আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এই মাটি আমার, এই দেশ আমার.........

মিলে মিশে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ!
হংকং, ইনচ'ন, সূবর্ণভূমি ইত্যাদি এয়ারপোর্ট দেখার পর যখন জিয়া আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে বিমান ল্যান্ড করতে থাকে তখন একদিকে যেমন আমরা কত গরীব সেটা বোঝা যায়, অন্যদিকে ঠিক তেমনি বোঝা যায় আমরা ক-ত সবুজ, শ্যামল। তাই একদিকে মনের মাঝে কিছুটা দৈন্যতা কাজ করে, আফসোস লাগে নিজের দেশের জন্য, অন্যদিকে প্রাণটা ভরে ওঠে মাটির গন্ধে, চোখ ভরে যায় সবুজে। আর দেশের কাছের মানুষগুলোর উষ্ণ পরশ তো আছেই, আছে আত্মীয়-স্বজনদের আন্তরিক আতিথেয়তা। নানা, চাচা, মামা, খালা, ফুফু যার বাসাতেই গিয়েছি, তোমার কি কি খেতে মন চায়, সেখানে কি কি খেতে পারনি......ইত্যাকার ভালোবাসাপূর্ণ প্রশ্নে জর্জরিত হতে হয়েছে প্রতিনিয়ত। আর সে সুযোগে আমিও শুরু করেছি নানা আবদার।

এয়ারপোর্ট থেকে প্রথমেই গিয়েছি নানার বাসায়, গিয়েই শুরু......আম আছে? আম খাব। সিজন শেষ হয়ে গেল নাতো? ইশ্‌, কোরিয়ায় আম নেই। কি যে কষ্ট লাগে!! আমের উপর আর কোন ফল হয়? এবার কিন্তু অনেক আমের আচার নিয়ে যেতে হবে। গত এক বছর আচারটা ভীষণভাবে মিস্‌ করেছি। বাবার বাড়ি, স্বামীর বাড়ী, নানার বাড়ী, চাচার বাড়ী সব জায়গায় গিয়েছি, আর আম, আমের আচার, আমের জেলী, কাঁঠাল, তাল, তালের পিঠা, নারকেল, নারকেলের পিঠা, আখ, পেয়ারা, আমড়া, খই, মুড়ি, চানাচুর মাখা, কচু শাক, অন্যান্য শাক, চিরিং মাছ, কৈ মাছ, ইলিশ তো বটেই, আরো নানা রকমের খাবার খেয়ে বেড়িয়েছি শুধু।

মুশকিলের কথা হলো যেখানেই যাই মেহমান ভেবে শুরু করে পোলাও-রোস্ট, গোশত রান্না। আর আমার হলো জ্বালা। প্রতি বেলায় তৈলাক্ত খাবার খেয়ে পেটের অবস্থা যায় যায়!! যত নিষেধ করি, কে শোনে কার কথা! এর মাঝেই খেয়েছি নীলক্ষেতের প্রিয় শাহী জিলাপী, লাচ্ছি, এছাড়া আরো যত রকমের মিষ্টি দোকানে পাওয়া যায়, বিশেষ করে কুমিল্লার ও ঢাকার মুসলিমের রসমলাই, চাঁদপুর ওয়ান মিনিটের মিষ্টি, আইসক্রিম.........যদিও নোয়াখালীর মহিষের দুধের দই খাওয়া হলো না , তবে গরুর দুধের দইও খাওয়া হয়েছে। এরপর এক সময় শবে-বরাতের দিন এলো। তখন আমি নানার বাসায়।

সারাদিন সব পর্যবেক্ষণ করলাম, শেষ বিকেলে আর টিকতে না পেরে ছোট মামাকে বললাম শবে-বরাতের আসল ব্যাপারটা। কিন্তু তাতে কি? এতোদিনের অভ্যাস কি আর আমার এক কথাতে যায়?? যাক্‌, বাড়িতে নানারকম হালুয়া বানানো হয়েছিল, পরিবারের সদস্যরা অনেকে রোজা রেখেছেন। সন্ধ্যায় তাদের সাথে ইফতার করতে বসে নানা পদের হালুয়া খেয়েই পেটের বারোটা কাঁটায় কাঁটায় বেজে উঠলো। সম্ভবতঃ বুটের হালুয়া পেট হজম করতে পারলো না। রাতে আতশবাজির ভয়ে ছিলাম, যাক্‌ শেষ পর্যন্ত সেটা ঘটেনি, স্বস্তি।

পুরো একমাস দেশে মূল যে দায়িত্ব ছিল সেটা হলো নিজের বাচ্চা দুটোকে ফুলটাইম সময় দেয়া, তাদের পড়াশোনার তদারকি করা। বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানোর প্রচন্ড ভালো অনুভূতির পাশাপাশি তাদের এই ছোট্ট বয়সে বিশাল সিলেবাস দেখে শিউরে উঠেছিলাম। দ্বিতীয় শ্রেণীর সিলেবাসে বাংলা ১ম পত্র (সাথে গল্পজগৎ), ২য় পত্র, ইংরেজী ১ম পত্র (সাথে র‌্যাপিড রিডার বা ইংরেজী গল্প), ২য় পত্র, গণিত একটাই পত্র (ভাগ্যিস!!), পরিবেশ পরিচিতি ও সমাজ, ধর্ম, সাধারণ জ্ঞান, ড্রয়িং, হাতের লেখা, শ্রুতলিপি, পিটি......। বাংলা ব্যাকরণ (ক্রিয়ার কাল, সন্ধিবিচ্ছেদ, যুক্তাক্ষর), রচনা, চিঠি বা দরখাস্ত, ইংরেজী ব্যাকরণ (টেন্স, নাম্বার, জ়েন্ডার) , প্যারাগ্রাফ, লেটার/ এপ্লিকেশান, ৫০টির মতো অনুবাদ (বাংলা থেকে ইংরেজী, ইংরেজী থেকে বাংলা)......... এতো এতো পড়া এই বয়সের বাচ্চাদের জন্য কতটা উপযোগী আর তাতে শিশুরা কতটুকু উপকৃত হবে , বড় হতে হতে এর কতটুকু মনে রাখতে পারবে, এই ব্যাপারগুলোর প্রতি সিলেবাসপ্রণেতাদের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এখন মফস্বল শহরগুলোতে যেসব ভাল সরকারী স্কুল ছিল, সেখানে প্রাইমারী শিক্ষা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।

তাই শিশুশিক্ষা বেশীর ভাগই কিন্ডারগার্টএন নির্ভর হয়ে পড়ছে। আর তাদের সিলেবাসগুলোরই এই রকম অবস্থা। এতে করে সবচেয়ে বেশী শারীরিক ও মানসিক চাপের মুখে পড়ছে শিশুরা। আমি দেখলাম এতো চাপে বাচ্চাদের দিনে-রাতের বেশীর ভাগ সময় পড়াশোনায় কাটাতে হয়, আর তাতে করে লেখাপড়ার প্রতি একটা অনাগ্রহতা, বিতৃষ্ণা তৈরী হচ্ছে তাদের। আর অভিভাবকদের উপরও এটা প্রচন্ড চাপ তৈরী করে।

কারণ, বাচ্চারা তো আর একা একা পড়তে পারে না, তাই এতো ছোট বয়সেই অনেকের জন্য গৃহশিক্ষকের ব্যবস্থা করতে হয়। অথচ, আগে আমাদের বাবা-মারা আমাদের জন্য এতো ছোট বয়সে গৃহশিক্ষক বা প্রাইভেট পড়ার কথা চিন্তাও করতেন না। অবশেষে একসময়ে যাবার দিন ঘনিয়ে এলো। বাচ্চাদের ছেড়ে, প্রিয় মানুষটিকে ছেড়ে, বাবা-মাকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু কি আর করা!! বাস্তবতার কাছে হারতে হয় অনেক সময়ই। যেদিন ফ্লাইট ছিল তার আগের দিন নোয়াখালী থেকে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।

বাসে করে পথে যেতে যেতে রাস্তার পাশে জলাশয়ের নীলপদ্ম, কচুরীপানা, কলমীফুলগুলো খুব মনোযোগের সাথে দেখেছি, পুকুরে বড় বড় ফোঁটার ঝুপঝুপ বৃষ্টি দেখছিলাম আর ভাবছিলাম আবার কতদিন চোখ এমন সবুজ, এমন রঙ, এমন শান্ত-শ্যামল সৌন্দর্য দেখবে না!! সারা মাস জুড়ে বাদলা দিনের ঝরঝর বৃষ্টি মন-চোখ-কান ভরে উপভোগ করেছি। যদিও তীব্র যানজট, সাময়িক জলাবদ্ধতা, মারাত্মক রকমের লোডশেডিং-এর কষ্টও সয়েছি। তবুও নিজের দেশ, সে তো নিজেরই, দেশের লজ্জা, তো নিজেরই লজ্জা। কার কাছে ফরিয়াদ জানাবো? বিরক্ত লেগেছিল সবার মুখে বারবার ডিজিটাল টাইম বললি নাকি এনালগ টাইম বললি? কি মুশকিল!!! এখন যা চলছে, তা। আগেরটার কথা কেন? টাইম-এর আবার এনালগ, ডিজিটাল কি? তবে প্রায় আটটায় সূর্যাস্ত দেখে কোন অবাক হইনি, কারণ আমি এতে অভ্যস্ত ছিলাম।

'ডিজিটাল বাংলাদেশ' এটা প্রায় একটা প্রবাদে রূপ নিয়েছে, সবার মুখে মুখে, কথায় কথায়। দ্রব্যমূল্যের দাম দেখলাম গতবারের চেয়ে ২/৩ গুণ বেশী, আমার বাজার করা হতো, তাই ফারাকটা বেশ ধরতে পেরেছি, ডিমের হালি ২৬ - ৩৩ টাকা পর্যন্ত দেখেছি, ডজন কিনেছি প্রায় ৭৫-৭৮ টাকা দিয়ে। চোষা আমা কিনেছি ১৫০ টাকা কেজি। সবজি ২৮-৩০ টাকা কেজি আগেও দেখেছি। মুরগীর দামও অনেক বেশী দেখলাম।

অথচ গত আওয়ামী আমলের কথা বেশ মনে আছে, ডিম কিনেছিলাম ৩৩ টাকা ডজন, ২০০২-২০০৩ সালের সময়। জানি এখন এতো কমানো হয়তো সম্ভব না, তবুও সরকার আরো আন্তরিক আর সচেষ্ট হলে হয়তো এ দাম আরো কমানো যেতে পারে। সে সাথে প্রান্তিক কৃষকদের লাভের দিকটি এবং মধ্যসত্ত্বভোগীদের দাপট, মাঝপথে চাঁদাবাজি-- এই ব্যাপারগুলোতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার। ট্যাক্সি ড্রাইভারদের মুখে শোনা গেল আগের চেয়েও অনেক বেশী জায়গায়, ২/৩ গুণ বেশী পরিমাণে চাঁদা দিতে হচ্ছে। আবারো বলি যখন বিভিন্ন দেশের উপর দিয়ে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করেছি, একটা কথাই বার বার মনে হয়েছে, কবে এ দেশের রাজনীতিবিদরা দূর্নীতি বাদ দিয়ে দেশকে আন্তরিকতার সাথে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে? আমরা আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের ভোটে নির্বাচিত নেতাদের দিকে।

সে সাথে আমাদের জনগণদের ব্যাক্তি পর্যায়ের দূর্নীতিও দূর করা দরকার। কি দেশী , কি প্রবাসী, যার যার অবস্থান থেকে ভাল একটা চেষ্টা প্রয়োজন দেশের জন্য নিজের দায়িত্বটুকু ঠিকভাবে পালন করার। তবে দেশের মেধা যত বেশী দেশে ফিরে আসবে, ততই মঙ্গল। ব্যক্তি কথা বলতে গিয়ে অন্য কথাই মনে হয় বেশী বলা হয়ে গেল, হয়তো এটা দেশ ছেড়ে আসার মুহূর্তের কষ্টটাকে ঢেকে রাখতে গিয়েই।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।