আদর্শটাকে আপাতত তালাবন্ধ করে রেখেছি
৫.
১৮ তারিখ রাতে রওনা দিই আমরা- আমি আর মামুন ভাই। মামুন ভাই একটি পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক, বয়সে আমার অনেক বড়, কিন্তু সম্পর্কটা অভিভাবক প্লাস বন্ধুত্বের মতো। একটা সময় ছিলো যখন প্রায় শনিবারে আমরা দলবেধে ঢাকার আশেপাশে কোথাও ঘুরতে যেতাম। কোনোদিন রাজেন্দ্রপুর, কোনোদিন ভাওয়াল গড়, কোনোদিন বা মাওয়া ঘাট। এসব ভ্রমণে মাঝেসাঝে আরও মানুষজন যোগ দিলেও টিমে আমরা দু'জন প্রায় সবসময়ই কমন।
এখনও সময় পেলে আমরা বেরিয়ে পড়ি।
ঈদের আগে বলে শ্যামলী কাউন্টারে প্রচুর ভিড়, তবে অধিকাংশই কলকাতার যাত্রী। আমাদের গাড়ি ছাড়ার কথা রাত ১১টায়, কিন্তু গাড়ি আসতে আসতে ১২টা পেরিয়ে যায়। যে বাসটি রাঙ্গামাটি যাওয়ার কথা ছিলো, সেটি নষ্ট হয়ে গেছে। ভালোই হলো- কারণ বদলে আমাদের দেওয়া হয়েছে ঢাকা-কলকাতা রুটের শ্যামলী-বিআরটিসির আরএমটু গাড়ি।
বেশ ঝাক্কাস জার্নি হবে বলে মনে হচ্ছে! আয়েশ করে জমিয়ে বসলাম। এসির হিম হিম ঠাণ্ডায় হালকা কাঁপন ধরলে সুপারভাইজারকে কম্বলের কথা বললাম। তিনি জানালেন- তাদের গাড়িতে কম্বল দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বেশ অবাকই হলাম! ঢাকা-কলকাতা রুটের এসি গাড়িতে কম্বল না থাকাটা একটু অদ্ভুত লাগলো- যেখানে দেশের ভেতরে সোহাগ বা গ্রিন লাইন পরিবহন গাড়িতে কম্বল এবং আরও টুকিটাকি জিনিস রাখা হয় যাত্রীদের প্রয়োজনের সময় দেওয়ার জন্য, সেখানে দু'দেশে যাতায়াতকারী একটা গাড়িতে সাধারণ কম্বল থাকবে না! শুধু দামী গাড়ি হলেই হয় না, পরিবহন সেবায় প্রফেশনালিজম যে কী জিনিস তা হাতেকলমে দেখাচ্ছে বলেই সোহাগ বা গ্রিন লাইনের টিকিটের জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যায়!
৬.
রাতের ভ্রমণে সময় বাঁচলেও আমার খুব একটা ভালো লাগে না- বসে বসে যেমন ভালো ঘুমও হয় না; তেমনি বাইরের কিছু দেখাও যায় না। কোথায় আছি, তাও বুঝা যায় না।
গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো বিকট শব্দে টিভি চালিয়ে রাখে- কেউ যে একটু শান্তিমতো বিশ্রাম নিবে, তারও উপায় নেই। অনেকে নাকি বাসে হুমায়ূন আহমেদ, প্রণব ভট্টের নাটক দেখতে পছন্দ করে। আমি খুব বিরক্ত হই। পাবলিক প্লেসে অন্ধকারে টিভি দেখা ও বিকট শব্দে সেগুলোর শব্দ শোনা- দুটোই অশ্লীল মনে হয়।
৭.
গাড়ি চলছে, কোথায় আছি জানি না।
টুকটাক গল্প করছি। আমাদের গল্পগুলো হয় মূলত দেশকে নিয়ে- দু'জন সুশীল ভদ্রলোক ড্রয়িংরুমে বসে মুখ দিয়ে শব্দ প্রক্ষেপনের মাধ্যমে যেভাবে দেশের জন্য বিপ্লব বইয়ে দেয়, আমরাও তাই করছি। দেশের জন্য আমাদের উদ্বেগ প্রবল! এক ধরনের নিরাপদ অবস্থানে থেকে এর ওর খুঁত ধরা থেকে শুরু করে মোটামুটি মধ্যবিত্ত সমাজের চাহিদা ও আদর্শকে সামনে রেখে এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার কী কী কাজকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত, সেগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনার শেষ নেই। নিজের কাছেই বিরক্ত লাগে একেক সময়- এসব ফালতু আলোচনার কোনো মানে নেই- কিন্তু রাজা-উজির মারা মধ্যবিত্তের সবসময়ই আপাত গন্তব্য ও নির্মল বিনোদন। আমরা নিচু স্বরে বেশ ক'টা উজির মেরে ফেললাম।
খাস উত্তরবঙ্গের টোনে সুপারভাইজার জানালেন- হোটেল তাজমহলে বিশ মিনিটের যাত্রাবিরতি। পুরো কুমিল্লাজুড়ে রাস্তার দু'পাশে অসংখ্য রেস্টুরেন্ট ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে- সেগুলোকে কী কারণে হোটেল বলা হয় কে জানে! কফি খেতে খেতে রসমালাইয়ের দাম জিজ্ঞেস করলাম। দাম অনেক বেশি। বয় জানালো- কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডার থেকে আনা বলে দাম বেশি।
এ প্রসঙ্গে পাঠকদের জানিয়ে রাখি- সারা দেশেই কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই পাওয়া যায়।
কিন্তু সেগুলো আসল না। কারণ কুমিল্লার মাতৃভাণ্ডার কারো কাছে পাইকারিভাবে রসমালাই বিক্রি করে না। এমনকি তাদের দোকানে বসে রসমালাই খাবার ব্যবস্থাও নেই। যার যতোটুকু দরকার, কিনে বাসায় নিয়ে যায়। সুতরাং এই আসল দোকানের বাইরে যারা মাতৃভাণ্ডারের রসমালাই বিক্রি করছে বলে দাবি করে, তারা নিশ্চিতভাবেই মিথ্যে বলে।
মাতৃভাণ্ডারের ম্যানেজারের সাথে এ ব্যাপারে আমি নিজে কথা বলেছি। কুমিল্লায় অবশ্য মাতৃভাণ্ডারের অভাব নেই- দি মাতৃভাণ্ডার, নিউ মাতৃভাণ্ডার, কুমিল্লা মাতৃভাণ্ডার, ময়নামতি মাতৃভাণ্ডার ইত্যাদি অনেক মাতৃভাণ্ডার আছে সেখানে। স্বাদের পার্থক্যটা চেখে না দেখলে বুঝা যাবে না।
৮.
চট্টগ্রাম পৌঁছতে পৌঁছতে সকাল আটটা বেজে গেলো। এখানে গাড়ি বদলাতে হবে।
আরএমটু গাড়ি নাকি পাহাড়ে উঠতে পারে না, মাঝপথে বন্ধ হয়ে যায়। কি জানি! হতেও পারে। এখনকার গাড়িটা ভালো না। পুরনো গাড়ি, এসিও তেমন সুবিধার না। তবে সামনের কাতারে সিট পড়েছে বলে পুরো পথটাই দেখতে দেখতে যাওয়া যাবে।
মাত্র এক সপ্তাহ আগে রাঙ্গামাটি ঘুরে গেছি অফিসিয়াল কাজে। এদিককার রাস্তাঘাট সব চেনা। খুব বিরক্ত লাগে হাটহাজারি এলাকাটা- ছোট রাস্তা, ভাঙা রাস্তা- তার উপর রাস্তায় একেকজন এমনভাবে গাড়ি চালায় আর রাখে, যেন তাদের পূর্বপুরুষরা এই রাস্তার মালিক ছিলেন। আর বাজার তো মনে হয় রাস্তার উপরে। ত্রিশ কিলোমিটার পথ পেরুতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়।
হাটহাজারি পেরুলেই রাউজান। আমার শ্বশুরবাড়ির এলাকা। তবে তারা কেউ এখানে থাকে না। বেঁচে গেছি। বাপরে বাপ! এই রাস্তায় মানুষ আসে!
৯.
রাউজান পেরুলেই অসম্ভব সুন্দর পাহাড়গুলো কাছে চলে আসতে থাকে।
কোনোটা সামনে, কোনোটা পাশে। মাত্র বর্ষা শেষ হয়েছে- প্রতিটা পাহাড়-ই অসম্ভব আবেদনময়ী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখের সামনে। দুচোখ ভরে দেখতে থাকি, খেতে থাকি- মাঝে মাঝে দুই-মেগাপিক্সেলের মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করি। কিন্তু চলন্ত অবস্থায় ছবি আসে না। এর-ই মধ্যে দু'দুটো ঝর্ণা দেখে ফেলি- সে কি উচ্ছ্বাস! ঝর্ণা জিনিসটা আমার কোনো কারণ ছাড়াই ভালো লাগে, তবে ভয় করে।
বাথরুমে আমি শাওয়ার ছেড়ে গোসল করতে পারি না, মগ দিয়ে পানি ঢালি।
চলন্ত গাড়িতে দুই মেগাপিক্সেলে যেমন ছবি আসে...
তাও তুলে ফেললাম একটা-দুটো ছবি, মোড় ঘোরার সময়। চলতি পথে তোলা পাহাড়ের ছবি
ছোট্ট, সুন্দর ঝর্ণা। না?
এদিককার রাস্তা বড় করা হচ্ছে, সেনাবাহিনী দেখলাম নিজেই রাস্তা বানাচ্ছে নয়তো তদারকি করছে। ভালোই হবে।
পাহাড় ক্রমশ কাছে চলে এসেছে। ...আর এখন তো পাহাড়ের উপরে উঠছি আর নামছি। খাগড়াছড়ি, বান্দরবান আর রাঙ্গামাটি- তিনটি জায়গায়ই গিয়েছি। তিনটি তিন রকম। খাগড়াছড়িতে ঢোকার পথে পাহাড়গুলো খুব একটা বড় না, তবে ছড়ানো, আস্তে আস্তে অনেকটা উঠতে হয়, আবার তেমনি নামতেও হয় অনেকটা।
বান্দরবানের পাহাড়গুলো বেশ উঁচু, হুট করেই অনেকটা উঠতে হয়, আবার তেমনি নামতে হয়। অন্যদিকে রাঙ্গামাটির পাহাড়গুলো মাঝারি। তবে রাঙ্গামাটিতে ঢোকার মুখে বেশ ক'টি পাহাড়ের বাঁক আছে, কোনোকোনোটি অসম্ভব তীব্র! মাঝে মাঝে ভয়ধরানো।
মনে পড়ে ত্রিপুরার কথা। বছর দুয়েক আগে এই মামুন ভাই, আমি আর আরেকজন গিয়েছিলাম ত্রিপুরায়।
মাঝে দু'দিন সময় বের করে আগরতলা থেকে ধর্মনগর গিয়েছিলাম শুধু পাহাড়ি পথ দেখার জন্য। পুরো পথটাই রোমাঞ্চকর। মাঝখানের প্রায় অর্ধেকটা পথ ত্রিপুরার মিলিশিয়া পুলিশ বাহিনী এসকর্ট করে নিয়ে যায়- চরমপন্থীদের হামলার ভয়ে- একটা নির্দিষ্ট সময় ছাড়া সে এলাকায় ঢুকা যায় না, বেরুনো যায় না। আগরতলা থেকে এই পথে ধর্মনগর যেতে প্রায় সারাটা দিন লাগে- আমরা আগের দিন গিয়ে পরের দিন চলে এসেছিলাম। দুটো দিনই প্রচুর টাকা দিয়ে জিপ ভাড়া করে গিয়েছিলাম- পাহাড়ি রাস্তা দেখতে দেখতে।
শুনেছি সেখানকার অনেক পর্যটকই নাকি এই কাজটা করে। ধর্মনগরে যাওয়ার রাস্তার মতো রাস্তা আমাদের তো কম নেই! আমরা কি পারি না এমন একটি রাস্তা বানাতে যেখানে পর্যটকরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গা যাবেনই কেবল পাহাড়ি রাস্তায় ভ্রমণ করার জন্য?
১০.
সকাল ১০টার দিকে ঢুকলাম রাঙ্গামাটি শহরে। আমাদের আপাত গন্তব্যস্থল হোটেল সুফিয়া। ওখানেই রুম বুক করা। গাড়ি নামিয়ে দিলো একেবারে হোটেলের সামনেই।
রিসেপশনের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সরাসরি রুমের বিছানায়। শরীরটা ভেঙে আসছে... একটু ঘুমানো দরকার। কী মনে করে বারান্দার দরজা খুলে দাঁড়ালাম- আরে বাহ! বারান্দার ঠিক নিচে কাপ্তাই লেকের অংশ- সকাল বেলায় দারুণ দেখাচ্ছে। আর সেখানে একজন আদিবাসি যুব্ক বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে! এই দৃশ্য ঢাকায় বসে কোথায় পাই!
এই আমাদের থাকার জায়গা- হোটেল সুফিয়া
দরজা খুললেই কাপ্তাই লেক, মন খুললেই প্রকৃতি
বারান্দার দরজা খুলেই দেখি- ওয়াও। দারুণ দৃশ্য! আদিবাসি যুব্ক মাছ ধরছে বড়শিতে।
তবে আমি বেশ খানিকক্ষণ লক্ষ করলাম- মাছে একটা ঠোঁকরও দেয় নি!
(ছবি-উৎসর্গ: ব্লগার ভেবে ভেবে বলি )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।