মহলদার
আপনি নিশ্চয় শাপলা চেনেন, কিন্তু ঢ্যাঁপ কি চেনেন, ঢ্যাঁপ? হ্যাঁ, আপনার দূর্দান্ত সেই কৈশোরের দিনগুলো যদি গ্রামে কেটে থাকে তাহলে আমি নিশ্চিত আপনি ঢ্যাঁপও চেনেন। গ্রামে যার শৈশব কেটেছে সে আবার ঢ্যাঁপ চেনেনা এটা হতেই পারে না। আর যদি আপনি নগর জীবনে বড় হয়ে থাকেন তাহলে হয়ত বলবেন ঢ্যাঁপ কি হে বাহে? অথবা এও বলতে পারেন, ও হ্যাঁ, ঢ্যাঁপের কথা শুনেছি। যাই হোক, সহজ ভাষায় ঢ্যাঁপ হচ্ছে শাপলার ফল। শাপলার ফুল শুকিয়ে গেলে ফুলের গোড়ার অংশটিই বড় হয়ে ফলের মত হয়।
এটিই ঢ্যাঁপ। এই ঢ্যাঁপ নিয়ে কত স্মৃতিই যে আছে সেই ছোট বেলার!
আজ কিছু তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে যেতে হয়েছিল একটি হাওরের মধ্যে (আমার বর্তমান জবের একটি রুটিন ওয়ার্ক যেটা আমি এনজয় করি সবচেয়ে বেশী) আর তখন চোখে পড়ল ঢ্যাঁপ। ফিরে গেলাম যেন সেই শৈশবে। ছোট বেলায় দেখেছি শাপলা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে বিল। শরতের সকালে, বিলে গেছি বাবার সাথে মাছ ধরতে, যতদুর চোখ যায় শুধু শাপলা আর শাপলা.... সাদা শাপলা, বেগুনী শাপলা।
খুব সকালে বিলে শাপলা ফুলের কি সুন্দর ঘ্রাণ, হালকা কুয়াশা, মৌমাছি শাপলা ফুলে ফুলে ঘুরছে (তখন এসব দৃশ্য কিছুই মনে হত না, এখন আফসোসে হা পিত্যেস করি ওই সব স্মৃতি মন্থন করে)। নৌকা চলছে, আমি হাত দিয়ে টেনে ধরছি শাপলা, উঠে আসছে। বাবা নিষেধ করছে। বাবার মাছ ধরা শেষে তুলে নিয়েছি কিছু ঢ্যাঁপ। বাড়ি এনে ওগুলো দিয়েছি বুড়ি মাকে (দাদীকে)।
ঢ্যাঁপ থেকে মুড়ি বানানোর দায়িত্ব ছিল তার। তবে বানানোর কারিগরী বিষয়গুলো আমার আজো মনে আছে। ঢ্যাঁপ এর ভেতর থাকে ছোট ছোট কালো রংয়ের বীজ (ঢ্যাঁপ কচি থাকলে বীজ গুলোর রং থাকে লাল)। ওগুলো বের করে ছাই দিয়ে ঘষে বীজের গায়ের পিচ্ছিল আস্তরন ছাড়ানো হত। এরপর ও গুলো শুকানো হত রোদে।
ঠিকমত শুকিয়ে গেলে চাল থেকে যেভাবে মুড়ি বানানো হয় ঠিক সেভাবেই ওই বীজগুলো দিয়ে বানানো হত ঢ্যাঁপের মুড়ি। মুড়ির সাথে খেঁজুরের গুড় মেখে বানানো হতো মোয়া, ঢ্যাঁপের মোয়া! আহ্ আর কি পাব ওই সব!
আমরা ঢ্যাঁপের মুড়ি খেতাম শখ করে। কিন্তু বাবা ও বুড়িমার কাছে গল্প শুনেছি অনেক গরীব পরিবার যারা চাল কিনতে পারত না তারা ঢ্যাঁপের ভাত রান্না করে খেত, শাপলা সেদ্ধ করে খেত। তখন শাপলা বাজারে বিক্রি হত না। তবে আরো কয়েক বছর পর, যখন শাপলা বাজারে বিক্রি হত তখন শাপলা বিক্রি করে সংসার চালাতে দেখেছি অনেক পরিবার কে।
নিজেদের বাড়িতে ভাজি খাওয়ার জন্য আমিও বিলে শাপলা তুলতে গেছি কতবার তার ইয়ত্তা নেই। কোথায় সেই শাপলা, কোথায় সেই ঢ্যাঁপ! আজ খোদ হাওড়ের মাঝে গিয়েও চোখে পড়ল সামান্য কিছু শাপলা। তাও যেন খুব জরাজীর্ণ চেহারা ওদের। মাঝিকে জিজ্ঞেস করলাম শাপলা নেই কেন হাওড়ে? উত্তরটা তারও জানা নেই। আসল ঘটনা হল আমরা নষ্ট করে ফেলছি আমাদের ইকোলজি।
প্রকৃতির উপর আমাদের অযাচিত অত্যাচারে হারাতে বসেছে অনেক উদ্ভিদ, প্রাণীকূল। আমি শাপলা ভাজি, ঢ্যাঁপের মোয়া খেয়েছি, আমার সন্তান হয়ত শুধু ছবিতেই দেখবে বাংলাদেশের জাতীয় ফুল শাপলা।
ফেরার পথে মাঝিও তার ছোটবেলার ঢ্যাঁপের মুড়ি খাওয়ার গল্প শোনাল। জানতে পারলাম এখনো নাকি হাটবারে কেউ কেউ ঢাঁপের মুড়ির মোয়া বানিয়ে বিক্রি করতে আসে। ইচ্ছে আছে মাঝে মাঝে হাটবারের দিন খুঁজতে যাব ঢ্যাপের মোয়া।
পেলে তখন ছবি সহ পোষ্ট দেওয়া যাবে আর একটা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।