কত আজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই দূরকে করিলে নিকট,বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।
আম্মু বলেন পড়রে শোনা আব্বু বলেন মনদে
পড়ায় আমার মন বসেনা কাঠালচাঁপার গন্ধে---
আমার ছোট্ট মেয়েটাকে অংক করাচ্ছি। কিছুতেই মন নেই অংকে। বার বার বলছে “আর করব না। “ একবার কেঁদেই ফেলল “আমি আর করবো না।
“
বললাম “কয়টা বাকি আছে বল। “ ও ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল “তিনটা আর দুইটা তো উড়ে গেল। “
উড়ে গেল!!! চমকে তাকালাম ওর দিকে ,জিজ্ঞাসা করলাম “কি উড়ে গেল?” সে উত্তর দিল “বাসায় তো পাঁচটা ঘুঘু ছিল। চাল খাচ্ছিল আর দুটা উড়ে গেল। “
শোবার ঘরের জানালার পাশের আকাশমনি গাছের ডালে বাসার মালীর সাহায্যে ওরা কিছু ছোট ছোট প্লাস্টিকের বাটি বেধে দিয়েছে।
প্রতি দিন মালী ও আমার ছেলে মেয়ে দুটি স্কুল থেকে এসে মই দিয়ে উঠে ঐ বাটি গুলিতে কিছু গম চাল দিয়ে আসে। পাখিরা খায় আর ওরা মজা করে দেখে ও গুনে কটা পাখি আসলো? কে কিভাবে খাচ্ছে? পাখিরাও সময় বুঝে গেছে কখন খাবার দেবে ওরা? সেই পাখিই এসে বসেছে আবার দুটো উড়েও গেল এর মাঝে অংক কি পোষায়?
হেসে ফেললাম --- “যাও ছুটি। সন্ধ্যায় কিন্তু বাকিগুলি করবে। ” ও মাথা নেড়ে সায় দিল। জানি এই অংক আর সন্ধ্যায় করা হবে না।
করতে হবে শোবার সময়। যখন বিছানায় শোবে তখন। কারন হোম ওয়ার্ক না করে তো স্কুলে যেতে পারবে না, আর স্কুলে না গেলে তো মাটির নিচে পিঁপড়ার বাসা খুঁজবে কাকে নিয়ে?। ওর ক্লাশের ছেলে মেয়েরা ওর চেয়ে অনেক বেশি জানে। ওদেরা ছাড়া তো পাখির বাসা খুঁজে পাওয়া যায় না।
ওর বন্ধুরা ওকে একদিন বোকা বলেছে গাছে চড়তে পারছিল না বলে-- তবে শেষ পর্যন্ত পেয়ারা গাছে চড়া শিখেছে।
আমার বাচ্চাদের শৈশবটা আমি চুরি করতে চাইনি। আমার ভেতরে সব সময় এই জিনিসটাই কাজ করেছে এই বাচ্চাগুলি আর কোনদিন তাদের হারিয়ে যাওয়া বয়সটা ফিরে পাবে না। আমার ছয় বছরের মেয়েটা বা ছেলেটা গাছে চড়তে চেষ্টা করছে ও বার বছর বয়সে আর চড়বে না। বার বছর বয়সে সাইকেল চালাবে সাঁতার কাটবে মাঠে দৌড়াবে যা সে বিশ বছর বয়সে করবে না।
ঢাকা -- হায়রে রাজধানী পাষাণ কায়া
বিরাট মুঠিতলে চাপিছে দৃঢ়বলে
ব্যাকুল বালিকারে নাহিকো মায়া। ----------
রবীন্দ্রনাথের বধূ কবিতাটির এই কয়টি চরন এখন ঢাকাবাসীর জন্য নির্মম সত্য। আমি যখন ঢাকা ছেড়ে আসি সবাই অবাক হয়েছে। কোথায় যাচ্ছ? পাগল নাকি? এত্ত ভাল স্কুলে তোমার বাচ্চারা পড়ে ওদের তুমি কোন মফস্বলে নিয়ে যাচ্ছ? আমি মনে মনে হাসলাম। তোমাদের সাথে আমার মিলবে না।
আমি আমার বাচ্চাদের মুক্তি দিতে চাই। মুক্তির স্বাদ দিতে চাই। এই চার দেয়ালের বাইরের বিশাল জায়গাটা দেখাতে চাই চিনাতে চাই। ওরা সারা দিন ভিডিও গেম , কার্টুন নেটওয়ার্ক বা সিনেমা নিয়ে সময় কাটাক আর জুল জুল নেত্রে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকুক আমি চাই না। আমি চাইনা একটা চওড়া ড্রেন দেখে ওরা বলুক এটা নদী।
ওরা দৌড়াতে দৌড়াতে পরে যেয়ে হাটু ছিলে ফেলুক। তার পর আবার উঠে দাড়িয়ে দৌড়াক। ওরাই দেখবে কখন ব্যাথা ভাল হয়ে গেছে। ওরা পাখির ডাক শুনে শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে পাখির পেছনে পেছনে ছুটে চলে। ওরা মেঘের রং দেখে, পরিবর্তন দেখে ।
মেঘের মাঝে খুঁজে পায় এই যে বাঘ, আমগাছ, হাতিরশুঁড়, দাদাবাড়ির টিনের ঘর। সন্ধ্যার আকাশটা লাল না সোনালী এই নিয়ে বিতর্ক। পুকুরের মাছগুলি বিকেলে এত্ত খেলা করে আর সন্ধ্যার সাথে সাথে কোথায় যেন ঘুমাতে যায়। একদিন মাছেদের বাসা দেখতে যেতে হবে যেখানে মাছেদের বিছানা আছে।
মাটির নিচে উঁই পোকারা কিভাবে থাকে? সন্ধ্যার সময় কেন এই ভাবে বের হয়? ঝাঁকে ঝাঁকে উঁই পোকা বের হচ্ছে আর হচ্ছে।
যেন একটা ফোয়ারার মত। আর ফিঙ্গে পাখিগুলি কি দুষ্টু? একটুও ভালো না। সন্ধ্যার সময় ওরা ঘুমানো বাদ দিয়ে খালি লাইটের পোকা গুলি ধরে ধরে খায়।
ঘাস ফড়িঙ্গের সাথে গড়ে তোলার চেষ্টা করে সখ্যতা আর এতে ওদের প্রানটাই যায়।
মাঝে মাঝে বিকালগুলি যায় কাঁকড়ার মুড়ি খাওয়া দেখতে দেখতে।
একমুঠো মুড়ি নিয়ে পুকুর পাড়ে বসে থাকে। একটু একটু করে মুড়ি পুকুরে দেয়। একটা দুইটা কাঁকড়া বের হয়ে এসে দ্বাড়া দিয়ে ধরে মুড়ি খায়। ঠিক আমরা যেভাবে হাত দিয়ে ধরে বিস্কিট খাই।
বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে মাঠে দৌড়ানোর যে কি মজা সে শুধু যে দৌড়ায় সেই জানে? বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসে??? কক্ষনই না ।
রঙ্গধনুর শুরুটা কোথায় আর শেষটাই বা কোথায় খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফেরে। বৃষ্টির শেষে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে গাছটা ঝাকি দিলেতো আবারও গাছটা গা ভিজিয়ে দেয়। পূর্ন চন্দ্রের যে সর্বগ্রাসী আলো সেই আলোয় লুকচুরি খেলার আনন্দ আমি আমার জীবনে পাইনি তাইতো ওদের সাথে মিশে আমিও ওই খেলায় মেতে উঠি।
আমাকে আমার বাচ্চা গুলিই চিনিয়েছে অনেক গাছ অনেক পাখি। কোন পাখি কিভাবে ডাকে? কোন পাখির ডাকে দূরে বসা তার সাথী উত্তর দিচ্ছে, এই পিচ্চিরাই আমাকে বলে দেয়।
আমাকে বলে --মা চুপ করে থাক, দেখ ঐ মাছরাঙ্গাটা না এখনই মাছ ধরে নিয়ে যাবে। ঠিক তাই খুব তীব্রগতিতে মাছরাঙ্গা এসে একটা মাছ নিয়ে চলে যায়। কালো মেঘের মাঝে চকচকে সাদা বকগুলি যখন উড়ে যায় সেই অপরূপ দৃশ্য দেখে ওরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। পানকৌড়ি ডুব দিলেই বলে দেখো মা ও একটা মাছ নিয়ে উঠবে। যদি না নিতে পারে বাচ্চারা খুশিতে হাত তালি দেয়।
পানকৌড়ি মাছ ধরতে পারে নাই। ।
আমার বাচ্চারা ভাল স্কুলে নেই। ওরা ম্যানার শিখছে না । ওরা গোছানো নয়।
ওরা এটিকেট শিখছে না। লেখাপড়া ভাল স্কুলে না শিখলে তো--ওদের ভবিষ্যত কি হবে? কি ভাবে বড় করছো বাচ্চাদের? বাচ্চাদের জন্যই তোমার ঢাকায় থাকার দরকার ছিল? হাসবেন্ড বদলি হয়েছে বলে কি তোমাকেও মফস্বলে যেতে হবে? এইসব ন্যাকামির বয়স কি আছে? বাচ্চাদের দিকে দেখবে না ? ওরাই তো সব??!! আশ্চর্য???!!!
আসলেই আশ্চর্য??!!!
আমি শুনি আর মনে মনে হাসি--
তবুতো ওরা কখনও বলবে না আমি মানুষ হব কিভাবে আমি যে জলে মাছের নৃত্য দেখিনি,? আমি কাকের কর্কশ স্বর ছাড়া পাখির ডাক শুনিনি। আমি শৈশবে কখনও একটি পাখির মৃত্যুতে কাঁদিনি। আমি তো মায়া মমতায় জাড়াজড়ি করে মানুষের সাথে গাছ, পাখি, মাছ, আকাশকে ভাবতে পারিনি? আমি ক্যনভাসে প্রকৃতিকে এঁকেছি কিন্তু এ যে বাস্তব তা জানিনি। ফিরিয়ে দাও আমার শৈশব??? মানুষ হবার যাতাকলে চাপা পরে গেছে আমার সকল সুকুমার বৃত্তি।
তোমরা যখন করছো পড়া মানুষ হবার জন্য
আমি না হয় পাখিই হব পাখির মত বন্য।
ওরা না হয় পাখিই হবে পাখির মত বন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।