আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নির্যাতন-০৩ জবানবন্দীতে পুলিশের শেখানো কথাই বলতে বাধ্য হন আসামীরা

Only I know what is my goal, My heart is my temple.

নির্যাতন-০৩ কাজী সায়েমুজ্জামান : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের আলোচিত ঘটনা ছিল এটি। ব্যবসায়ী আজম জে চৌধুরীর একটি চাঁদাবাজী মামলায় গ্রেফতার হন বর্তমান মন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম। তাকে রিমান্ডে নিয়ে কয়েকদিন রাখা হয়। পরে আদালতে গিয়ে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে তিনি চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত হিসেবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম বলেন। পুলিশ অভিযোগ পত্রে শেখ হাসিনার নামও লিপিবদ্ধ করে।

এভাবেই একটি চাঁদাবাজী মামলার আসামী হয়েছিলেন শেখ হাসিনা। পরে আদালতের বিচার শুরু হওয়ার সময় নিজের জবানবন্দী প্রত্যাহার করে নেন শেখ সেলিম। তিনি আগের জবানবন্দী নেয়ার কারণ হিসেবে ভয়াবহ নির্যাতনের কথা আদালতে তুলে ধরেছিলেন। তাদের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিরা রিমান্ড শেষে যদি এধরনের জবানবন্দী দিতে বাধ্য হন তাহলে সাধারণ মানুষের বেলায় কি হয় তা সহজেই অনুমেয়। শেখ সেলিমের এ জবানবন্দী ও মামলা গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে হলেও এটাই ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থায় জবানবন্দী প্রথার আসল রূপ।

আসলে পুলিশের সুবিধামতো যেভাবে দরকার সে অনুযায়ী নিজের জবানবন্দী দিতে বাধ্য হন অভিযুক্তরা। পরে শতকরা একশভাগ আসামীই তার দেয়া জবানবন্দী প্রত্যাহারের আবেদন করেন। ফৌজদারী বিচার ব্যবস্থা অনুযায়ী জবানবন্দী দেয়ার পর আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। এসময়ই আসামী তার আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন। আর আইনজীবী তার পক্ষে প্রথম যে কাজটি করেন তা হলো আগের দেয়া জবানবন্দী প্রত্যাহারের একটি আবেদন দাখিল করা।

এতে আগের দেয়া জবানবন্দীর কোন মূল্যই থাকেনা। ফলে নিম্ন আদালতে বিচার চলাকালেই ওই আবেদনের ওপর ভিত্তি করে হাইকোর্টে জামিন আবেদন করে আসামী প। এখন প্রশ্ন হলো তারপরও এত নির্যাতন করে কেন সাজানো জবানবন্দী নেয়া হয়? রাজধানীতে অধিকার আয়োজিত নির্যাতনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মীজানুর রহমান বলেছিলেন, নির্যাতিত ব্যক্তি যেকোন সময় এ জবানবন্দী প্রত্যাহার করতে পারেন। আইনেই এটা রয়েছে। রাষ্ট্র এটা ভালো করেই জানে কাউকে জোর করে স্বীকারোক্তি দেয়া হলেও তার কোন মূল্য নেই।

তারপরও কেন সাজানো জবানবন্দী দেয়ার জন্য নির্যাতনের আশ্রয় নেয়া হয়? সরজমিনে জবানবন্দী আদালতে গিয়ে দেখা গেছে, একজন আসামীকে পুলিশ হেফাজত বা রিমান্ড শেষে আদালত কে হাজির করে পুলিশ। পরে তারা দূরে সরে যায়। পরে বিচারক ওই আসামীকে আদালতের একজন কর্মচারীর তত্ত্বাবধানে দুই ঘন্টা থাকতে দেন। পরে ম্যাজিষ্ট্রেট আসামীকে আটটি প্রশ্ন করেন। এগুলো হলো- আমি পুলিশ নই, ম্যাজিষ্ট্রেট জানেন কি? আপনার দৃষ্টি বা শ্রবণ সীমায় কোন পুলিশের লোক দেখতে পাচ্ছেন কি? আপনি এ মামলায় দোষ স্বীকার করবেন কি? আপনি দোষ স্বীকারে বাধ্য নন, এই দোষ স্বীকার আপনার বিরুদ্ধে স্ব্যা হিসেবে ব্যবহার করা হতে পারে জানেন কি? পুলিশ বা অণ্য কেউ আপনাকে কোন নির্যাতন, প্রলোভন বা চাপ দিয়াছে কি? আপনি দোষ স্বীকার করেন আর নাই করেন আপনাকে আর পুলিশের নিকট দেয়া হবেনা জানেন কি? আপনি কেন দোষ স্বীকার করছেন? আপনি সত্য বলছেন কি? আসামী জবানবন্দী দেয়ার পর ম্যাজিষ্ট্রেট লিখেন, পরিদর্শনকালে আসামীকে সুস্থ ও সজ্ঞান দেখা গেল।

পুলিশ তাকে কোন নির্যাতন করেনি এবং চাপ বা মুক্তির প্রলোভন দেখায়নি বলে সে জানায়। আসামীর দোষ স্বীকারোক্তি স্বেচ্চামূলক ও সত্য বলায় তা প্রতিয়মান হওয়ায় তা রেকর্ড করা হলো। ম্যাজিষ্ট্রেটের এ ধরনের সনদ পেয়ে পুলিশ ধরা ছোয়ার বাইরে চলে যায়। এখানে যে বিষয়টি বলা প্রয়োজন তা হলো দোষ স্বীকারের পরই কেবল জানানো হয় তাকে আর পুলিশের কাছে দেয়া হবেনা। এছাড়া পুলিশ আসামীকে নিজের মতো করে জবানবন্দী দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত না করতে পারলে ফের অধিকতর তদন্তের জন্য রিমান্ডের আবেদন করে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ম্যাজিষ্ট্রেট তাকে দ্বিতীয়বার রিমান্ডে দেন। একশ ভাগ জবানবন্দী প্রত্যাহার শতকরা একশ ভাগ জবানবন্দীই প্রত্যাহার করা হয়। জবানবন্দী প্রত্যাহারের পক্ষে একটি যুক্তিই উপস্থাপন করা হয়। দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন করেই আগের জবানবন্দী নেয়া হয়েছিল বলে তারা অভিযোগ করেন। আইনজীবীরা বলছেন, জবানবন্দী প্রত্যাহার বিচার কার্যক্রমের একটি অংশ।

এছাড়াতো আসামী পরে আইনজীবী মক্কেলকে নির্দোষ প্রমাণ করার পক্ষে কোন যুক্তি উপস্থাপন করতে পারেননা। ২০০৮ সালের ২৩ অক্টোবর রাজশাহীর জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তি জবানবন্দী দেন একটি খুনের মামলার আসামী কোটালি পাড়া গ্রামের বিহারীর পুত্র মো সাজ্জাদ হোসেন। পরে ২২ ডিসেম্বর সাজ্জাদ একই আদালতে আগের জবানবন্দী প্রত্যাহারের আবেদন করেন। এতে তিনি অভিযোগ করেন, আগের দেয়া স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছাকৃত নয়। ওই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গ্রেফতারের পর দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন করে।

থানার দুজন সিপাহীকে দিয়ে আমার দু হাত পেছনের দিকে বেধে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে লাঠিচার্জ করে। পরে তাদের শেখানো জবানবন্দী দিতে বাধ্য হয়েছি। প্রতিটি আবেদনপত্রের ভাষা প্রায় একই রকমের হয়ে থাকে। সাজানো জবানবন্দীর খন্ডচিত্র জোট সরকারের সময় শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার মামলায় জজ মিয়াকে গ্রেফতার করে তার জবানবন্দী নেয়া হয়েছিল। ওই জবানবন্দীতে জজ মিয়া গ্রেনেড হামালার দোষ স্বীকার করেন।

তার জবানবন্দীতে খুশী হয়ে জজ মিয়াকে তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতের হাজাতেই বিরিয়ানী খাইয়েছিলেন। পরে প্রমাণিত হয়েছে আসলে এ ঘটনার সঙ্গে জজ মিয়ায় ন্যুনতম সম্পর্কও নেই। এ বছর কারাগার থেকে বের হন জজ মিয়া। এর মধ্যে গত নয়টি বছর কারাগারেই কাটাতে হয়েছে তাকে। তবে এখনও মুক্তি মেলেনি তার।

আগের তদন্তকারী কর্মকর্তারা এখন চাবরিতে না থাকলেও ঠিকই পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকী দেয়ার মিথ্যা অভিযোগে জোট সরকারের আমলে পার্থ সাহাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে সীমাহীন নির্যাতন চালানো হয়। একপর্যায়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা বুঝতে পারেন যে পার্থ এ ঘটনায় জড়িত নয়। পরে তারা পার্থকে বলেন, ধরে নিচ্ছি তুমি তাকে ইমেইলে হুমকী দাওনি।

তবে এখন স্বীকারোক্তি দিতে হবে যে মজা করে এ কাজটি করেছিলে। পার্থ একপর্যায়ে বাধ্য হয়েছিল তদন্তকারী কর্মকর্তাদের কথামতো জবানবন্দী দিতে। এরপর মানবাধিকার সংস্থাগুলো পার্থর পে আইনী সহায়তায় নামে। তত্ত্বাবধায়কের আমলে এর সুষ্ঠূ তদন্ত হয়। দেখা যায় পার্থ নিরপরাধ।

পরে পার্থ কারাগার থেকে মুক্তি পান। মুক্ত হলেও তিনি এখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেননা। জবানবন্দী নিয়ে একটি কৌতুক জাতিসংঘের একটি প্রশক্ষণ কর্মসূচীতে বাংলাদেশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা যোগ দেন। তার সঙ্গে সুইটজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স আর বৃটেনের একজন করে পুলিশ কর্মকর্তাও যোগ দেন। তাদের প্রশিক্ষনের একটি অংশ ছিল আমাজান বনে।

এ বনের মধ্যে কয়েকটি হরিণের বাচ্চা ছেড়ে দেয়া হয়। কর্মকর্তাদের বলা হয় এ বাচ্চা গুলোকে খুজে বের করে আনতে হবে। সময় দেয়া হবে একদিন। তবে এর বেশী সময় লাগলেও হরিণের বাচ্চা ছাড়া খালি হাতে ফেরা যাবেনা। সুইটজারল্যান্ডের পুলিশ কর্মকর্তা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই হরিণের বাচ্চা উদ্ধার করে ফিরলেন।

ফ্রান্সের পুলিশ হরিণের বাচ্চা নিয়ে হাজির হন তিন দিন পর। বৃটেনের কর্মকর্তা সাত দিন পর। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ১৫ দিন পর। কিন্তু বাংলাদেশের পুলিশের কর্মকর্তার কোন খোজ নেই। প্রশিক্ষকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন।

একমাস পর ব্রজিলের বিভিন্ন শহর থেকে ঘুরে ফিরে একটি ছাগলের বাচ্চা নিয়ে হাজির হলেন বাংলাদেশী পুলিশ কর্মকর্তা। প্রশিক্ষকরা প্রশ্ন করলেন, ছাগলের বাচচা নিয়ে আসলেন কেন? জবাবে পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, কে বলেছে এটা ছাগলের বাচ্চা। একে রিমান্ডে দেন। দেখবেন পরদিন এটা নিজেই স্বীকার করবে যে সে একটা হরিণের বাচ্চা। দ্বিতীয় কিস্তি Click This Link প্রথম কিস্তি Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।