আমি লিখতে চাই...................
রঞ্জুর মামা এসেছে। শুধু রঞ্জুর মামা না, এসেছে আরো অনেকে। বাদলের মেঝ আপা, স্বপনের বড় ভাইয়া, শিউলির বাবা এরকম আরো অনেকে আসছে কয়েক দিন ধরে। এরা সবাই বিভিন্ন কারণে ঢাকায় থাকে। এ সময়ে তো কারোই আসার কথা না।
সবাই যে কেন হুট হাট চলে আসছে বুঝতে পারছে না রঞ্জু। তার অবশ্য ভাবার সময়ও নেই। মামা এনেছে সেই আনন্দেই সে বিভোর। কোন উৎসব-টুৎসব না হলে যে মামার দেখা পাওয়া দুষ্কর, আজ দুপুর বেলা খালের ঘাট থেকে শোনে সেই মামার হাঁক। প্রথমেতো বিশ্বাই হচ্ছিল না, পরে গিয়ে দেখে সত্যি সত্যি মামা।
অসময়ে মামাকে পেয়ে রঞ্জু যে কি পরিমান আনন্দিত তা ওর চোখমুখের ঝিলিক না দেখলে বোঝা যাবেনা। মামা ঢাকায় থাকে। সেখানে সে বড় বিশ্ব বিদ্যালয়ে পড়ে। বছরে দুই কি তিনবার ঈদ-পূজোর ছুটি ছাড়া মামার দেখা পাওয়া ভার। এসে কায়েকদিন থেকে আবার দে দৌঢ়।
মা যদি তখন বলে খলিল আর কটা দিন থেকে যা তখন কিসব বলে এই ক্লাশ সেই ক্লাস হেন তেন কত কি? আর প্রতিবার যাওয়ার সময় বলে কি সামনের বার এসে রঞ্জুকে ঢাকায় নিয়ে যাবে। আর যাওয়ার সময় রঞ্জু খালি ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদে। রঞ্জু এরার ক্লাশ থ্রিতে উঠেছে। ওর যে রোল এক, সেটা গল্পের ফাাঁকে সবাইকে বলে। মামা রঞ্জুর জন্য একটা সবুজ টিÑশার্ট, একটা লাল হাফপ্যান্ট আর একজোড়া হলুদ জুতা এনেছে।
আর এনেছে এক খানা বই। নাম ফটিকচাদ। মলাট টাই বেশ সুন্দর। রঞ্জুর মতো একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে, কাঁধে একটা ব্যাগ। টিÑশার্ট, প্যান্ট আর জুতা পড়ে রঞ্জু বারান্দায় বসে আছে চুপচাপ।
হাতে ফটিকচাদ। বেশ মজার বই। বসে বসে ভাবছে মামাকে নিয়ে কি কি করা যায়। মামা তালপাতা দিয়ে খুব সুন্দর বল বানাতে পারে, এবার মামাকে দিয়ে বেশ কায়েকটা বল বানাতে হবে। দুই তিনটা ডান্ডা আর চার-পাঁচটা গুটিও বানিয়ে রাখতে হবে।
বলাতো যায়না আবার কবে হুট করে চলে যায়। নতুন লকট গাছটায় যে এবার লকট এসেছে তা মামাকে ছাড়া আর কাউকে বলা যাবে না। কাটলে ভিতরে লাল বের হয় এমন একটা সন্ধান পাওয়া গেছে ছাড়া বাড়ির গভীর জঙ্গলে সেখানে মামাকে নিয়ে যেতে হবে। মামাকে বললেই আলির বাগান থেকে জামরুল এনে দিবে তা রঞ্জু জানে। মামার একটাই দোষ সবার সামনে মামা রঞ্জুর প্যান্ট একটানে খুলে ফেলবে।
আর সবাই তখন হেহে করে হাসবে। রঞ্জুর তখন কাঁদতে ইচ্ছা করে। এটা কেমন কথা? মায়ের চ্যাচামেচিতে সম্বিৎ ফিরে পায় রঞ্জু। মা তো মামার সাথে কখনও এরকম রাগারাগী করে না, আজ কি হলো? বারান্দা থেকে উঠে বড় ঘরের দিকে হাঁটা দেয়। কান পাতে ঘরের দরজায়।
শোনে মামা বেশ বিনয়ের সাথে মাকে বলছে
- তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো বুজি, ওরা এই সময়ে কোথায় যাবে? আর ওরা তো আমারই বন্ধু।
- যেখানে খুশি যাক আমি যানি না কোথায় যাবে। আচ্ছা দেশের এই অবস্থায় তুই কিভাবে ওদের বাসায় রাখার কথা বলিস? ওরা পাঁচ জন আর তুই একজন তোর দুলাভাই একজন মোট সাত জনের একটা বিশাল দল। সবাইকে একত্রে ধরে নিয়ে গুলি করতে সুবিধা হবে।
- ওরা বেশী দিন তো আর থাকবে না, মাত্র দিন দুয়েক।
- তারপর? তারপর কোথায় যাবে ওরা?
- ট্রেনিং-এ যাব আমরা।
- আমরা? আমরা মানে কি? তুই ও যাবি নাকি?
মায়ের কন্ঠটা কেমন যেন আর্ত নাদের মতো শোনালো রঞ্জুর কাছে।
- হু।
- কি বলছিস তুই? কান্নায় ভেঙে পড়লেন মা।
- আমার লক্ষী ভাই, তোর যাওয়ার দরকার নেই, ওরাই যাক।
তোর কোত্থাও যাওয়ার দরকার নেই, তুই এখন থেকে বাড়ীতেই থাকবি।
- না বুজি, তুমি আমাকে নেগেটিভ কোন কথা শোনাবে না প্লীজ, তোমার দুটি পায়ে পড়ি। দেশের যে এখন কি অবস্থা তা তুমি গ্রামে থেকে কিছুই বুঝতে পারছ না। গতো পরশু রাতে ওরা ঢাকায় কি হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তা তুমি কল্পনাও করতে পারছনা। ওদের এক রাতের কর্মকান্ডে শ্মশান বানিয়ে ফেলেছে, এভাবে চলতে থাকলে সারা বাংলায় মাটি ছাড়া আর কিছুই থাকবে না।
তোমরা কি চাও এটা। এটা যদি চাও তো বল আমি আর কোত্থাও যাবো না। সারা দিন তোমার আঁচল ধরে বসে থাকব।
মা কোন কথা বলে না। তবে মা যে কাঁদছে তা দরজার এপাশ থেকেও বুঝতে পারছে রঞ্জু।
- বুজি আমাকে বাধা দিওনা, এখন সময় এসেছে হাতে অস্ত্র তুলে নেবার।
মা এবার ডুকরে কেঁদে উঠলো। রঞ্জু কিছু না বুঝেই আস্তে করে চলে এলো। কিছুই বুঝতে পারছেনা ও। কি হয়েছে দেশের? কারা মারামারি করছে? মামা কোথায় যেতে চায়? মামা কি মারামারি করবে?
বিকেলে মামার কড়ে আঙ্গুল ধরে হাঁটতে হাঁটতে যখন জোড়া তালগাছের নীচে এসে বসল তখন রঞ্জু আচমকা মামাকে প্রশ্ন কারে বলস
- তুামি কোথায় যাবে মামা?
- কোথাও না তো! কে বলল তোকে?
- এইযে তুমি মাকে বললে আবার মা তোমাকে নিষেধ করলো।
মামা তার তর্জনী নাকের নীচে রেখে বলল
- শশশশশশশশশ....... খবরদার কাউকে একথা বলিসনা, তাহলে ওরা আমাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলবে।
- ওরা কারা মামা?
মামা সব বুঝিয়ে বলল রঞ্জুকে। সব শুনে রঞ্জু বলল আমিও যাব তোমার সাথে। হেসে উড়িয়ে দিলো মামা। অনেক বুঝিয়ে শেষে শান্ত করা গেলো রঞ্জুকে।
রাতে সবাই মিলে খেতে বসেছে। খেতে খেতে মা সব খুলে বললেন বাবাকে। সব শুনে বাবা বললেন
- তা বেশ তো। যাবেই তো! অবশ্যই যাবে। এখন যুদ্ধে যাওয়া তো ফরজে আইন।
আমার তো মনে হয় এখন যারা যুদ্ধে না যাবে হাসরের ময়দানে তাদের কে জবাবদিহি করতে হবে আল্লাহর কাছে। তোমার ক’জন বন্ধু আসবে খলিল?
বাবা জানতে চায় মামার কাছে।
- পাঁচ জন
- সবাই কি ছেলে?
- না দুইজন মেয়েও আছে।
- শুনেছ শুনেছ? মেয়েরাও যুদ্ধে যাচ্ছে। এখনও কি তোমার ভাইকে আটকাবে?
মা কিছুই বলে না খালি মুখে আঁচল দিয়ে কাঁদে।
পরের দিন খুব সকালবেলা মামার বন্ধুরা চলে এলো। সবাই রঞ্জুকে খুর আদর করে। নাদুশ নুদুশ যে সুমা আন্টিটা সে খালি রঞ্জুর গাল ধরে টানে। অবশ্য সে বেশ কিছু চকলেটও দিয়েছে রঞ্জুকে।
দুই দিন পরে সবাইকে কাঁদিয়ে আন্টিরা আর মামারা চলে গেলো ট্রেনিং-এ।
আর বলে গেলো ট্রেনিং শেষে আবার ফিরে আসবে। আবার একা হয়ে গেলো রঞ্জু। স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে সারাদিন ঘরে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না রঞ্জু। মায়ের কড়া আদেশ ঘর থেকে এক পা ও বাইরে দেয়া যাবে না।
মাস তিনেক পরের কথা--------
একদিন খরব আসে ওদের স্কুলে আর্মি এসেছে।
শুনে খুবই রাগ লাগলো রঞ্জুর। আর্মিদের ও প্রচন্ড ঘৃনা করে। মামা বলেছে ওরা নাকি খুব খারাপ। এর আটদশ দিন পরে একদিন সকাল দুপুর বেলা বাবা বেশ আনন্দ মাখা মুখ নিয়ে হাঁক দিয়ে রঞ্জুকে ডেকে বলল
- তোর মা কোথায়?
- রান্না করছে, সকাল থেকে তুমি কোথায় ছিলে বাবা?
- বলছি, আগে তোর মাকে ডেকে নিয়ে আয়।
রঞ্জু এক দৌড়ে গিয়ে মাকে ডেকে নিয়ে আসলো।
মাকে বাবা বলল
- দেখো তোমার ভাই চিঠি লিখেছে তোমাকে।
- বল কি? কোথায় ও? কেমন আছে?
বলেই কেঁদে ফেলল।
- আছে আছে ভালোই আছে, তোমাকে চিঠি লিখেছে।
- পড় পড়।
বাবা পড়তে শুরু করল
বুজি,
জানি আমার উপর তুমি অনেক রেগে আছো।
আর এও জানি আর মাত্র কয়েকদিন পর যখন তোমাকে একটি স্বাধিন দেশ উপহার দেব তখন তোমার এই রাগ আনন্দে পরিনত হবে। যাই হোক, আশা করছি ভালো আছো। অনেক দিন তোমাকে, রঞ্জুকে দেখিনা। তোমাদের জন্য মনটা খালি ছটফট করছে। আমরা রঞ্জুর স্কুলের মাইল খানেক পূর্ব দিকে আছি।
ওদের স্কুলে আর্মি এসেছে আজ রাতে অ্যাম্বুস করব। আমাদের নয় জনের একটা দল আছে। বুজি অনেক দিন তোমার হাতের রান্না খাইনা। আমাদের জন্য কষ্টকরে একটু রান্না করে পাঠাবে? অ্যাম্বুস সাকসেসফুল হলে আজ রাতে তোমাদের সাথে দেখা হবে। ভালো থাকো।
ইতি
তোমার
øেহের খলিল।
চোখ মুছতে মুছতে মা বললেন
- কি ব্যাপার চিঠিতো তোমার কথা কিছুই লিখলো না যে?
- আমার কাছেই তো চিঠি লিখে দিলো। আমি সকাল থেকে ওদের সাথে ছিলাম। শোন এখন কথা না বাড়িয়ে চলো ওদের জন্য কিছু রান্না করি।
- খাবার কে নিয়ে যাবে?
- আমি।
রঞ্জু, বাবা আর মা মহা সমারহে রান্না করছে মামাদের জন্য। সাধ্য মতো যতোটুকু সম্ভব। মুরগীর মাংশ, কৈ মাছ আর বেগুন ভাজি আর আউশ চালের লাল ভাত। হঠাৎ রঞ্জু বলল
- মা কয়েকটা ডালের বড়া বানাওনা, মামা তো ডালের বড়া অনেক পছন্দ করে।
- যা ডালের বয়াম নিয়ে আয়।
রান্না শেষে রঞ্জুর বাবা বলল আমার খাবারটাও ওদের সাথে দিয়ে দাওনা, আমিও খাই ওদের সাথে। বাবা যখন রওনা দিলো তখন রঞ্জু মামার দেয়া জুতা, প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে হাজির, সেও যাবে মামাকে দেখতে।
আগে রঞ্জুর বাবা বাশার মিয়া, মাথায় ভাত আর তরকারী, একটু পিছনে রঞ্জু ডালের বড়ার বাটি নিয়ে। রঞ্জুরা যখন ওর স্কুলের কাছাকাছি তখন মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হুজুরের সাথে দেখা হলো ওদের। রঞ্জুর বাবাকে ছালাম দিয়ে বলল
- কি বাশার মিয়া মাথায় পাতিল লইয়া কই যাও?
- এই তো হুজুর আমার ফুফু বাড়িতে যাই একটু।
- পাতিলে কি?
- ভাত তরকারি হুজুর। তারা সবাই অসুস্থ তো রান্না করার কেউ নাই এই জন্য রান্না করে নিয়ে যাচ্ছি।
- ভালো ভালো।
রঞ্জু বুঝতে পারলো না যে বাবা কেন মিথ্যা কথা বলল। বাবাই তো সব সময় বলে সদা সত্য কথা বললবে।
আবার হেঁটে চলছে দু’জন। বাবাকে কেন জানি খুব চিন্তিত লাগছে।
আরো বেশ কিছু সময় হাটার পর রঞ্জু বলল
- বাবা আর কতো দুর?
- এই তো সামনে বাবা।
রঞ্জুরা একটা বড় জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় একদল আর্মি এসে হাজির হলো ওদের সামনে।
বাবা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো। এক জন আর্মি বলল
- কোথায় যাচ্ছিস?
- আমার আত্মীয় বাড়ি যাচ্ছি।
- মাথায় কি?
- খাবার
- এটা নামা।
বাশার মিয়া নামিয়ে রাখলো। একটা আর্মি এসে বাবাকে চেপে ধরে বলল
- বল মুক্তি কোথায়?
- আমি জনিনা
বেশ ভয়ার্ত কন্ঠে বলল বাশার মিয়া।
সাথে সাথে এক আর্মি এসে রঞ্জুর পেটের কাছে বন্দুকের মাথার চাকুটা ঠেসে ধরে বলল
- বল মুক্তি কোথায়, না হলে তোর ছেলের পেটে এটা ঢুকিয়ে দেব।
- বললাম তো আমি জানিনা। আমার ছেলেকে ছেড়ে দাও। মুক্তি কোথায় আমি জানিনা।
- জানিস না, না? এবার জানবি।
বলেই রঞ্জুর পেটের মধ্যে বেয়নেটের পুরোটা ঢুকিয়ে দিলো। একত্রে গগন ফাটা চিৎকার দিলো রঞ্জু আর বাশার মিয়া। আর্মিরা বাবাকে টানতে টানতে মারতে মারতে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে দেখতে পাচ্ছে রঞ্জু। তার চার দিক আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে রঞ্জুর।
চোখের সামনে কতোগুলো মুখ ঘুরছে। মা, বাবা, মামা আরো কয়েকজন। আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। তার বুকের কাছে সে অবচেতনে ধরে আছে ডালের বড়ার বাটি। এটা ছাড়া যাবেনা কোন মতেই।
এটা মামা খুব পছন্দ করে। এটা মামার জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।