মানুষ এবং মানুষ সম্পর্কে যাবতীয় বিষয়ে আমার দারুন আগ্রহ ……
উৎসর্গঃ প্রিয় ব্লগার নুশেরা তাজরীন, রিফাত হাসান, তারার হাসি আর সেই সাথে চট্টগ্রামের সমস্ত ব্লগারদের।
আমাদের যাত্রা হল শুরু...
ছিঁচকাদুনে বাচ্চাদের মতো নাছোড়বান্দা বৃষ্টি আর সেই সাথে পাল্লা দিয়ে— সুতার গুলিতে গিট্টু লাগার মতো যানজট...
এই জট পাকানোর কোথা থেকে যে শুরু আর কোথায় গেলে এই জট পাকানো অবস্থার শেষ, তা বোঝার উপায় নেই। জুবুথুবু হয়ে বসে আছি বাসের মধ্যে, তো বসেই আছি... কিছুই করার নাই। গাড়ী মাঝে মধ্যে একটু নড়ে, তো নড়ে না... সামনে পিছনে সারিবদ্ধ যানবাহনের দীর্ঘ লাইন, স্থির হয়ে দাড়িয়ে আছে, নট নড়ন-চড়ন... গাড়ীর সামনের উইন্ড স্ক্রীনে শুধু এক জোড়া ওয়াইপার, ক্লান্তিহীন ভাবে মুছে যাচ্ছে পানির ধারা।
বাস ছেড়েছিলো কলাবাগান থেকে ঘড়ির কাঁটায় রাত ১১টায়, টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যেই।
তখন থেকেই গাড়ী এগুচ্ছিলো ইঞ্চি ইঞ্চি করে। হাত ব্যাগে রাখা একটা বইয়ে চোখ বুলাচ্ছিলাম, এরই মাঝে কখন ঝিমুনি এসে গিয়েছিল, চোখ কচলে দেখি, বাস তখনও সোনার গাঁও এর মোড়ে, আর ঘড়ির কাঁটায় ১২টা ছুইছুই। এই কয়েকশ গজ রাস্তা পার হতেই ঘন্টা খানেক সময় বেরিয়ে গেল! ঢাকা শহরের শেষ সীমানা কতদুরে তখনো, কে জানে? রাত ক্রমশঃ গভীর হচ্ছে, অথচ রাস্তায় গাড়ীর ভিড়ের কমতি নাই।
এত বৃষ্টি-বাদল আর দুর্যোগের মধ্যেও দূর পাল্লার এই বাস, ভিতরে তার আবছা আলোর মোহময় পরিবেশ, কোন একটা সিটও খালি নাই। যাত্রা শুরুর আগে, বিকাল থেকেই ভাবছিলাম গল্প উপন্যাসে যেমন দেখা যায় (অন্ততঃ ব্লগে নুশেরার ইলিয়াস কাঞ্চনের স্টাইলে) আমার পাসের সিটে আজ যদি কোন বালিকার অধিস্থান ঘটে।
সেই কিশোর বয়স থেকেই দুরপাল্লার ভ্রমনে এটা আমার প্রিয় ফ্যান্টাসী। ... এক্সকিউজ মি, এটা কি ফোর সি? এটা আমার সিট... ভ্রমনের শুরুতে এভাবে বাক্য বিনিময় ঘটবে বালিকাটির সাথে, তারপর পরিচয় শুরু হবে সাধারন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে, আর এক সময় আবিস্কার হবে আমাদের দুজনের অন্তত দু একজন কমন ফ্রেন্ড আছে, যারা আমাদের দুজনেরই খুব ঘনিষ্ঠ... ইত্যাদি ইত্যাদি।
কলাবাগানে যখন কোচে উঠে পড়েছি, বাস ছাড়তে তখনও আধা ঘন্টা বাকি। বাসের অধিকাংশ যাত্রী তখনও এসে পৌছায় নি। আরাম করে বসার জন্য অ্যাডজাষ্টেবল সিটের হ্যান্ডেল আর লিভারগুলো নিয়ে যখন টানা হ্যাঁচড়া করছি, কানে এল একটা রিনরিনে কন্ঠস্বর... এক্সকিউজ মি, এটা কি ফোর সি? এটা আমার সিট... !! মুহুর্তের জন্য আমার সৌভাগ্যে আমি নিজেই মুগ্ধ হতে যাচ্ছিলাম, কি আশ্চর্য্য, এই রকম একটা বাক্যাংশই তো এতক্ষন আমার মাথায় ঘুরছিল!!
ঘোর কাটল বক্তার চেহারার দিকে তাকিয়ে।
বয়স হয়েছে, কাজকর্ম থেকে অবসর নেবার, কিন্ত ভদ্রলোকের কন্ঠস্বর কিশোরদের মতো হালকা, সুরেলা। বোঝাই যায় না, কোন বয়স্ক মানুষের গলা হিসাবে। শরীরে সাদা সাদা ছোপ, মাথার চুল সম্পুর্ন সাদা, এমন কি চোখের পাঁপড়ি থেকে দাড়ি গোঁফ পর্যন্ত্য। ভদ্রলোক কি অ্যালবিনো? চেহারা এবং অবয়বে উচ্চপদস্থ দায়ীত্বশীল ব্যক্তিত্বের ছাপ, পোষাক এবং কথাবার্তায় রুচির ছোঁয়া। হাতব্যাগ থেকে একটা চাদর বের করে আপাদ মস্তক মুড়ে নিয়ে ভদ্রলোক টান টান হলেন... আমিও হাঁফ ছাড়লাম।
এ যাত্রায় আমি একাই, তবু অজ্ঞাতকুলশীল কারও সাথে সারা রাস্তা ভ্যাজর ভ্যাজর করার, আমার কোন পরিকল্পনা নাই।
আগেই বলেছি, এ যাত্রার ভ্রমনে আমি একাই, আমার সঙ্গী সাথীরা ইতিমধ্যেই পৌছে গেছে কক্সবাজার। আজকের এই ভ্রমনের উদ্যোক্তা অবশ্য আমি নই। অ্যালবার্টা থেকে এসেছে আমার কাজিন, ইমরান আর তার এক বন্ধু। ঢাকার পুরানো বন্ধুদের দলবল নিয়ে, ইমরান গত সপ্তাহে গেছে সিলেটে।
বেড়ানো শেষ করে ইমরানের পুরানো বন্ধুরা ফিরে আসবে ঢাকায়, আর তার বন্ধুকে নিয়ে ইমরান কক্সবাজার পৌঁছে যাবে, গত রাতেই।
নানা কারনে আমাদের জীবনগুলো আর আগের মতো সরল নেই, সেই ঢিলেঢালা ভাবও নেই। অনেক কিছুর মতো ভ্রমনের সেই ধরা বাঁধা মৌসুম বলেও আর কিছু নেই এখন। এই তো ইমরান এসেছে মাসখানেকের জন্য বেড়াতে, এল প্রায় ৩ বছর বাদে, আবার কবে আসবে, কোন ঠিক নাই। ফলে বেড়ানোর মৌসুমের তোয়াক্কা না করেই, সে অনুযায়ী তৈরি করতে হয়েছে আমাদের ভ্রমন সূচি।
আমাদের লাইফ এখন অনেক বেশী কাস্টোমাইজড। আমার যখন ফুসরত মিলবে, ইচ্ছা জাগবে... বেরিয়ে পড়বো ভ্রমনে... সেটাই হবে আমার জন্য ভ্রমনের মৌসুম। যে কোন সময়ই এখন তাই বেড়াতে যাওয়ার সময়, তা সে আবহাওয়া যেমনই হোক না কেন! তা না হলে, এখন তো এই ভরা বর্ষার মৌসুম, প্রায় প্রতিদিনই কিছু না কিছু বৃষ্টি লেগেই আছে, ভ্রমনের জন্য মোটেই আদর্শ কিছু নয়... অথচ আমরা যাচ্ছি ঘুরতে, এই বৃষ্টি-বাদল মাথায় নিয়ে...!!!
এ যাত্রা আমাদের প্রথম গন্তব্য কক্সবাজার, তারপর বান্দরবন... আর বাস ভর্তি লোকজন, অনেকেই তো যাচ্ছে, আমাদের মতো ঘুরতে।
বিদ্যুতবেগে ছুটে যাওয়া গাড়ীর তীব্র গতি, খোলা জানালার পাশে বসে— চোখে মুখে এলোমেলো বাতাসের ঝাপটা, আমার কাছে ভ্রমন বলতে তেমনই কিছু বোঝায়... ভ্রমন তো আর ফিটফাট পোষাক পড়ে, শ্বশুরবাড়ী যাওয়া নয়!! আজকালের ভ্রমন হয়ে গেছে বড়ই সুশীল। এখনকার আয়েসি ভ্রমনে সে সব উত্তেজনা উধাও।
এমন কি জানালার পাশে বসে খোলা বাতাসে চুল উড়িয়ে (আর চুল চটচটে আঠা বানিয়ে) বাসে চড়ার সেই দিন আর নাই। এখনকার অত্যাধুনিক বিলাস দিয়ে মোড়া শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কোচ গুলোতে জানালা বলে কিছু থাকে না। বাসগুলো যেন লম্বা একটা টিউব, ভিতরে সারিবদ্ধ বসার আসন। আমি যেখানে বসেছি, আমার সিটের পাশে কোন জানালা নেই, আছে স্বচ্ছ কাঁচের ঘেরাটোপে মূড়ে রাখা দেয়াল।
স্বচ্ছ কাঁচের ঘেরাটোপে মূড়ে রাখা পুরোটা বাস, এই মুহুর্তে স্থবির হয়ে পড়া শহরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে, বৃষ্টিতে।
সেই জানালা বিহীন দেয়ালের পর্দা সরালে দেখা যায় কাঁচের স্বচ্ছতা বেয়ে নামছে অবিরাম জলের ফোঁটা, ফিরতি পথের গাড়ীর হেড লাইটের আলোয় মুহুর্তেই প্রতিটা জলের ফোঁটা পরিনত হচ্ছে উজ্জ্বল একেকটা আলোক বিন্দুতে। সারাটা কাঁচের দেয়াল ঝকমকিয়ে ওঠছে, যেন ঝলসে উঠছে অজস্র চূনী পান্না... সুন্দরীর নাকে বসানো হীরার নাকছাবি।
সে দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার চোখে তন্দ্রা নেমে আসে...।
প্রথম পর্ব সমাপ্ত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।