শীতভর সেলাই করি ছেঁড়াকাঁথা
তৃতীয় বিশ্বের কবিদের লড়াই হলো রোমান্টিসিজমের বিরুদ্ধে প্রাণপন টিকে থাকার প্রচেষ্টা। কেননা রোমান্টিসিজমই তাদের অধিকাংশের নিয়তি এবং অপ্রিয় মৃত্যু।
I believe that I am in hell, therefore I am there.
স্বর্গকে পৃথিবীতে রূপবান করে তোলার পরিবর্তে যা যাত্রা করতে চায় পৃথিবী ছেড়ে স্বর্গলোকে। আর স্বর্গে যাওয়ার পথটি মৃত্যুর কম বিনিময়মূল্যে কখনো খোলে না এখানে। স্বর্গ ও নরক শব্দের আবির্ভাবে কারো উৎফুল্ল কিংবা শংকিত হওয়ার কোন কারণ নেই বলেই মনে করি।
আমি এই দুটি শব্দকে পারলৌকিক বা আধ্যাত্মিক অর্থে নয়, বরং পার্থিব ও মানবিক অর্থে ধারণ করতে চেয়েছি, আর অধিবিদ্যক কামড় কে এড়াতে পারে এই ভাষার জগতে। আমার কাছে এরা বিকৃত বাস্তবজাত কিন্তু বাস্তবাতিশায়ী, বর্জনাতীত ও অর্জনাতীত, পরম ও পরস্পর নির্ভর বিপরীত দুটি ধারণা। কিন্তু এরা ধারণামাত্রই নয়, বরং দুটি বাতিঘর, সাধারণ মানুষের জন্যে। যাদের একটি আমাদেরকে তার দিকে এগিয়ে যেতে চিরআগ্রহী করে রাখে। অপরটি তার দিকে না এগোতে নির্দেশ তো করেই, তার নিকট থেকে যতটা সম্ভব দূরে ও দ্রূত সরেও যেতে নির্দেশ করে।
নরক তাদের বাস্তবতা, স্বর্গ তাদের বাসনা। অথচ অধিকাংশ সাধারণ মানুষের, যাদের সমাজের উপর এখনো নগণ্য নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা রয়েছে, নিয়তি হলো দুটোকেই তার চাই। না হলে তাদের স্বাধীনতার, তাদের সৃজনের, তাদের লড়াইয়ের, তাদের সফলতার, তাদের ব্যর্থতার বোধও তারা হারিয়ে ফেলবে যেনো। মানব সভ্যতার আবহমান যাত্রায় অর্জিত অভিজ্ঞতার একভাগ তাদের দুর্ভোগ, জমা পড়েছে নরকের ধারণায়। আর অভিজ্ঞাতীত বা ক্ষণসুখগুলো দিনে দিনে সঞ্চিত হয়েছে স্বর্গের ভাঁড়ারে।
নরক তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়, আর স্বর্গ তাদেরকে কেবলি ডাকে। নরক রয়েছে পায়ের নিচেই আর স্বর্গ রয়ে যায় কেবলই দূরাতীদূর কল্পলোকে। স্বর্গ আসলে তাই যেসুখানুভব মানুষ পেয়েছে তাকে ফের ফিরে পাওয়ার আমরণ তেষ্টা। পায়ের নিচ থেকে তাদের নরককে তাড়ানো চা-ই চাই। আর কল্পলোক থেকে স্বর্গকে নামানো চাই-ই চাই তাদের পার্থিব পরিধি জুড়ে।
নরক আসলে সেসবরেরই তালিকা, যেসব অপ্রিয় অভিজ্ঞতা তাদের হয়েছে এবং দ্বিতীয়বার যাদের মুখোমুখি তারা হতে চায় না। অথচ এই তালিকা থেকে ছিটকে আসা হুমকি তাদেরকে ত্রস্ত রাখে, তারা ভুলতে পারে না। তারা থাকে সারাক্ষণ অত্যল্প স্বর্গ আর অত্যধিক নরকে মাখামাখি। এই অসহ্য যন্ত্রণার স্বর্গীয় বাস্তবতা ও স্বর্গের নারকীয় বঞ্চনা তৃতীয় বিশ্বের কবিদেরকে বারবার প্রলুব্ধ করে তাদের জগতকে রোমান্টিক ভাবালুতায় রাঙিয়ে নিতে। এতে নিজেকে ভুলানোর নতুন প্রপঞ্চ তৈরি হয়।
কবি ধরাশায়ী হন। দুঃখ, কষ্ট, বঞ্চনার মতো অমানবিক বিষয়াবলির মধ্যে খুঁজতে শুরু করেন যত মহত্ব। শরীরের উপর আঘাত সইতে সইতে শরীরকেই ভুলে থাকার ব্যর্থ চেষ্টা যেনো। এতে চাবকানির যন্ত্রণা আদৌ কমে না। বরং এ আত্মপ্রবঞ্চনা যেকোন বিবেকবান মানুষের মতোই তার জন্যেও সঞ্চিত রাখে দীর্ঘ অনুশোচনা।
একটি তার চিরউদ্বেগবস্তু। আর অপরটি চিরস্বপ্নের চরাচর।
যদিও তৃতীয় বিশ্বের নয়, তথাপি নভালিস Ñ
জগতকে অবশ্যই রোমান্টিক ভাবালুতায় রাঙিয়ে দিতে হবে। এইভাবে আদি অর্থ উদঘাটন করা যাবে। আবার... ... বৈশিষ্ট্যহীনকে বৈশিস্ট্যপূর্ণ অর্থ, সাধারণকে রহস্যের আভরণ, পরিচিতকে অপরিচিতের মর্যদা, সসীমকে অসীমের রূপ দিয়ে... ... আমরা যে নিজেদের কল্পলোকে দেখতে পারি না এই ঘটনার একমাত্র কারণ আমাদের শারীরিক ও প্রত্যক্ষগত দুর্বলতা।
নভালিস, এবং আবার Ñ
কোন সংযুক্তি ছাড়া কেবল অনুষঙ্গ নির্ভর গল্প, স্বপ্নের মতো; কোনরকম অর্থ ছাড়া, সম্পূর্ণ সংযোগহীন সুরেলা, শ্র“তিমধুর ধ্বনিপূর্ণ শব্দ সম্ভারে সাজানো কবিতা, যার অল্প কছত্রই বোধগম্য হবে: এ সব কিছুই হতে হবে সম্পূর্ণ আলাদা জিনিসের খণ্ডাংশ।
লক্ষ্যণীয়, বলা হয় না কল্পলোক আসলে আমাদের বাসনার নির্মিতি বলেই আমরা একে ধীরে আংশিক হলেও বাস্তবায়িত করতে চাই এই পার্থিব আকাশের তলেই। তাছাড়া শরীর এক অনিবার্য বিবর্তনের ফল। এর বিকাশ আছে। একে অনিবার্যতা হিসেবে সনাক্ত না করে দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং শরীরকে অবমূল্যায়নের চোরাফাঁদ তৈরি হয়েছে, যেনো কল্পলোক শরীর বহির্ভূত কিছু, বাস্তবতার কেউ নয়।
এও এক রাজনীতি। যখন আমরা আমাদের সবকিছুই মাপতে চাই শরীরের প্রয়োজনের অনিবার্যতা দিয়ে এবং আমাদের চারপাশে মূর্ত করতে চাই প্রয়োজনগুলোকে। আর শরীরের কথা আসলেই চলে আসে বস্তুবিশ্বের বাস্তবতার দিকে খোলা চোখে তাকানোর অভিপ্রায়ের প্ররোচনা। তাই তাকেই লুকানোর নিপুন আয়োজন হয়ে ওঠে এই নভালিসীয় ধারণা। শরীরের দুর্বলতাকে মেনে নিলে আমাদের প্রার্থিত বস্তু ধূয়াশায় ডুবে থাকবে চিরকাল।
আমাদের কল্পনা ছিলো উড়াল এবং তা শরীরের দুর্বলতার কারণে বোঝা যাবে না যেনো স্পস্ট করে কোনদিনই। এবং তাই উড়ার স্বপ্নই আমাদের সম্বল। যেহেতু কোনদিন উড়তে পারব না, প্লেন আবিস্কারের প্রচেষ্টা অতএব নিস্ফল। এই তো রাজনীতি নভালিসীয় ধারণার পশ্চাতে। উড়ার স্বপ্ন শুধু নয় আমরা চাই স্বপ্নের বাস্তবতাও এবং এজন্য চাই চিন্তার স্পষ্টতা এবং বোধগম্যতার তীব্রতা।
কবিতার কাছে এত চাওয়া হয়তো ঠিক নয়। তবু কবিতা বৈপ্লবিক পরিবর্তন প্রদায়ী কিছু নয় জেনেও বলা যায়, কবিতা নিজের দিকে নিজের বাসনার দিকে স্বপ্নের দিকে আবেগ, বেগ, দৃষ্টিভঙ্গীর, রাজনীতির, দর্শনের, ভাষার ও কবির ও পাঠকের সংস্কৃতির এক মিশ্র আবেশ নিশ্চয়, যার তলে আসলে থাকে এদের প্রত্যেকের প্রতি সমপরিমাণের স্পষ্টতা অর্জনের বাসনাও। এই সত্যকে ভুলে যাওয়াই তখন প্রাধান্য পাবে। রোমান্টিসিজম আমাদের এইটুকু ভুলিয়ে রাখে এই ভাবের সাধনার নামে।
It is slavery to live in the mind unless
it has become part of the body.
অহংকারের মৃত্যু আর কজনকেই বা সাদর সম্বর্ধনা জানায় আমাদের তৃতীয় জগতে।
আমরা ক্রমে মরণাবেশ লাভ করি। আর এক ঘোরের মধ্যে দিয়ে যমকে খোঁজে বেড়াই কিন্তু সে কেবলি আমাদের লক্ষ্য করে আরো দূরে সরে যেতে থাকে। আমরা জেনে যাই, সে যতই আমাদের অবহেলা করে চলুক, তার মনোযোগের কেন্দ্রে আমরাই রয়েছি। তাই আমরাও আশা ছাড়ি না, তক্কে তক্কে থাকি, কখন সে অমনোযোগী হয়ে পড়বে। আর আমরা সেই সুযোগে তার চোখের সামনে এসে দাঁড়াবো, তার চোখের উপর বলে বসবো Ñ এবার অস্বীকার করো তো দেখি।
আমরা এমন হতভাগার দল যাদের মৃত্যু পাহারা দিয়ে চলে যেন বেঁেচ থাকি, জীবন তো আমাদের ত্যাগ করেছে অনেক আগেই। আমাদের ত্যাগ করেছে রাষ্ট্র, দেশ, পরিবার, প্রচল লোকজন। আর অচল মুদ্রার মতো কয়েকটা মানুষ আজো ভালেবেসে চলে আমাদের। কিন্তু তাদের অসার্মথ্য হেতু এই ভালোবাসা অদৃশ্যই থেকে যায়। আমাদেরকে ভালোবাসার বদলে বরং তারা বাধ্য হয় ত্যাগ করতে।
আমরাও বিস্মিত, তাদের অদৃশ্য বা গোপন ভালোবাসা আমরা যে কিভাবে টের পাই, তা ভেবে। হয়তো আমাদের কেউ-ই ভালোবাসে না। তা আমরা ভেবে উঠতে পারি না বা ভেবে উঠার সাহস অর্জন করতে পারি না। তাই কেউ না কেউ আমাদের ভালোবাসে, এমন কল্পনা করে নিতে বাধ্য হই। যেভাবে বেড়াল পালিয়ে যাবার পরেও কিছুক্ষণ থেকে যায় বেড়ালের হাসি, সূর্যের মৃত্যুর পরেও রক্তিম আভাটুক আকাশ জুড়ে থেকে যায় আরও কিছুক্ষণ।
একবার বজ্জাত বেড়ালের সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার অপরাধে, এই হাসিও অতিজীবিত হয়ে ওঠে এখানে। আমরা ওই অবিদ্যাটুক নিয়ে বসে পড়ি ভালোবাসার, প্রতিশ্র“তির, মানব উদ্ধারের যত বাকবন্যা বইয়ে দিতে। এই প্রকল্প একদিন ধ্বসে পড়লে আমরা অতিরাগী কেউ কেউ দঁড়ি পাকাতে শুরু করি আর তার শেষ প্রান্তে গাঁটশুন্য গিঁট দিতে শিখি। যার অপর প্রান্ত বেধে নিতে চাই কোন নির্জন মাঠের আরো নিঃসঙ্গ গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে, যাকে এই তৃতীয় কক্ষপথে জন্মানোর অপরাধে আর উঁচু হবার যোগ্যতায় মৃত্যুপিপাসুদের সহযোগী হয়ে ওঠতে হয়েছে ।
Every reading is
misreading
and every interpritation is
misinterpretation.
নিজের জীবন নিয়ে যত আদিখ্যেতা কর না কেন, তুমি আর তল পাবে না এর।
আমার জীবনকে আমার পাঠ্যসূচি করে তুলতে চাÑই চাই। আর তারা সেই অধিকার লুণ্ঠনের পাঁয়তারা করে চলেছে। আমি আমার শরীরকে আমার থার্মোমিটার হিসেবে ব্যবহার করতে চাই। অথচ তারা সেই সম্ভাবনাকেও নাকচ করার পায়তারা করে চলেছে। আমি যতবারই আমাকে পড়ি, ততবারই আমি কি আমাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে পড়তে সক্ষম হই।
আমার মস্তিষ্ক আমারই শরীরের অংশ, ফলে আমার চেতনাও আমার শরীরের অংশ বলেই আমি মনে করি। আমার আনন্দের, আমার সফলতার, আমার হতাশার, আমার ব্যর্থতার, আমার অহংকারের, আমার লজ্জার মানদন্ড হোক আমার শরীর, এই আমি চা-ই। কিন্তু তৃতীয় জগতের বাসিন্দা হওয়ার কারণে শরীর যদি আমার নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে কী হতে পারে? আমার মানদণ্ডটি বোবা হয়ে পড়তে চাইবে, না হয় অন্যের কথা বলবে, না হয় ভুল পাঠ দেবে। আমার শরীরের ক্রোধ যন্ত্রণা দুঃখ বিষাদ আমার, কিন্তু শরীরটি আর কোনভাবেই আমার নয়। আর এসব অনুভব তখন বিকৃত পাঠ দেবে, এবং দিতে থাকে।
অতএব আমি যখন বলতে থাকি, আমি চেঁচিয়ে ওঠতে চাই, তখন আমি সবচেয়ে বিস্ময়কর কাজটিই করে বসি। আমার চেতনা একদিকে চলে, আর শরীর চলে আরদিকে। শরীর যায় আরদিকে মানে বিভিন্ন দিকেÑ হাত একদিকে তো পা আর দিকে, চোখ আবার তৃতীয় কোন দিকে, আর পেট ও চেট তো ছুটে চলে বিপরীত দিকে নাক্ষত্রিক বেগে। নিজের অর্জিত উপলব্ধিকে ঝাঁপসা করে দিতে চায় মন। নিজেরই বিরুদ্ধেই যেনো খোলা আছে একমাত্র ক্রমমুক্তির পথ।
চেতনা ও শরীরকে যখন একসাথে সেলাই করতে বসি আমি টের পাই না কখন আমার শরীর ভীষণ বিষমরূপ ধারণ করেছে, যখন চোখে পড়ে কেবল চোখ বড় বড় হয়ে পড়ে। এই যে আমার নিজেকে নিজের করে রাখার চেষ্টা। এই প্রাণপন লড়াই, যা আমার জীবন, মন আর শরীরের যে নিবিড় আত্মীয়তা থাকার কথা ছিল, তাকে পুনরোদ্ধারের চেষ্টা। তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার যে ন্যায়সম্মত যুদ্ধ তার ফলাফল আমার কিম্ভুত চেহারা অন্যের হাসির খোরাকও হয়ে থাকে। ভয়ংকর দৃশ্য দেখে আজকাল খুব অল্প লোকই ভয় পায়, বরং অধিকাংশ লোকই হাসাহাসি করে।
তারপরও আশা, এই সর্বনাশা দৃশ্য দেখে কেউ না কেউ সর্বনাশের পরিচয় না হোক ইঙ্গিতটুক তো পাবে। সর্বনাশে বাস করে করে মানুষ সংবেদনশুন্য হয়ে পড়েছে যেনো। আমি কি মানুষকে সংবেদনময় করে তুলতে চাই? তাহলে তো আগে আমাকেই সংবেদনময় হয়ে ওঠতে হবে পূর্ণ মাত্রায়। একইসাথে পৌঁছাতেই হবে অনুভব থেকে উপলব্দিতে। কিন্তু আমাকেই যেখানে সঠিকরূপে সেলাই করে উঠতে পারছি না, সেখানে কিভাবে অন্যের কথা ভেবে ওঠা সম্ভব হবে।
কিন্তু মানুষ আজও স্বপ্নবন্দী, স্বপ্নের দিকেই সাড়া দেয়, এই সংবেদন তাকে জাগিয়ে রাখে। আর পুঁজিবাদী বিশ্বই আজও ঠিক করে দেয় কি স্বপ্ন দেখতে হবে তার, আর স্বপ্ন মাত্রই মানুষ আজও কাতর ও আপন মনে হয়। ফলে স্বপ্নের সত্য মিথ্যা আমাদের খুব কমই মনে থাকে। আর এখানেই পুঁজিবাদ জিতে যায়, আর ঠকে আপামর মানুষ। আর অন্যরা তো তাদের ভিন্ন ধরনের স্বপ্নও দেখাতে পারে না।
স্বপ্নসর্বস্বতা আমাদের ঠকায়, আমাদের স্বপ্ন যেমন দেখতে হবে, তেমনি পরমুহুতেই স্বপ্নের বাইরে এসে দাঁড়িয়ে দেখতে হবে, কার স্বপ্ন দেখছি আমি নিজের স্বপ্ন ভেবে, আর এভাবে বারবার নিজের স্বপ্নকেও প্রশ্নের ছাকনিতে ছেকে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় আমাদের কপালে এখন খোলা নেই।
What cannot be expressed
should pass over in silence.
বোবামানুষের সাইলেন্স বেশ মজার চিজ বটে। ধরো আমার জ্বর এলো আর আমি বোবা রযে গেলাম। কিন্তু আমার শরীর তখনো কথা বলতেই থাকে। ফলে ভাষার বাইরেও ভাষার অস্তিত্ব থাকেই।
তার হয়তো ধ্বনিময়তা থাকে না। কিন্তু অভিব্যাক্তি থাকে। যা পুনরায় ভাষিক হয়ে ওঠে, আমরা তা যদিও দেখতে না চাই।
অধ্যাপকীয় গদ্য যারা লিখবে তাদের কবিত্ব নাহোক তার কাক্সিক্ষত পরিণতি তথা গদ্যে কবিতা-স্বাদ নষ্ট হতে বাধ্য। তাদের প্রকাশভঙ্গিতে দিনে দিনে তা স্পষ্টতার দিকে যায় ঠিকই, তা কেবলি উপলব্ধির স্পষ্টতা।
সংবেদনের রূপময় রেখা ক্রমে মুছে যেতে থাকে ভাষার গা থেকে, অনুভবের চাপ আর অনুমানের অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য, তথ্যের স্বল্প ঘাটতি জনিত অস্পষ্টতার ফলে উদ্ভূত মৃদু বিশৃংখলা কোথায় তখন ভেসে যায় তা খেয়াল থাকে না। কেননা উপলব্ধির স্পষ্টতা তাদের কোনভাবেই অনমোদন করতে চায় না। প্রকাশভঙ্গীর গা কাব্যজীর্ণ হতে থাকে। অকথনের ভেতর দিয়ে এক দিব্যস্পষ্টতা অর্জন করতে চায় আমাদের কবিতা, দৃশ্য আর রূপকের সংশ্লে¬ষগণিতে কষা। আর অধ্যাপকীয় গদ্য চায় ইন্দ্রিয়ের ঘুম আর ইন্দ্রিয় মন্থন শেষে প্রাপ্ত ইন্দ্রিয়লেশুন্য অমৃত বা বিষটুকু তথা শরীরশূন্য একনিষ্ট নিরাবেগ চেতনার নিরবিচ্ছিন্ন জাগরণ ও এর আধিপত্য।
অধ্যাপকীয় গদ্য খারাপ একথা কোনভাবেই আমি বোঝাতে চাই না, বরং তা পাঠ একজন কবি ও পাঠকের স্বাস্থ্যকে ভালো করে। আর কে না জানে, স্বাস্থ্য ভালো থাকলে যেকোন বিষয়ই উজ্জ্বল আনন্দের হয়ে ওঠে। এবং কবির কবিতা নির্মাণে ও পাঠকের কবিতা পাঠে তা ওষুধির মতো অনোপাদেয় হলেও শক্তি বর্ধক হতে পারে। তবে অনবরত কখনই নিরস গদ্য তিতপল্লার মতোই ভাল লাগে না। আমার বলার কথা হলো, কবিরা অধ্যাপকীয় ভঙ্গিতে মননশীল গদ্য লিখবে না, বরং মন ও মনন যুগপৎ উদ্ভাসনসম্ভব গদ্য লিখবে, এমন গদ্য যা কাব্য বৈশিষ্ট্য বর্জিত নয়,অর্জিত।
যা যুক্তিদামী ধারাবাহিকতা বিপর্যয়ী, কিন্তু নবনির্মাণকামী। আপাত নৈর্ব্যাক্তিক দার্শনিক মননকে কেবল নয়, ইন্দ্রিয় উপাত্তে উপচানো, আপাতযুক্তিবিরোধী, বিশৃঙখল, আসলে স্বাভাবিক ও নিরবিচ্ছিন্ন কবি মনকেও পাশাশাশি তৃপ্ত করবে।
I is another.
আমরা যখনই বাস্তবতাকে ফাঁদে আটকাতে চাই তখনই আমাদের নির্ধারণ করতে হয় তাকে কিভাবে ধরতে চাই। নির্ধারণ করতে না চাইলেও তা করতে হয়, এ আমাদের নিয়তি, এ আমাদের অনাদি বাধ্যবাধকতা। এই হলো আসলে কোন অংশগ্রহনকারীর একাধারে স্বাতন্ত্র্য এবং বিপদ, যদি সে বাস্তবতাকে হুবুহু ধরতে চায়।
হুবুহু বাস্তবতা বলে আসলে কিছু নাই। আছে এক তৃতীয় বাস্তবতা। আর এতে থাকে বাসনা আর বাস্তবতার এক মিশেল। আর এদের মিশ্রণে কোন একটার ভাগ বেশি বা কম। আমরা তা নির্ণয় করতে গিয়ে কোন একটার উপড় জোর দিয়ে ফেলি আর অনর্থপাত ঘটাই।
তাতেই বিপত্তি ঘটে আর তা চাপিয়ে দিতে চাই লেখকের বা পাঠকের উপর। কিন্তু একবার বাস্তবতাকে ভাষাবন্দী করার পর আর নিখাঁদ বাস্তবতা বলে কিছু থাকে না। থাকে না নিখঁ^াদ বাসনা বলেও কিছু। অথচ আমরা তাতে পৌরণিক রাজহাঁসের মতো সাঁতার কাটতে গিয়ে জলের বদলে দুধটুকু বা দুধের বদলে জলটুকু চাই বলেই যত প্যাচ। একবার লেখা হয়ে গেলে, তা থেকে আর বাসনা আর বাস্তবতাকে জল থেকে নির্ভেজাল দুধের মতো কোন আলাদা করতে সফল হাঁসের মতো কোন সমালোচক বা পাঠক বা লেখকের দেখা পাওয়া খুব মুশকিল।
স্থূল একটি উদাহরণ হতে পারে জামা, এক তৃতীয় বাস্তবতা। শারীরিক প্রয়োজন এবং সূতা হলো বাস্তবতা। বুনন, ডিজাইন হলো বাসনা। বুননের পর সূতাটি আর বাস্তবতা হিসেবে ঠিকঠাক নেই। বাসনার চাপ তাকে বুননের ভেতর আঁকাবাঁকা করেছে, মুচড় খাইয়েছে, নিজের মাঝে অনেক ফসকা গেরুর সৃষ্টি করেছে।
ফলে বাস্তবে সূতাটি যেভাবে ভাঁজ বা বিন্যস্ত ছিলো, তা আর নেই, নতুন বিন্যাস পেয়েছে। আর সুতাটিকে আমরা তখন জামা হিসেবে আবিস্কার করি, সূতা হিসেবে ভাবি না, যদিও সূতাটি বেশ লক্ষ্যযোগ্য। শুধুু সূতাটিকে পেতে চাইলে আমরা জামাটি হারাবো আর এর পেছনে নিহিত পূববর্তী বাসনার মূর্ত রূূপটিও আমরা নাশ করে ফেলবো। অর্থাৎ ব্যাক্তির ব্যক্তিত্বকে অস্বীকার, তথা তার স্বাধীন ক্ষমতাকেই অস্বীকার করবো। হায়, বাস্তবতাকে অবিকৃতভাবে ধরার কোন ফাঁদ আমাদের জানা নাই।
যন্ত্রমাত্রই আমাদের বাসনার শিকার, আর যন্ত্রও আমাদের বাসনাকে বাঁকিয়ে চুড়িয়ে দেয়। ফলে সর্বদাই আমরা এক তৃতীয় বাস্তবতাকে সৃজন করে চলি, অর্খাৎ আমরা প্রকৃতগতভাবেই সৃজনশীল। কেননা আমরা প্রকৃতিকে অনুকরণে ব্যর্থ, বশ মানাতে ব্যর্থ, অস্বীকারে ব্যর্থ। আমাদের নির্মিত ফাঁদে প্রকৃতি কথা বলে না তা নয়, তবে সবটা কখনই নয়। বলে, তবে বিকৃত ভাষায়।
আমাদেরও বাধ্য করে ফাঁদের ভেতর দিয়ে বেকেঁচুড়ে তার কাছে যেতে। এই ক্ষেত্রে কারো স্বাধীনতাই চরম বা পরম নয়। ফলে আমরা কিছুটা হলেও স্বাধীনতা উপভোগের সুযোগ পাই। আমরা আমাদের সৃজনশক্তি অনুভব করতে পারি। এই যে বাস্তবতার ভেতর দিয়ে যাত্রা অথচ বাসনার চাপে এর বেকেচুড়ে নতুনপ্রায় বা অনিবার্য ছদ্মরূপ ধারণ, একে কেউ প্রকৃতিবাদ, কেউ রূপকের বাস্তবতা, রোমান্তবাদী, কেউ স¤প্রসারিত বাস্তবতা, কেউ পরাবাস্তবতা, কেউ যাদু বাস্তবতা, কেউ লজিক ও লজিক্যাল ক্র্যাকের মিশ্রণ, কেউ ভাববাদি, অভিব্যাক্তিবাদি, যুক্তিঅতিক্রমী, স্বাতিক্রম বা সাতিক্রম বাস্তবতা ইত্যাদি শব্দের পোশাকে বুঝে নেয়।
এখানে বলে রাখা ভাল, এদের প্রতিটিতেই বাস্তবতা কম বা বেশি রয়েছে, কিন্তু বাস্তবতার পরিপূর্ণ বা শূন্য প্রতিফলন এখানে অবশ্যই নেই। সর্বদাই এক অমোঘ প্রতিসরণ কাজ করে চলেছে। ভাষামাত্রই আজ মনে হয়, বাসনা আর বাস্তবতার এক দ্রভিভূত রূপ। যেখানে বাসনাও বেকেচুরে গেছে আর বাস্তবতাও। এক অমোঘ প্রতিসরণ এতে লেপ্টে রয়েছে।
একই সাথে এ স্বীকৃতি আর অস্বীকৃতির মোহনা। বাস্তবতাশূন্য বা বাসনাশূন্য কোন সাহিত্য বা সৃজনশীলতা নেই। একজন সমাজবিদ্যক খোঁজেন বাস্তবতাটুকু আর একজন মনোসমীক্ষক খোঁজেন বাসনাটুকু, তা লেখকের কি পাঠকের। আর আমার চায় দুটোই এবং অবশ্যই তৃতীয় বিশ্বেও প্রেক্ষাপটে।
এই বাসনার চাপই মূলত খণ্ডিত সময়ের ব্যাক্তিক এবং সামষ্টিক ঝোঁক হিসেবে ভাষার গায়ে আনে কাংখিত বুনন।
আর এই সময়ের গ্রন্থীতে বন্দী হয়েই বাস্তবতা আর বাসনা ভাষার গ্রন্থিতে এক ছদ্মবেশী সময় অতিক্রমী বোধ ও দেহ নিয়ে আবির্ভূত হয় আমাদের তৃতীয় বাস্তবতা। সর্বদাই এক তৃতীয় বাস্তবতায় আমাদের বসবাস, এই নিয়তি কাউকে ঠেলে দেয় নাস্তিকতায়, কাউকে ঠেলে দেয় আস্তিকতায়, কাউকে ঠেলে দেয় নীরবতায়, কাউকে ঠেলে দেয় অধিবিদ্যারিবোধী অভিযানে। এই নিয়তিকে অস্বীকার করার অবিবাম প্রচেষ্টার নামই যেনো জীবন। আসলে আমরা এরও বাইরে বাস করতে চাই, পারি না, কিন্তু আপাত-সফলতায়, বা ছদ্ম-সফলতায় আমরা কখনও হেসে উঠতে পারি। অহংকারী হতে পারি।
এই হলো ট্র্যাজিক জীবন। আর তৃতীয় বিশ্বে এই ট্রাজেডির সাথে যুক্ত হয় নিজ ভৈাগলিক বাস্তবতাকে অসচেতন অস্বীকারের ধারা যা আমেরি-ইউরো-মুখ অর্জনের এক অতি-চেষ্টা। যেখানে নিজের মুখ, এক অসুখি ও পরাজিতের মুখ অবচেতনে ঢাকার চেষ্টা। এবং প্রভু যখন যে সেই তো আমার জন্য বুনে চলে তার বাসনাপ্রতিফলনে সক্ষম জামা, মুখোশ এর পরিচয় এবং সুখ। আমরা ওখানে মুখ লকিাতে যাই এবং নির্বিচারের অনিবার্য পরিণতি আত্মধ্বংস ডেকে আনি।
এবং এর অসেচতন বিরোধীতার মাঝে বপন করি আরো এক ধরণের ধ্বংসের বীজ।
এক সংস্কৃতির ভাষাকে বাধ্য করি অন্যসংস্কৃতিকে বাঙময় করতে। এবং এজন্য বৃটিশ আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ইউরোপীয় দর্শন, ইউরোপীয় বিজ্ঞান, মধ্যপ্রাচ্যের ধর্মকে ভাষায় প্রকাশযোগ্য করে তুলতে ভাষাকে দিতে থাকি ইংরেজি আদল। বাধ্য করি ভাষাকে বলতে অপর্যাপ্ত, অনুন্নত। এ ভাষায় বিজ্ঞান, দর্শন সার্থকভাবে আলোচনযোগ্য হয়ে ওঠে না।
এই অভাব বোধ আসলে ভিন্ন সংস্কৃতির সংস্পর্শে আসার পর ঐ সংস্কৃতি ও ভাষাকে মানদন্ড এবং উন্নত ভাবার জের। অর্থাৎ সেই দাসোনুচিত মনোভাবেরই বহির্প্রকাশ এবং এই ধারাই আমরা আমাদের স্নায়ুতে বহন করছি। যদি ধরে নেই সংস্কৃতিই আসলে ঠিক করে দেয় তার দেশ, রাজণীতি, অর্থনীতি, পরিবার কিভাবে সংগঠিত হবে এবং সংস্কৃতির অনুসরণেই ভাষার আদল এবং বিকাশ ঘটে এবং ভাষাই সেই সংস্কৃতি চেতনার বাহক। তা হলে কেন ও কিভাবে সেই ভাষা সেই একই সংস্কৃতির লোকদের কাছে এত বেশি অসম্পূর্ন ঠেকতে পারে! আরো অনেক কারণের পাশে এর একটি প্রধান কারণ হলো, প্রভুর সাথে যোগাযোগের দাসুনোচিত বাসনার এক ছদ্মাবরণ। এই উপলব্ধির জন্মদাতা ক্ষমতার প্রতি স্বতোনতজানু প্রবৃত্তি।
একেও বারবার আঘাত করে পথ বানাতে হয় একজর কবির।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।