আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লুল-এর উৎস অনুসন্ধানে


প্রথম পর্ব সামুতে আমার সক্রিয় অংশগ্রহণের সম্ভবত: তিনদিনের মাথায় ‘লুল’ শব্দটি গোচরে আসে, লেখাজোখা শামীমের কোন এক পোষ্টে। আমার অশ্রুতপূর্ব হলেও শামীম ভাইয়ের সাবলীল সেই লেখায় ‘লুল’ শব্দের ভাবার্থ সম্পর্কে খানিকটা আভাস পাই। ইতোমধ্যে বহতা সময়ের ধাক্কায় সামুতে চলে অর্ন্তজালিক প্যাকেজের অজস্র আনাগোনা এবং একদিন মডারেটরদের বদান্যতায় আমি সামুর ‘সেফ ব্লগার’ হিসেবে চিহ্নিত হই। সেই সাথে ব্লগিং-এর সবচে আনন্দময় কর্ম (অন্তত: আমার কাছে), মন্তব্য চালাচালিতে আমার নেশা ধরে যায়। আমার কোন এক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সামু কাপাঁনো ব্লগার গোয়েবলস্, যাকে আমি স্নেহ করে গোবলী বলে ডাকি, সেই আমাকে ‘লুল’ হিসেবে চিহ্নিত করে।

আমার আতেঁ ঘা লাগে, অভিমান হয়, উদাস উদাস হয় আমার সংবেদী মনটা(অবশ্য গোবলীকে আমি তা জনাতে দেই না)। এরপর, আমার এক মন্তব্যের জবাবে সামুর সুভদ্র ব্লগার, দীপান্বিতা, স্মৃতিচারণামূলক লেখায় যার রয়েছে জাদুকরী কলম তিনিই অভিযোগ সুরে বলেন, “আচ্ছা, অনেকগুলো শব্দ আছে ব্লগে এসে দেখছি......১মে বুঝতাম না......এখন বুঝি এগুলো ভাল শব্দ না......সবচেয়ে বেশি দেখি ‘লুল’, মানেটা কি! এখানে যেমন জেলকে ‘শ্বশুড়বাড়ি’ বলে, অমন ব্যাপার, নাকি!...অন্যের ব্লগে গিয়েতো জিজ্ঞেস করাটা বোকা বোকা হয়ে যায়......ভালই হল!. .....এই যে তাজা কলম আপনি ঠিক করে বলেন! লুলবাবু না ফুলুবানু......আপনিই বলুন............মানেটা ঠিক কি?” তার অভিযোগের উত্তরে বিনয়ের অবতার হয়ে বলি, "আরে বাবা, শব্দের কি দোষ আপু। নির্ভর করে তা ব্যবহারের উপর। ধরে নিন লুল বাবুরা হচ্ছে পুরুষ প্রজাতির রোমান্টিক ব্লগার আর ফুলবানুরা হচ্ছে নারী প্রজাতির রোমান্টিক ব্লগার। আসলে সবকিছুই আমাদের ভাবনায়, দৃষ্টিভঙ্গীও আপেক্ষিক।

মহামতি আইনস্টাইন তো তার রিলেটিভিটি সূত্রে এটিই শিখিয়েছেন। শব্দের দোষ ধরিয়েন না আপু, শব্দের ব্যবহারের উপর নির্ভর করে শ্লীল কিংবা অশ্লীল। “ আমার এ ব্যাখ্যায় দীপান্বিতাকে বেশ সন্তুষ্ট বলেই মনে হল। [তবে কাব্যিক ঝংকারে, সুললিত ভায়ায় লুলের রোমান্টিক কাব্যিক ব্যাখ্যা যদি সামুর রোমান্টিক কবি, কালপুরুষ, সহেলি, সুলতানা শিরীন সাজি, সুনীল সমুদ্র, নাজনীন খলিল, কালিদাস কবিয়াল, ভাস্বর চৌধুরী, আব্দুল্লাহ আল মনসুর, হেমায়েতপুরী, শামসীর প্রমুখের কাছ থেকে আসতো তাহলে হয়তো দীপান্বিতা খুশী হতেন। জুলভার্ণ, ইমন জুবায়ের , রাজ মো, আশরাফুল হক বারামদী তাদের গবেষণাধর্মী লেখাতেও হয়তো লুল চরিত্রের যৌক্তিক চরিত্র উদঘাটন করতে পারতেন।

আর সামছা আকিদা জাহান, আইরিন সুলতানা, নুশেরা, কঁাকন প্রমুখ নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে সামুর লুলদের সম্পর্কে কিছু কথা বললে হয়তো তা এক ভিন্নমাত্রা পেত] যা হোক, এরপর ভাবলাম আর নয়। ‘লুল’ শব্দের উৎসমুখ, ধাতুমূল আমাকে জানতেই হবে। লুলের সন্ধানে ঘাটাঘাটি করতে শুরু করলাম ঢাকা ও কলিকাতা থেকে প্রকাশিত উচ্চমার্গের বেশ কটি অভিধান। লুলা আছে, কিন্তু লুল নেই। লুলার আভিধানিক অর্থ লেংড়া, আঁতুর ইত্যাদি।

খানিকটা গবেষণা করেই নিশ্চিত হই লুলের সাথে লুলার কার্যকারণ কোন সম্পর্ক নেই। অবশ্য আরেকটি কাছাকাছি শব্দ পাই ‘লোল’, যার অর্থ খাদ্যদ্রব্য (বিশেষত: তেঁতুল বা আচার) গ্রহণের লোভে মুখে যে লালা সঞ্চারিত হয় তা। লোলের সাথে কি লুলের সম্পর্ক আছে? ‘লুল’ শব্দের উৎস খুঁজতে আমার মস্তিস্কের নিউরণগুলো যখন অসহায় দাপাদাপি করছে তখনই দেখা হলো সামুর জনপ্রিয় পুরানো ব্লগার কবি সুনীল সমুদ্রের সাথে। সুনীল সমুদ্র, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সতীর্থ, যার সাথে এখনো রয়েছে ঘনিষ্ট যোগাযোগ। সে মূহুর্তে ওর আগমন যেন দৈব কোন ঘটনা।

কোন কুশলবাক্য বিনিময় না করেই আচমকা ওকে প্রশ্ন করি, ‘এই, বলো তো লুল কি?’ সুনীল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। আমি ঝেড়ে কাশি, “আরে, এই যে সামুতে লুলদের নিয়ে এত মাতামাতি, লুলীয় কবিতা, লেখালেখির এত ছড়াছড়ি—সেই লুল শব্দের উৎস কোথায়, এর ধাতুমূলই বা কি?” টিউব লাইটের মতোন ধীরগতিতেও হলে ও এবার বুঝতে পারে আমার প্রশ্নের শানে নজুল। এবার ও হাসে এবং রাশভারী অধ্যাপকের মতোই বলতে শুরু করে, "বুঝলে না, লুল শব্দের মূল হচ্ছে ‘লোল’ বা মুখে লালা আসা। এক্ষেত্রে নারী ব্লগারদের গন্ধ পেলে যে সব পুরুষ ব্লগাররা ঝাপিয়ে পড়ে ভার্চুয়াল সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য তাদেরকে লুল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। দেখবে অনেক নারী নিকধারী ব্লগারদের এলেবেলে লেখায় লুল ব্লগারদের মেকী প্রশংসামুখর মন্তব্যের ছড়াছড়ি ।

এই লুল ব্লগারদের একমাত্র উদ্দেশ্য নারী ব্লগারদের (অথবা নারী নিকধারী ব্লগারদের) ভার্চুয়াল কৃপা অর্জন করা। “ সুনীলের বক্তব্যে আমি শ্লাঘা বোধ করি। লুলের সাথে লোলের সম্পর্ক রয়েছে এমন ভাবনাই তো আমি করছিলাম। এখন কথা হচ্ছে, লুল তো ভাচুয়াল জগতে, বিশেষত: সামুতে প্রচলিত শব্দ। অ্যাকচুয়াল জগতে এর প্রতিশব্দ কি হতে পারে? সম্ভবত: ‘আলুর দোষ’।

আপনাদের ঞ্জাতার্থে জানাচ্ছি আলুর দোষ ইতোমধ্যেই বাগধারা হিসেবে বাংলা ব্যাকরণে গৃহিত। এর প্রমাণ পেলাম উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের একটি বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে প্রচলিত বাগধারার তালিকায় ‘আলুর দোষ’ সংযোজিত দেখে। বইটিতে আলুর দোষ বলতে ভাদ্রমাসের কুকুরের মতোন নারীসঙ্গ লিপ্সু ‘লুচ্চা’ (শব্দটি অভিধানে পাবেন) পুরুষদের বৈশিষ্ট্যকে বুঝানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বভাবত:ই পতিত রাষ্ট্রপতি এরশাদের কথা এসে যায়। এরশাদের পতনের অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম ছিল তার ‘আলুর দোষ’।

আলুর দোষ মুক্ত হতে পারলে এরশাদ হয়তো মাত্র নয় বৎসর নয় বরং আমৃত্যু দেশের রাষ্ট্রপতি হয়ে থাকতেন! রাজনীতিতে আলুর দোষ এক অভিশাপ। আলুর দোষের কারণেই রাবণ সীতা হরণের মতো কাজে প্রবৃত্ত হন, যাতে ঘটে তার অনিবার্য পতন। আধুনিককালে, প্রচলিত ইতিহাস বলে, লেনিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লবের কারণে রাশিয়ার প্রতাপশালী জার সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। কথাটি আংশিক সত্য। সত্যিকার অর্থে জার সাম্রাজ্যের পতনের বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল আলুর দোষে দোষায়িত রাস পুতিন।

ইতিহাসবিদরা কেন যে বিষয়টা গুরুত্ব দেন না তা আমার বোধগম্য নয়। ভাগ্যিস, অ্যাকচুয়াল জগতের আলুর দোষের মতোন লুলামী ততটা বিপদজ্জনক নয়। প্রমাণ? সামুতে এতো লুলের ছড়াছড়ি, তবুও তো সামুর পতন হচ্ছে না। বরং অর্ন্তজালে সামুর বিস্তৃতি ঘটছে দ্রুতলয়ে। (চলবে..)
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।