের অনেক ধন্যবাদ। আর যারা আগেই বুঝতেন তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী এতক্ষন বিরক্তিকর কিছু সময় আপনাকে পার করতে হল বলে। এইবার আমরা মূল আলোচনায় আসি।

আমরা ৭২ এর সংবিধানে ফেরত যাবো নাকি যাবো না সে বিষয়ে সিদ্ধানাত নিতে গেলে আপনাকে ১৯৭২ এর সংবিধান এ কি কি পরিবর্তন এসেছে তা জানতে হবে। সংক্ষেপে ৭২ এর সংবিধান এর সঙশেঅধনীগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরছিঃ প্রথম সংশোধনীঃ ১৭জুলাই, ১৯৭৩ বিষয়ঃ যুদ্ধাপরাধীসহ অন্যান্য গণবিরোধীদের বিচার নিশ্চিত করা। দ্বিতীয় সংশোধনীঃ ২২সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ বিষয়ঃ অভ্যন্তরীন বা বহিরাক্রমন গোলযোগে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বিপন্ন হলে সে অকস্থায় জরুরী অবস্থা ঘোষনার বিধান। তৃতীয় সংশোধনীঃ ২৩ নভেম্বর, ১৯৭৪ বিষয়ঃ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত চুক্তি অনুযায়ী বেড়ুবাড়ীকে ভারতের নিকট হস্তান্তরের বিধান। চতুর্থ সংশোধনীঃ ২৫জানুয়ারী, ১৯৭৫ বিষয়ঃ সংসদীয় শাসন পদ্ধতির পরিবর্তে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন পদ্ধতি চালুকরন এবং বহুদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে একদলীয় রাজনীতি প্রবর্তন।

পঞ্চম সংশোধনীঃ ৬ এপ্রিল ১৯৭৯ বিষয়ঃ ১৯৭৫ সালের ১৫আগষ্টের সামরিক অভ্যুথ্থানের পর হতে ১৯৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক সরকারের যাবতীয় কর্মকান্ডের ফরমান ও প্রবিধানের বৈধতা প্রদান। এই সময় ই বেশ কিছু বেসিক পরিবর্তন আসে সংবিধান এর। যথাঃ সংবিধানের মূলনীতি হতে "সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা" বাদ পড়ে ১৯৭৮ সালে। এছাড়াও "বিসমিল্লাহির-রহমানির রহিম (দয়াময়, পরম দয়ালু, আল্লাহের নামে)" - এটা সংবিধানে সংযোজিত হয় ২২শে এপ্রিল, ১৯৭৮ সালে। "বাঙালি" এর পরিবর্তে "বাংলাদেশী" জাতীয়তাবাদের প্রবর্তন করা হয় - ৩রা মার্চ, ১৯৭৮ সালে।

আর এই বিধানগুলো বৈধতা পায় পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে। ষষ্ঠ সংশোধনীঃ ৯জুলাই, ১৯৮১ বিষয়ঃ উপরাষ্ট্রপতি পদ হতে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের বিধান নিশ্চিতকরন। এই সময়ও বেশ কিছু বেসিক পরিবর্তন আনা হয সংবিধানে। যথাঃ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয় এই সময় ই। আর তা বৈধতা পায় এই ষষ্ঠ সংশোধনীর মাধ্যমে।

সপ্তম সংশোধনীঃ ১১নভেম্বর, ১৯৮৬ বিষয়ঃ ১৯৮২ এর ২৪শে মার্চের পর থেকে ১৯৮৬ সালের ১১নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক শাসনের অধীনে যে সমস্ত আদেশ জারি হয় তা অনুমোদনের জন্য। অষ্টম সংশোধনীঃ ৯জুন, ১৯৮৮ বিষয়ঃ রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দান। ঢাকার বাইরে ৬টি জেলায় হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন। Dacca এর নাম Dhaka এবং Bangli এর নাম Bangla পরিবর্তন করা হয়। নবম সংশোধনীঃ ১১জুলাই, ১৯৮৯ বিষয়ঃ প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট এর মেয়াদ সম্পর্কিত।

দশম সংশোধনীঃ ২৩জুন, ১৯৯০ বিষয়ঃ জাতীয় সংসদে ৩০টি আসন ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখা। একাদশ সংশোধনীঃ ১০আগষ্ট, ১৯৯১ বিষয়ঃ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের পূর্বপদে পিরে যাবার প্রসংগে। দ্বাদশ সংশোধনীঃ ১৮সেপ্টেম্বর, ১৯৯১ বিষয়ঃ সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন। ত্রয়োদশ সংশোধনীঃ ২৮মার্চ, ১৯৯৬ বিষয়ঃ অবাধ, সুষ্ঠু সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন। চতুর্দশ সংশোধনীঃ ১৭মে, ২০০৪ বিষয়ঃ ৪৫টি নারী আসন, প্রতিকৃতি সংরক্ষন, বিচারপতির বয়সসীমা প্রমুখ বিষয়।

এইবার আলোচনা করা যাক। আমি বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত সূত্র থেকে আলোচনা করছি। আপনারা আমার কোন ভুল থাকলে তা শুধরে দেবেন আশা করি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের কোন সংবিধান ছিল না। সে সময় "Proclamation of Independence"-এর মাধ্যমে সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয় এবং "Law Continuence Enforcement Order"-এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যেসব আইন বাংলাদেশে বলবৎ ছিল সেগুলোকে উপরোক্ত Proclamation এর সঙ্গে সঙ্গতি সাপেক্ষে অপরিবর্তিত অবস্থায় বলবৎ করা হয়।

পরে ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি "Provitional Constitution Of Bangladesh Order" জারি করা হয়। এর মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণপরিষদ গঠন করা হয় এবং আইন বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ পরিচালনার জন্য অস্থায়ী বিধান প্রণয়ন করা হয়। এরপর ২৩মার্চ,১৯৭২ সালে গন পরিষদ এ সংবিধান তৈরীর নির্দেশ জারি করা হয়। সংবিধান কমিটির প্রধান ছিলেন, ডঃ কামাল হোসেন। কার্যকর হয় ৪ নভেম্বর ১৯৭২ হতে।

ভারত আর বৃটেন এর সংবিধান এর আলোকে তৈরী বাংলাদেশের সংবিধান, গণপরিষদে বিস্তারিত আলোচনা, পর্যালোচনা ও বিতর্কের পর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর এ চুড়ান্তভাবে প্রণীত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে সংবিধান প্রণয়নের আগ পর্যন্ত সময়ে রাষ্ট্রপতি বিভিন্ন বিষয়ে প্রয়োজনীয় আদেশ জারি করতেন। সংবিধান প্রণয়নের পর বাস্তবতা বিবেচনায় এসব আদেশ ও তৎকালীন সরকারের সব কর্মকান্ডের বৈধতা দেয়ার প্রয়োজন ছিল। ফলে সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানবলি জারির ক্ষমতা দেয়া হয়। অনুচ্ছেদ ১৫০-এ বলা হয়েছে, "এই সংবিধানের অন্য কোন বিধান সত্ত্বেও চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত ক্রান্তিকালীন ও অস্থায়ী বিধানাবলী কার্যকর হইবে"।

এই অনুচ্ছেদের ক্ষমতা অনুসারে সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে ক্রান্তিকালীন বিধান যুক্ত করা যায়। এই অনুচ্ছেদকে ব্যবহার করে এ পর্যন্ত সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে মোট ১৭টি অনুচ্ছেদ সংযোজিত হয়েছে। এই অনুচ্ছেদগুলোর মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে প্রথম সংসদ অধিবেশন অনুষ্ঠান পর্যন্ত সব কার্যক্রমের বৈধতা দেয়া হয়। এর মধ্যে আছে গণপরিষদ ভঙ্গকরণ, প্রথম নির্বাচন, ধারাবাহিকতা রক্ষা ও অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার জন্য ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে সংবিধান প্রবর্তনের তারিখের মধ্যে প্রণীত বা প্রণীত বলে বিবেচিত সব আইন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও অন্যান্য আইনের বৈধতা, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী, বিচার বিভাগ প্রভৃতির বৈধতা। সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের অধীনে চতুর্থ তফসিল প্রথম সংশোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে।

এর মাধ্যমে তফসিলের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হয়। এই অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকারের বিধান ছিল। এরপর দুটি সামরিক শাসনের সব রকমের বৈধতার জন্য এই অনুচ্ছেদের আশ্রয় নেয়া হয়। ১৯৭৯ সলের ৬ এপ্রিল পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এতে অনুচ্ছেদ ১৮ যুক্ত করে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, বিচারপতি আবু সায়েম এবং মেজর জিয়ার সামরিক শাসনামলের সব কাজের বৈধতা দেয়া হয়। এতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত প্রণীত সব ফরমান, আদেশ, সামরিক আইন, প্রবিধান, সামরিক আইন অধ্যাদেশ ও অন্যান্য আইন এবং এই সময়ে সরকার কর্তৃক কৃত সব কাজকে বৈধতা দেয়া হয়।

১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ১৯ যুক্ত করে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনামলের বৈধতা দেয়া হয়। ১৮ অনুচ্ছেদের মতো এই অনুচ্ছেদেও বলা হয় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চে জারিকৃত সব সামরিক ফরমান, আদেশ ও আইন বৈধ এবং এসব নিয়ে উচ্চ আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। এরপর একাদশ সংশোধনী আনা হয় ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এবং স্বৈরতন্ত্রের পতনের পর। এরশাদ সরকারের পতনের পর সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে তৎকালীন প্রধান বিচরপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদ উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, নির্বাচন পরিচালনা করেন এবং নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করলে তিনি আবার প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফিরে যান। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সরকারের নির্বাহী বিভাগের প্রধান আর প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের প্রধান।

সরকারের এক বিভাগের প্রধানের পদ থেকে অন্য বিভাগের প্রধানের পদে যাওয়া এবং পুনরায় পূর্ববর্তী পদে ফিরে আসা যায় না। তাই তার এই পদ পরিবর্তনের ঘটনাটিকে সাংবিধানিক বৈধতা দেয়ার প্রয়োজন ছিল। একাদশ ও দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে কর্তব্য পালন ও স্বপদে পুনর্বহালকে বৈধতা দেয়া হয়। ১৯৯১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ২০-এর উপ-রাষ্ট্রপতি সম্পর্কিত বিধান বিলোপ করা হয় এবং এই সংশোধনীর অব্যবহিত পূর্বের সংসদের বৈধতা দেয়া হয়। এবং সর্বশেষ চতুর্দশ সংশোধনীর মাধ্যমে অনুচ্ছেদ-২৩ যুক্ত করে সংসদে মহিলা সদস্য সম্পর্কিত বিশেষ বিধান করা হয়।

এ হলো সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদের অধীন চতুর্থ তফসিলের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এখানে লক্ষণীয়, যতবার আমরা সংবিধান থেকে বিচ্যুত হয়েছি, ততবারই এর আশ্রয় নিয়েছি কেবল চতুর্থ ও চতুর্দশ সংশোধনী ছাড়া। অর্থাৎ দুটি সামরিক শাসন ও সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের দায়িত্ব পালনের বৈধতা এর মাধ্যমে দেয়া হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৫০-এ যদিও বলা নেই যে, কেবল সংবিধান প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত সব কর্মকান্ড এর মাধ্যমে বৈধতা পাবে, তবুও সংবিধান ব্যাখ্যার নীতি অনুযায়ী এটি প্রণয়নের পরিস্থিতি ও সে সময় সংবিধান প্রণেতাদের চিন্তা-চেতনা বিবেচনায় বলা যায়, সংবিধান প্রণেতারা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় থেকে সংবিধান প্রণয়নের পূর্ববর্তী সব কর্মকান্ডের বৈধতা দেয়ার জন্যই এই অনুচ্ছেদ তারা যুক্ত করেন। আবার অনুচ্ছেদটি সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এতে বলা হয়নি যে সংবিধান প্রণয়নের পূর্ববর্তী কর্মকান্ডের বৈধতার পর আর কোন অসাংবিধানিক কর্মকান্ডের বৈধতার জন্য এর আশ্রয় নেয়া যাবে না।

ফলে আইনের এই ফাঁক রয়েই যায় আর এই ফাঁকের সুযোগ বার বার নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে সামরিক শাসকরা এর আশ্রয় নিয়ে তাদের কর্মকান্ডকে সাংবিধানিক বৈধতা দিয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে বিশ্বের সব দেশের সংবিধানেই জরুরি অবস্থার বিধান রাখা হয়। আমাদের সংবিধানে এজন্য দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে জরুরি অবস্থা জারির বিধান করা হয়েছে। জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট হিসেবে অনুচ্ছেদ ১৪১(ক) তে বলা হয়েছে "যুদ্ধ, বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগকে।

দেশে জরুরি অবস্থা বিদ্যমান থাকাকালে সরকারকে বিভিন্ন বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হতে পারে। সেসব ব্যবস্থার বৈধতার জন্য এই অনুচ্ছেদের আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। দেশে সামরিক শাসন জারির প্রাক্কালে প্রথমে "অভ্যন্তরীণ গোলযোগ" এই অজুহাতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় এবং পরবর্তীতে সামরিক আইন জারি করা হয়। জরুরি অবস্থা জারির প্রেক্ষাপট নির্দিষ্ট করে বলা হলেও ক্রান্তিকালীন অবস্থা বলতে কী বোঝাবে তা বলা হয়নি। ফলে সামরিক শাসকরা ক্ষমতা গ্রহণকালে "দেশ ক্রান্তিকালীন সময়ের মুখোমুখি" এই অজুহাত পেশ করেছে এবং এই অনুচ্ছেদের আশ্রয় নিয়ে নিজেদের সব কর্মকান্ডের বৈধতা দিয়েছে।

তাই ক্রান্তিকালীন অবস্থাকে সংজ্ঞায়িত করা, জরুরি অবস্থা ও ক্রান্তিকালীন সময়ের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করা এবং এদের মধ্যে পার্থক্য নির্দিষ্ট করাও জরুরি। নতুবা বার বার দেশে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এখানে একটা কথা মনে রাখা দরকার যে, শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের সংবিধানকে অকার্যকর করার জন্য সর্বপ্রথম বড় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ওই সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করে তার চার স্তম্ভের অন্যতম "গণতন্ত্র" বিধ্বস্ত করেন। এই সংশোধনীর জোরে তিনি নিজেদের দল বাকশাল ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন।

সরকারি দু-একটি পত্রিকা বাদে সব পত্রপত্রিকা, এমনকি মাসিক পত্রিকা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেন এবং নিজের দল বাকশালের দরজা আনসার, মিলিটারি, পুলিশ ইত্যাদির জন্য উন্মুক্ত করে সশস্ত্র বাহিনীকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করেন। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে যে জিয়াউর রহমান সামরিক কর্তাব্যক্তি হিসেবে ক্ষমতায় বসেন তিনি ছিলেন শেখ সাহেবের "বাকশাল"-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। এদিক থেকে বলা চলে, শেখ সাহেব যে বীজ বপন করেছিলেন, জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন আমলেই তা প্রস্ফুটিত হয়েছিল। কিন্তু এটা মনে করা আবার এক চরম মূর্খতা যে, শেখ সাহেব শুধু একজন স্বৈরতন্ত্রী ছিলেন বলেই তিনি চতুর্থ সংশোধনী পাস করে এক চরম অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন। এ চিন্তা অবাস্তব।

সংক্ষেপে বলা চলে, আওয়ামী লীগের তিন বছরের শাসনকালের মধ্যেই সরকার থেকে নিয়ে ক্ষমতাসীন দল ও নব্য শাসকশ্রেণীর সমগ্র অংশ লুটতরাজ, চুরি, দুর্নীতি, প্রতারণা ইত্যাদির মাধ্যমেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল যা সামাল দেয়ার জন্য শেখ মুজিবকে চতুর্থ সংশোধনী পাস করতে হয়েছিল। স্বৈরতন্ত্রের তাগিদ সেই পরিস্থিতির মধ্যেই ছিল। কিন্তু পরিস্থিতির মধ্যে আরও পরিবর্তন ঘটতে থাকায় তার শেষ রক্ষা হয়নি। চতুর্থ সংশোধনীর ধারাবাহিকতা রক্ষা করেই পাস হয়েছিল বিভিন্ন সরকারের আমলে একের পর এক অগণতান্ত্রিক সংশোধনী। মোটামুটি বাংলাদেশের সংবিধান এর ৭২ এর রুপ আর বর্তমান রুপ, এবয় ২রুপের বিরোধের প্রেক্ষাপট হল এই।

সুতরাং ৭২ এর সংবিধানে ফিরে গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সহজ হতে পারে। এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে হলে যে, ৭২ এর সংবিধানেই ফেরত যেতে হবে এমন কোন কথা নেই। বর্তমান সংবিধান অনুযায়ীই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্ভব। সুতরাং যদি সরকার শুধুমাত্র এই কারনে ৭২ এর সংবিধানে ফেরত যায় তাহলে, কিছু ব্যাপার সামনে চলে আসে। যেমনঃ সমাজতন্ত্র,ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম" থাকবে কিনা, বাঙালী-বাংলাদেশী বিতর্ক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক ইত্যাদি সরকারের সামনে চরে আসবে।

এখন এই ব্যাপারগুলো নিয়েও সরকার পরিষ্কার করে কিছু বলছে না। সুতরাং আপনিই চিন্তা করুন আপনি ৭২ এর সংবিধানে ফেরত যেতে চান কিনা বা ৭২ এর সংবিধানে ফেরত যেতে হলে সরকারকে কোন কোন বিষয়ে পরিস্কার একটা পদক্ষেপ নিতে হবে। ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে করি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আর "চতুর্থ তফশীল" এর অপব্যবহার ঠেকাতে সরকার সংবিধানে কিছু পরিবর্তন আনতে পারেন। তবে অবশ্যই সমাজতন্ত্র,ধর্মনিরপেক্ষতা, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, "বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম" থাকবে কিনা, বাঙালী-বাংলাদেশী বিতর্ক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিতর্ক প্রভৃতি বিতর্ক এর একটা আনুষ্ঠানিক মতৈক্যে পৌছানোর পর। ' [কনসেপ্ট ক্লিয়ার করার জন্য কমেন্ট নং ১৬ এবং ১৭ পড়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি।

] ধন্যবাদ সবাইকে পড়ার জন্য। তথ্যসূত্রঃ গভর্নমেন্ট ওযেবসাইট http://www.pmo.gov.bd/constitution ল.গভ.বিডি Click This Link বিডি.ল.গভ http://bdlaws.gov.bd উইকিপিডিয়া http://bn.wikisource.org http://taiyabs.com/ বিডি লিড নিউজ.কম http://bdleadnews.com ইউকে বিডি নিউজ http://www.ukbdnews.com কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ একরামুল হক শামীম ভাই Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।