আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কবি কনস্টানটাইন কাভাফি: তাঁর জীবন, তাঁর কবিতা ...

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
কনস্টানটাইন কাভাফি: (১৮৬৩-১৯৩৩) আধুনিক গ্রিক কবি। পেশায় অবশ্য ছিলেন সাংবাদিক ও সরকারি চাকুরে। কাভাফি তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ন কবিতাগুলি লিখেছেন চল্লিশ বছর বয়েসের পর।

জীবদ্দশায় গ্রন্থ ছাপানোর আগ্রহ কাভাফির ছিল না- অথচ এঁকেই এখন ইউরোপীয় সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ মনে করা হচ্ছে। এতোদিন এলিয়ট ও এজরা পাউন্ডকে ইউরোপীয় সাহিত্যে আধুনিকতার পথিকৃৎ মনে মনে করা হলেও এখন দেখা যাচ্ছে এলিয়ট ও এজরা পাউন্ডের চিন্তাচেতনার ওপর কাভাফির প্রভাব ছিল অপরিমেয় ... মিশরের বন্দর নগরী আলেকজান্দ্রিয়া। সেই আলেকজান্দ্রিয়া নগরেই ১৮৬৩ সালের ২৯ এপ্রিল এক গ্রিক পরিবারে কাভাফির জন্ম। পরিবারটির শিকড় প্রোথিত ছিল তুরস্কের ইস্তানবুল (কনসটানটিনেপল) নগরে। কাভাফির পিতা ছিলেন একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী এবং বসবাসের সূত্রে ইংল্যান্ডের নাগরিক।

১৮৭০ সালে তিনি মারা যান। এরপর পরিবারসমেত কাভাফি কিছুকাল ইংল্যান্ডের লিভারপুলে বাস করেন। ওখানেই এক স্কুলে ইংরেজি শেখেন ও ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। অবশ্য ১৮৭৭ সালে অর্থনৈতিক দূরবস্থার কারণে পরিবারটি আলেকজান্দ্রিয়ায় ফিরে আসে । ১৮৮২ সাল।

আলেকজান্দ্রিয়ার পরিস্থিতি হয়ে ওঠে বিক্ষুব্দ । সে সময় কাভাফি তাঁর পরিবারের সঙ্গে সাময়িকভাবে তুরস্কের কনসটানটিনেপল (ইস্তানবুল) শহরে চলে যায়। ঐ বছরই ঔপনিবেশিক ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে মিশরে দানা বাধতে থাকে তীব্র আন্দোলন । মিশর ইঙ্গ-ফরাসি শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। বৃটিশ সৈন্যরা নৌবহর থেকে আলেকজান্দ্রিয়া নগরে বোমা বর্ষন করে।

কাভাফিদের পারিবারিক অ্যাপার্টমেন্টটি ছিল আলেকজান্দ্রিয়া রামলিতে। সেই অ্যাপার্টমেন্টটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ২ ১৮৮৫ সালে কাভাফি আলেকজান্দ্রিয়া ফিরে আসেন। পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া পারিবারিক অ্যাপার্টমেন্টটি দেখে বিমর্ষ বোধ করেন হতাশায় ভোগেন। ‘সেপ্টেম্বর, ১৯০৩’ কবিতায় কাভাফি লিখেছেন- অন্তত আমায় বিভ্রমে থাকতে দাও যেন আমি আমার জীবনের শূন্যতা টের না পাই।

আর আমি অনেকবারই খুব কাছে এসেছি। আর কী হতভম্ভ আমি, কী রকম ভীতু। আমি কেন আমার ঠোঁট বন্ধ করে রেখেছি যখন আমার জীবনের শূন্যতা কাঁদছে আমার ভিতরে আর আমার আকাঙ্খাগুলো রাখা কালো কাপড়ের ওপর? অনেকবারই খুব কাছাকাছি আসা চোখের কাছে, লোভী ঠোঁটের কাছে, আমার স্বপ্নে র ভালোবাসার দেহটির কাছে অনেকবারই খুব কাছাকাছি আসা। অ্যাপার্টমেন্টটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! কি আর করা! সবই নিয়তি। বাঁচার জন্য একটা কিছু করা দরকার।

সাংবাদিকতার কাজ জোটালেন। বৃটিশপরিচালিত একটি সরকারি সংস্থায় চাকরি নিলেন। ওই সংস্থায় চাকরি করেছেন প্রায় তিরিশ বছর। অবসর সময়ে কবিতা লিখতেন। ‘এক রাতে’ কবিতায় লিখেছেন- পুরনো ক্যাফের উপরতলার কক্ষটি ছিল সস্তা আর দূর্গন্ধময়।

জানালার কাছে দাঁড়ালে চোখে পড়ত সংকীর্ণ এঁদো গলি । নিচে থেকে ভেসে আসত লোকজনের কন্ঠস্বর। তাশ খেলছে তারা- সময় কাটাচ্ছে নির্ভার সুখে । ঘরের মাঝখানে ছিল একটি সাদাসিদে খাট। খাটের ওপরে ছিল ছিল তাহার প্রেমের শরীর ও ঠোঁট মাতালের শীৎকারের মতো লোভী গোলাপী ঠোঁট এইরকম শীৎকারের লোভী গোলাপী ঠোঁট এখন- যখন আমি লিখছি, অনেক বছর পর আমার নিঃসঙ্গ ঘরে, আবার মাতাল হই আমি।

কাভাফি কবিতা লিখে কাভাফি ছাপাতেন ব্রডশিটে। বিলি করতেন বন্ধুমহলে । তাঁর কবিতার সমঝদার ছিল আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক কমিউনিটির সাহিত্যবোদ্ধারা। । ১৯০৩ সাল।

ঘটনা নতুন দিকে মোড় নিল। গ্রিক সাহিত্যসমালোচক জেনোপউলস কাভাফির কবিতা নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখে ছাপলেন-এতে করে কাভাফি গ্রিসের মূলভূমির সাহিত্যি-পরিমন্ডলে প্রথমবারের মতো পরিচিতি পেলেন । তবে তখনও তাঁকে নিয়ে তেমন আলোরণ ওঠেনি। তার কারণও আছে। কাভাফির রচনারীতি ও মূল বক্তব্য ছিল তৎকালীন গ্রিক কবিদের চেয়ে অনেকই আলাদা।

একটি উদাহরণ দিই। কাভাফির ‘জানালা’ কবিতাটি পাঠ করা যাক। এইসব ছায়াময় ঘরে যেখানে কেটেছে আমার নিরানন্দ দিন পায়চারী করতে করতে খুঁজেছি জানালা। জানালা খুলে গেলেই তো শান্ত্বনা। অথচ, জানলাগুলি সব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কিংবা আমি খুঁজে পাচ্ছি না।

অথবা খুঁজে না-পেলেই ভালো হয়। সম্ভবত আলো বয়ে আনবে নতুন স্বৈরাচার। কে জানে কোন্ নতুন বিষয় আলোয় প্রকাশিত হবে! এমন নিপাট সংশয় ওই সময়কার গ্রিক কবিতায় ছিল না। এ কারণেই বলছিলাম গ্রিক সাহিত্যসমালোচক জেনোপউলস কাভাফির কবিতা গ্রিসের মূলভূমির সাহিত্যি পরিমন্ডলে পরিচিতি করে তুললেও তাঁকে নিয়ে তখনও তেমন আলোরণ ওঠেনি। কথা আরও আছে।

কবিতায় এরুপ প্রাগাঢ় নৈরাশ্যধ্বনির জন্যই আমি শুরুতে বলছিলাম যে- অথচ এঁকেই এখন ইউরোপের আধুনিকতার পথিকৃৎ মনে করা হচ্ছে। এতোদিন এলিয়ট ও এজরা পাউন্ডকে ইউরোপের আধুনিকতার পথিকৃৎ মনে করা হত। এখন দেখা যাচ্ছে এলিয়ট ও এজরা পাউন্ড এর ওপর কাভাফি প্রভাব ছিল অপরিমেয় ...এবং নৈরাশ্যবাদের সঙ্গে দার্শনিকতা ও ইতিহাস চেতনা কাভাফির কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য। । ‘মানুয়েল কমমিনোস’ কবিতায় কাভাফি লিখেছেন- সেপ্টেম্বরের এক বিষন্ন দিনে সম্রাট মানুয়েল কমমিনোস-এর মনে হলো মৃত্যু নিকটে।

বেতনভোগী জ্যোতিষীরা বসল হিসেবে-সম্রাট আর কদ্দিন বাঁচেন। এইসব বাকবিতন্ডার মাঝে সম্রাটের মনে পড়ে গেল প্রাচীন এক ধর্মীয় প্রথার কথা । তিনি মঠ থেকে স্বর্গীয় পোশাকটি আনার নির্দেশ দিলেন। সম্রাট স্বর্গীয় পোশাকটি পরলেন; তাঁকে সাধুর মতন দেখাচ্ছিল। আসলে যারা বিশ্বাস করে তারাই সুখি।

এবং সম্রাট মানুয়েল কমমিনোস-এর মতো বিশ্বাসের পোশাক পরে তারা পৃথিবী ত্যাগ করে। কাভাফি গ্রিকসাহিত্যে পূজনীয় হয়ে উঠেছিলেন আরও পরে। ১৯২২ সালে গ্রিকরা তুর্কিদের কাছে পরাজিত হয়। এর পর গ্রিক সাহিত্য হয়ে ওঠে নৈরাশ্যপ্রবন। গ্রিক নৈরাশ্যবাদী কবিরা কাভাফির লেখায় শান্ত্বনা খুঁজে পায়।

বৃটিশ ঔপন্যাসিক ই এম ফস্টার ব্যাক্তিগতভাবে কাভাফিকে চিনতেন। ইউরোপীয় পাঠকের কাছে তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। কাভাফির লেখায় ইতিহাসচেতনা, দার্শনিকতা, নৈরাশ্য ও আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি বারবার ফিরে এসেছে। বৃদ্ধ বয়সের ভাবনাও স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতায়। ‘বুড়ো মানুষ’ কবিতায় কাভাফি লিখেছেন- পিছনে, ক্যাফের গুঞ্জনের ভিতর, একা, টেবিলের ওপর মাথা রেখে বৃদ্ধটি বসে রয়েছে।

সামনে তার খবরের কাগজ। বয়েসের ভারে কাতর, সে কি যৌবনের ঝলমলে দিনগুলির কথা ভাবছে। যখন সে ছিল সুদর্শন, বুদ্ধিমান আর চতুর। সে জানে সে এখন বৃদ্ধ হয়েছে। সে অনুভব করছে, সে দেখছে, এখন স্বপ্নের মতো মনে হয়-সেইসব দিন।

গতকাল। কী দ্রুত, কী দ্রুত গেল মিলিয়ে ... এখন সে জানে স্বাধীন ইচ্ছেরা কী ভাবে তাকে করেছে প্রতারিত । কী ভাবে নির্বোধ সে মিথ্যাবাদীকে দিয়েছে প্রশয় - ‘আগামীকাল । প্রচুর সময় আছে। কোনও একদিন ...’ এখন সে মনে করছে- ঝোঁকগুলি কীভাবে দমন করেছিল কী ভারে উৎসর্গ করেছিল আনন্দকে ।

প্রতিটি হারিয়ে ফেলা সুযোগ এখন তার অসার মস্তিস্ককে করছে উপহাস । এইসব স্মৃতি বিমর্ষ করে তোলে বুড়োকে সে ঘুমিয়ে পড়ে, গুঞ্জনময় ক্যাফেতে টেবিলের ওপর তার মাথা । ২৯ এপ্রিল, ১৯৩৩ ছিল কাভাফির ৭০তম জন্মদিন। ঐ দিনই কাভাফি মারা যান। ক্যান্সারে।

মৃত্যুর পর বিশ্বময় আরও বিখ্যাত হয়ে ওঠেন কাভাফি। একদিন যিনি ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া নগরের প্রায় অচেনা এক নাগরিক কবি- তাঁর কবিতাই এখন গ্রিস ও সাইপ্রাসের বিদ্যালয়ে পাঠ্য। কাভাফি ঘরের মাঝখানে ছিল একটি সাদাসিদে খাট। খাটের ওপরে ছিল ছিল তাহার প্রেমের শরীর ও ঠোঁট মাতালের শীৎকারের মতো লোভী গোলাপী ঠোঁট এইরকম শীৎকারের লোভী গোলাপী ঠোঁট এখন- যখন আমি লিখছি, অনেক বছর পর আমার নিঃসঙ্গ ঘরে, আবার মাতাল হই আমি।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।