আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ড. ইউনুসের স্মৃতি

সাহিত্যের সাইটhttp://www.samowiki.net। বইয়ের সাইট http://www.boierdokan.com

২০০৫-এর শেষ দিকে বা ২০০৬-এর প্রথম দিকে হতে পারে। লোকালবাসে কোনো রকমে সিট পেয়ে মিরপুর ১০ নম্বরের দিকে যাইতেছি। এইসব যাত্রায় যা হয়, তাই হইতেছে। আশপাশে তাকানো, ঘেমে নেয়ে বিরক্ত হয়ে ওঠা।

তো ওই রকম তাকাইতে গিয়া হঠাৎ দেখি আমাদের মুড়ির টিনের পাশেই একটা মাইক্রোবাস। তাতে খুব পরিচিত এক মানুষ। ড. ইউনুস। গাড়িতে ড্রাইভার আর উনি ছাড়া কেউ নাই। একা একমনে বইসা রইছেন।

তখন খুব আলাপ হইতো ড. ইউনুস নোবেল পাইতে পারেন কি না এইটা নিয়া। আমরাও আলাপ করছি মেলা। ওনাকে পাশের গাড়িতে দেখে খুব ভাল লাগলো। অনন্ত একটা জ্যামে সবাই আটকে আছি। হবু নোবেল উইনার, ব্যাংকের উদ্যোক্তা, খেটে খাওয়া কর্মী।

ড. ইউনুস শান্ত হয়া বইসা রইছেন। শুনেছি মিরপুরেই থাকেন। গরীবের এলাকায়। ড. ইউনুস নোবেল পাইলেন ২০০৬ সালের অক্টোবরে। বৃহস্পতিবার দিন সাহিত্যে নোবেল ঘোষণা হইলো।

ওরহান পামুক পাইলেন। যায়যায়দিনে আর্ট অ্যান্ড কালচারের সংখ্যাটা ওরহান পামুক দিয়ে সাজানো হইলো। তার নোবেল বক্তৃতা অনুবাদ করলাম। গভীর রাতে বাড়ি ফিরে পরদিন অফডে। আধবেলা ঘুমাইলাম।

আধবেলা রান্নাবান্না করলাম। আর সিনেমা দেখলাম। ঘরে টিভি নাই। ইন্টারনেট নাই। এমনকি পত্রিকাও দিয়া যায় না।

মন চাইলে সকালে গিয়া পত্রিকা কিনে নিয়া আসি। না চাইলে না। তো ওইদিন মন চাইলো না। রাইতে টুয়েন্টিফোর দেখে ঘুমাইতে গিয়া ৪টা বাইজা গেল। শনিবার অফিস পৌঁছাইতে পৌঁছাইতে ২টা।

অফিসে ঢুকতে গিয়া সঞ্জীবদার সঙ্গে দেখা। সঞ্জীবদা কয়, পায়া তো গেলা। আমি বললাম, কী পাইলাম? সঞ্জীবদা কয়, ফাইজলামি করো, জানো না বলে ভাব নাও? আমি তো কিছুই বুঝলাম না। সঞ্জীবদাও কিছু ভেঙে কন না। আমি ওপরে গিয়া সবাইরে জিগাই, কিছু হইছে নিকি? কেউ কিছু কইতে পারে না।

উপায়ন্তর না দেখে পত্রিকার ফাইল হাতে নিলাম। পত্রিকা লালে লাল। ড. ইউনুস নোবেল পাইছে। পাক্কা ২৪ কি ৩৬ ঘণ্টা পর আমি জানতে পারলাম। তাজ্জব কি বাত! একটা ঘটনা ঘটলো।

মনটা ফুরফুরে হয়া গেল। তো ড. ইউনুসের কথা আরো কিছু মনে পড়লো। আমাদের গ্রামে গ্রামীন ব্যাংকের জোরদার কর্মকাণ্ড চলতেছে আশির দশক থিকা। আমি স্কুলে থাকতে দেখতাম এলাকার গরীব নারীরা দলে দলে গ্রামীন ব্যাংকের পতাকার তলে সমবেত হইতেছে। তখন গ্রামীন ব্যাংকের লোকেরা গ্রামের নারীদের জন্য নানা কর্মসূচি নিত।

এর মধ্যে একটা হইলো সকাল বেলা পিটি প্যারেড। তো গ্রামে একটা ছড়া চালু হয়া গেল। স্বামীর কথা ছাড়ো আমার কথা ধরো গ্রামীন ব্যাংকের টাকা নিয়া লেফ-রাইট করো। নানা অবজ্ঞা-বিরোধিতার মধ্য দিয়া গ্রামীন ব্যাংক কাজ চালাইতো। তারা একটা ছোট ঘর থেকে শুরু করে দোতলা বিল্ডিং বানাইলো।

আমাদের এলাকায় ওই প্রথম দোতলা বিল্ডিং। তো ব্যাংকে ছোট থাকতে থাকতেই গ্রামে ড. ইউনুস আইলেন। গরীব-দুঃখী মানুষেরা তাকে বিপুল সংবধনা দিলো। এমন সংবর্ধনা রাজনৈতিক নেতারাও গ্রামদেশে পান না। তখন তো বুঝি নাই।

এখন বুঝতেছি, গরীব-দুঃখী মানুষেরা নিশ্চয়ই একটা কারণ ছিল বলে এমনে সংবর্ধনা দিছিলো। ওই সংবর্ধনার ব্যাপক বিরোধীতা করছিল এলাকার মোল্লা মাওলানারা। গ্রামীন ব্যাংক এলাকার নারীদের ধর্মের রাস্তা থেকে সরায়া নিতেছে এই ছিল অভিযোগ। প্রফেসর ইউনুসের কথা নতুন কইরা মনে পড়লো গত শুক্রবারের নিউএজ আর ডেইলি স্টার পইড়া। দুই পত্রিকা দুইটা ম্যাগাজিন করছে।

ডেইলি স্টার ওনার ইন্টারভিউ নিছে। শিরোনাম দিছে- দি ম্যান হু চেঞ্জড দি ওয়ার্ল্ড। আর নিউ এজের ম্যাগাজিনের কভার স্টোরির শিরোনাম- ডার্ক সাইড অফ মাইক্রোক্রেডিট। অন্যসব বিষয়ের মতো ড. ইউনুসকে নিয়াও তাইলে জাতি বিভক্ত। কয়দিন আগে উনি বারাক ওবামার কাছ থেকে পদক নিয়া আসলেন।

এ নিয়া দেশের পত্রিকা-টিভি তেমন কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। সাদামাটা নিউজ ছেপে কাজা সারছে। যেদিন উনি যুক্তরাষ্ট্র গেলেন সেদিন রাতে এনটিভিতে ওনার একটা সাক্ষাৎকার প্রচার হইতেছিল। শুনলাম। লোকটার কথা এমনে কম শুনছি।

উনি নাকি দেশি প্রেসে তেমন উপস্থিত হইতে চান না। দেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার দিতে উৎসাহী নন। তো শুনতেছিলাম ওনার কথা। এখনও স্বপ্ন আছে। এখনও কিছু করতে চান।

নতুন আইডিয়া সোশাল বিজনেস নিয়া অনেক কথা কইতেছিলেন। এইরাম মানুষ বাংলাদেশে খুব কম। ধৈর্য আছে। ধী শক্তি আছে। এইরাম ভাল ভাল মেলা জিনিশ আছে ওনার।

আমাদের প্রেসের সঙ্গে ইউনুস কথা বলতে চান না। আমাদের লোকেরাও যে ওনার কথা খুব শুনতে চায় তাও না। ওনার কথা শুনতে এই দেশে রাহুল, হুগো, সোফিয়া কত রাজা বাদশা আসে। উনি তাদের বলেন। ঘুরায়া ঘুরায়া গরিব মানুষের উন্নতি দেখান।

ওরা যাওয়ার সময় কয়া যায়, এই জিনিশ আমরা আমাদের দেশে করবো। আমাদের কাছে, ইউনুস বড় সুদ খোর। সুদ তো আমরা সবাই খাই। ইউনুস বেশি খান, এই তার দোষ। আর উনি বিদেশীদের এজেন্ট।

ওনার কথায় বিদেশীরা নাচে। উনি নীতিনির্ধারণ করেন। উনি গরিবদের ঋণ দিয়া কিস্তি তোলার জন্য চাপ দেন। দরকার হইলে নির্যাতন করেন। উনি রাজনীতি দখলের জন্য পাঁয়তারা করেন।

ইউনুসের মূল্যায়ন শেষ। ডেইলি স্টারের ম্যাগাজিনে ইউনুসের সাক্ষাৎকার পড়ে বন্ধুরে কইলাম, ইউনুস তো দুনিয়াটারে বদলাইয়া দিলেন। বন্ধু ব্রিলিয়ান্ট। কই আমি তো টের পাইলাম না। তুই পাইলি? আমিও তো বুঝলাম না।

একটু বোকা হয়া গেলাম। ওবামা মেডেল পরাইতে গিয়া কইছেন, ইউনুস পরিবর্তনের অনুঘটক। কিন্তু দুনিয়াটা তো অনেক বড় জিনিশ। এইটারে চেঞ্জ করাও তো কঠিন। দুনিয়ার ভেতরে ছোট ছোট অনেক দুনিয়া থাকতে পারে।

ইউনুস হয়তো সেই ছোট কোনো দুনিয়া চেঞ্জ কইরা থাকতে পারেন। মেয়নে মেহসুস নেহি কিয়া। আমি বুঝতে পারি নাই। আর যারা মাইক্রোক্রেডিটের ডার্ক সাইড নিয়া আলোচনা করেন, তাদের ফিরিস্তি একই। একজন দুইজন নারীর সাক্ষাৎকার তারা নেয়।

গ্রামীন ব্যাংকের লোন নিয়া তিনি যে কিছু করতে পারেন নাই, উপরন্তু তাকে যে কিস্তি দিতে চাপ দেওয়া হইতেছে এইগুলা নিয়া স্টোরি। এইরাম স্টোরি বহু পড়লাম। এইটার নাম আমি দিসি মাইক্রো ডিসক্রেডিট। তো দেখা যাইতেছে ডেইলি স্টার ইউনুসকে যা দিতেছে তা হইলো ম্যাক্রো ক্রেডিট। আর নিউ এজ দিতেছে মাইক্রো ডিসক্রেডিট।

আমাদের অবমূল্যায়ন আর অতিমূল্যায়নের এই হইলো সংক্ষিপ্ত ফিরিস্তি। কিন্তু ইউনুস এই দুনিয়ারে কী দিলেন তা কি মোটা দাগে বুঝার চেষ্টা হইলো? আমার মতো বোকা লোকদের বুঝার কোনো ব্যবস্থা তো দেখি না। দুনিয়া বদলায় নাই, ইউনুস সুদ খেয়ে দেশটারে ছাপা কইরাও দেয় নাই। তাইলে হইছে টা কী? বোকা মানুষ হিসেবে আমি দুইটা ঘটনা দেখি : ১. গ্রামদেশে যে উচ্চসুদের মহাজনী ব্যবসা আছিলো, ইউনুসের মাইক্রোক্রেডিট সেইটারে ঝেঁটিয়ে বিদায় করছে। একটা ক্যাপিটালিস্ট ব্যাকিং সিস্টেমে উনি গরীব মানুষরে আনছেন।

২. এইটা করতে গিয়া উনি ব্যাকিং সেক্টরে একটা নতুন ধারণা আনছেন। সেইটা হইলো যার কিছু নাই তারেও লোন দেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। যা ব্যাকিং ধারণায় নতুন জিনিশ। এইখানে তার ১০০% রিটার্ন আসছে। রিটার্ন যখন এমন তখন তা যে কোনো ব্যাংকারকে প্রলুদ্ধ করবে।

আর তাই দুনিয়া তার পেছনে ছুটছে। এই দুইটার বাইরে আরও কিছু জিনিশ আছে : ক. গ্রাম দেশে নারীর সক্রিয়তার ক্ষেত্রে ইউনুস ও গ্রামীন ব্যাংক ভাল অবদান রাখছে। আশির দশকে ইউনুস না আসলে গ্রামের মেয়েরা শহরের মেয়েদের চাইতে কর্মক্ষেত্রে এতো আগায়া থাকতে পারতো না। খ. ইউনুস সারাদেশে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত ব্যাকিং নেটওয়ার্ক বানাইছেন। এইটা একটা বড় প্রতিষ্ঠান।

মরার দেশে এমন প্রতিষ্ঠান গড়ার তাকদ তিনি রাখছেন। আর সেই প্রতিষ্ঠান মানুষরে কাজ দিতেছে। উনি দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন না অন্ধকার করছেন সেইটা আর কইলাম না। দেশের মুখ ধুয়া পানি খায়া লাভ নাই। আমার মনে হইতেছে, সামাজিক বিজনেসটাও নতুন ধারণা।

এইটা চালু হইলে ভাল কিছু ঘটনা ঘটতে পারে। দুনিয়া বদলাবে না। কিন্তু বাজারে কিছু ইতিবাচক ফল আসতে পারে। এখন ইউনুসের ডিসক্রেডিট। মহাজনী সুদী মুনাফার জায়গায় কম সুদের ক্যাপিটালিস্ট পুঁজির পর একে নেক্সট ফেজে নিয়া যাওয়ার কোনো উপায় ইউনুস বাতলাইতে পারছেন বইলা শুনি নাই।

উনি নতুন ক্যাপিটালিস্ট মহাজনদের পথ দেখায়া সুদের ব্যবসায় আনছেন। কিন্তু তত্ত্বের মধ্যে এদের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখতে পারেন না। আর যার কিছু নাই তাকে তিনি লোন দেওনের ব্যবস্থা করলেও যার কিছু জমি জিরাত আছে তাকে লোন দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেন নাই। কৃষির সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে ব্যর্থ হয়েছে গ্রামীন ব্যাংক। আমরা তো অর্থনীতি বুঝি না।

কিন্তু এইটুকু বুঝতেছি। ইউনুসের সঙ্গে আমাদের লোকজন তেমন সুবিচার করতেছে না। ওনারে একদল আকাশে তুলতেছে একদল কাদায় চুবাইতেছে। মাটিতে কেউ বসাইতে চাইতেছে না। কিন্তু ঘটনাটা ঘটা দরকার।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।