আমাদের সাগরবক্ষের তিনটি গ্যাসব্লক যুক্তরাষ্ট্রের কনোকো ফিলিপস আর আইরিশ কোম্পানি টাল্লোকে ইজারা দেয়ার সময়ে আবারো শাসকগোষ্ঠী ও তার বংশবদ মিডিয়া-অর্থনীতিবিদ-বিদ্ধিজীবীরা সেই অতি পুরাতন কায়দায় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের বিরুদ্ধে নানারকম মিথ ছড়িয়ে যাচ্ছে। অতি পুরাতন কায়দায় ও সুচতুরভাবে। আদমজী ধ্বংসের সময়ে যা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাইভেটাইজ তথা বন্ধ করার সময়ে যেসমস্ত প্রচারণা চালানো হয়, এবং আমাদের অনশোর গ্যাসক্ষেত্রগুলো অসম পিএসসি চুক্তির মাধ্যমে বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার সময়েও আগেরবার পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সকে নিয়ে যেরকম মিথ ছড়ানো হয়েছিল- এবারো তা শুরু হয়েছে। বাস্তবতার দোহাই দেয়া হচ্ছে, সফলতা/ব্যর্থতার খতিয়ান দেয়া হচ্ছে, নানা চটকদারি কথাও শোনাও যাচ্ছে। কিন্তু আমরা মনে করি এসবের মধ্য দিয়ে মূল সত্যটা সবসময়েই আড়ালেই থেকে যাচ্ছে, আড়াল করে রাখা হচ্ছে।
বাস্তবতার দোহাই দিয়ে যা বলা হচ্ছে তা অনেকাংশে রংচং মাখিয়ে তিলকে তাল করা হচ্ছে- কখনো বা এই মুহুর্তের বাস্তবতাকে পূর্বতন কারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে সবসময়ের বাস্তবতা হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। আজ আমরা এরকম মিথের দিকেই দৃষ্টি দেয়ার চেস্টা করবো।
বাপেক্স/পেট্রোবাংলাকে নিয়ে যতসব মিথ
# পেট্রোবাংলা/বাপেক্স একটা অথর্ব প্রতিষ্ঠান
# এটা মাথাভারী প্রতিষ্ঠান
# এটার কোন এক্সপার্টিজ নাই, গ্যাস অনুসন্ধান বা উৎপাদন করার জন্য এদের দক্ষ লোকবল নেই-
# ৩৮ বছরে এরা কিছু করতে পারেনি- শুধু সীমাহীন দুর্নীতি ছাড়া
# মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি আর আমলা/কেরানী দিয়ে গ্যাস অনুসন্ধান সম্ভব?
# এদের চালাতে গিয়ে সরকারের প্রতিবছর কাড়ি কাড়ি টাকা লস হয়
........ ইত্যাদি
প্রকৃত চিত্র ও বাস্তবতা
বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা জাতিগতভাবে অনকে হীনমন্য- আমাদের হীনমন্য করে তোলা হয়েছে। আমরা অলস জাতি- আমরা দুর্নীতিবাজ- আমরা পিছিয়ে পড়া- আমরা অদক্ষ ... ইত্যাদি শুনে শুনে আমরা অভ্যস্ত, আমাদের সফলতার চেয়েও আমাদের ব্যর্থতাগুলোর গল্প মিডিয়ায় গুরুত্ব পায়। বৃটিশ আমল থেকে শুনেছি- আমাদের শোনানো হয়েছিল, আমাদের জন্য বৃটিশ শাসন আশীর্বাদ কারণ বৃটিশরা সভ্য আর আমরা অসভ্য-নীচু জাতি, আমরা আমাদের শাসন করতে পারি না, পারবো না।
বৃটিশ আমলের সেই প্রচারণা এখনও চালু- বৃটিশদের প্রেতাত্মা হয়ে এখনকার শাসকগোষ্ঠী নিষ্ঠার সাথে একই কাজ করে যাচ্ছে। তাই যেকোন মিথ নিয়ে আলোচনার আগে আমরা এই বাস্তবতার দিকেই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আজকের এই পরিসরে আমাদের সফলতার ফিরিস্তি দেয়া বা ব্যর্থতাগুলোর মূল কারণগুলো অনুসন্ধানের সুযোগ নেই, তবে পেট্রোবাংলা/বাপেক্সকে নিয়ে প্রচলিত এই সব মিথের জবাব দেয়ার চেষ্টা আমরা করবো। একটু পেছন থেকেই আমরা শুরু করছি:
বাপেক্সের সৃষ্টিই - একে দুর্বল করার লক্ষে
১৯৮৯ সালে বাপেক্সের সৃষ্টি হলেও এই প্রতিষ্ঠানটি পাকিস্তান আমলের OGDC (১৯৬২-১৯৭১) এবং বাংলাদেশের পেট্রোবাংলা (১৯৭১-৮৯) এর উত্তরসুরী (১)। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত সহায়তায় OGDC প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তান আমলেই বাংলাদেশে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম করে শুরু করে এবং ৪টি কুপ খনন করে সেমুতাং এ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারও করে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সাবেক OGDC এর জনবল, রিগ ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি নিয়ে দেশে "তৈল সন্দ্ধানী" নামে অনুসন্দ্ধাণ কোম্পানী সৃষ্টি করা হয় এবং মূলত এ কার্যক্রমকে দেখভাল করার জন্য পেট্রোবাংলা সৃস্টি করা হয়। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে "তৈল সন্দ্ধানী"কে পেট্রোবাংলার সাথে একীভূত করা হয়। এর পর থেকে পেট্রোবাংলাই (এর এক্সপ্লোরেশন ডিরেক্টরেট) এই অনুসন্ধানের কাজ চালায়। ১৯৮৯ সালে বিশ্ব ব্যাংকের পরামর্শে পেট্রোবাংলা এর Exploration Directorate কে অবলুপ্ত করে বাপেক্স সৃস্টি করা হয় (২)। আপাত দৃষ্টিতে এ ব্যাবস্থা অনুসন্দ্ধান কার্যক্রমকে জোরদার করার উদ্যোগ মনে হলেও মূল উদ্দেশ্য ছিল ঠিক উল্টো।
কোন আয়ের উৎসবিহীন বাপেক্স দ্রুত একটি উদ্যমহীন হতাশাগ্রস্থ প্রতিষ্ঠানে পরিনত হয়। শুরু থেকেই এর আর্থিক দিকসমূহ যেমন তার আয়- তার স্থায়ী খরচ, অনুসন্ধান ও খনন খরচ সবকিছুই দারুন অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে (৩)। একেকটা এক্সপেনডিচারের জন্য বরাদ্দ লম্বা প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারণে বাপেক্সের কাজ হয়ে পড়ে দারুন মন্থর। বছরের শুরুতে ঘোষিত বরাদ্দটুকু যে কতদিনে আসবে তার কোন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না- অসংখ্যবার সংশোধিত বাজেট হয়ে সেটা বাপেক্সের হাতে এসেছেও অনেক খর্বিত আকারে, কখনো কখনো দেখা এসেছে অর্থবছরের একদম শেষ সময়ে - খুব অল্প সময়ে তা সেই বরাদ্দটুকু খরচ করে ফেলার একটা তাগিদ সহকারে- এবং এভাবেই হাতে তুলে দেয়া হয়েছে দুর্নীতির সুযোগ। আর এই অনিশ্চয়তার মাঝে পড়ে সে সময় থেকে শুরু হয় বাপেক্সের দক্ষ লোকদের বাইরে চলে যাওয়া।
সকলের হতাশা আরো বাড়িয়ে যখন ৯০ এর দশক জুড়ে ব্লকগুলো একের পর এক বিদেশী কোম্পানিদের হাতে তুলে দেয়া হয়- তখন বুঝা যায় বাপেক্সকে এমন ঠুটো জগন্নাথ বানানোর প্রচেস্টার মূল উদ্দেশ্য।
এর মধ্যে অবশ্য বাপেক্সকে একটু সাবলম্বী করার চেষ্টাও হয়। ১৯৯৪ সালে গ্যাস বাজারজাতে নিয়োজিত কোম্পানীগুলোর আয়ের ২% বাপেক্সকে দেয়ার বিধান হয়। কিন্তু সেটা অপ্রতুল বিবেচনায় বাপেক্সকে প্রোডাকশনের কাজও দেয়া হয়। কিন্তু সেই গ্যাস উৎপাদনে নামতে নামতে এরই মধ্যে পেরিয়ে গয়েছে ১১ টি বছর- ২০০০ সাল থেকে বাপেক্স গ্যাস উৎপাদন শুরু করে (৪)।
এর মধ্যে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়েই গিয়েছে!
পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের এই ইতিহাস আলোচনা করে রাখার উদ্দেশ্য, এই প্রেক্ষাপট আমাদের মনে রাখার দরকার। বাপেক্স/পেট্রোবাংলা কি করতে পেরেছে, সেই আলোচনায় যাবার আগে- আরো দু একটি এদের সাথে কেমন আচরণ করা হয়েছে ও এখনও হচ্ছে- তার কিছু চিত্র দেখে নেয়া যাক।
অপারেশন ক্যাপাবিলিটি স্ট্রেনদেনিং প্রকল্প (৫)
এই বাহারি নামের প্রকল্পটি আসলে বাপেক্সের জন্য অত্যাবশ্যক হওয়া একটা রিগ কেনার প্রকল্পের নাম। মান্ধাতার আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করে বাপেক্স- এটা আজ আমরা সকলেই জানি। এটার সমাধান যে নতুন যন্ত্র কেনা- পুরাতন জীর্ণ শীর্ণ যন্ত্র মেরামত করা, সেটা কারো মনে থাকে না বা বলা হয় না: উল্টো এটাই হয়ে যায় বিদেশীদের হাতে গ্যাসক্ষেত্রগুলো তুলে দেয়ার মোক্ষম যুক্তি!
১৯৯৮ সালেই বাপেক্স অনুভব করেছে তার একটি নতুন রিগ দরকার।
সে সময়েই এটা বাপেক্স বোর্ড কর্ত্বক অনুমোদিতও হয়। তারপরে ১৯৯৯ সালে পেট্রোবাংলা বোর্ডও এটা অনুমোদন করে, একই বছরে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগও অনুমোদন করে। কিন্তু সেটা একনেক এ পাশ হতে সময় লাগে আরো ৪টি বছর, ২০০৩ সালে। এখানেই গল্পের শেষ নয়, বলা যায় শুরু। একনেকে ৮১ কোটি টাকা অনুমোদিত হলেও দেখা গেল ততদিনে রিগের আন্তর্জাতিক বাজারদর অনেক বেড়েছে এবং দরপত্রে অংশ নেয়া সর্বনিম্ন দাম ৩১% বেশী, অর্থাৎ ১০৬ কোটি টাকা।
ফলে টেণ্ডার বাতিল হয়ে যায় এবং আবার সেটা দাম পুনর্মূল্যায়নের জন্য পাঠানো হয়। ১ম সংশোধিত বাজেট (১৪২ কোটি টাকা) আবার একনেক এ অনুমোদিত হতে হতে পার হয়ে যায় ২০০৬ সাল, এবং যথারীতি এবারেও আমরা টেণ্ডার মিস করি। এভাবে আরো কয়েকবার দরপত্র আহবান করে ও বাতিল করে অবশেষে পঞ্চমবারে ২৫৬ কোটি টাকা সংশোধিত বাজেট সহ ২০০৮ সালের নভেম্বরে দরপত্র আহবান করা হয় এবং ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে একটি চাইনিজ কোম্পানির সাথে চুক্তি সম্পাদিত হয়। রিগটি দেশে এসে অপারেশনে যাওয়ার কথা ২০১১ সাল।
৯৮ সালেই বর্তমান রিগগুলো (৩ টি রিগ) জীর্ণ-শীর্ণ হয়ে যাওয়ার পরেও এখন পর্যন্ত সেগুলোই বাপেক্সের সম্বল!
এক্সপ্লোরেশন এণ্ড প্রোডাকশন ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অব বাপেক্স প্রকল্প (৭)
এটা আরেকটি বাহারি নামের প্রকল্প, শুনলেই মনে হয় বাপেক্সকে নিয়ে যেনবা কতই না সকলের আগ্রহ- একে আধুনিক ও দক্ষ প্রতিষ্ঠান বানাতে সকলের কতই না উদ্যোগ! অথচ একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে- এখানেও মজার একটি খেলা আছে।
প্রকল্পের নাম বাপেক্সের ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, কিন্তু একনেক এ অনুমোদিত প্রকল্প বরাদ্দ পুরোটাই কেবল বাপেক্সের জন্য নয়, পেট্রাবাংলারই আরেক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিজিএসএল। বাখরাবাদ গ্যাস সাপ্লাই লি ৬৫ কি:মি: পাইপ লাইন বসাবে- সেই প্রকল্পের নাম কেমন করে বাপেক্সের ক্যাপাসিটি বিল্ডিং হতে পারে। ফলে- এটা অন্তত পরিষ্কার যে- এই প্রকল্পের জন্য অনুমোদিত ৩৪০ কোটি টাকার পুরোটা বাপেক্সের জন্য নয়। বাপেক্সের অংশ হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা।
তো খুব ভালো, এই ২০০ কোটি টাকাতেও বাপেক্সে সিসমিক ডাটা একুইজিশন সিস্টেম কিনতে পারবে, একটি ওয়ার্ক ওভার রিগ কিনতে পারবে, অনুসন্ধান সাপোর্ট ইকুয়েপমেন্ট কিনতে পারবে, দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ট্রেনিং এর আয়োজন করা যাবে।
খুবই ভালো, এগুলোই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হিসাবে বলা হয়েছে। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে- প্রকল্পের বাস্তবায়নকাল জুলাই ২০০৮ থেকে জুন ২০১১ সাল পর্যন্ত ধরা হলেও জুন ২০০৯ সাল পর্যন্ত বরাদ্দ এসেছে মাত্র ৪৫ লক্ষ টাকা (বাপেক্স ও বাখরাবাদ অংশ মিলিতভাবে)।
শ্রীকাইল প্রকল্প
২০০৪ সালে বাপেক্সের খনন করা এই অনুসন্ধান কূপটি পেট্রোবাংলার ওয়েবসাইটে দেয়া তালিকায় গ্যাস আবিষ্কার হিসাবে দেখানো হয়েছে। অথচ, অন্য সমস্ত জায়গায় বাপেক্স-পেট্রোবাংলার আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা বলা হয় ৮ টি, যেখানে শ্রীকাইল গ্যাসক্ষেত্রের কোন নাম গন্ধই মেলে না। এখনই অবাক হবেন না, বা মনে করবেন না যে দুটি তথ্যের কোন একটি ভুল।
আসলে দুটিই সত্য। শ্রীকাইল কূপটি খনন করে সেখানে গ্যাস পাওয়ার সমস্ত অনুষঙ্গ মিলেছিল বলেই সেটাকে গ্যাস আবিষ্কার ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিল পেট্রোবাংলা। কিন্তু পরবর্তীতে কূপ দিয়ে পানি আসায় সেটাকে বাতিল করা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে গ্যাস পাওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়ার পরেও সেখানে এখন পর্যন্ত বাপেক্স পরবর্তী কূপ খননের জন্য কোন উদ্যোগ নেয়নি এবং সেটাকে গ্যাসক্ষেত্র হিসাবে ঘোষণাও করা হয়নি।
মূল কারণটা আসলে অন্যত্র।
এই শ্রীকাইল ক্ষেত্রটি টাল্লোর একটি গ্যাসক্ষেত্র বাঙ্গোরার খুব কাছে, এবং কথিত আছে শ্রীকাইল ও বাঙ্গোরা নাকি একই গ্যাসক্ষেত্রের অন্তর্গত। সুতরাং কি আর করা! বাপেক্সের কাজই বন্ধ হয়ে যায়। আরেকটি অভিযোগের কথা শোনা যায়, সেটা হচ্ছে বাপেক্সের জিওলজিস্টরা কূপটি খননের জন্য ঠিক যে জায়গা চিহ্নিত করেছিল- সেখানে নাকি কূপটি খনন করা হয়নি!
আরো কিছু প্রকল্পের অনুমোদিত বরাদ্দ
মোবারকপুর, কাপাসিয়া, সুন্দলপুরে অনুসন্ধান কুপ খনন প্রকল্পগুলোর ঘটনাগুলোও একই রকম। একটি বললেই বাকিগুলোর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। ২০০১ সালে বাপেক্স বোর্ড মোবারকপুর প্রকল্প অনুমোদন করে পেট্রোবাংলায় পাঠায়, পেট্রোবাংলা এবং জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ বিভাগও একই বছরে অনুমোদন করে।
তারপরে একনেক এ অনুমোদন পেতে পাতে ২০০৬ সাল। ৫৬ কোটি বরাদ্দ ধরা হয়, বাস্তবায়নকাল জানুয়ারি ২০০৬ থেকে জুন ২০০৯। খুবই মজার বিষয় হচ্ছে এ পর্যন্ত বরাদ্দ এসেছে ৩ কোটি ১১ লাখ টাকা (৭)!
আর বেশী চিত্র তুলে ধরার দরকার নেই- এরই মধ্যে আমাদের সামনে সমস্তকিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। কারণটা নাহয় বুঝা গেল- কেন বাপেক্সের এই অবস্থা। কিন্তু তাই বলে কি স্বীকার করে নিব যে বাপেক্স কিছুই করতে পারেনি? না- সেটাও স্বীকার করা যাচ্ছে না।
বাপেক্সের প্রতি এমন আচরণের পরেও- বাপেক্স তার ভাঙ্গা-জীর্ণ-শীর্ণ যন্ত্রপাতি দিয়েই অনেক কিছু করেছে। তাহলে এবার সেটা দেখা যাক:
বাপেক্স কি কি করেছে:
প্রথমে ১৯৮৯ সালে বাপেক্স সৃষ্টির পরে থেকেই এর কাজগুলো দেখি।
বাপেক্স গঠনের পর থেকে ১৯৮৯ পরবর্তী সময়ে বিদেশী কোম্পানি ১৭ টা অনুসন্ধান কূপ খনন করে, বেশ কিছু গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে (যেগুলোর সাম্ভাব্যতা আগেই পেট্রোবাংলা/বাপেক্স বের করেছিল), দুটো গ্যাসক্ষেত্র ধ্বংস করে ফেলে- আর এর বিপরীত বাপেক্সকে দেয়া হয় মাত্র হাতে গোনা কয়টি ক্ষেত্র, তার মধ্যেও বাপেক্স সালদানদী, শাহবাজপুর ও শ্রীকাইলে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। অনুসন্ধান কুপ খনন করে ৪ টি, যার ৩ টিতেই গ্যাস মিলে। অর্থাৎ সাফল্যের হার ১.৩৩:১ (৮)।
এর বাইরেও এ সময়ে বাপেক্স কিছু গুরুত্বপূর্ণ(!) কাজ করে। নাইকোর একটা কুপ (ফেনী-২) খনন করে দেয়, টাল্লোর হয়ে লালমাই ও বাঙ্গোরায় Well cellar survey'র কাজ করে, চাঁদপুরে Control Point ই স্থাপন করে দেয় (৯)। বাঙ্গোরায় টাল্লোর একটা কুপও (ওয়ার্ক ওভার) খনন করে দেয়। তারপরেও বলা হবে- বাপেক্স কি করেছে? আসলেই তো - বাপেক্স কি করেছে? ফেনী-২ কুপ খনন করে দিলেও তো সেটা বাপেক্সের কিছু না, টাল্লোর লালমাই-বাঙ্গোরা-চাঁদপুর তো আর বাপেক্সের নয়। এমনকি পেট্রোবাংলার আরেক সেলফ ফাইনান্সিং গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান BGFCL এর হবিগঞ্জ-৯ কুপ খনন করে দিলেও সেটা বাপেক্সের কিছু করা নয় (সেলফ ফাইনান্সিং BGFCL হবিগঞ্জ-৯ এর গ্যাস উত্তোলন ও বিক্রয় করে মুনাফা করতে পারলেও- ঐ কুপ খননের জন্য বাপেক্সকে সরকারের বরাদ্দের দিকে থাকতে হয় দীর্ঘ প্রতীক্ষায়!!)।
এখানে একটা হিসাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। বাঙ্গোরায় টাল্লোর ওয়ার্ক ওভার কুপটি খননের জন্য বাপেক্স নেয় ১০ লাখ ডলার, যদিও বাপেক্সের খরচ হয় মাত্র ৫৩ লাখ টাকা। এরকম লাভে সাবকন্ট্রাক্টর হিসাবে কাজ করতে পারার ক্ষমতায় আমরা বহুত খুশী, কিন্তু যখন দেখি ঐ ১০ লাখ ডলার তো ঠিকই টাল্লো তার রিকভারি কস্টের মধ্যে দেখিয়ে আমাদের কাছ থেকেই আদায় করে নেয়, যখন ভাবি ঐ গ্যাসক্ষেত্র যদি বাপেক্সের হাতে থাকতো- তবে ১০ লাখ ডলারের বদলে ৫৩ লাখ টাকায় কাজটি করে ফেলতে পারতাম- এমনি করে সম্পূর্ণ প্রজেক্টই আমরা কত সহজে ও কম খরচে সমাধা করতে পারতাম- তখন কি আমাদের একটুও আফসোস হবে না?
বাপেক্স কি কি করেনি
বাপেক্স আমাদের দেশের একমাত্র গ্যাস অনুসন্ধানকারী প্রতিষ্ঠান, ফলে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজই এর কাছ থেকে কাম্য। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সেই কাজটি বাপেক্স ঠিকভাবে করেনি। করেনি না বলে বলা দরকার করতে পারেনি- করতে দেয়া হয়নি।
আজ দেশে গ্যাস সংকটের কথা জোরেশোরে বলা হচ্ছে, গ্যাসের অভাবে সার কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যহত হচ্ছে, সাধের বিনিয়োগও নাকি হচ্ছে না। এ মুহুর্তে গ্যাসের ঘাটতি দৈনিক ২৫০মিলিয়ন কিউবিক ফুট, তারচেয়েও বড় সমস্যা আগামিতে আমাদের গ্যাসের মজুদ, আসলেই আমাদের জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চয়তার মুখে। অথচ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখনও প্রাথমিক অনুসন্ধানের কাজ শুরু করা হয়নি। গ্যাস সংকটের কথা বলে বিদেশীদের হাতে সমুদ্রব্লকগুলো দিয়ে দেয়ার আয়োজন হয়- কিন্তু বাপেক্সকে নিয়ে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয় না। বাপেক্স গঠনের পর থেকে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয় মাত্র ৪ টি, অথচ এসময়ে আইওসি অনুসন্ধান কূপ খনন করেছে ১৭ টি।
১৯৯৬ সালের পর থেকে গত ১৩ বছরে বাপেক্স কূপ খনন করেছে মাত্র ১ টি!
পেট্রোবাংলা/বাপেক্স কি করেছে?
ওজিডিসি, পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স এ পর্যন্ত ১৮ টি অনুসন্ধান কুপ খনন করে ৮ টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে (১০)। সাফল্যের হার ২.২৫:১। যা বাংলাদেশ কর্মরত বিদেশী কোম্পানীর সাফল্যের হারের চেয়ে ভালো। ১৯১০ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশী বিদেশী কোম্পানি মিলে অনুসন্ধান কুপ খনন করেছে ৭৫ টি যার মধ্যে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে ২৫ টি (১১)। সাফল্যের হার ৩:১।
এর বিপরীতে মাগুরছড়া ও টেংরাটিলার মত কোন দুর্ঘটনার উদাহরণ পেট্রোবাংলা/ বাপেক্সের নেই। সাংগু গ্যাস ফিল্ডের মত তড়িঘড়ি করে ক্যাপাসিটির বেশী গ্যাস উত্তোলন করতে গিয়ে রিকাভরেবল গ্যাস উত্তোলনের অনেক আগেই গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদনক্ষমতা নষ্ট করার ঘটনা পেট্রোবাংলা/বাপেক্সের নেই।
পেট্রোবাংলা নিয়মিতভাবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে অর্থ যোগান দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ১ হাজার ২শ কোটি টাকা, সেখানে ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে এর পরিমাণ ৩১৫০ কোটি টাকা এবং ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে এর পরিমাণ ৩৩৪৯ কোটি টাকা(১২), যার মধ্যে বাপেক্স দিয়েছে ৮২ কোটি টাকা (সবচেয়ে বেশী দিয়েছে বিজিএফসিএল- ১৪৩১ কোটি টাকা)। পেট্রোবাংলার গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সরকারকে প্রতি হাজার কিউবিক ফুট গ্যাস মাত্র ২৫ টাকায় দিতে পারে (মুনাফা রেখেই) - যেখানে বিদেশী কোম্পানির কাছ থেকে কিনতে খরচ হয় ২৫০ টাকা।
এমন চরম দুর্দশার মধ্যেও এই সাফল্যগুলোকে কি বলা যাবে?
আমাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে- এদের লোকবলের দক্ষতা নিয়ে কি আমরা গর্ববোধ করতে পারি না?
বাপেক্সকে শক্তিশালী করার জন্য আমাদের দাবী সমূহ:এটা খুবই পরিষ্কার বাপেক্সের যে- আজ যেমন দশা, যত সংকট তা সম্পূর্ণভাবে আরোপিত, শাসক গোষ্ঠীর তৈরী। আমাদের দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার তাগিদেই আমাদের বাপেক্স ও পেট্রোবাংলাকে খুব সিরিয়াসলি দৃষ্টি দেয়া আবশ্যক হয়ে পড়েছে। সুতরাং বাপেক্সকে শক্তিশালী করা, একে আরো অনেক বেশী করে কার্যকর করে তোলা এখন সময়ের দাবি। এ লক্ষে আমাদের দাবিগুলো হচ্ছে:
১। ভবিষ্যতে দেশের অভ্যন্তরে এবং উপকূলে অবস্থিত ব্লকসমূহে অনুসন্ধান ও উৎপাদন কাজ শুধুমাত্র বাপেক্সের উপর ন্যাস্ত করতে হবে।
সকল পিএসসি বাতিল করতে হবে।
২। বাপেক্সকে আরও দক্ষ ও শক্তিশালী করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহন করতে হবে যেন স্থল ভাগের মতো গভীর সমুদ্রেও দেশীয় কোম্পানীগুলো নিজেরাই তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলণ কার্য চালাতে পারে। মধ্যবর্তী সময়টুকুতে একটি বা দুটি ব্লক থেকে কাজ চালানোর মতো গ্যাস উত্তোলণের জন্য বাপেক্সের কর্তৃত্ত্বাধীনে দেশী-বিদেশী কন্ট্রাক্টর ও যন্ত্রপাতি ভাড়া করা যেতে
৩। বাপেক্সের জন্য প্রয়োজনীয় রিগ ও অন্যান্য সরঞ্জাম অবিলম্বে সরবরাহ করতে হবে।
৪। বাপেক্সের কারিগরি জনবলের দক্ষতা বৃদ্ধির নিমিত্তে দেশ-বিদেশে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা করতে হবে। কারিগরি জনবলকে উপযুক্ত মর্যাদা ও গুরুত্ব দিতে হবে।
৫। বাজেটে বাপেক্সের জন্য পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দিতে করতে হবে।
এই বরাদ্দ একনেক এ অনুমোদন ও বাপেক্সকে প্রদানে অহেতুক সময় ক্ষেপন বন্ধ করতে হবে। বাপেক্স ও পেট্রোবাংলা তথা পেট্রোবাংলার প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে প্রাপ্ত রাজস্ব আয় সরাসরি বাপেক্স ও পেট্রোবাংলার অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন প্রকল্পে সরাসরি বরাদ্দ করার সুযোগ দিতে হবে।
৬। মূল সংস্থা পেট্রোবাংলাকে দক্ষ ও শক্তিশালী করতে হবে।
৭।
গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন নিয়ে সরকারের একটি সুনির্দিষ্ট ও সুদুরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকতে হবে। বাপেক্সের অধীনে সমস্ত বাংলাদেশে জিওলজিকল সার্ভে কাজ সম্পন্ন করার একটা লক্ষমাত্রা ঠিক করতে হবে, বাপেক্সকে দিয়ে বছরে কতটি অনুসন্ধান কূপ খনন করানো হবে- তারও একটি লক্ষমাত্রা ঠিক করতে হবে। এ লক্ষমত্রা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় রিগ, যন্ত্রপাতি কিনতে হবে- অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে, লোকবল নিয়োগ ও তাদের দক্ষতা বাড়িয়ে তুলতে হবে।
তথ্যসূত্র:
১। Click This Link
এবং http://www.petrobangla.org.bd/corp_history.php
২।
Click This Link
৩। ঐ
৪। ঐ
৫। মাসিক অগ্রগতির প্রতিবেদন জুন ২০০৯, বাপেক্স ; পৃষ্ঠা: ০৩
এবং http://www.bapex.com.bd/more-2.html
৬। মাসিক অগ্রগতির প্রতিবেদন জুন ২০০৯, বাপেক্স; পৃষ্ঠা: ০৯-১০
7. ঐ; পৃষ্ঠা: ০৪
৮।
Click This Link
৯। http://www.bapex.com.bd/achievement.html
১০। Click This Link
১১। Click This Link
১২ Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।