আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি । ।
সেলাই মেশিনের আওয়াজ শুনলে আজকাল স্বপ্নার মাথা ধরে। অথচ শুধু স্কুলের সময়টা ছাড়া জেগে থাকা দিনের প্রায় সারাটা সময়ই ওকে এই শব্দটাই শুনতে হয়। এখনও মেশিনটা সমান তালে চেঁচিয়েই চলেছে।
মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে- মেশিনটা তুলে মোড়ের ময়লা বাক্সে ফেলে দিয়ে আসে। কিন্তু, ওই ভাবা পর্যন্তই, ও ভাল করেই জানে ওই মেশিন একদিন না চললে ওদেরকে উপোস করেই থাকতে হবে।
মা পারেও! সারাটা দিন মেশিন চালিয়েও যেন ক্লান্তি নেই। যদিও স্বপ্না জানে মার বানানো লাল নীল জামাগুলোর একটাও ওর জন্য নয়। ওগুলো সব দুদিন পরপর হাশেম চাচা এসে নিয়ে যাবে, আর দুদিন পরপর মা ঠিক ওইসময়ই বোধহয় একটু হাসে।
বাবা ওদেরকে ফেলে চলে যাওয়ার পর থেকে এছাড়া আর কখনোই ও মায়ের মুখে হাসি দেখেনি।
আগামীকাল ঈদ! অথচ স্বপ্না ভাল করেই জানে প্রতিবারের মত এবারও ও নুতন জামা পাবেনা। মা ওকে পুরনো জামা বের করে দিবে আর প্রতিবারের মতই স্বপ্না চোখমুখ ফুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় পড়ে থাকবে। একসময় ও ঘুমিয়েও পড়বে। আর স্বপ্নে দেখবে বান্ধবীদের সাথে সেও নুতন জামা পড়ে ঘুরছে, হাসছে, খেলছে।
আগে স্বপ্নার রাগ হত খুব। ভাবত পালিয়েই চলে যাবে যেদিকে খুশি। এখন শুধু কাঁদে, আবার চোখ মুছে হেসে মায়ের কাছে যায়। বসে মায়ের মেশিন চালানো দেখে। সে এখন ক্লাস ফোরে উঠেছে, অনেক বড় হয়ে গেছে! ও মায়ের কষ্ট বোঝে।
বোঝে মা কেন সারাদিন এভাবে মেশিনের সাথে বেঁধে নিয়েছে নিজের জীবন।
তবু ওর চোখে ভাসতে থাকে- কাল সুমি, মুন্নি, টুম্পা ওরা সবাই ঘুরবে। স্বপ্নার আবার কান্না পায়। ও তাড়াতাড়ি ওপরের দিকে তাকায়, চোখের পানি যেন গড়িয়ে না পড়ে সেদিকে অনেক খেয়াল ওর, ও এখন অনেক বড় হয়েছে না!
: স্বপ্না…
: কও মা
: ওপরে কি দেহস?
: টিন দেহি মা…
: ওমা টিনে দেহার কি আছে? ফুটা গুনস?
: না মা, এমনিই দেহি…
জমিলা সবটাই বোঝে। মেয়ের অভিনয়টুকুও।
কিন্তু করার কিছু নেই। হাশেম মিয়া টার্গেট ধরে দিয়ে যায়। টার্গেট মত সেলাই অর্ডার কমপ্লিট করতে না পারলে কন্ট্রাক্ট ক্যান্সেল। অন্য ঠিকাদারদের পেমেন্ট ভালো না। স্বভাবও ভালো না, গায়ে হাত দিতে চায়।
কালকের মধ্যে জামাগুলো ডেলিভারী দিতে হবে। জমিলা বেগম আরো তাড়াতাড়ি হাত চালায়। মেয়েটা ওপর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়েই পড়েছে!
হাতের কাজ শেষ জমিলা বেগম মেয়েকে ডাকেন…
: স্বপ্না… ও স্বপ্না… ওঠ
: কি অইছে মা?
: খাবি না?
: খিদা নাই মা…
: খিদা নাই কইলে অইব? যা আয়নায় গিয়া দেইখা আয় মুখখানা শুকাইয়া ক্যামন অইছে
: দেখা লাগবো না মা, কিসু অয় নাই…
: আরে যা না তুই, আমি কইসি একবার দেইখাই আয়।
: উঠতে মন চায় না মা…
: যা কইলাম
স্বপ্না ঘুম জড়ানো চোখে হাঁটি হাঁটি পায়ে আয়নার দিকে যেতে থাকে। জমিলা জানে আয়নার সামনে যেতেই স্বপ্নার চোখ থেকে ঘুম উড়ে যাবে।
ও খুশিতে লাফিয়ে উঠে দৌড়ে এসে জমিলার গলা জড়িয়ে ওর পড়নের জামাটা দেখিয়ে বলবে- মা… সত্যি এইটা আমার জন্য !!!
জমিলার হাত চলতে থাকে মেশিনে। একটা জামা আরও বেশি সেলাতে হবে আজ। রাত বাড়তে থাকে… স্বপ্না তখনও আয়নার দিকে চেয়ে চেয়ে নিজেকে দেখে হাসছে। জমিলার ঠোঁটেও হাসি!
মেশিন চলছে রাতের সাথে পাল্লা দিয়ে। হাই তোলে জমিলা, তবু হাত দুটো তার রঙিন সুতোয় জোড়া দিয়ে চলে দুটো জীবন… … ।
।
সেলাই দিদিমণি / সাতকাহন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।