আমি লিখি মানুষের কথা,মানুষ পড়ে না। তারা হাসে। তাদের হাসির জন্যে আমি লিখি 'সবকিছু হাসির বিষয় নয়' তারা হাসে না! তবু আমি লিখব।
পিচ রাস্তা যেখানে গিয়ে দুহাত মেলেছে তার ডানদিকের হাতটা ধরে হাঁটলেই মা শীতলার মন্দির ।
মন্দিরে বাম পাশের মোরাম ছড়ানো গলিপথের শেষ বাড়িটা আমাদের।
মনে পড়ে আমি একদিন ওই বাড়িতেই থাকতাম। এখন ভিন রাজ্যে আছি। হলুদরঙা বাড়িটা যেন বুকের
ভেতর সেঁধিয়ে আছে এখনও। মাস তিনেক আগে ওই বাড়িতে ঢুকতে গিয়ে চোখে জল এসে গেছিল
আমার। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঝটপট মুছে ফেলেছিলাম সেই নস্টালজিয়ার ধারা।
এখন আমি যে বাড়িটায় মানে ফ্ল্যাটে থাকি তার সাথে ওই বাড়িটার কোন তুলনা হয় না। এখানে একবেলা
গ্যাস না থাকলে বউয়ের মুখভার হয়। অথচ ওই বাড়িটাতে আমার মা চিরকাল তোলা উনুনে রান্না করেছেন।
কয়লার ধোঁয়ায় আঁধার হয়ে উঠতো চারদিক। মনে হতো মা যেন মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছেন।
সেই
ধোঁয়া একসময় মাকে ছেড়ে বাগান পেরিয়ে মেঘের খোঁজে বেরিয়ে পড়তো বাতাসের কাঁধে চেপে।
পড়া ফেলে আমি ছুটে যেতাম মায়ের কাছে। তাঁর আঁচলে হাত জড়িয়ে বলতাম: " সুমনদের মতো গ্যাস
নাও না কেন মা?"
মা হাসতেন। বলতেন: " তুই লেখাপড়া শিখে বড় হ, চাকরী করবি, তখন আমরা গ্যাস নেব, ফ্রিজ নেব। "
এখন আমি একটা চাকরী করি।
পেটের দায়ে পড়ে আছি, বাড়ি থেকে অনেক দূর রাজ্যের ভিনভাষী
শহরে। মনে হয় আলাদা কোন দেশ কিম্বা অন্য কোন গ্রহে বাস করি এখন।
গ্রহান্তরের এই জীবনে আমার বউ গ্যাস, ফ্রিজ, এয়ারকুলারে এমন সেঁটে থাকে, যেন মনে হয়, ওসব ছাড়া
পৃথিবী অচল। তবে কি আমার মায়ের পৃথিবী অচল ছিল? কিম্বা সেই কয়লার ধোঁয়া, যা কিনা উড়তে
উড়তে হারিয়ে যেত দিক্ দিগন্তে, তারা নিশ্চল ছিল?
কিম্বা জীবন হয়তো এমনই, যাতে বউ মানে অভিযোগ, অনুযোগ আর আব্দার। কোন কিছুর অভাব হলেই
সাপের মতো ঠান্ডা চোখে তাকানো।
যেন ওই চোখের হিমদৃষ্টি যদি আগুনময় হতো আমি উড়ে যেতাম
কয়লার ধোঁয়ার মতো।
গ্রামের মানুষজন বউ পিটিয়ে নিজের পৌরুষ জাহির করে। তারা বেশীর ভাগই অশিক্ষিত। তাই ওটাই
তাদের দর্শন, বউ আর বানরকে নাকি কখনও লাই দিতে নাই। দিলে মাথায় ওঠে।
মাথার চুল খামচে
উকুন বের করে। নড়চড় করলে গালে চড়ায়।
আমার সেসব কিছুর করার উপায় নেয়। প্রথম কথা, এই বিদেশবিভূঁইয়ে সেই আমার একমাত্র সঙ্গী, বন্ধু।
দ্বিতীয় কথা আমি কারিগরী বিদ্যার উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত, যুক্তির আঘাতে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা ছাড়া
আমার সামনে দ্বিতীয় কোন দর্শন নাই।
তৃতীয় কথা, আমার বউ গর্ভবতী। যেকোন দৈহিক, মানসিক আঘাত
অনাগত অতিথির দেহমনে প্রভাব ফেলতে পারে।
আমি তাই চুপচাপ বউয়ের তিরস্কার, ভৎর্সনা সহ্য করি। কাজ থেকে হাজার ক্লান্তি নিয়ে ফিরলেও তার
সব হুকুম হাসিমুখে তামিল করি। তামিলনাডুতে আছি বলেই হয়তো "তামিল" শব্দটি আমার জীবনে, মননে,
সংগোপনে সংযোজিত হয়ে গেছে।
বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে মিসকল হয়। বউ আমার মোবাইল নিয়ে বাবামায়ের সাথে আলাপন শুরু করে।
তাতে কুশলাদির চেয়ে আমি কত অপদার্থ তাই
বাক্য বাক্যান্তরে জানান দেয়।
আমি চুপচাপ শুনি। কখনোই কোন প্রতিবাদ করি না।
চুপিচুপি মেনে নিই, যে মানুষের এত দোষ সে
নিঃসন্দেহে অপদার্থ।
ছেলেবেলায় শুনেছি, আমার গনেশ নামটা রেখেছিলেন আমার ঠাকুমা। আমার নাদুসনুদুস চেহারা দেখে
তিনি "গোবর গনেশ" বলে আদর করতেন।
এখন বিভিন্নভাবে বুঝে যাচ্ছি ,আমি সার্থক নামা। আমার মতো মানুষের নাম "গনেশ" এর চেয়ে " গোবর
গনেশ" হওয়ায় শ্রেয়।
মাস তিনেক আগে বাড়ি গেছিলাম। মা খুশি হয়ে ভাবলেন, আমি বুঝি তাঁকে দেখতে এসেছি। পড়শীরাও
জানলো। শুধু আমি জানি, কেন গেছিলাম আমি।
দেখলাম মা এখনও সেই কয়লার উনুনে রান্না করছেন, ধোঁয়ার কুন্ডলী তাদের গতিপথ পরিবর্তন করেনি,
তারা আগের মতোই বাগানের মাথা ছুঁয়ে মেঘমালার খোঁজে আকাশে উড়ে যায়।
মায়ের মতো বাবাকেও
এখন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন করে রাখে। তাতেই দিব্যি ইংরেজী কাগজ পড়েন মানুষটি। গোবর গনেশের বাবা
হলেও তিনি যেন সত্যিই সদাশিব।
আমি ইচ্ছে করলেই বাড়িতে গ্যাসের ব্যবস্থা করে দিয়ে আসতে পারতাম। ফ্রিজ, এয়ারকুলারও অসাধ্য
কিছু ছিল না।
কিন্তু সেসব কিছু না করেই ফিরে এলাম কর্মস্থলে। ভেবে রাখলাম যদি কোনদিন ফিরি তবে
ওসবের ব্যবসথা করতেই হবে। ওসব ছাড়া আমার মায়ের চললেও বউয়ের চলবে না। তবে এখন আমার
শিরে সংক্রান্তি, সিজার নাকি নর্মাল হবে তাই নিয়ে ভাবছি। যে কোন পরিস্থিতির জন্যে তৈরী আছি ওই
ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সের ভরসায়, তা থেকে বাবামায়ের জন্যে খরচা করা মানে বিলাসিতা।
ওগুলো ছাড়া আমার
বাবামায়ের চলে যাচ্ছে কিন্তু ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ছাড়া আমি অচল।
গৃহস্থের কাছে ছোটখাট অসুখবিসুখে মৌচাক যেমন ভরসার আমার জীবনযাপনে ছোটবড় সবকিছুতেই
ওই ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স তেমনই আশাদায়ী। যে সংস্থায় কাজ করি তা চুক্তিভিত্তিক। কাজ হলো তো পয়সা
পেলাম, কাজ নাই তো জমানো টাকা ভেঙে সংসার চালাও। কাজও এক জায়গায় নয়, আজ কোয়াম্বাটুর
তো কাল ত্রিচুর, ছুটে যাও শুধু পয়সার সন্ধানে, মৌমাছি যেমন একফোঁটা মধুর খোঁজে পাড়ি দেয় হাজার
মাইল।
বাবামায়ের হাতে টাকাপয়সা দিয়ে এলাম না ঠিকই কিন্তু মনের মধ্যে খচখচানি থেকে গেল । মনে হলো, আমি
বউয়ের কাছে অপদার্থ, সমাজের চোখে গোবর গনেশ, সত্যি!
আমার গোবর গনেশ নামটা সর্বসমক্ষে খ্যাতি পেয়েছিল বোসদের বাড়ির নারকেল চুরির ঘটনায়। দিনে যে
নারকেল গাছে বানরের মতো উঠে পড়ি রাতে সেই গাছে লটকে গেলাম। গাছে পায়ের ছাঁদ মারা আছে,
মাথা ঝুলে গেছে নিচে, গনেশ ওল্টানো যাকে বলে আর কি। না পারছি পায়ের ছাঁদ খুলতে, না পারছি মাথাটাকে তুলে ধরতে।
প্রাণের দায়ে চিৎকার করছি:" বাঁচাও, কে আছো বাঁচাও। "
আমার সঙ্গীসাথীরা কেউ অন্য গাছে চড়েছিল, তারা না পারছে গাছ থেকে নামতে, নিচে যারা আছে তারা
না পারছে আমাকে ফেলে পালাতে।
শেষমেষ আমাকে বাঁচাতে ছুটে এলেন বোসবাবু স্বয়ং। গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বললেন: "আর একটু কষ্ট করে
পায়ের ছাঁদ মেরে লটকে থাক, আমি দেখছি কি করতে পারি।
শেষ অব্দি গাছের নিচে কম্বল পেতে ধরল চারজন এবং আমাকে ছাঁদমুক্ত হতে বলা হলো।
মা ধরিত্রী দ্বিধা হও, ভেবে নিজেকে গাছ মুক্ত করে পড়লাম কম্বলে। সেই চারজন যখন আমাকে কম্বল সহ
নিচে নামালো তখন যেন মনে হলো আমার পাতাল প্রবেশ ঘটছে। লজ্জার কারণগুলি ছিল, গেছোবাবু রুপে
খ্যাতিমান আমি কিনা শেষে গাছেই লটকে গেলাম। চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়া। পলাতক সতীর্থরা হয়তো
কাছেপিঠেই অপেক্ষা করে আছে।
ছিঃ ছিঃ কি লজ্জা!
বোসবাবু আমার পরিচয় জানলেন। বললেন:" তোমার বাবাকে চিনি, ভালমানুষের ছেলে হয়ে ওইসব বদ
ছেলের সঙ্গে মেশো কেন?
সেই থেকে আমার ঠাকুমার দেওয়া পারিবারিক " গোবর গনেশ" নাম সার্বজনীন হয়ে গেল।
স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির বিভিন্ন স্তরে নানাভাবে আমার গনেশত্বের সাথে গোবরত্বের প্রমাণ স্বতসিদ্ধ হয়েছে।
তা নিয়ে আমার আক্ষেপ নাই। তবে পাত্রী দেখতে গিয়ে ঠাম্মা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন:"কি রে, গোবরা,
বউ পছন্দ হয়েছে?"
আমি হাসিমুখে বলেছিলাম:"হ্যাঁ হয়েছে।
"
"গোবর গনেশ কোথাকার!" বলে ঠাম্মা হেসেছিলেন। সেই হাসিতে যোগ দিয়েছিল ঘরে উপস্থিত সকলের
সাথে আমার হবু বউও।
সেদিন থেকে বউ আমাকে ওই নামে জেনেছে, মনেমনে ডেকেছেও হয়তো। তবে আমার অপদার্থতার কথা কি ভাবে নার্সিং হোমের ডাক্তার নার্সরা কি ভাবে টের পেল কে জানে। পেন উঠছে বউয়ের ওরা বলে কিনা
আপনিও পেনকিলার নিন।
হয়তোবা আমার ছটফটানি দেখে ওরা ভেবেছে, বউয়ের চেয়ে আমার বেশী দরকার পেনকিলারের।
বউ ক্ষিদেতে ছটফট করছে, ওরা বলে কিনা:" আপনি কিছু খেয়ে নিন। "
মৃদু হেসে
বললাম:" আমি খেলে কি ওর ক্ষিদে কমবে?"
নার্স মিষ্টি হেসে বললো:" উনি এখন কিছু খেতে পাবেন না কিন্তু আপনার খাওয়াটা জরুরী। "
মনে ভাবলাম, এরা বুঝি তামিল ভাষায় রবীন্দ্রনাথ পড়েছে, তাই "পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য" কথাটি খাওয়া
দাওয়াতেও প্রয়োগ করে দেখছে।
বাবা হওয়ার সংবাদটা একের পর এক আত্মীয় বন্ধু সকলকে ফোন করে জানালাম।
অভিনন্দনের জোয়ারে
ভাসতে ভাসতে একসময় আমার সদ্যজাত ছেলেটার কথা মনে হলো, চেহারা তো হয়েছে আমার মতো
নাদুসনুদুস, তবে কি ও আমারই মতো গোবর গনেশ হবে, গোবর গণেশ দ্য জুনিয়ার?
পুত্রজন্মানোর সংবাদ দেওয়ার সাথে সাথে আমি আমার আত্মীয় বন্ধুদের কাছে একটা বিষয়ে মতামত
চায়ছিলাম। তামিলনাডুতেই থাকবো নাকি ফিরে যাব আমাদের ধুলোমাখা পশ্চিমবাংলায়। ওরা বলেছিল,
ভেবেচিন্তে জানাবে।
তামিলনাডুর ভাষা, জীবনযাপন, আমাদের থেকে আলাদা। এখানে কাজ করে পয়সা পাই ঠিকই তবে
অনেককিছুই মিস করি।
কলকাতার কফি হাউসের আড্ডা, শান্তিনিকেতনের পৌষমেলা, দুর্গাপুজোর হৈচৈ,
এখানে আশা করা যায় না। কিন্তু আমাকে দেওয়ার মতো কারো কোন কাজ নাই। জমানো টাকা দিয়ে
একটা ব্যবসা করা যেতে পারে, তবে তাতে লাভবান হবো কিনা নিশ্চয়তা নাই। এখানে কিছু না থাকলেও
কাজ আছে, আমার মতো গোবর গনেশ মানুষের চাহিদা আছে। কিন্তু এখানে ছেলেকে মানুষ করলে ও আর
বাঙালী থাকবে না, তামিল হয়ে যাবে।
আমার সমস্যা ও সিদ্ধান্তহীনতার কথা ঠাম্মা শুনেছেন। পক্ষাঘাতে অচল বৃদ্ধার গলার আওয়াজ এখনও
টনটনে। বললেন:"গাঁয়ে আর মায়ে সমান,নিজের উপর ভরসা থাকলে বাপমায়ের কাছে দাঁড়াবি,নিজের বুদ্ধিতে ভিখারী হতে হয়, মেরুদন্ডের হাড় শক্ত না হলে চিরকাল গোবর গনেশ হয়েই থাকবি। "
ঠাম্মার কথায় নিজেকে আরো একবার গোবর গনেশ মনে হলো, প্রতিবার যেমন মনে হয়!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।