মানুষ এবং মানুষ সম্পর্কে যাবতীয় বিষয়ে আমার দারুন আগ্রহ ……
উৎসর্গঃ প্রিয় ব্লগার নুশেরা তাজরীন, রিফাত হাসান, তারার হাসি আর সেই সাথে চট্টগ্রামের সমস্ত ব্লগারদের।
প্রথম পর্বঃ আমাদের যাত্রা হলো শুরু...
দ্বিতীয় পর্বঃ আমার কর্ণফুলী, আমার চট্টগ্রাম। বৃষ্টিমেদুর স্মৃতিকাতরতা
শ্রদ্ধেয় ব্লগার মনজুরুল হক'কে এবারের ২য় পর্ব উৎসর্গ করা হলো
স্বচ্ছ কাঁচের ঘেরাটোপে মূড়ে রাখা পুরোটা বাস, এই মুহুর্তে স্থবির হয়ে পড়া শহরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে, বৃষ্টিতে। সেই জানালা বিহীন দেয়ালের পর্দা সরালে দেখা যায় কাঁচের স্বচ্ছতা বেয়ে নামছে অবিরাম জলের ফোঁটা, ফিরতি পথের গাড়ীর হেড লাইটের আলোয় মুহুর্তেই প্রতিটা জলের ফোঁটা পরিনত হচ্ছে উজ্জ্বল একেকটা আলোক বিন্দুতে। সারাটা কাঁচের দেয়াল ঝকমকিয়ে ওঠছে, যেন ঝলসে উ্ঠছে অজস্র চূনী পান্না... সুন্দরীর নাকে বসানো হীরার নাকছাবি।
সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখে তন্দ্রা নেমে আসে...।
আজ ভোরে ঘুম ভাঙ্গলো বউ এর টেলিফোনে, আটলান্তিকের ওপার থেকে ভেসে আসে তার উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর।
—তুমি এখন কোথায়, কক্সবাজার পৌঁছে গেছ?
ঘুমের আঠায় জড়িয়ে আছে চোখ... ভাল করে তাকাতে পারছি না, চোখ খুলতে কষ্ট। কতক্ষন ধরে বাসটা চলছে...? গত রাতের জট পাকানো রাস্তার গিঁট খুলে বাস কখন শহর ছেড়েছে কে জানে? আবছা মনে আছে, শেষ রাতে কুমিল্লায় থেমেছিল বাসটা কিছুক্ষনের জন্য, তারপর আর কিছু মনে পড়ছে না। পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরে আলো ফুটে গিয়েছে।
কিন্তু চারপাশ ভোরের ফ্যাকাশে আলোতে বোঝার উপায় নেই, এটা কোথায়... বাইরে ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি তখনও পড়ছে, ঠিক ঘুমিয়ে পড়ার আগে যেমন দেখেছিলাম। বাস চলছে সতর্ক সাবধানী ভঙ্গীতে, একঘেঁয়ে গতিতে...
ভারী মুশকিল হলো... হঠাৎ করে কি ভাবে বলি— এটা কোথায়? কক্সবাজার নাকি চট্টগাম...? শেষবার কক্সবাজার এসেছিলাম প্রায় ৮/৯ বছর আগে। তখন রাস্তাঘাটের যা অবস্থা ছিল, এর মধ্যে কত কিছুর বদল ঘটে গেছে, চারপাশে... আমার পক্ষে এখন ঠাওর করা মুশকিল, কোনটা কক্সবাজার, আর কোনটা চট্টগ্রামের রাস্তা!! ফলে কিছুই বুঝতে পারছি না, মাথাও কাজ করছে না। এটুকু বোঝা যাচ্ছে, এই মুহুর্তে বাসটা কোন শহরতলীর মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, চারপাশের গাছ-গাছালি কমে আসছে, এখুনি শুরু হয়ে যাবে লোকালয়। দেখতে পাচ্ছি রাস্তার পাশে জড়ো করে রাখা বিস্তর সিরামিকসের কমোড, ওয়াশ বেসিন..., বিশাল বিশাল সিলিন্ডার আর পুরানো ফার্ণিচার।
এক সময় চোখে পড়ল, একটা নারকেল গাছে ছোট একটা সাইনবোর্ড ঝুলছে, তাতে লেখা ভাটিয়ারী (বাকী শব্দ গুলো অস্পষ্ট)। এ জায়গাটা অবশ্য আমি ভাল মতো চিনি, চট্টগ্রামে ঢোকার ঠিক আগে, পুরানো বাতিল সব জাহাজ ভাঙ্গার যে জেটিগুলো আছে, এগুলো ভাটিয়ারীতে। আরো কি কি যেন আছে ভাটিয়ারীতে, শুনে নিতে হবে। একটু পরেই আসবে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ...
কিন্তু এ সময় তো আমাদের কক্সবাজারের কাছাকাছি থাকার কথা, ঘড়িতে বাজে প্রায় ৯টা... বৃষ্টির দাপটে সব কিছু আবছা হয়ে যাওয়ায় এতক্ষন ঠিক বোঝা যায় নাই। যতটা ভোর ভাবছিলাম, সে তুলনায় বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে।
ঢাকায় আমাদের বলা হয়েছিল ৯টার মধ্যে আমরা কক্সবাজার পৌঁছে যাব। কোথায় কি...? গাড়ী এখন মাত্র ঢুকছে চট্টগ্রাম শহরে, কক্সবাজার তবে পৌঁছবে কখন?
এ সব নিয়ে আমার খুব যে উৎকন্ঠা, তা অবশ্য নয়। নেহাৎ এই হঠাৎ ঘুমের চটকা ভেঙ্গে বউ এর গলায় কিছুটা দুঃশ্চিন্তার সুর শোনা, (আর কে না কানে বউদের কাজই হলো স্বামীদের সব কিছু নিয়ে দুঃশ্চিন্তা করা)। সাত সকালে সেটাই হয়তো ছোঁয়াছে রোগের মতো আমাকে আক্রান্ত করেছে। তা না হলে, বেড়াতে বেড়িয়েছি, কারও সাথে কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই, ফেরারও কোন দিনক্ষন নেই, কোথাও কেউ আমার জন্য অপেক্ষা করে নেই... এখানে দুঃশ্চিন্তার প্রশ্ন আসে কোত্থেকে...? আমার কি কোন সকাল বিকাল আছে? কক্সবাজার পৌছানো নিয়ে কথা, এক সময় পৌছলেই তো হলো।
তার চেয়ে আমি খুব মনোযোগ দিয়ে চট্টগ্রাম শহরটাকে দেখতে থাকি। এখনও যথেষ্ট যৌবনদীপ্ত এ শহর, উপচে পড়া গাড়ীর চাপে নষ্ট হয়ে যায় নি। কাল সারা রাতের বৃষ্টিতে ভিজে পুরো শহরকে লাগছে ধোয়া ফিটফাট ঝকঝকে। দেখতে বেশ লাগে। যেন ঈদের দিনের সকালের নবীনা কিশোরী।
গোসল সেরে উঠে সাজগোজ করার অপেক্ষায়- সামনে ছড়ানো তার এক গুচ্ছের ড্রেস, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না... কোনটা রেখে কোনটা পড়বে। আয়নায় ভেসে উঠে তার পান পাতার মতো সজীব মুখচ্ছবি... আর চুলের গোড়া বেয়ে নামতে থাকে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা।
ছুটির দিনের চাকুরীজীবির মতো এ শহরের ঘুম তখনও ভাঙ্গে নাই। আমার সিট পড়েছে বাসের ডান ধারে, সিটে বসে বসে দেখছি চারপাশ। দোকানপাট, খাটো পাঁচিল দেওয়া বাসাবাড়ী আর রাস্তার ফুটপাত... সব কিছু পিছলে চলে যাচ্ছে- পেছনের দিকে।
এখান থেকে রাস্তার অপর প্রান্ত অনেক দূর... সাইনবোর্ডগুলোর ছোট ছোট লেখাগুলো পড়া যাচ্ছে না। ফলে বোঝা যাচ্ছে না, এটা শহরের কোন এলাকা।
খুবই অবাক লাগে, চট্টগ্রাম শহর নিয়ে আমার অধিকাংশ স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে বৃষ্টি... ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। সেই আমার জীবনের প্রথম সমুদ্র দেখা, আর প্রথম দেখা একটা শহর, যার পথের চড়াই উৎড়াই এর বাঁকে বাঁকে ছড়ানো ছিটানো থাকে ঘন সবুজ অরণ্যানী, লতানো গাছপালা আর গভীর খাদ — দিকচক্রবালে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে সারিবদ্ধ মাটির পাহাড়। অপুর্ব লাবন্যময়ী বালিকারা সেখানে সবুজ ফিতায় তাদের স্কুল ড্রেসের কোমরবন্ধ এঁটে রাখে, আর স্কুলের সামনের ঢালু মাঠটায় জটলা করার সময় গাড়ী থামানো ভিনদেশী তরুনদের পাঁচলাইশের ঠিকানা বাতলে দেয়।
এই শহরের ধর্মীয় মুল্যবোধের আধিক্য আর আপাত রক্ষনশীলতা নিয়ে অনেক কিছু শুনেছি, কিন্ত মনে আছে অচেনা সেই স্কুল বালিকারা আমাদের সাথে কথা বলেছিলো সোজাসুজি চোখে চোখ রেখেই।
চট্টগ্রামে সেটাই ছিল আমার প্রথম আসা।
দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।