আচমকা উর্মির ঘুম ভেঙ্গে গেল। গলাটা কেমন শুকনা শুকনা লাগছে তার । এটা দুঃস্বপ্ন না সুখস্বপ্ন সে বুঝতে পারছেনা । এক ঢোক পানি খেল উর্মি। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে সাড়ে চারটা বাজে।
জানালা দিয়ে হালকা বাতাস ঢুকছে। সাথে নিয়ে আসছে তৃপিলমা ফুলের সুবাস।
আজ দু”শ বছর হল মানুষ নেকটুপলি গ্রহে বসবাস শুরু করেছে। পৃথিবী যখন বসবাসের অযোগ্য হয়ে গিয়েছিল, তখন মানুষ হন্য হয়ে খুঁজছিল বসবাস উপযোগী একটা গ্রহ। সৌভাগ্য বলতে হবে- হঠাৎ করেই এই গ্রহের সন্ধান পায় মানুষ।
এই গ্রহের অনেক কিছুই ভাল লাগে উর্মির। বিশেষ করে তৃপিলমা ফুল। এর সুবাস তার মন জুড়িয়ে যায়। তব্ওু পৃথিবীর আগের ইতিহাস পড়ে মন কেমন যেন করে। এটাকে কষ্ট বলা যায়না।
রাগ , দুঃখ, কষ্ট এখন নিয়ন্ত্রণে। মানুষ এখন খুব উন্নত। তাদের মনে এখন কোন লোভ নেই । সব মিলে এক জাতিÑ মানুষ। সবাই মানুষ।
কবে বিজ্ঞানী সায়রা ভয়েস সিন্থেসাইজার যন্ত্র আবিষ্কার করেছিল। এই যন্ত্রটাকেই ডেভেল্পড করে, আজ মানুষ রাগ, লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে। এখন কান্নাও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যদিও সিদ্ধান্তটি অনেক বিতর্কের মধ্য দিয়ে পাস হয়েছে।
এসব যখন উর্মি ভাবছে , তখন অ্যালার্ম বেজে উঠল।
উর্মি লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়লো। তাড়াতাড়ি নাস্তা সেরে নেকটুপলি আর্টস এন্ড হিস্ট্রি রিসার্চ সেন্টারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।
২৪ নভেম্বর, ৩০০০ খ্রীঃ
নেকটুপলি আর্টস এন্ড হিস্ট্রি রিসার্চ সেন্টার
সবাই ব্যাস্ত। আজ হিস্ট্রি বিভাগের অনার্সের সব স্টুডেন্টদের পৃথিবীতে প্রজেক্ট-এর কাজে পাঠানো হবে। প্রজেক্টের বিষয়- গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ।
১৯০০-২১০০ সাল পর্যন্ত যত যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা হয়েছে- এর পেছনে কারণ কী। যুদ্ধাপরাধী, গণহত্যাকারীদের মনে ঐ সময় কী ছিল- তা খুঁজে বের করাই এই প্রজেক্টের উদ্দেশ্য।
চেয়ারম্যানের রুম
মনযোগের সাথে প্রতিটা ফাইল চেক করছেন ডিজনি সাহেব।
-আসতে পারি স্যার?
-ইয়েস। ফাইল দেখা থেকে মুখ না তুলেই চেয়ারম্যান উত্তর দিলেন।
-আলফা-৬১
-ইয়েস স্যার।
-তোমাকে তৎকালীন বাংলাদেশে পাঠানো হবে। ১৯৭১ সালে যে যুদ্ধাপরাধ হয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের মনে তখন কী কাজ করছিল- কেনইবা তাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে শেষ করা গেল না। তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের মনে কী ছিল- এসব খুঁজে বের করাই তোমার কাজ হবে।
তোমার সাথে রেডিয়েশন সিন্থেসাইজার দেওয়া হবে। তুমি তৎকালীন নেতা ও যুদ্ধাপরাধীদের কবরে গিয়ে যন্ত্রটা টিপ দিলেই হবে। প্রোগ্রাম সেট করা আছে। যখন সব কাজ শেষ হবে, মোটা সবুজ বাটনে চাপ দিবে। এর ত্রিশ মিনিট পর ফ্রিকুয়েন্সি টোটাল আসবে।
তোমার কাজ হলো তখনই এটা দেখে কী বুঝলে তা অল্প কথায় রের্কড করা। রের্কডের ত্রিশ মিনিট পরেই যন্ত্রও তার কমেন্ট করবে।
আন্ডা‘স্টেন্ড?
রেডিয়েশন সিন্থেসাইজার হাতে ধরে কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বললেন ডিজনি সাহেব। যেন এই যন্ত্রটা জীবনে দেখেনি উর্মি।
-ইয়েস স্যার।
হাসি চেপে উত্তর দিল উর্মি।
স্যার...
-অ্যানি প্রবলেম?
-নো স্যার। আমার দুইটা চাওয়া ছিল।
-শুনছি..
- স্যার এই মিশনে আমার নামটা কি ’উর্মিআলফা-৬১‘ দেওয়া যায়? আমার পূর্বপুরুষ বাঙ্গালী ছিল। আমি কি আমার পূর্বপুরুষদের কবরে যেতে পারি?
-তুমি এটাকে মিশন বলছো কেন?
-স্যার, এটা আমার মিশন ইন লাইফ।
আমি এটাকে মিশন-১৯৭১ নাম দিয়েছি।
- আর কিছু?
-নো স্যার।
-ওকে, তোমার চাওয়া মেনে নিলাম। পাগলী মেয়ে- মনের অজান্তেই বলে ফেললেন ডিজনি সাহেব।
-থ্যান্কস্ স্যার।
- ও, হ্যাঁ। তোমার হেল্পে আছে আলফা-৫২। যখন কোন প্রয়োজন হবে- দেরী করবেনা, হেল্প চাইবে। পৃথিবীর অবস্থা খুবই ভয়ংকর।
- ওকে স্যার।
উর্মি এক লাফেই চেয়ারম্যানের রূম থেকে বের হয়ে আসলো। আরেকটু হলেই কেলেংকারী ঘটিয়ে ফেলত। আলফা-৫২ সরে না গেলে উর্মি সরাসরি ধাক্কা লাগাতো তার গায়ে।
-হাই
-হাই।
-কখন রওনা হচ্ছো?
-এইতো, এখনই।
-আমি কিন্তু তোমার হেল্পার!
-হেল্প লাগলে না হেল্পার। এটা বলেই হনহন করে টুলস্ রুমের দিকে এগোল উর্মি।
বড় পাজি! যতই ঘোরাঘুরি করো- আমি প্রেম করছিনা।
মনে মনে কথা বলতে বলতেই রেডি হয়ে গেল উর্মি। সাথে প্রচুর টোস্ট নিল ।
স্পেসশীপে যখন উঠে তখন ছয়টা বাজে। আলফা-৫২ তাকে হাত নেড়ে বিদায় জানালো।
রায়ের বাজার বধ্যভূমি
উর্মি রেডিয়েশন সিন্থেসাইজার টিপ দিল।
একে একে সবার কবরে গেল- নেতা, যুদ্ধাপরাধী।
পৃথিবী এক বিরান ভুমি।
উর্মি হাঁটছে। এখানেই একদিন মানুষ বাস করতো। আজ চারদিকে শুধু পোড়া মাটি- তেজস্ক্রিয়তা। এখনই সবুজ সুইচ টিপ দেবে না আরো পরে- উর্মি ভাবছে। এই প্রজেক্ট শেষ হলেই সে গ্র্যাজুয়েট।
মন তার খুশিতে ভরে গেল। উর্মি সবুজ সুইচ টিপে দিল।
এখন যেতে হবে হবিগঞ্জে। তার পূর্বপুরুষদের এলাকা। আগেই লোকেশন ঠিক করা আছে।
উর্মি কম্পিউটার ঘাটাঘাটি করে অনেক আগ থেকেই ঠিক করে রেখেছে। স্যার না দিলেও এই প্রজেক্ট সে চেয়ে নিতো। এসব যখন সে ভাবছে , তখন স্পেসশীপের দরজা খুলে গেল।
উর্মি পা রাখলো পূর্বপুরুষদের ভূমিতে। এখানেই একদিন তার পূর্বপুরুষ জীবন যাপন করেছিল।
ফসল ফলিয়েছে। চাঁদনী রাতে মন খুলে গান গেয়েছে। উর্মির খুব ইচ্ছা হচ্ছে-“ বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই” কবিতাটা শুনতে। কিন্তু যন্ত্রটা ভুলে রেখে এসেছে।
উর্মি হাঁটছে, মাটি ছুঁয়ে দেখছে- আবার হাঁটছে।
রেডিয়েশন সিন্থেসাইজার টোটাল ফ্রিকুয়েন্সির সংকেত দিল। উর্মি ফ্রিকুয়েন্সি অভজারবেশন করতে লাগলো। ও চেয়ে দেখে- একদিকে মানুষের প্রতি মমতা- ভালোবাসা এতো বেশী, যা বলে শেষ করা যাবেনা।
বিপরীতে! স্বার্থপরতা, লোভ!
সে রেকর্ড করছে:
১৯৭১-এ যারা বাংলাদেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে- যুদ্ধ পরিচালনা করেছে, তারা মানুষকে ভালবাসতো- দেশকে ভালবাসতো। বিপরীতে যারা গণহত্যা , লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ করেছিল- তা করার আদেশ দিয়েছিল, তারা ছিল স¦ার্থপর, নীচ প্রকৃতির মানুষ।
তারা ছিল ক্ষমতালোভী!
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেও শেষ না করার পেছনে মূলত কারণ ছিল- ক্ষমতাসীন নেতাদের ক্ষমতার লোভ। কিছু নেতার মনে ভয় ছিল, বিচার শেষ করলে হয়তো আর ক্ষমতায় যেতে পারবেনা। তারা যুদ্ধাপরাধীদের আর্ন্তজাতিক লবিংকে ভয় পেয়েছিল। এজন্যই তারা বিচার শেষ করতে পারেনি। পরিশেষে একটা বাক্যই বলব- ক্ষমতার লোভ।
এর কারণেই, শুধু বাংলাদেশ নয়- সমগ্র পৃথিবীতে গণহত্যা, যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। ক্ষমতার লোভই সকল অনাচারের মূল।
এই বলেই উর্মি রেকর্ড সেন্ড করে দিল।
সে হাঁপাচ্ছে। হাঁটতে হাঁটতে একটু সামনে এগোল উর্মি।
ছোট রেডিয়েশন সিন্থেসাইজার চালু করার খুব ইচ্ছা হচ্ছে তার। সে সময়টা উপভোগ করছে। হঠাৎ করে একটা নামফলকে চোখ আটকে গেলো তার। তাতে লেখা-
মো: করিম উল্লা
বীর মুক্তিযোদ্ধা, যার কোন সার্টিফিকেট নেই।
যিনি গর্বকরে বলতেন: আমার হাত দুটোই সার্টিফিকেট!
চিরনিদ্রায় শায়িত:- ১৭ই আগস্ট, ২০১০ ।
-ভেরী ইন্টারেস্টিং! উর্মি তার ছোট রেডিয়েশন সিন্থেসাইজারটায় টিপ দিল। এটার প্রোগ্রাম খুব ফাস্ট। কছিু সময় পরেই তার জিন কোডে সবুজ বাতি জ্বলে উঠলো। বাতি বলে দিচ্ছে এই মুক্তিযোদ্ধা তার পূর্বপুরুষ ছিলেন। উর্মির শরীরে একটা শিহরণ বয়ে গেলো।
ছোট যন্ত্রে কমেন্ট এল: তোমার পূর্বপুরুষ- দেশের প্রতি খুব ভালবাসা ছিল।
একই সাথে বড় যন্ত্রে কমেন্ট এল: ভালবাসা ভার্সেস ক্ষমতার লোভ।
উর্মি প্রোগ্রাম সিলেক্ট করল ২০০০-২০১০ সাল। সে আবার যন্ত্রে টিপ দিল। সে সকল ইতিহাস জানতে চায়- নিজেকে জানতে চায়।
যন্ত্রে কমেন্ট এল: ঘৃনা আর ক্ষোভ, দুঃখ আর কষ্ট।
উর্মির বুকে মুছড় দিয়ে উঠল। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। তার-তো কষ্ট হওয়ার কথা নয়! কষ্ট, রাগ ,লোভ তার নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তার কষ্ট হচ্ছে।
যার দেশের প্রতি এত মমতা ছিল। যে নিজের জীবনের ঝুকি নিয়ে সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে- সে কেন শেষ বয়সে ঘৃণা-ক্ষোভ আর কষ্ট নিয়ে মরবে। উর্মির বুক ফেটে কান্না আসছে। সাথে সাথে উর্মির প্রচ- রাগ ফেলো। সে চিৎকার দিয়ে উঠলো....
নেকটুপলি আর্টস্ এন্ড হিস্ট্রি রিসার্চ সেন্টারে রেড এলার্ট বেজে উঠলো।
মনিটরে ভেসে এল- উর্মিআলফা-৬১ গো টু র্যাক এন্ড রুয়িন!!
অনিরুদ্ধ আনজির
২৫/১১/২০১১
সিলেট।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।