ল্যাজে যদি তোর লেগেছে আগুন স্বর্ণলংকা পোড়া
গত কয়েক মাস পাউলো কোয়েলোর বই ছাড়া আর কোন গল্পের বই তেমন পড়িনি। মনে হচ্ছে সবগুলো পড়া শেষ না করে অন্য কারো বই পড়া হবে না। মাঝে মাঝেই এমন হয়। এর আগে যেমন হঠাৎ এরিক সেগালের সবগুলো লেখা পড়লাম একটানা, তার আগে সিডনি শেল্ডন, তার আগে ড্যান ব্রাউন। এর মাঝে শরদিন্দুর সব লেখা।
মোট কথা পাঠক হিসাবে আমার কিছুটা উন্নতি হচ্ছে। এতে আমি খুশি। সেটা বিষয় না।
কোয়েলোকে বা তাঁর লেখা নিয়ে কিছু বলতে বসেছি। (আগে একটা পোস্টে কিছু বই শেয়ার করেছিলাম )
আমার গল্পটা সংক্ষিপ্ত।
হঠাৎ একজনের মুগ্ধতা দেখে কোয়েলোর বেশ কিছু বই কিনেছিলাম। বইগুলো পড়ে ছিল। পড়ার সময় পাচ্ছিলাম না। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বই নিয়ে বের হতাম। ট্রাফিক জ্যামে আটকা পড়ার সময়টুক সহনীয় করতে।
লাইক দ্য ফ্লোয়িং রিভার বইয়ের ছোট ছোট গল্পগুলো বেশ লাগছিল।
আব্বু যখন হাসপাতালে তখনো অস্থিরতা বা টেনশন কাটাতে পকেটে রাখা বইটার আশ্রয় নিয়েছিলাম। আব্বুকে যখন দাদুর কাছে শুইয়ে রেখে আসতে গ্রামে গেলাম, গাড়িতে যেতে যেতে সবকিছু ভুলে থাকতে সেই বইটাই পড়ছিলাম।
কী অদ্ভুত যোগাযোগ! তখন গাড়িতে যেতে যেতে পড়ছিলাম সেই ইহুদি দম্পতির গল্প। গল্পটা বললে পাঠক বুঝবেন কেন বললাম অদ্ভুত যোগাযোগ।
এক ইহুদি রাব্বি একবার তাঁর স্ত্রী আর দুই ছেলেকে বাড়িতে রেখে ধর্মপ্রচারের জন্য দূরে কোথাও গিয়েছিলেন। তাঁর স্ত্রীও ছিলেন খুব ধার্মিক। হঠাৎ এক সড়ক দুর্ঘটনায় তাদের ছেলে দুটি মারা গেল। ছেলে হারানোর শোক সেই মা তারঁ অসীম ধৈর্য দিয়ে সহ্য করলেন। কিন্তু তাঁর স্বামীকে কিভাবে এই সংবাদ জানাবেন তাই নিয়ে পড়লেন বিপদে।
ইহুদি রাব্বি ছিলেন হৃদরোগী। স্ত্রীর ভয় ছিল এই সংবাদ তিনি হয়তো সহ্য করতে পারবেন না। কিন্তু মহিলার বিশ্বাস ছিল অসম্ভব দৃঢ়। রাব্বি ফিরে এলেন বেশ কিছুদিন পর। নীরব থমথমে বাড়িতে ঢুকলেন।
ঘরে ঢুকতেই তাঁর স্ত্রী তাঁকে আলিঙ্গন করলেন। কুশলাদি বিনিময় হল। পথশ্রমে ক্লান্ত রাব্বি বারবার ছেলেরা কোথায় জিজ্ঞেস করলে, স্ত্রী বারবার বলতে লাগলেন, 'ওরা আছে আশেপাশেই... হয়তো খেলছে। '
স্ত্রীকে স্পর্শ করেই রাব্বি প্রথমে বুঝেছিলেন কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। তিনি স্নেহভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে জানাতে।
তারপর তাদের মধ্যে এই কথপোকথনটুকু হল-
-'তুমি যখন ছিলে না, তখন একটা ঘটনা ঘটেছে। কেউ একজন আমার কাছে তার খুব মূল্যবান দুটো রত্ন রাখতে দিয়েছিল। আমি সেগুলো আমানত হিসাবে খুব যত্নে রেখেছিলাম। হঠাৎ কী হল। ওইদুটো রত্নের প্রতি আমার লোভ জন্মালো।
এই লোভকে আমি ভাবলাম ভালোবাসা। আস্তে আস্তে লোভ আমাকে আষ্টপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলল। কিছুদিন পর সে এসে যখন আমার কাছে রত্নগুলো ফেরত চাইল, আমি আর দিতে চাইলাম না। বললাম, আমি সেগুলো হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমি রত্নদুটো ফেরত দিতে পারছি না, আবার ফেরত না দিয়ে প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছি।
কি করব আমি?'
-কী বলছ তুমি!!! এটা ঠিক নয়। এটা অধর্ম। তুমি জানো, যা তোমার নয় তার প্রতি লোভ করা পাপ। জেনেশুনে এ তুমি কিভাবে করলে? তুমি আজকে এই মূহুর্তে ওগুলো ফেরত দেবে।
-না, আমি দেব না।
আমি ওগুলোকে ভালবাসি।
-ছিঃ, তুমি জানো না, এই অন্যের সম্পদের প্রতি লোভ কত বড় পাপ?
অনেকক্ষণ রাব্বি বুঝালেন। তাঁর স্ত্রী বারবার কাঁদতে কাঁদতে বললেন তিনি ফেরত দিতে পারবেন না।
রাব্বি বারবার জিজ্ঞেস করলেন কে সে যে এই রত্ন দুটো গচ্ছিত রেখেছিল। তাঁর স্ত্রী বারবার বললেন তিনি বলবেন না সে কে এবং তিনি ফেরত দিবেন না।
অনেক বাদানুবাদের পর মা (মায়ের হৃদয় একটা মিরাকল) মুখ খুললেনঃ
"তিনি ঈশ্বর। তিনি আমার কাছে তাঁর দুটো প্রিয় রত্নকে সন্তান হিসেবে আমানত রেখেছিলেন। ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম, ওরা আসলে ঈশ্বরের সম্পদ। তিনি চাওয়া মাত্র ফেরত দিতে না চাইলে সেটা হবে পাপ। ঈশ্বর ওদেরকে চেয়েছিলেন।
আমি দিতে চাইনি। আজকে তুমি যখন আমাকে বুঝিয়ে দিলে আমার দায়িত্ব ওদেরকে ফিরিয়ে দেওয়া, আমি আমার লোভকে তোমার শক্তি দিয়েই জয় করলাম ওদেরকে আমি ফিরিয়ে দিলাম ওদের মালিকের কাছে। আর কোন দাবি নেই। " স্বামীকে জড়িয়ে ধরে সেই মহান মা ধীরে ধীরে দুর্ঘটনার কথা জানালেন। রাব্বি পরম মমতায় স্ত্রীকে কাছে টেনে নিলেন।
প্রাণ খুলে কাঁদতে কাঁদতে দুজন দুঃখী মানুষ কষ্টটুকু সহনীয় করে নিলেন বিশ্বাস দিয়ে।
--------------------------------------------------------------------
গল্পটা এতো সুন্দর যে সেটার আসল ভার্সন না পড়লে বুঝানো শক্ত যে সেই গল্পটা কিভাবে আমাকে সেই মূহুর্তে সোজা দাঁড় করিয়ে রেখেছিল।
বারবার মনে হচ্ছিল, এই গল্পটা ঠিক এই সময়েই কেন আমার সামনে এলো! এতো রহস্য কেন! একটা সামান্য গল্প কিভাবে সময়মত আমার চোখের সামনে এসে আমাকে ধৈর্য ধরতে সাহস দিল! কী অসম্ভব শক্তি নিষ্প্রাণ শব্দগুলোর!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।