আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাহ আব্দুল করিমের একটি সাক্ষাৎকার

_________________সেলাই গাছের কারখানা _______________________________________

শাহ আব্দুল করিমের এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন নব্বইয়ের শক্তিমান কবি টি এম আহমেদ কায়সার, হাবিবুর রহমান এনার সম্পাদিত ছোটকাগজ 'খোয়াব' এর পক্ষ থেকে। সময়কাল ১৯৯৭ এর সেপ্টেম্বর। আমার জানা মতে শাহ আব্দুল করিমকে নিয়ে এটাই প্রথম ছাপা অক্ষরে মলাটবন্দি সাক্ষাৎকার। এই গুরুত্বপূর্ণ আলাপচারিতা সামহোয়্যার ইন ব্লগে প্রকাশের অনুমতি প্রদানের জন্য শ্রদ্ধাস্পদ টিএম আহমেদ কায়সারের প্রতি কৃতজ্ঞ। ____________________________________________ তাছাড়া তাঁর পিচুটি পড়া রক্তবর্ণ চোখ থেকে জল ঝরছিলো অবিরাম আর ভাঁজ পড়া, স্থানে স্থানে কুঁচকে যাওয়া গালে, থুতায় ছিলো সাত-আটদিন ধরে না কামানো দাঁড়ির সুক্ষ্ণ ভগ্নাংশ আর চোখ দুটো যদি ও গর্তের মতো ভেতরে ঢুকে গিয়েছিলো প্রায়, তাহলে ও দৃষ্টি,অন্তত এটুকু আন্দাজ করা যায় যে তা ছিলো খুবই গভীর এবং অন্তর্ভেদীও।

একখানি ভাঙ্গা খাট,যাতে বাড়তি একজনমাত্র লোক বসতে গেলেও মড়মড় শব্দ করে করে ভেঙ্গে যাবার ভয় দেখায়, তার উপর ছেঁড়া, ময়লা এবং স্থানে স্থানে বিশ্রী রকম দাগপড়া বিছানার চাদর ফলত দুর্গন্ধই ছড়ায় যা অবশ্য বাড়ীর চারদিকে বিশাল হাওরের জল, কাদা ও পঁচা শ্যাওলার গন্ধের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায় পরবর্তীতে। খাটের পাশে ঘূণে খাওয়া একখানি জীর্ণ টেবিল এবং প্রায় একই অবস্থার একটি লম্বা বেঞ্চ,আমরা বসে পড়লাম বেঞ্চেই, নূর হোসেন(১) পাশেই ছিলেন, অগত্যা উঠে দাঁড়ালেন বেচারা এবং অন্তঃপুরের দিকে অদৃশ্য হলেন দ্রুত। এদিকে সূর্য অস্তমিত হচ্ছিলো, কিন্তু এতে কেউই খুব একটা ভ্রুক্ষেপ করলোনা,কেননা আকাশ ছিলো মেঘেঢাকা, তার উপর বৃষ্টি ছিলো গুঁড়িগুঁড়ি,নিশ্চিতই সেটা কোন সুখকর দৃশ্য নয় আর মাসটাতো ছিলো আষাঢ়, আষাঢ়ে ভাটি অঞ্চলের গ্রামগুলো যা হয়-উঠান,বারান্দা এমনকি ঘরের পুলিতে পর্যন্ত থিকথিক করে কাদা, বাইরের দিকে তাকাতে গা ঘিনঘিন করে তবুও চারদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় সাদা হাওর, এমনকি এই মেঘে ঢাকা সন্ধ্যাবেলা যা চিকচিক করে উঠে, তা দেখে ভেতরটা জুড়িয়ে গেলো। চারদিকে সাদা জল, দূর-দূরান্তে কালো গ্রামগুলো যেন জলে ভাসমান কোন জাহাজ; স্থির,নিশ্চল। এই জল থৈথৈ হাওরের মধ্যে কোথাও থাকবে একটা নদী, নদীর নাম কালনী, কালনী নদীর দুই পাড়ে গ্রাম, গোচার আর বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত।

কালনী নদী এমনিতে খুব শান্ত, কিন্তু বর্ষায় একে সনাক্ত করা খুব কঠিন। প্রবল বেগে স্রোত বয় প্রথম, দুই পাড় উপচে পানির ঢল গোচার, শস্যক্ষেত ডুবিয়ে দেয়, একসময় জলে ভাসমান মাঠ-ঘাটের মধ্যে কোনটা যে কালনী নদী তা বুঝার জন্য নৌকার লগি ফেলে ফেলে সন্তর্পণে এগোতে হয় রীতিমত কিন্তু সেটা স্পষ্টতই আমাদের আলোচনার কোন অনুসঙ্গ নয়। যাহোক, আমাদের পা ছিলো স্বভাবতই কাদাটে। যদি ও বারান্দায় পা ধুয়েছি দুবার তাহলেও কাদা তো হলো এক অর্থে হাওরের কালো কালো জোঁক যা একেবারে ছাড়াতে যাওয়া মানে নিজের চামড়ার কিছু অংশ খুইয়ে ফেলার আশংকা করা খুবই স্বাভাবিক। ফোল্ড করা জিন্সের প্যান্টের এদিক ওদিক কাদার ছোপ, ঘিনঘিন লাগছিলো খুব, তাছাড়াও আমরা সকলেই ছিলাম কমবেশী ক্লান্ত কেননা পাক্কা তিনঘন্টা বাসজার্নি তারপর দুঘন্টা ট্রলার অবশেষে মাইলখানেক হাঁটু বরাবর কাদাটে পথ হেঁটে আসার ধকল শরীরের উপর দিয়ে বেশ যাচ্ছিলো।

কেউবা রুগ্ন খাটের উপর, কেউ বেঞ্চিতে বসে যাবার পর নুরুন্নেছা(২)লন্ঠন জ্বালিয়ে দেন ঘরে, বাইরে উৎসুক কয়েকজন গ্রামবাসী উঁকিঝুঁকি মারেন, একসময় ঘরের ভেতরও ঢুকে পড়েন কেউ কেউ,পরবর্তীতে অবশ্য এঁদের সবার অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত এক গানের আসর জমে উঠবে, আমরা ও আমাদের নিজেদের বেসুরো গলা দিয়ে তাল মেলানোর জন্যে হন্যে হয়ে উঠবো কিন্তু সেটা মধ্যরাত্রির অ-অনেক পরে। যাহোক শুরুতেই কুশলাদি বিনিময় হয়, উৎসুক লোকজনের সঙ্গে কথা হয় এক-আধটু, এরপরই আমরা মুখোমুখি হই তাঁর, বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিমের। আশি-উর্ধ্ব এই ভঙ্গুর শরীর নিয়েও এখনো আপোষহীন এক বাউল, এখনো গান লিখেন সমানতালে,এমনকি এখনো সুর করে গানের কলি আওড়ালে সংলগ্ন পরিবেশ ঝিম ধরে যায় যেন। খোয়াবঃ করিম ভাই,ব্যক্তিগত বিষয় দিয়েই শুরু করি,আপনার বয়স এখন কতো? করিম শাহঃ আমার জন্ম ১৩২২ বাংলার ফাল্গুন মাসের প্রথম মঙ্গলবার। বোধহয় আশির কোঠা পেরিয়ে এসেছি ইতিমধ্যে খোয়াবঃ যমদূতের চোখটাকে ও ফাঁকি দিয়ে রীতিমত…।

করিম ভাই,আপনার পরিবার নিয়ে কিছু বলুন এবার করিম শাহঃ (গানের সুরে) পিতার নাম ইব্রাহিম আলী মাতা নাইওরজান ওস্তাদ ছমরুমিয়া মুন্সী পড়াইলেন কোরান। বাউল ফকির আমি, একতারা সম্বল সরলা সঙ্গিনী নিয়ে আছি উজানধল। । নূরজালাল নামে মোর আছে এক ছেলে… খোয়াবঃ আপনার সন্তান কি মাত্র একজনই? করিম শাহঃ হ্যাঁ। একছেলে মাত্র।

১৩৭১এ ওর জন্ম। খোয়াবঃ আপনার স্ত্রী সম্পর্কে কিছু বলুন। করিম শাহঃ আমার স্ত্রীর নাম আফতাবুন্নেসা। আমি ডাকতাম সরলা নামে। আমার ‘আফতাবসঙ্গীত’ বইটি এই আফতাবুন্নেসার নাম অনুসারেই রাখা।

আজকের এই করিম কখনোই করিম হয়ে উঠতে পারতোনা যদি কপালের ফেরে সরলার মতো বউ না পেতাম। আমি সরলাকে এখনো মুর্শিদ জ্ঞান করি। দীর্ঘ বাউলজীবনে দিনের পর দিন ঘরবাড়ি ছেড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি, সরলা তার ন্যুনতম কষ্ট ও আমাকে বুঝতে দেয়নি। পোড়া কপাল আমার, এমন বউকে ধরে রাখতে পারিনি। মৃত্যুই তার সকল কষ্টের অবসান ঘটিয়েছে।

খোয়াবঃ আমরা এবার আপনার নিজের সম্পর্কে জানতে চাইবো। কিভাবে শুরু করলেন? ক্যামনেইবা গানের জগতে আসলেন? করিম শাহঃ একেতো ভাটিঅঞ্চল, এই যুগেও দেখেন যোগাযোগ,শিক্ষা-দীক্ষায় কতো অবহেলিত,উপেক্ষিত। তখনকার যুগে তো লেখাপড়া করা ভয়ানক কষ্টের ব্যাপার ছিলো। ছোটবেলায় দুঃখ যে কি জিনিস,দারিদ্র যে কি জিনিস মর্মে মর্মে টের পেয়েছিলাম। আমার মা চাইতেন একটু পড়ালেখা করি।

বাবা যদিও এক অর্থে ছিলেন খুবই সরল-সোজা, তবু জীবনের কুৎসিত বাস্তবতার রূপটাও তার জানা ছিলো ভালোই। তাই প্রায়ই বলতেন- ‘আগে অইলো খাইয়াবাঁচা। বাদে পড়ালেখা’। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ আর হয়ে উঠেনি। বেঁচে থাকার জন্য মোড়লের ঘরে গরু রাখালের কাজ করেছি।

পরে নৈশবিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়াশুনা করেছি। ইতিমধ্যে বিশ্বযুদ্ধের গুজব উঠলে সবাই বিদ্যালয়ে আসা বন্ধ করে দেয়। ফলে নিজের চেষ্টায় যতটুকু পারি নিজের বুঝবাঝটুকু সেরে নিয়েছি। আর গান তো ছিলো রক্তের ভেতর। ‘ভাবিয়া দেখো মনে, মাটির সারিন্দারে বাজায় কোনজনে’ এরকম গান শুনতাম আগে।

গাইতাম ও। খুব দাগ কাটতো মনে। মাঠে গরু রাখতে রাখতে গান গাইতাম। রাখাল বন্ধুরা তখন গোল হয়ে গান শুনতো। আস্তে আস্তে গান আমাকে কব্জা করতে শুরু করে।

আমি বুঝে যাই সারিন্দাই আমার প্রথম ও শেষ। খোয়াবঃ তখন গান গাওয়া নিয়ে সমস্যা হতোনা? করিম শাহঃ হতোনা মানে? শুক্রবারে মসজিদে পর্যন্ত কথা উঠে। মুসল্লীরা অভিযোগ করেন,করিম বেশরিয়তী কাজ-কারবার শুরু করেছে। অচিরেই তা বন্ধ করতে হবে। আমি থামিনি।

গান তো মিশে গিয়েছিলো অস্থি-মজ্জায়,ক্যামনে থামি। তবে একটা ব্যাপার ছিলো তখন। গানের দুশমন যতো ছিলো তার চেয়ে অনেক বেশী ছিলো গানের ভক্তকুল। বাউলাগানের আসর শুনলেই মানুষ আট/দশ মাইল পথ হেঁটে আসতো অনায়াসে। গান শুনতো ও খুব মনোযোগ দিয়ে।

প্যান্ডেলের কোথাও কোন হট্টগোলের আভাস পাওয়া গেলে যখন মঞ্চে উঠে বলেছি ‘গান শুনতে চান না ঝগড়া করবেন আপনারা?’ওমনি সব গোলমাল থেমে যেতো। এখন সেই ভক্তকুল নেই,সেই পরিবেশ নেই, সেই মানুষ ও নেই। খোয়াবঃ আপনার একটা বিখ্যাত গানই আছে যেখানে বর্তমান ও অতীতের একটা চমৎকার তুলনা টেনে এনেছিলেন। গানের প্রথম দিকটা বোধ হয় এইরকমঃ’গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান/মিলিয়া বাউলাগান আর মুর্শিদী গাইতাম/আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম। ‘ সন্দেহ নেই গানটা মর্মস্পর্শী।

কিন্তু একটা বিষয় এখানে লক্ষনীয়,মনে হয় আপনি যেন তুলনামুলকভাবে অতীতমুখী;বর্তমান আপনার কাছে বিশ্রী এবং বিভৎস। বর্তমান থেকে এরকম মুখ ফেরালেন কেন? করিম শাহঃ বর্তমান আমার কাছে গৌণ কোন বিষয় নয়। আমার চোখের সামনে এই পরিবেশ-পরিপার্শ্ব আমূল বদলে গেছে। নগরায়ন ও যন্ত্রসভ্যতার বিকাশ মানুষের জীবনযাত্রার মানকে পরিবর্তন করেছে। আমি একে খারাপ চোখে দেখিনা।

কিন্তু আমার কান্না পায়, ভেতরে তীব্র হাহাকার অনুভব করি চোখের সামনে অবিকল যন্ত্র হয়ে উঠলো মানুষগুলো। ‘মন’ বলতে আমরা যে জিনিসটাকে বুঝাই সেটার চিহ্নমাত্র ও থাকলোনা আর । তাছাড়া সবচেয়ে আক্ষেপ লাগে যখন দেখি এই বিজ্ঞান বা যন্ত্রসভ্যতার ফল ভোগ করছে কয়েকজন হাতেগোনা কোটিপতি। এই যন্ত্রসভ্যতা ফলত ধনী-গরিবের মধ্যকার বৈষম্যকে আকাশ-পাতাল পর্যায়ে উন্নীত করেছে। আপনারা আমার গাঁয়ে এসেছেন, দেখে যান এখানে, এই বিশাল ভাটি-অঞ্চল জুড়ে মানুষগুলো কি অপরিসীম দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে বাস করে।

যখন মাঝেমাঝে শহরে স্তম্ভিত হয়ে এই ব্যবধান লক্ষ্য করি। লোকে কয়, আমি নিরণ্ণ দুঃস্থ মানুষের কবি। আমি আসলে তাক ধরে দুঃস্থদের জন্য কিছু লিখিনি। আমি শুধু নিজের কথা বলে যাই,ভাটি অঞ্চলের একজন বঞ্চিত নিঃস্ব দুখী মানুষ আমি, আমার কথা সব হাভাতে মানুষের কথা হয়ে যায়… দ্যাখেন তো এই অঞ্চল ঘুরে, মানুষের আয়ের কোন উৎস আছে কিনা?( করিম শাহ ক্রমশঃ উত্তেজিত এবং তাঁর চোখ দুটো আর্দ্র হয়ে উঠছে। ) চারদিকে ভাসান পানি।

জলে থৈথৈ করছে প্রতিটি বাড়ির উঠান। মানুষ কি খেয়ে বাঁচবে?(করিম শাহের চোখে অশ্রুধারা) দিনে তিনবেলা নয়, শুধু একবেলা যদি দু’মুঠো খেতে না পারে, এই জন্ম কি মানুষের জন্ম? জিজ্ঞাস করি তোমার কাছে বলো ওগো সাঁই(গানের সুরে) এইজীবনে যত দুঃখ কে দিয়াছে বলো তাই। দোষ করিলে বিচার আছে,সেই ব্যবস্থা রয়ে গেছে দয়া চাইনা তোমার কাছে আমরা উচিত বিচার চাই। দোষী হলে বিচারে সাজা দিবা তো পরে এখন মারো অনাহারে কোন বিচারে জানতে চাই? দয়াল বলে নাম যায় শুনা,কথায় কাজে মিল পড়েনা তোমার মান তুমি বুঝোনা আমরা তো মান দিতেই চাই তুমি আমি এক হইলে পাবেনা কোন গোলমালে বাউল আব্দুল করিম বলে আমি তোমার গুন গাই। ।

(চোখ বন্ধ;চোখে অশ্রুধারা পূর্বাপর বহমান। পরিবেশ স্তব্দ,নিরবতা শুধু দীর্ঘ হয়। ) আমি বেহেস্ত চাইনা দোজখ চাইনা,জীবিত অবস্থায় আমার ভাটি অঞ্চলের বিপন্ন মানুষের সুখ দেখতে চাই। এই মানুষগুলোর সুখ যারা কেড়ে নিয়েছে,আমার লড়াই তাদের বিরুদ্ধে। একদা তত্বের সাধনা করতাম।

এখন দেখি তত্ব নয়,নিঃস্ব বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে। দেহতত্ব, নিগুঢ়তত্ব আর সোনার বাংলা, সোনার মানুষ বললেই হবেনা। লোভী,শোষক, পাপাত্নাদের আঘাত করতে হবে। তত্বগান গেয়ে গেলেন যারা মরমী কবি আমি তুলে ধরি দেশের দুঃখ দুর্দশার ছবি বিপন্ন মানুষের দাবী করিম চায় শান্তির বিধান। ।

খোয়াবঃ একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। আপনার এ যাবৎ লিখিত গানের সংখ্যা কতো? করিম শাহঃ দীর্ঘ পঞ্চাশের ও অধিক বছর ধরে গান লিখে যাচ্ছি। কতো যে লিখেছি তার হিসেব আমার কাছে নেই। গানগুলো সংরক্ষন করার চিন্তা কখনো মাথায় জাগেনি। রচনা করার পর এগুলো গুছিয়ে লিখে রাখার অভ্যেস ও ছিলোনা।

এখন স্মরনশক্তি ক্ষীন হয়ে এসেছে। মগজের কোনে আমার অনেক গান চাপা পড়ে আছে। তাহলে ও এ পর্যন্ত গানের পরিমান মোটামোটি দুই হাজারের অধিকতো হবেই। খোয়াবঃ আপনার কয়টা গানের বই প্রকাশিত হয়েছে অদ্যাবধি করিম শাহঃ পাঁচটা। ‘আফতাব সঙ্গীত’ বেরোয় ১৩৫৬ বাংলায়।

তারপর ‘গণসঙ্গীত’, ’কালনীর ঢেউ’, ‘ধলমেলা’ এবং কিছুদিন পূর্বে ‘ভাটির চিঠি’। ‘কালনীর কুলে’ নামে আরেকটা বইয়ের পান্ডুলিপি প্রস্তুত হয়ে আছে। এছাড়া বাংলা একাডেমী আমার দশটা গান ইংরেজী অনুবাদ করে বের করেছিলো বেশ আগে। খোয়াবঃ আপনার সমসাময়িক বাউলদের সম্পর্কে কিছু বলুন। করিম শাহঃ আমার সমসাময়িক কেউ এখন আর বেঁচে নেই।

যাদের সংগে গান করেছি তাদের মধ্যে সাত্তার মিয়া, কামালুদ্দিন, আবেদ আলী, মিরাজ আলী,বারেক মিয়া, মজিদ তালুকদার, দূর্বিন শাহ এদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিলো। এছাড়া ও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গান করতে গিয়ে অনেকের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছে,তাদের সবার নাম এখন আর মনে নেই। তুলনামুলক ভাবে আমার গাঢ় হৃদ্যতা ছিলো নেত্রকোনার সাত্তার মিয়ার সঙ্গে। মজিদ একদা অন্যের গান নিজের নামে গাইতো। কারন জিজ্ঞেস করলে বলতো ‘গানটা গাইতেছে কে? হোক অন্যের; আমি যখন অন্যের গান করি তখন আমিও তো একই ভাবের ভাবুক থাকি।

আমার কথা আমি বলবোনা কেনো?’ জালালউদ্দিন, উকিল মুন্সী আমার চাইতে বয়সে যদিও অনেক বড় ছিলেন তাদের সঙ্গেও আমি দু-এক আসরে গান করেছি। দূর্বিন শাহ তুলনামুলকভাবে তত্বগানের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন বেশী। ১৯৬৭ সালে আমরা এক সঙ্গে বিলাতে যাই ‘ইষ্টার্ণ ফিল্ম ক্লাবে’র আমন্ত্রনে। তার গলা খুব একটা ভালো ছিলোনা, তার উপর ঠান্ডার দেশ-ওখানে গিয়ে তো গলা একেবারে বসে যায়। উপায়ন্তর না দেখে দুর্বিনশা’র অনেক গান আমি নিজের কন্ঠে গেয়েছি ওখানে।

খোয়াবঃ বিলেত সফরের কোন মজার অভিজ্ঞতা কি মনে আছে? করিম শাহঃ খুব একটা মনে নাই। তবে বিলাতের দিনগুলোর উপর আমার একটা দীর্ঘ গান আছে যা ‘ভাটির চিঠি’ গ্রন্থে প্রকাশিত। বিলাতে সবচেয়ে যে ব্যাপারটা আমার দৃষ্টি আকর্ষন করেছে,সেখানে মানুষ মানুষকে মানুষ বলেই গন্য করে। একেবারে দরিদ্র যে সেও তার কাজের শেষ সমানতালে আনন্দফুর্তি করতে পারে। মোটামোটি একটা মানুষ্য-জীবনের গ্যারান্টি সে পায়।

অফিসের বড়কর্তারা আমাদের মতো ঘুষ-টুষ খায় বলে মনে হলোনা। আমাদের অফিসগুলোর বড়কর্তারা তো ঘুষ ছাড়া মানুষকে পাত্তা পর্যন্ত দেয়না। আমি একবার রেডিও’র একটা চেক ভাঙ্গাতে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ এ গেলাম। সেখানে যাবার পর আমি মানুষ গিয়েছি না পশু গিয়েছি এ ব্যাপারে নিজেরই কিছুটা সংশয় এসে গিয়েছিলো। এই কি স্বাধীন দেশের অবস্থা!( করিম শাহ আবারো উত্তেজিত হয়ে উঠছেন) আমার পাঞ্জাবী ছিড়া তো কি হয়েছে, আমি এই দেশের নাগরিক না? আমার লুঙ্গীতে না হয় তিনটা তালি বসানো, আমি তো ট্যাক্স ফাঁকি দেইনা কখনো।

এতো ব্যবধান, এতো বৈষম্য কেনো? মানুষই তো মানুষের কাছে যায়। আমি তো কোন বন্যপশু যাইনি। বন্যপশুর ও অনেক দাম আছে, এদেশে মানুষের কোন দাম নেই, মানুষের কোন ইজ্জত নেই। (করিম শাহ’র চোখ জলে টলোমল) খোয়াবঃ এই সুদীর্ঘ জীবনে আপনার কোন প্রাপ্তির কথা বলুন যা আপনাকে মাঝে-মধ্যে পুলকিত করে? করিম শাহঃ আমি কখনো কোন প্রাপ্তির ধার ধারিনি। প্রাপ্তি-সংবর্ধনা এগুলোর প্রতি আমার বিতৃষ্ণা ধরে গেছে।

জীবনে এতো প্রতারিত হয়েছি যে নতুন করে প্রতারিত হতে ভয় লাগে। করিমকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কী দরকার আছে? করিমের গান তো বাংলার মাঠে-ঘাটে খুব ক্ষীনস্বরে হলেও গাওয়া হয় এখনো। আমার সংবর্ধনা পাবার কোন দরকার নেই, আমার গানই আমার সংবর্ধনা। গানের ভেতর আমি কথাগুলো বলার চেষ্টা করেছি তা প্রতিষ্ঠিত হওয়া এখন জরুরী। নিঃস্ব পরিবারে জন্ম নিয়ে আমি এখনো নিঃস্বই থেকে গেছি, নিঃস্ব হবার যন্ত্রণাটা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাই।

আমি আমার এলাকায় নিজের যথসামান্য সামর্থ্য নিয়ে ‘বাঁচতে চাই’ নামে একটা সংগঠন করেছি। আমার চাওয়াটা খুব সামান্য, দুবেলা দু’মুঠো খেয়ে শুধু বেঁচে থাকা। এই অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে শোষকের দল। প্রাপ্তির কথা যদি বলেন, সেটা অনেক হয়েছে। হোসেন সোহরাওয়ার্দী আমার গণসঙ্গীত শুনে একশো পঁচাশি টাকা দেন।

শেখ মুজিব তখন দুর্নীতি দমন মন্ত্রী, গান শুনে এগারোশো টাকা দিলেন আর বললেন’ আপনার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হবে। মুজিব ভাই বেঁচে থাকলে করিম ভাই বেঁচে থাকবে,ইনশাল্লাহ’। করিম ভাই জীর্ণ শরীর নিয়ে বেঁচে আছি, উপযুক্ত মর্যাদা কারে কয় এখনো বুঝিনি। উপযুক্ত মর্যাদার দরকার নাই,জীবনের প্রায় আশিবছর দুঃখ-দারিদ্রের সঙ্গে সংগ্রাম করে এসেছি, বেঁচেইবা থাকবো আর কয়দিন, নতুন করে আর স্বপ্ন না দেখলেও চলবে। কিন্তু লাখ লাখ বঞ্চিত মানুষ,তাদের দিকে চোখ ফেরান একবার।

প্রাপ্তি, হায়রে প্রাপ্তি! দেশ স্বাধীনের পর সামাদ আজাদ সাহেব লোক পাঠান তার নির্বাচনী সভায় শুধু উপস্থিত হবার জন্য। ঘরে অসুস্থ স্ত্রী রেখে ছুটে গেছি আমি। উপস্থিত দর্শকদের অনুরোধে গানো গেয়েছি। দর্শকরা বক্তৃতা চায়নি, সমস্বরে বলেছে’ বক্তৃতা লাগতো নায়, ভোট আপ্নারেই দিমুনে, করিম ভাই’র গান আরো দুইডা শুনান’। ক্ষমতায় গিয়ে এরা সব ভুলে যায়।

দেশ,জনগন সব। মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনার কথা বলে, সেটাও। কিছুদিন পুর্বে হুমায়ূন আহমেদ টিভিতে আমার গান দিয়ে একটা প্যাকজ প্রোগ্রাম করলেন। আমি এসবে যেতে চাইনা,পারতপক্ষে এড়িয়ে চলি। তবু উনি আমার কাছে যে ব্যক্তিটিকে পাঠিয়েছিলেন তিনি সুনামগঞ্জেরই লোক, একেবারে জোঁকের মতোই ধরলেন যে আমার না গিয়ে কোন উপায় থাকলোনা।

যাহোক আমি গেলাম। আমার সাক্ষাৎকার নিলেন এক বয়স্ক ভদ্রলোক। ফিরে আসার সময় হুমায়ূন আহমেদ আমার সাথে সৌজন্যমুলক আলাপটুকু পর্যন্ত করলেননা। কিছু টাকা দিলেন,তাও ড্রাইভারের মারফত। বাউলরা কি এতোই অস্পর্শ্য? এভাবেই উপেক্ষিত থাকবে যুগের পর যুগ? হাওড় অঞ্চলে বড় হয়েছি, অন্ততঃ মনটাতো ছোট নয়।

শুধু টাকার জন্য কি আমি এতোদূর গিয়েছিলাম? টাকাকে বড় মনে করলে তো অনেক আগেই অনেক কিছু করে ফেলতে পারতাম। অর্ধাহারে-অনাহারে কাটিয়েছি দিনের পর দিন, উপোস করার অভিজ্ঞতা আমার আছে, জীবনের শেষ দিকে এসে ক’টা টাকারে জন্য তো হঠাৎ লোভী হয়ে উঠতে পারিনা। হুমায়ূন আহমেদ এমনকি অনুষ্ঠানটা কবে প্রচারিত হবে তারিখটা ও আমাকে জানাননি। মানুষের কাছে কি মানুষের এতটুকু দাম ও থাকবেনা?পরে যখন অনেকেই অনুষ্ঠান দেখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন,আমার খুব আঘাত লাগলো। কষ্ট পেলাম খুবই।

আমি এইসব লোকদের ‘মরা গরুর হাড্ডির কারবারী’ বলে থাকি। জীবিত করিম আসলে কিছুই নয়, কিন্তু মৃত করিমের হাড্ডি নিয়ে ও একদিন ব্যবসা হবে, এটাই হলো এদেশের বাস্তবতা। গান নিয়ে আমি দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছি। ঢাকা, পাবনা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, কুমিল্লা সহ প্রায় সব জায়গায়। লন্ডনেও দুবার গিয়েছি।

১৯৬৭ ও ১৯৮৫ সালে। মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা পেয়েছি। সিলেট রোটারী ক্লাব, উদীচি শিল্পী গোষ্ঠী আমাকে ‘সংবর্ধনা স্মারক’ দিয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অহনা পর্ষদ’ আয়োজিত দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠানে আমাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছে। এগুলো যদি প্রাপ্তি বলেন,তাহলে প্রাপ্তি অনেক।

খোয়াবঃ শুনেছি কাগমারী সম্মেলনেও আপনি যোগ দিয়েছিলেন। সেখানকার অভিজ্ঞতা কিছু বলুন। করিম শাহঃ কাগমারী সম্মেলনে আমি রমেশ শীলের সঙ্গে গান করেছি। তাছাড়া এই সম্মেলনে বড় পাওনা হলো মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে আমার আলাপ হওয়া। তিনি আমার গান শুনে বলেছিলেন’ সাধনায় একাগ্র থাকলে তুমি একদিন গণমানুষের শিল্পী হবে’।

ভাসানীর এই কথাটি আমাকে এখনো প্রেরণা দেয়। খোয়াবঃ আমরা যতদূর জানি প্রচলিত ধর্ম-ব্যবস্থায় আপনি খুব একটা বিশ্বাসী নন। বিভিন্ন গানে আপনার এ বিষয়ক চিন্তাধারা ঘুরে ফিরে এসেছে বারবার। ধর্মকে আসলে কিভাবে দেখেন আপনি? করিম শাহঃআমি কখনোই আসমানী খোদাকে মান্য করিনা। মানুষের মধ্যে যে খোদার ইরাজ করে আমি তার চরণেই পুজো দেই।

মন্ত্রপড়া ধর্ম নয়,কর্মকেই ধর্ম মনে করি। লাখ লাখ টাকা খরচ করে হজ্জ্ব পালনের চেয়ে এই টাকাগুলো দিয়ে দেশের দুঃখী দরিদ্র মানুষের সেবা করাটাকে অনেক বড় কাজ মনে করি। প্রচলিত ধর্ম-ব্যবস্থা আমাদের মধ্যে সম্প্রদায়গত বিদ্বেষ তৈরী করে দিয়েছে। কতিপয় হীন মোল্লা-পুরুত আমাদের ভাইয়ে ভাইয়ে বিভাজন নিয়ে এসেছে। এই বিভাজনই যদি ধর্ম হয় সেই ধর্মের কপালে আমি লাত্থি মারি।

‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ এই হলো আমার ধর্ম। নামাজ রোজার মতো লোক দেখানো ধর্মে আমার আস্থা নাই। কতিপয় কাঠমোল্লা ধর্মকে তাদের নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে। আমার এলাকায় প্রতিবছর শীতের সময় সারারাত ওয়াজমাহফিল হয়। দূর-দূরান্ত থেকে বিশিষ্ট ওয়াজীরা আসেন ওয়াজ করতে।

তারা সারারাত ধরে আল্লা-রসুলের কথা তো নয় বরং আমার নাম ধরেই অকথ্য-কুকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। কি আমার অপরাধ? গান গাইলে কি কেউ নর্দমার কীট হয়ে যায়? (তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে দ্রুত, উত্তেজনায় কন্ঠস্বর চাগান দিয়ে উঠছে ক্রমে) এই মোল্লারা ইংরেজ আমলে ইংরেজী পড়তে বারণ করেছিলো, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানীদের পক্ষে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিলো। আজো তারা তাদের দাপট সমানতালে চালিয়ে যাচ্ছে। এগুলো দেখে মনে হয় একাই আবার যুদ্ধ করি। একাই লড়াইয়ের ময়দানে নামি।

জীবনের ভয় এখন আর করিনা। আরেক যুদ্ধ অবধারিত হয়ে পড়েছে, এছাড়া আর মুক্তি নাই( তাঁর চোখ থেকে জল উপচে পড়ছে) কি বলবো, কতোই বলবো দুঃখে ভেতরটা পাথর হয়ে আছে। আমার এক শিষ্য, তার নাম ছিলো আকবর । সিদ্ধি টিদ্ধি খেতো বোধহয়। আকবর মারা গেলো অকালেই।

তার মৃত্যুর কথা মাইকে ঘোষনা দেবার জন্য আমি নিজে মসজিদে গিয়ে ইমাম সাহেবকে বললাম। ইমাম তো ঘোষনা করবেনইনা বরং জানাজার নামাজ পড়াবেননা বলে সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন। আকবরের দোষ হলো সে আমার শিষ্য। আমি গান গাই, আমি কাফির। শুধু আমি গিয়ে যদি উনার হাত ধরে তওবা করি তাহলেই আকবরের জানাযার নামাজ পড়ানো যায় কিনা তিনি ভেবে দেখবেন।

বেতনভোগী এই চাকরটার কথা শুনে রাগে দুঃখে ভেতরটা বিষিয়ে গেলো। আতরাফের সবাই তাকে বাৎসরিক যে চাঁদা দিয়ে রাখে সেই চাঁদার একটা ভাগ তো আমি ও দেই। তাৎক্ষনিক কিছুই বলিনি কারণ কথাটা আমার গ্রামবাসীর কানে গেলে একটা ঝামেলা হয়তো বেঁধে যেতে পারে। অগত্যা আমি নিজেই জানাজা পড়িয়ে আকবরের কবর দেই। এই কথা মনে আসলে আজো চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা।

খোয়াবঃ আচ্ছা, এতো গেলো ধর্ম। ঈশ্বরকে নিয়ে কি ভাবেন আপনি? করিম শাহঃ ঈশ্বরকে আমি মনে করি একটা পেঁয়াজ, খোসা ছিলতে গেলে নিরন্তর তা ছিলা যায় এবং হঠাৎ একসময় দেখি তা শূন্য হয়ে গেছে। আমি ঈশ্বরকে এক বিশাল শক্তি হিসেবে গন্য করি, ব্যক্তি হিসেবে নয়। ব্যক্তি কখনো একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নরূপে অবস্থান করতে পারেনা, শক্তি তা পারে। বৈদ্যুতিক শক্তির কথা ধরুন, একই সাথে কোথাওবা ফ্যান ঘুরাচ্ছে, কোথাও বাতি জ্বলাচ্ছে, কোথাও কারখানা চালাচ্ছে… মক্কা শরীফ আল্লার বাড়ি বোঝে না মন পাগলে ব্যক্তি নয় সে শক্তি বটে আছে আকাশ পাতালে।

। তবে আমি কোন অবাস্তব কিছুতে বিশ্বাস করিনা। বেহেস্ত, দোজখ, দুই কান্ধে দুই ফেরেস্তা এগুলো আমার কাছে অবাস্তব মনে হয়। আল্লাহ নিজেই যেখানে কর্তা, তার তাহলে এতো কেরানী রাখার কি দরকার আমি বুঝে উঠতে পারিনা। খোয়াবঃ আপনার পূর্বের বাউলা যাঁরা বিশেষতঃ এই সিলেট অঞ্চলে মরমী সাহিত্যের ভূমি কর্ষন করেছেন-তাদের আপনি কিভাবে মুল্যায়ন করেন? করিম শাহঃআমি নিজেকে তাঁদের উত্তরসূরী হিসাবে বিবেচনা করি।

সৈয়দ শানুর,আরকুম শাহ, শীতালং শাহ, রাধারমন, হাছনরাজা এঁরা সত্যিকারের সাধক ছিলেন। ভাবুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন এঁরা। একসময় আমরা গ্রাম-গ্রামান্তরে তাদের গান গেয়ে বেড়িয়েছি। তাদের গান থেকে প্রেরণা নিয়ে আমরা আজো গান লিখি। কিন্তু একটা দুঃখজনক ব্যাপার ঘটছে আজকাল, আমার কিছু গান দেখলাম রাধারমনের নামে গাওয়া হচ্ছে।

এই জিনিসটা যে কারো পক্ষেই সহ্য করা খুব কঠিন। আমার বেশ কিছু গান যে যেভাবে পারীন এমনকি কেউ কেউ ভনিতায় নিজের নাম যুক্ত করেও গেয়ে থাকেন, এটা খুবই দুঃখের। দীর্ঘ পঞ্চাশ ষাট বছরের সাধনার ফসল এই গানগুলো। অন্যের কাছে কোন মুল্য থাক বা না থাক আমার নিজের কাছে এই গানগুলোর যথকিঞ্চিৎ মুল্য তো আছে। ঘর অসুস্থ স্ত্রী রেখে গান রচনা করে বেড়িয়েছি।

আজ সেওসব স্মৃতি মনে পড়লে চোখে পানির ধারা নেমে আসে। এই গানগুলোই যদি আমার চোখের সামনে অন্য কারো হয়ে যায় তাহলে সারা জীবনের সাধনাই তো ভুল ! বেশ কিছুদিন আগে রাধারমনের একটা গানের বই বেরিয়েছিল মদনমোহন কলেজ থেকে গোলাম আকবর সাহেবের সম্পাদনায়। রাধারমনকে একেবারে জীবন্ত কাষ্ঠ করা হয়েছে বইটার পাতায় পাতায়। গানের কলি নেই ঠিক, শব্দ-বিভ্রান্তি, পদ-বিভ্রান্তি, একেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড। মনটা দমে গেলো এটা দেখে।

রাধারমনের গান তো আমি এই ক্ষীণ স্মৃতিশক্তি নিয়ে ও আজো ভুলতে পারিনি। এই ভাগ্য যদি রাধারমনের ঘটে, আমি করিম তো কোন ছার! আজকাল প্রচার মাধ্যমে এমন কিছু অগ্রজ বাউলের নাম শুনতে পাই যাদের নাম এই পঞ্চাশ-ষ্টা বছরের বাউল জীবনে কখনো শুনি। আমার এই দীর্ঘ জীবনে রকিব শাহ কোন ফকিরের গান তো দূরের কথা-নাম পর্যন্ত শুনিনি। হঠাৎ রেডিও টেলিভিশনে তার গান শুনে বিস্মিত হই। এমনকি এও দেখলাম তাঁকে আরকুম-হাছনদের সঙ্গেও তুলনা করা হচ্ছে।

হায়রে দেশ! টাকা দিয়ে কি সবকিছু কেনা হয়ে যাবে? বয়স তো কম হয়নি,এক জীবনে দেখেছি অনেক। এবার বোধ হয় ছাঁচাছোলা কিছু বলার সময় এসেছে। আজ যে হাছন রাজা হাছন রাজা বলতে আমরা অজ্ঞান-এই গানগুলো তো কিছুদিন পূর্বেও কাউকে গাইতে শুনিনি। এতো মর্মস্পর্শী গান তাঁর অথচ গাইতো কয়জন? আমার জানামতে উজির মিয়া নামে এক ব্যক্তি হাছন রাজার গানকে সাধারনের গোচরে নিয়ে এসেছিলেন- আজ তাঁর নামগন্ধ পর্যন্ত হাওয়া হয়ে গেলো। প্রচার মাধ্যম তাকে খুঁজে বের করার কোন প্রয়োজনো অনুভব করেনা।

সব সফলতার পেছনে কিছু কষ্ট থাকে, এই কষ্ট যারা করে আমরা তাদের ভুলে যাই। কী নির্মম নিয়তি! ভেতরে জমা থাকা কথাগুলো এবার হয়তো বলা দরকার। যদি কেউ রাগ করে করুক, ভেতরের ক্ষোভ ভেতরে জমাট রেখে কোন লাভ হয়না। খোয়াবঃ আপনার ব্যক্তিগত কোন দুঃখের কথা বলুন যা গভীর রাতেও আপনাকে কষ্ট দেয়। করিম শাহঃ দুঃখতো হাজার হাজার, কয়টা বলবো? তবে আমার সরলা, যাকে আমি মুর্শিদ জ্ঞান করি সেই সরলা বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে এটা মনে পড়লেই কলজে খানি উল্টে যেতে চায়(তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন) খোয়াবঃ আপনার শিষ্য-ভক্ত অজস্র,যারা এখনো প্রত্যন্ত অঞ্চলে আপনার গান গেয়ে বেড়ান, তাদের সম্পর্কে কিছু বলুন করিম শাহঃ আমার শিষ্যরা প্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত।

রুহী ঠাকুর, রণেশ ঠাকুর, আব্দুর রহমান, প্রানকৃষ্ণ ঘোষ, নূর হোসেন, সুনন্দ দাস(৩) আরো অনেকেই আমার গান করে বেড়ায়, আমি তাদের জন্য আশীর্বাদ করি। খোয়াবঃ আপনাকে অনেক ধন্যবাদ করিম ভাই করিম শাহঃ আপনাদের ও অজস্র ধন্যবাদ। পাদটিকাঃ ১। নূরহোসেনঃ শাহ আব্দুল করিমের শিষ্য। তিনি বেশীর ভাগ সময় উজান ধলে করিম শা’র সাথেই থাকেন।

গান ও করেন ২। নুরুন্নেছাঃ শাহ আব্দুল করিমের ভক্ত শিষ্য। ৩। সুনন্দ দাসঃ কিছুদিন পূর্বে মারা গেছেন। ভক্ত শিষ্যের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কান্না ভেজানো কন্ঠে করিম বলেন- দুনিয়ায় কিছু মানুষ আছে যারা কোনকিছুতেই রা’ করেনা।

সুনন্দ ছিলো সেই মানুষ’ *** এই সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ ২০-৯-১৯৯৭ ইং রোজ শনিবার। সাক্ষাৎকার গ্রহণের সময় অন্যান্য যারা উপস্থিত ছিলেন-‘খোয়াব’ সম্পাদক হাবিবুর রহমান এনার, ‘বিকাশ’ সম্পাদক মোস্তাক আহমাদ দীন ও মঞ্জু রহমান লেবু।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।