দ্রিমু য্রখন ত্রখন স্রবট্রাতেই দ্রিমু
মুভি বানানোর ব্যাপারে ৩ টি ফরমুলার বাইরে আমরা প্রায় যেতেই দেখি না মাস্টার অব সাসপেন্স খ্যাত পরিচালক আলফ্রেড হিচকককে।
ফরমুলা-১
হিচককের ছবিতে কমন যে ব্যাপারটি আসে সেটি হল, অপরাধী হিসেবে এমন একজনকে চিহ্নিত করা যে আসলে নিরাপরাধ ৷এর কারণটা খুব সহজ। হিচককের মতে, "নিরপরাধ মানুষের ঘাড়ে অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিলে দর্শকের মধ্যে বিপদের অনুভূতিটা খুব সহজে সঞ্চারিত করা সম্ভব ৷ওই নিরপরাধ মানুষটার সঙ্গে সহজেই একাত্ম হতে পারে দর্শক ৷কিন্তু পালিয়ে বেড়ানো কোনও আসল অপরাধীর সঙ্গে কখনওই দর্শক একাত্মবোধ করে না।" অর্থাত্ দর্শককে প্রথম থেকেই গুরুত্ব দেওয়া, হিসেবের মধ্যে রাখা, এই ছিল হিচককের মূল উদ্দেশ্য ৷ এই উদ্দেশ্য সাধন করার প্রথম পদক্ষেপ হল, নিরপরাধ মানুষের ঘাড়ে অপরাধের দায় চাপিয়ে দেওয়া ৷দর্শককে সিনেমার প্রতিটা মুহূর্তের অংশীদার করে তোলাটাই হিচককের লক্ষ্য ছিল৷ আর এই ভাবনা থেকেই জন্ম নিচ্ছে ফরমুলা-২ ৷
ফরমুলা-২
ধরা যাক, সিনেমার একটা দৃশ্যে কাহিনির মূল চরিত্র বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সিতে চেপে স্টেশনে চলেছে ট্রেন ধরতে ৷খুব সাধারণ দৃশ্য। কিছুই ঘটছে না, বরং পর্দায় এই দৃশ্য বেশিক্ষণ থাকলে দর্শক হাই তুলতে পারে ৷অথচ দৃশ্যটা দেখাতেই হবে ৷হিচকক এই সাধারণ দৃশ্যটাই অসাধারণ করে তুলতে পারেন ৷কীভাবে? ট্যাক্সিতে ওঠার আগে হাতঘড়িতে চোখ রেখে শুধু লোকটি বলবে, "এই রে, আমার মনে হচ্ছে ট্রেনটা বোধহয় পাব না!" ট্যাক্সি চলতে শুরু করল ৷কোথাও ট্রাফিক জ্যাম, কোথাও রেড সিগন্যাল, হঠাত্ই গাড়ির সামান্য বিগড়ে যাওয়া- আর এই সব কিছুর মাঝে-মাঝে বারে বারেই লোকটির ঘড়ি দেখা ৷এর ফলে চাপা উত্তেজনার স্রোত বয়ে চলবে দর্শকের মনের ভিতরে প্রতিনিয়ত - লোকটা ট্রেন ধরতে পারবে তো? যে দৃশ্যটা এক মিনিট লম্বা হলেই লোকের বিরক্তি ধরে যেত, সেই দৃশ্যটাই পাঁচ মিনিট লম্বা করে দিলেও পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারবে না দর্শক, কারণ সে ততক্ষণে জড়িত হয়ে পড়েছে গোটা ঘটনার সঙ্গে ৷হিচককের মতে এটাই হল 'সাসপেন্স'৷দর্শককে নিরন্তর দোদুল্যমান রাখা 'হবে' কি 'হবে না'-র মধ্যে ৷এই সাসপেন্স থেকে মুক্ত হবে দর্শক তখনই যখন প্রায় ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে যাওয়ার মুহূর্তে লোকটি ট্রেনে উঠে পড়বে ৷আর কী আশ্চর্য চাপ মুক্ত দর্শকের মনের মধ্যে একটিবারের জন্যেও তখন প্রশ্ন তৈরি হবে না, 'লোকটার কীসের এত তাড়া'? অথচ, 'পরের ট্রেনে গেলেই বা ক্ষতি কী ছিল'?
হিচকক বার-বারই বলতেন 'সারপ্রাইজ' নয়, 'সাসপেন্স' ৷একটা টেবিলের দু'প্রান্তে দু'জন কথা বলছে ৷হঠাত্ই সেই টেবিলের তলায় রাখা একটা বোমা ফেটে গেল ৷এটা মুহূর্তের 'সারপ্রাইজ' ৷ কারণ বোমাটা ফাটার আগে পর্যন্ত দৃশ্যটা ছিল অত্যন্ত মামুলি ৷অথচ দর্শককে যদি আগে দেখানো হয় ওই টেবিলের তলায় দু'জন সন্ত্রাসবাদী বোমা লাগিয়ে চলে যাওয়ার পর দু'জন এসে বসল সেই টেবিলে, তাহলে মুহূর্তের মধ্যে চাপা উত্তেজনা সঞ্চারিত হবে দর্শক মানসে 'বোমাটা কখন ফাটবে' বা 'বোমা ফাটার আগেই দু'জন টেবিল ছেড়ে চলে যাবে কি না' এই সব নিয়ে ৷পনেরো সেকেন্ডের একটা মামুলি দৃশ্যকে পনেরো মিনিটের একটা সাসপেন্সময় দৃশ্যে রূপান্তর করাটাই হল হিচককের মুন্সিয়ানা ৷আর এটা করতে গিয়ে 'অপরাধ'-এর খুঁটিনাটি আগে দেখিয়ে দিতেন দর্শককে, যাতে ছবির আগাগোড়া দর্শক সাসপেন্স-আবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে ৷এখন ওই যে লোকটা, যে ট্রেনে উঠল, যার তাড়া নিয়ে টেনশন দর্শকের মনে - এই তাড়াটাই হল এই দৃশ্যের পূর্বকথন বা প্রি-টেক্সট ৷অথচ এই তাড়াটা কাহিনিতে না থাকলেও লোকটা ট্রেনে উঠত, কারণ ট্রেনে উঠে অন্য জায়গায় যাওয়াটাই হল গল্প ৷ অথচ ওই তাড়ার প্রি-টেক্সটটা না থাকলে দৃশ্যটা জমত না ৷এটাই হল হিচককের গল্প বলার ফরমুলা-৩ ৷
ফরমুলা-৩
এটাকে হিচকক বলছেন 'ম্যাক গাফিন' ৷কিন্তু 'ম্যাক গাফিন' বস্তুটা কী? হিচকক একটা গল্প শুনিয়েছেন এটা বোঝাতে গিয়ে ৷দু'জন চলেছে একটা ট্রেনে চেপে ৷একজন লক্ষ্য করলেন, অন্যজন একটা বড় প্যাকেট নিয়ে চলেছেন যেটা রাখা আছে বাঙ্কের ওপরে ৷কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইলেন,
-আপনার ওই প্যাকেটে কী আছে?
-ম্যাক গাফিন!
-সেটি আবার কী বস্ত্ত?
-স্কটিশ হাইল্যান্ডে সিংহ ধরার এক ধরনের যন্ত্র!
-কিন্ত্ত স্কটিশ হাইল্যান্ডে তো সিংহ নেই!
-তাই বুঝি! তাহলে ম্যাক গাফিন বলেও কিছু নেই!
একটা বাংলা সিনেমা থেকে উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে ৷ছবির নাম সত্যজিৎ রায়ের 'সোনার কেল্লা' ৷ছবির শেষে ফেলুদা বলে, 'গুপ্তধন নেই ৷জন্মান্তর থাকলেও নেই, না থাকলেও নেই!' এই 'জন্মান্তর'টাই গোটা সিনেমার ম্যাক গাফিন, যেটা হল গল্পের প্রি-টেক্সট, যার জন্যে দর্শকের মধ্যে কৌতূহল তৈরি হয়, যার জোরে গল্প এগিয়ে চলে ৷ অথচ মূল গল্প তো নকল হাজরা ধরা পড়ল কি না তাই নিয়ে ৷
ছবির শেষে তাই কেউ প্রশ্ন করে না পূর্বজন্ম বলে কিছু কি আছে? করে না তার কারণ, সেটা অবান্তর ৷অথচ কাহিনির প্রাথমিক ড্রাইভিং কোর্স এটাই ৷মজাটা এখানেই ৷ঠিক যেভাবে 'জয়বাবা ফেলুনাথ' সিনেমায় গণেশ-এর বদলে রত্ন খচিত উট হলেও গল্পটা একই থাকত৷এটাই 'ম্যাক গাফিন', যা হিচককের অন্যতম হাতিয়ার ৷
হিচককের সিনেমা মূলত দাঁড়িয়ে আছে এই তিনটি ফরমুলার ওপরেই ৷
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।