``চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল। ' -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
…সাহিত্যের দিনমজুর !
.
(০১)
‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…’, রবীন্দ্রনাথের এই সঙ্গীতটিকে ঋদ্ধি ও মননে ধারণ করেছিলেন বললে হয়তো ভুলভাবে বলা হবে ; বলতে হবে, ওই সঙ্গীতের মন্থিত জীবন-রসের সবটুকু মাধুর্যকেই বুকে আগলে নিয়েছিলেন তিনি। শুধু কি আগলেই নিয়েছিলেন ? আগুনের ওই পরশমণির অনিন্দ্য ছোঁয়ায় অগ্নিশুদ্ধ হয়ে নিজেকে এমন এক জীবনশিল্পীর মর্যাদায় আলোকিত করে নেন, সমকালীন বাস্তবতায় কী সাহিত্যে কী সাংবাদিকতায় কী চিন্তা চেতনা জীবনাচারে সময়ের চেয়েও এক অগ্রবর্তী পুরুষে উত্তীর্ণ হন তিনি। আর সময়ের চেয়ে এগিয়ে গেলে যা হয়, চলনে বলনে যাপনে সহজ সারল্যের প্রকাশ সত্ত্বেও সাধারণের চোখে হয়ে যান দুর্নিবার বিস্ময়, জিজ্ঞাসায় মোড়ানো এক রহস্য পুরুষ ! মাহবুব-উল আলম ছিলেনও তা-ই।
ধন্দে পড়তে হয় তাঁর নামের আগে প্রয়োগযোগ্য একক কোনো বিশেষণের খোঁজে। কথাশিল্পী ? হতেই পারে। সাহিত্যে মৌলিক চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গির জন্য যিনি সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে ১৯৬৫ সালে ‘বাংলা একাডেমী পুরস্কার’, ১৯৬৭ সালে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দেয়া পুরস্কার ‘প্রাইড অব পারফরমেন্স’ এবং ১৯৭৮ সালে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন, ‘কথাসাহিত্যিক’ বিশেষণটা যে তাঁর একান্ত নিজস্ব শব্দমালার অংশ হয়ে যায়, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে ! প্রেসিডেন্ট আইজেন হাওয়ার কর্তৃক আমন্ত্রিত লেখক হিসেবে আমেরিকা সফরে (১৯৫৯ সালে) পাওয়া ‘He is a man of unusual talent’ অভিধা যাঁর স্বীকৃতিপত্রে ঝলমল করতে থাকে, বিশেষণ নিজেও হয়তো বিশেষায়িত হয়ে যায় মাহবুব-উল আলম নামটির সাথে একাত্ম হতে পেরে।
মাত্র উনিশ বছর বয়সে প্রথম মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় রচিত ‘পল্টনজীবনের স্মৃতি’ (১৯৪০), ‘বর্মার হাঙ্গামা’ (১৯৪০), সাড়া জাগানো আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘মোমেনের জবানবন্দী’ এবং ‘পঞ্চ অন্ন’ (১৯৪৬), সমকালীনতা উত্তীর্ণ আধুনিক শিল্পকর্ম রূপে স্বীকৃত ও সমাদৃত উপন্যাসিকা ‘মফিজন’, হাস্য-রসাত্মক গল্প সংকলন ‘গোঁফ সন্দেশ’ (১৯৫৩) সহ ৩৪টিরও অধিক গ্রন্থ সেই সাক্ষ্যই বহন করে। তাঁর ‘মোমেনের জবানবন্দী’ গ্রন্থটি ইংরেজী ও উর্দুতে অনুদিত হয় তখনই।
ইংরেজীতে অনুবাদ করেন অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্ত্রী শ্রীমতি লীলা রায় ‘Confessions of a Believer’ নামে (১৯৪৬)। অসাধারণ জীবনদৃষ্টি সম্পন্ন এই বইটি তৎকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকায়ও অন্তর্ভূক্ত হয়। তিনটি ভ্রমণ কাহিনী ইন্দোনেশিয়া (১৯৫৯), তুর্কী (১৯৬০) ও সৌদী আরব (১৯৬০) ছাড়াও তাঁর মরণোত্তর প্রকাশিত হাস্য-রসাত্মক গল্প সংকলন ‘প্রধান অতিথি ও তাজা শিংগী মাছের ঝোল’, ‘রঙবেরঙ’, ‘পল্টনে’ এবং ‘সাত সতেরো’ সে সময়ে পাঠক মহলে যথেষ্ট সাড়া জাগায়। অন্নদাশঙ্কর রায়ের সাথে দীর্ঘদিনের পত্রালাপের প্রেক্ষিতে বাংলা সাহিত্য ঋদ্ধ হয় আরো দুটো পত্র-সাহিত্য গ্রন্থ পেয়ে- ‘আলাপ’ ও ‘আলাপ: নবপর্যায়’।
কথাসাহিত্য চর্চার পাশাপাশি অত্যন্ত মননশীল ও শ্রমসাধ্য ইতিহাস রচনায় নিজেকে ব্রতী রেখেছেন এমন নজির বাংলা সাহিত্যে খুব একটা চোখে পড়ে না আমাদের।
অথচ কী বিস্ময়করভাবে দেখি অভূতপূর্ব প্রকরণ, প্রক্রিয়া ও উপকরণ মিশিয়ে তিন খণ্ডে চট্টগ্রামের ইতিহাসের এক সমৃদ্ধ জগতের উপহার তুলে ধরেন পাঠকের হাতে- পুরানা আমল, নবাবী আমল ও কোম্পানী আমল নামে। আরো বিস্ময় অপেক্ষা করে জীবদ্দশায় সর্বশেষ যে দুঃসাধ্য কাজটি করে গেলেন তিনি, তা দেখে ! সাত বছরের একাগ্র সাধনা ও একক প্রচেষ্টায় সর্বাধিক তথ্যসমৃদ্ধ চার খণ্ডে রচিত ১২০০ পৃষ্ঠার বাঙ্গালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিবৃত্ত, যার অসামান্য শিরোনাম- ‘রক্ত আগুন অশ্রুজল: স্বাধীনতা’। অশ্রু যখন কাব্যিক ব্যাপ্তি নিয়ে অশ্রুজল হয়ে ওঠে, এর নৈর্ব্যক্তিক গভীরতা স্বাধীনতা শব্দটির সাথেই শুধু মাখামাখি হয় না, স্বাধীনতার বোধটিও কেমন যেন বেদনাসিক্ত হয়ে ওঠে আমাদের বুকের কোণে। ভাবতেই অবাক লাগে, যে বয়সে একজন ব্যক্তি-মানুষ ব্যবহারিক জীবন থেকে নিজকে বিশ্লিষ্ট করে অসহায় সীমাবদ্ধতায় আটকে নিজেকে গুণ্ঠিত করে নেয় আত্মজৈবনিক স্মৃতিমত্ততায়, সেই বয়সে এসে কী করে একজন মাহবুব-উল আলম গোটা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়টাতে হেঁটে হেঁটে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য কুড়িয়ে এতো বিশাল ইতিহাস গ্রন্থের কাঁচামাল সংগ্রহ করেন ! ভাবতেই গা শিহড়ে ওঠে ! নামের পাশে একটা ‘ইতিহাসবিদ’ বিশেষণ ধারণ করতেও এতো বিশাল কর্মকুশল আয়োজনের প্রয়োজন পড়ে কি ! কিন্তু তাঁর তো ইতিহাসবিদ বিশেষণের চাওয়া ছিলো না। দরকার ছিলো আগুনের পরশমণির ছোঁয়ায় ভেতরে ধারণ করা ব্যক্তিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার উন্মুক্ত জানালা দিয়ে যত কঠিনই হোক সত্য আর সুন্দরের সুবাতাস বইয়ে দিয়ে এই জনগোষ্ঠিকে ইতিহাসমনস্ক করে তোলা।
কতোটা যোগ্যতা, সামর্থ আর নিজের উপর কঠিন আত্মবিশ্বাস থাকলে এরকম একক ও বিশাল একটা কাজের পরতে পরতে আন্তরিক কুশলতা ছুঁয়ে থাকে, তা বিস্ময়কর বৈ কি !
প্রজাতন্ত্রের চাকুরি থেকে অবসর নিয়েই ১৯৫৩ সালে মাহবুব-উল আলম ‘জমানা’ নামে চট্টগ্রামের প্রাচীনতম যে সাপ্তাহিক পত্রিকাটি বের করেন এবং পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে তা ‘দৈনিক জমানা’য় রূপান্তর ও প্রতিষ্ঠিত করেন, এর মধ্য দিয়ে তিনি যে শুধু নিজেকে সাংবাদিকতায় নিয়োজিত করেন তাই নয়, সম্পাদকীয় বিষয় নির্বাচন ও রচনারীতিতে স্বাতন্ত্র্যের জন্য সাংবাদিকতায়ও রীতিমতো পথিকৃতের মর্যাদা লাভ করেন।
জীবনকে ভেতর থেকে কৌতুকময় দৃষ্টিতে দেখা এবং চতুর্মাত্রিক দৃষ্টিকোণে গভীর উপলব্ধির মধ্য দিয়ে তাকে যাচাই বাছাই করার বিশ্লেষণধর্মী সারস্বত ক্ষমতা সবাই পায় না। কাউকে কাউকে তা অর্জন করতে হয় প্রচুর অধ্যয়ন অধ্যবসায় আর অগ্নিশুদ্ধ জীবনবোধ দিয়ে। মাহবুব-উল আলম তাঁদেরই একজন। পরম হংসের মতো জীবনের সারটুকু ছেঁকে নিয়ে নিজের জন্য জমিয়ে রাখেন নি তা, আমাদের সাহিত্য পাতে ঢেলে দিয়েছেন শিল্পমমত্ব দিয়ে।
নিজেকে এই সমাজের বৃহত্তর জনগোষ্ঠির বাইরের কেউ ভাবেন নি বা মানুষ ও সমাজের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত দায়বদ্ধতাকেও গোপন করেন নি কখনো। তাই হয়তো তাঁর সহজাত কৌতুকময়তা দিয়ে নিজেকে সাহিত্যের একজন দিনমজুর হিসেবে আখ্যায়িত করতে একটুও কুণ্ঠাবোধ না করেই নির্দ্বিধায় বলে ফেলেন- ‘… আমি সাহিত্যের দিনমজুর !’ এখানেই তাঁর দায়বোধ কড়ায়গণ্ডায় উশুল করে দিয়ে যান তিনি। কিন্তু উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আমরা কি তাঁর চর্চা করছি ? চাইলেও তাঁর সেই আলোচিত বইগুলো এখন কোথাও পাওয়া যায় না। এবং যতটুকু জানি তাঁর কোন রচনা-সমগ্রও প্রকাশিত হয় নি আজতক। আমাদের এই লজ্জাজনক সীমাবদ্ধতাকে আর কতোকাল অক্ষম পরিতাপ দিয়ে ঢেকে রাখবো আমরা ?
আমাদের সাহিত্যপাড়ায় বহু অঘা-মঘাকে নিয়েও আলোচনা হতে দেখা যায় বিস্তর।
কিন্তু কী আশ্চর্য, মাহবুব-উল আলম’কে নিয়ে কোন আলোচনা আদৌ কি হয় ? তাহলে বর্তমান প্রজন্ম তাঁর সম্পর্কে জানবে কোত্থেকে ? যাঁর মেধা ও কাজের তুলনায় বহুগুণে তুচ্ছ ও নগন্য কাজ দিয়েও একালের সাহিত্যপাড়ায় রীতিমতো আলোচিত হয়ে ওঠা কোনো বিষয়ই নয়, সেখানে নতুন প্রজন্ম এ সম্পর্কে কিছুই জানে না যে, আমাদের এমন একজন মাহবুব-উল আলম ছিলেন যিনি তাঁর মননশীলতার অনেক বড় ও ঈর্ষণীয় স্বীকৃতি পেয়েও নিজেকে সাহিত্যের একজন দিনমজুর পরিচয় দিতেই ভালোবাসতেন। ব্যক্তি ও কর্মযজ্ঞে কী ছিলেন তিনি- তা জানার দায়বোধ উত্তর প্রজন্ম হিসেবে আমাদের মধ্যে যদি সঞ্চারিত না হয়, এবং তা অর্জনেও যদি অক্ষম হয়ে পড়ি, এই দায়-দায়িত্ব কি এড়াতে পারবো আমরা ? কেননা, আমাদের পরেও আরো প্রজন্ম আসবে এবং আসতেই থাকবে।
(০২)
৭ আগষ্ট ২০০৯, শুক্রবার। নির্ধারিত সময় সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা পেরিয়ে গেছে। ৩২, তোপখানা রোডের চট্টগ্রাম ভবনের নয় তলার তাপানুকুল হলরুমে যখন ঢুকলাম ততক্ষণে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।
কথাশিল্পী সাংবাদিক ইতিহাসবিদ মাহবুব-উল আলম-এর ২৮তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানমঞ্চ আলোকিত করে বসে আছেন ডান থেকে ড.রফিকুল ইসলাম, ড.মাহমুদ শাহ কোরেশি, সভাপতি সবিহ-উল আলম, ড.আনিসুজ্জামান ও ড.মনিরুজ্জামান। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে পরিচিত-অপরিচিত বহু মুখ। তবে এরা প্রায় সবাই যে সাহিত্যপাড়া সংশ্লিষ্ট, তা বলার বাকি রাখে না। একে একে আলোচনা করলেন অনেকেই। মঞ্চে উপবিষ্টরা ছাড়াও দর্শক সারি থেকে রণজিৎ বিশ্বাস, সুব্রত বড়ুয়া, ড.মনসুর মুসা, আলী ইমাম প্রমুখরা মাহবুব-উল আলমের জীবন ও কর্মমুখরতা নিয়ে স্মৃতিচারণ আর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার পাতাগুলো উল্টেপাল্টে সন্ধ্যাটাকেই সার্থক করে দিলেন বলা যায়।
তাঁকে নিয়ে কৌতুহল আমার দীর্ঘদিনের। কিন্তু প্রয়োজনীয় রচনাবলী বা প্রতিনিধিত্বশীল গ্রন্থের অভাববোধ এই কৌতুহল নিবৃত্তির কোন সুযোগ দেয় নি বলে চাপা পড়ে ছিলো। হঠাৎ করে মাসিক শিশু-কিশোর পত্রিকা ‘টইটম্বুর’-এর আমন্ত্রণপত্রটি পেয়ে সে সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। মাহবুব-উল আলমের জোটবদ্ধ বংশধারা চট্টগ্রামের বিখ্যাত সেই আলম পরিবারই মূলত সতের বছর ধরে টইটম্বুর পত্রিকাটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে শিশু-সাহিত্যের একটা ক্লাসিক ধারা জিইয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এবং কালে কালে এর লেখক পাঠক ও শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে বৃহৎ পরিসরে একটা টইটম্বুর পরিবারই গড়ে উঠেছে বলা যায়।
তাদের সাগ্রহ প্রশ্রয়ে মাঝেমধ্যে দুয়েকটা লেখালেখির সূত্র ধরে নিজেকেও আমি কখন যে এই টইটম্বুর পরিবারের অবাধ্য একজন হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলাম জানি না। তাই মাহবুব-উল আলম সম্পর্কে আমার জানার পরিধিটা যে প্রায় না-জানার পর্যায়ে ছিলো তা টের পেলাম এ অনুষ্ঠানে এসে।
চট্টগ্রামের ফতেহাবাদ গ্রামে ১লা মে ১৮৯৮ সালে জন্ম আর ৭ই আগষ্ট ১৯৮১ মালে কাজির দেউড়ীস্থ নিজ বাসভবনে মৃত্যু, ৮৩ বছরের এই ক্ষণজন্মা পুরুষ মাহবুব-উল আলম ছিলেন পিতা মৌলভী নসিহউদ্দিন সাহেবের দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর অন্য ভাইরা হচ্ছেন শামসুল আলম, দিদার-উল আলম ও ওহীদুল আলম। মৌলভীর পুত্র খুব স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় মৌলভী না হয়ে যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন ফতেয়াবাদ মিডল ইংলিশ স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ করে তৎকালীন দেশসেরা কলেজ চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়ে কিছুকাল লেখাপড়া করেন, তৎকালীন সামাজিক বাস্তবতায় এটা একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় বৈ কি।
তাঁর কোন ভাই-ই মৌলভী হন নি। চট্টগ্রাম কলেজের পড়ালেখা চলছিলো ভালোই। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলে মনোযোগ চলে গেলো যুদ্ধের ময়দানে। যাকে বলা হতো পল্টন। ১৯১৭ সালে উনিশের সে তারুণ্য তাঁকে নিয়ে গেলো সেখানেই।
যুদ্ধ করতে করতে চলে গেলেন মেসোপটোমিয়া। ১৯১৯-এ সেখান থেকে ফিরে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দৌঁড়ে সহপাঠিদের থেকে পিছিয়ে পড়া অত্যন্ত মেধাবী মাহবুব-উল আলমের শিক্ষাজীবনে আর ফেরা হলো না। সোজা কর্মজীবনেই ঢুকে গেলেন। প্রজাতন্ত্রের সাব-রেজিস্টার থেকে কর্ম পরিক্রমায় হলেন ডিস্ট্রিক্ট সাব-রেজিস্টার। তারপর ডিস্ট্রিক্ট রেজিস্টার এবং সবশেষে ইন্সপেক্টর অব রেজিস্ট্রেশন।
৩৪ বছরের চাকুরিকালেই ফাঁকেফোকে লেখালেখির চর্চা আর অবসর গ্রহণ করে লেখা ও প্রকাশনায় পুরোপুরি জড়িয়ে যাওয়া এ মানুষটির স্চ্ছলতায় কোন ঘাটতি ছিলো না। কিন্তু কাজির দেউড়ী থেকে বেরিয়ে রোজ হেঁটে হেঁটে শহরময় ঘুরে বেড়ানো এ মানুষটিকে কখনো রিক্সায় চড়তে দেখেছেন কিনা, প্রত্যক্ষদর্শী কেউ তা মনে করতে পারলেন না। এক বগলে কতকগুলো বই আর অন্য হাতে ছাতা ধরে চিরকালীন সাদা টুপি পরিহিত এই মানুষটি গোটা চট্রগ্রামবাসীর চোখে এমনই এক আর্কিটাইপ ব্যক্তিত্বের প্রতীকে পরিণত হয়ে গেলেন যে, এর বাইরে তাঁর অন্য কোন প্রতিকৃতি থাকতে পারে তা যেন একেবারে অকল্পনীয় ছিলো। কখনো টাউন বাসের ভীড়ের মধ্যে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা সেই বই-বগলে মানুষটি এভাবেই বুঝি অত্যন্ত সঙ্গত ও স্বাভাবিক। বক্তাদের স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে কল্পনায় আমিও যেন স্পষ্ট দেখছিলাম তাঁকে।
বাসের টিকেট, হ্যান্ডবিল কিংবা হাতে নেয়া কোন ঠোঙ্গা ইত্যাদি বিভিন্ন আকার আকৃতি আর ঢঙের উদ্ভট সব কাগজের ফাঁকা পিঠে গুটগুট অক্ষরে লিখে ফেলা কথাগুলোই যখন অবিকৃতভাবে একত্র গ্রন্থিত হয়ে কোন মহার্ঘ রচনার অদ্ভুত পাণ্ডুলিপির চেহারা পেতো, তা হাতে পেয়ে প্রকাশকদের যেরকম আক্কেলগুড়ুম চেহারা হতো, কল্পনায় আমি ঠিকই দেখতে পাচ্ছি যেন। স্রষ্টারা নাকি এরকম খেয়ালিই থাকেন। একেকজনের খেয়াল হয়তো একেকরকম। কিন্তু মাহবুব-উল আলমের মতো এমন বিচিত্র খেয়াল আর কোন লেখকের কোথাও কোনকালে ছিলো কিনা ড. আনিসুজ্জামানও তা বলতে পারলেন না।
এরকম বহু স্মৃতির ঝাঁপি খুলে গেলো সেদিন চট্টগ্রাম ভবনের নবম তলার হলরুমটিতে।
আমার জন্য তা খুবই আকর্ষণীয় ছিলো। তাই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে এলেও কথাশিল্পী মাহবুব-উল আলমের সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ পুত্র সবিহ-উল আলম, যিনি দীর্ঘদিন পিতার সান্নিধ্যে থাকার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁর কথাটা তখনও বুকের ভেতর অনুরণিত হচ্ছিল- ‘আমার জীবনশিল্পী বাবা বলতেন, তিনটা বিষয় মেনে চলার চেষ্টা করো। এক, বছরে একবার হলেও সমুদ্রের কাছে যাবে ; সমুদ্রের বিশালতার পাশে নিজের ক্ষুদ্রত্ব ও নগন্যতাকে উপলব্ধি করে নিজেকে চিনতে পারবে। দুই, সম্ভব হলে বছরে একবারের জন্য সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টার চূড়ায় উঠবে ; উপর থেকে নিচের ছোট-বড় ভেদাভেদগুলো মুছে কিভাবে সবকিছু সমান হয়ে যায় তা শিখবে। তিন, বছরে অন্তত একটা রাত পূর্ণ জ্যোৎস্নায় কাটাবে ; সূর্যালোকের প্রখর তীব্রতার বিপরীতে চাঁদনির মোহনীয় স্নিগ্ধতায় মানবিক সৌন্দর্যবোধের পরিচর্যা হবে।
ব্যাখ্যার চেয়ে কথাগুলোর উপলব্ধিজাত অনুভবই বুকের মধ্যে একটা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিলো। লিফট থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তায় নামলাম, খুব ইচ্ছে হলো, আহা, আমিও যদি সাহিত্যের নগন্যতম কোন এক দিনমজুর হতে পারতাম…!
তথ্যসূত্র:
০১) মাহবুব-উল আলম কেন প্রাসঙ্গিক/ রণজিৎ বিশ্বাস।
০২) আজ কথাশিল্পী মাহবুব-উল আলম-এর ২৮তম মৃত্যু বার্ষিকী/ অনুষ্ঠান আয়োজনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।