ওবামার নোবেল পাওয়ার কারণ যদি হয়ে থাকে আফ্রিকান-আমেরিকান হওয়া সত্ত্বেও বর্ণবাদী এক সমাজে নির্বাচনে জেতা, তাহলে মোরালেসেরও তা প্রাপ্য। তিনি নেটিভ হওয়া সত্ত্বেও নির্বাচনে জয় এবং প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ করার জন্য তা পেতে পারেন।
গরিব কৃষক ইভো মোরালেস। বয়স ছয় বছর হওয়ার আগেই বাবার সঙ্গে আন্দিজ পর্বতমালায় চরিয়ে বেড়াতেন লামা নামের গবাদি পশু। পনের দিন ধরে হেঁটে বাজারে নিয়ে বিক্রি করে সম্প্রদায়ের লোকজনের জন্য খাবার কেনা হতো।
এ সময়ের অভিজ্ঞতা বিষয়ে মোরালেস বলেন, ‘আকাশের হাজার তারকার হোটেলই ছিল আমার আশ্রয়’।
চে আহত ও নিরস্ত্র হওয়ার পর ১৯৬৭ সালের ৯ অক্টোবর যখন তাঁকে লা হিস্তয়েরার অদূরে হত্যা করা হয়, মোরালেসের বয়স তখনো আট বছর হয়নি। তাঁর জন্ম হয় ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর। বাড়ি থেকে তিন মাইল হেঁটে ছোট্ট এক অবৈতনিক বিদ্যালয়ে স্প্যানিশ ভাষায় লিখতে ও পড়তে শেখেন। মা-বাবা ও ভাই-বোনদের সঙ্গে বাস করতেন এক ঘরের কুটিরে।
যেখানেই কোনো শিক্ষকের খোঁজ পেতেন, সেখানেই ছুটে যেতেন মোরালেস। তাঁর সম্প্রদায় তাঁকে তিনটি শিক্ষা দিয়েছিল: মিথ্যা বোলো না, চুরি কোরো না ও দুর্বল হয়ো না। উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় খরচ মেটানোর জন্য রাত দুইটায় উঠে কখনো রুটি তৈরি, কখনো নির্মাণশ্রমিক বা অন্য কোনো কঠিন খাটুনির কাজ করে বিকেলে ক্লাসে যেতেন। কিন্তু এক গরিব আইমারার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছা ছিল আয়ত্তের বাইরে।
তাঁর বয়স যখন ২৩ তখন বাবা মারা যান।
জমিতে কঠোর পরিশ্রম করতে থাকেন, শ্রমিকদের সংগঠিত করে ট্রেড ইউনিয়ন তৈরি করেন। বলিভিয়ায় সামাজিক বিপ্লবের শর্তাবলি পরিপক্বতা লাভ করছিল গত ৫০ বছরে। ১৯৫২ সালের ৯ এপ্রিল ভিক্টর পাজ এস্তেনসোরোর জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনের (এমএনআর) মাধ্যমে বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। বিপ্লবী খনিশ্রমিকেরা দমনমূলক শক্তিগুলোকে পরাজিত করে, এমএনআর ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু বলিভিয়াতে বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
১৯৫৬ সাল থেকে এ প্রক্রিয়ায় অবক্ষয় শুরু হয়। ১৯৫৯ সালের ১ জানুয়ারি কিউবাতে বিপ্লব জয়লাভ করে। মেক্সিকো বাদে সব দেশ কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে।
আন্তর্জাতিক বিপ্লবী আন্দোলনের বিভক্তির প্রভাব পড়ে বলিভিয়াতে। এরপর অনেক সময় গড়িয়েছে।
৪০ বছরেরও অধিককাল ধরে চলমান অবরোধ, নয়া উদারনৈতিকতা ও এর ভয়ঙ্কর পরিণতি; ভেনেজুয়েলায় বলিভারিয় বিপ্লব ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোকে নিয়ে বলিভারিয় জোট (এলবা) গঠন আর বলিভিয়ায় মোরালেস ও তাঁর রাজনৈতিক দল সমাজতন্ত্রের আন্দোলনের (এমএএস) ক্ষমতারোহণ ঘটেছে। মোরালেসের এই জয় সাম্রাজ্যবাদী দুষ্ট প্রচারণার বিরুদ্ধে, তাদের সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে এবং দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তাদের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তিনি বলিভিয়ার সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেছেন এবং দেশের মানুষের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করার জায়গায় এনেছেন। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় মারিজুয়ানা প্রস্তুতকারক ও মাদকের ভোক্তাকে তিনি বলে দিয়েছেন ‘কোকা, কোকেন নয়’। মাদকের বাজার তৈরি করেছে সংঘবদ্ধ অপরাধচক্র, যারা মেক্সিকোতে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মাদক উত্পাদনকারী দেশগুলোর দুটিতে মার্কিনি সেনা ও সামরিক ঘাঁটি আছে। মাদক পাচারের ভয়ঙ্কর ফাঁদে আটকানো যায়নি বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা ও ইকুয়েডরকে। এলবার সদস্য দেশগুলো কিউবার মতোই জানে, তাদের জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও কল্যাণ বয়ে আনতে তারা কী করতে পারে এবং কী করা উচিত। মাদক পাচার রুখতে তাদের বিদেশী সেনার দরকার নেই।
জনগণের সহায়তায় এক আইমারা প্রেসিডেন্ট বলিভিয়া বিস্ময়কর এক কর্মসূচি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
তিন বছরেরও কম সময়ে বলিভিয়া নিরক্ষরতা দূর করেছে। বলিভিয়ার আট লাখ ২৪ হাজার ১০১ জন নাগরিক লেখাপড়া শিখেছে, ২৪ হাজার ৬৯৯ জন আইমারা ভাষায় ও ১৩ হাজার ৫৯৯ জন কুয়েচুয়া ভাষায় লিখতে-পড়তে শিখেছে। কিউবা ও ভেনেজুয়েলার পর বলিভিয়া নিরক্ষরতামুক্ত তৃতীয় দেশ। বলিভিয়াতে এখন লাখ লাখ মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়, আগে তা কখনোই দেওয়া হতো না। গত পাঁচ বছরে যে দেশগুলো শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে কমাতে পেরেছে, তেমন সাতটি দেশের একটি বলিভিয়া।
২০১৫ সালের আগেই সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জন করার বাস্তব সম্ভাবনা জাগিয়েছে। মাতৃমৃত্যু রোধের বেলাতেও তাদের অর্জন এ রকমই। চার লাখ ৫৪ হাজার ১৬১ জনের চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, যার মধ্যে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পেরু ও প্যারাগুয়ের নাগরিক ছিলেন ৭৫ হাজার ৯৭৪ জন।
বলিভিয়া এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী সামাজিক কর্মসূচি নিয়েছে: প্রথম থেকে অষ্টম গ্রেড পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর শিক্ষাসামগ্রীর খরচ জোগানোর জন্য তাদের বার্ষিক মঞ্জুরি দিচ্ছে সরকার। এর মাধ্যমে প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী উপকৃত হচ্ছে।
ষাটোর্ধ্ব সাত লাখেরও বেশি নাগরিক প্রতিবছর ৩৪২ ডলারের সমতুল্য বোনাস পাচ্ছে। প্রতিটি গর্ভবতী নারী ও প্রতিটি দুই বছরের কম বয়সী শিশু অতিরিক্ত ২৫৭ ডলার করে পাচ্ছে।
পশ্চিম গোলার্ধের দরিদ্রতম দেশ বলিভিয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। এটি করতে গিয়ে যাদের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে এবং তাদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। সতর্ক পদক্ষেপ নিচ্ছে কারণ তারা চায় না যেন তাদের পেছাতে হয়।
মুদ্রার সঞ্চয় বেড়েছে। মোরালেস দায়িত্ব গ্রহণের আগে যে সঞ্চয় ছিল এখন তা কমপক্ষে তিন গুণ হয়েছে। পরিবেশবিষয়ক বিবেচনার ক্ষেত্রেও বলিভিয়ার অবস্থান বেশ জোরালো।
অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে বলিভিয়া বায়োমেট্রিক ইলেকটোরাল রেজিস্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৭ লাখ ভোটার নিবন্ধিত হয়েছে, যা জানুয়ারি ২০০৯-এর ভোটার তালিকার থেকে প্রায় ১০ লাখ বেশি।
তখন ছিল ৩৮ লাখ ভোটার। ডিসেম্বরের ৬ তারিখে নির্বাচন হবে। জনগণের প্রেসিডেন্টের প্রতি নিশ্চয় তাদের সমর্থন বাড়বে। তাঁর মর্যাদা ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি কেউ ঠেকাতে পারেনি।
তাহলে কেন তাঁকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয় না? তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নন।
ফিদেল কাস্ত্রো: কিউবার বিপ্লবের নায়ক ও সাবেক প্রেসিডেন্ট।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ আহসান হাবীব
আজকের আজকের প্রথম আলো থেকে নেয়া
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।