আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওই লোকটা আমিও হতে পারতাম(গল্প)

আমি লিখি মানুষের কথা,মানুষ পড়ে না। তারা হাসে। তাদের হাসির জন্যে আমি লিখি 'সবকিছু হাসির বিষয় নয়' তারা হাসে না! তবু আমি লিখব।

আমার অফিসে যখন কাজ থাকে না তখন যেন সবকিছু নিঝঝুম। আবার যখন কাজের চাপ বাড়ে তখন যেন পাহাড়ের মতো ভার নিয়ে কাঁধে চেপে বসে।

নিঃশ্বাস নেওয়ার অবকাশ টুকুই পাওয়া যায় মাঝেসাঝে। আমাদের অফিসে জেনারেটর নেই তাই যখন কারেন্ট যায় তখন অখন্ড অবসর। কি করে সময় কাটবে তাই নিয়ে ভাবতে হয়। কাজ করি দোতলার একটা ঘরে। জানালার পাশে বিশাল দিঘি।

সেখানে শরৎকালে পদ্মের শোভা মনকে পুলকিত করে। কখনও তাই দেখি। কবিতার মতো কতো কি-যে আবোল-তাবোল ভাবনা মাথার মধ্যে ফেনিয়ে ওঠে। সেইসব ভাব-ভাবনা টুকটাক করে এঁকে রাখি পকেটে রাখা ভাঁজ করা কাগজে। সব সময় তা-ও হয়ে ওঠে না।

আমার এক সহকর্মী কবিতার কথা বুঝতে পারলেই চিৎকার করে ওঠে, অফিসে বসে কবিতা লেখা চলবে না। অন্যরা অবশ্য তাতে কর্ণপাত করে না। জানে যে, নিজের নিজের কাজ সকলকেই নিজেই তুলতে হবে। হয়ও। তবু আমি বিব্রত হই।

জানি, কারেন্ট না থাকলে আমি যদি একশোটা কবিতা লিখি, কারো কিছু বলার নেই। বলেও না। বলে না কারণ তারা জানে, ওই লোকটা অফিস ফাঁকি দেয় না। কিন্তু কবিতা লেখা যেন অনেকের চোখে অফিস ফাঁকির চেয়েও বেশী কিছু। স্বপ্নবিলাসীরা কবিতা লেখে, বাস্তববাদীরা পড়ে, যুক্তিবাদীরা বিশ্লেষণ করে।

আমিও অফিসের সকলের কাছে বাস্তববাদী হয়েই থাকতে চাই। তাই আমার অনেক ভাবনার বুদবুদ, সময়ের বাতাসে বিলীন হয়। আমার ঘর থেকে বার হলেই বিশাল বারান্দা। সেখানে পিওনরা বসে থাকে। আমি কখনও তাদের কাছে বসি।

কুশলাদি জানি। টুকটাক কথা বলি। মন কিন্তু অস্থির থাকে, কারেন্ট নেই, কাজের চাপ বাড়ছে। অবুঝ চোখ দুটি অস্থিরতা কাটাতে দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় সামনের মাঠে ফসলের ক্ষেতে। তেঁতুল গাছের পাতায় ঝিরিঝিরি কাঁপন দেখতে।

কিম্বা মাঠের ওপারে পিচরাস্তায় হেঁটে চলা পথচারী, ছুটে চলা যানবাহন কিম্বা নীল আকাশে পাখির উড়ান দেখতে। নিচের তলায় অন্য একটা অফিস। সেখানে উচ্চপদে আসীন আমার এক সহপাঠী বন্ধু। তার যখন কাজ থাকে না, সে চলে আসে আমার খোঁজে। এসে দেখে আমি ফাইলের স্তুপে ডুবে আছি।

বেচারা আপশোষ করে, তোমাদের শুধু কাজ আর কাজ। আমি যখন তার অফিসে ঢুকি, তখন সে-ও ব্যস্ত থাকে কাজে। আমাকে দেখেই বলে, কারেন্ট নেই। কারেন্ট আর আমি যেন ব্যস্ত-অনুপাতিক! তবে সে আবার এই অফিসে সপ্তাহে তিনদিন। অন্য দিন গুলিতে আরও একটা অফিসের দায়িত্ব পালন করতে হয় তাকে।

তার অনুপস্থিতির দিনগুলিতে আমি যাই পাশের লাইব্রেরীতে। ছোট্ট একতলা বাড়ি। আলমারীর থাকে-থাকে সাজানো বই। রোদ-গরম বেশী হলে লাইব্রেরিয়ান ও তাঁর পিওন গিয়ে বসেন মোড়াম রাস্তার পাশের ঝুড়ি-নামা বটতলায়। সেখানে তাদের সঙ্গ দেয় গ্রামের কিছু মানুষ।

তাঁরা সংবাদপত্র পড়েন, আর দেশকাল নিয়ে আলোচনা করেন। আমাকে দেখলেই তাঁদের কোন একজন বলেন, কারেন্ট নাই বুঝি? আমি নিরবে মাথা নাড়ি। লাইব্রেরিয়ান হেসে বলেন--কারেন্ট থাকলে উনি কি আমাদের এখানে আসেন। বটগাছের শেকড়ে বসি। তাঁদের আলোচনা শুনি।

কখনও দু-একটা কথা বলি। বটগাছের ছায়ায়। ফুরফুরে বাতাসে মন ভাল হয়ে যায়। হঠাৎ কখনও অফিসের পিওন আসে আমার কাছে। বলে--কারেন্ট এসেছে।

আবার অফিসে ফিরি। ফাইল টেনে নিই। কাজ করতে-করতে কোন একসময় পিওন বলে--ওরা তো সব চলে গেল, আপনি যাবেন না? মৃদু হেসে বলি, হ্যাঁ, যেতে হবে। ফাইলপত্র গুছিয়ে একসময় বেরিয়ে পড়ি। ঘর তখন যেন টানে চুম্বক আকর্ষণে।

পশ্চিম আকাশে ঘন মেঘ। হু-হু করে উড়ে এলো মাথার উপর। ভিজিয়ে দিলো সব। রৌদ্র-ঝলাসে দগ্ধ শরীরের উষ্ণতা শুষে নিয়ে সিক্ত করে দিলো বারিধারা। ভেজা সপসপে জামাকাপড় সহ বাসায় ঢুকলাম আর বৃষ্টি থেমে গেল।

গামছায় মাথা মুচছি তখনই পশ্চিমাকাশে অগ্নিঝলক তার পরে-পরে বিকট আওয়াজ। মন বলল--বৃষ্টি থামার পরে-পরেই মেঘের ডাক, কারো কোন বিপদ হলো না তো? সবেমাত্র চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছি তখনই শুনলাম হৈ-চৈ। আমার বাসার সামনের রাস্তায় লোক ছুটে যাচ্ছে। বাইরে বেরিয়ে পথচারী একজনকে বললাম--কি হয়েছে, তোমরা অমন ছুটছো কেন? সে অবাক হয়ে বললো--আপনি?????????সবাই তো আপনার কথা বলছে। --আমার কথা, আমার আবার কি হলো? --বাজ পড়ে একজন মারা গেল, সবাই বলছে আপনি।

অবাক কান্ড সকলের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি, তবু আমার নামে খবর হয়ে যায়। পরদিন অফিসে গিয়ে শুনলাম। তার শরীরে আমার মত পোষাক ছিল। বয়স নাকি আমারই মত। তার ঝলসে যাওয়া চেহারায় অনেকেই নাকি আমার মুখের আদল খুঁজে পেয়েছিল।

পরে অবশ্য তার ফেটে যাওয়া মোবাইল থেকে সিমকার্ডের সাহায্যে পরিচয় উদ্ধার হয়েছে তার। জীবনবিমার প্রতিনিধি সারাদিনের কাজ সেরে ঘরে ফিরছিল। বৃষ্টিতে থেমেছিল পাশের বাসস্ট্যান্ডে। থেমেছে দেখেই ফের সাইকেলে চড়ে রওনা হয়েছিল বাড়ির দিকে। ঘরে ফেরা তার আর হয়নি।

আমি প্রতিদিন ওইসময়ে যেখানে বাঁক নিই। সেখানেই বজ্রপাত। সাঁঝবেলা তার ঘরে ফেরার কথা ছিল। তার ছোট মেয়েটি ভেবেছিল, বাবা কাজ থেকে ফেরার পথে তার জন্যে কিছু নিয়ে আসবে। ঘুমিয়ে পড়লে ঘুম-ভাঙিয়ে কোলে তুলে আদর করবে।

সেই লোকটা কিনা বাড়ি ফিরলো ঘুমন্ত অবস্থায়। নিঃশব্দে চলে গেল চিরঘুমের দেশে! অফিস ঢোকার আগেই আমাকে ছেঁকে ধরলো গ্রামের লাইব্রেরীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন। ওরা অবিশ্বাস্য আমাকে দেখতে এসেছে। একজন বুড়ি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল--শতায়ু হও বাবা, কাল আমরা তোমার কথা ভেবে কেঁদে অস্থির। আশেপাশের সকলের চোখে খুশির ঝিলিক।

আমি যেন মৃত্যুকে জয় করে অফিসে ফিরেছি। সকলেই ফিসফাস করছে, আমরা ভেবেছিলাম এই ছেলেটাই বুঝি। আমি মৃদু হেসে বললাম--ওই লোকটা আমিও হতে পারতাম।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।