আজি হতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছো বসি আমার ব্লগখানি কৌতুহল ভরে
স্টিফেন কিংয়ের গল্প অবলম্বনে বিশ্বখ্যাত পরিচালক স্ট্যানলি কুবরিকের পরিচালনায় হলিউডের চলচ্চিত্র "The Shining" মুক্তি পায় ১৯৮০ সালে । শুরুতেই শাইনিং দর্শক , বোদ্ধাদের রোষানলে পতিত হয় , কেউ অভিযোগ তোলেন গল্প অনুসরণ না করার , কেউ বা দুর্বল চিত্রনাট্যের । সব মিলিয়ে অসফল চলচ্চিত্র হিসেবে The Shining এর হারিয়ে যাওয়া সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় । আশ্চর্য ব্যাপার হল , দু'দশক ঘুরতেই শাইনিং বিংশ শতাব্দী অন্যতম সেরা হলিউড চলচ্চিত্রের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয় ।
The Shining থেকে চলে আসি বাংলাদেশের সুদূর শাইনিপাড়া হোল্ডিংসের বিজ্ঞাপন বা শাম্মি নাকফুলের বিজ্ঞাপনে ।
জানা গেছে গত ২/৩ বছরে বাংলাদেশের ১০টি চ্যানেলে
প্রচারিত এমন বিজ্ঞাপনের সংখ্যা মোটামুটি ৯০০ । দর্শকদের চোখে এসব বিজ্ঞাপন দুর্বল চিত্রনাট্য , সমন্বয়হীনতা , পণ্যকে ফুটিয়ে তুলতে অহেতুক নাচন-কুঁদন , সর্বোপরি অদক্ষ বিজ্ঞাপন নির্মাতা এবং কলাকুশলীদের ব্যর্থতার দোষে দুষ্ট । সেকারণে এসব বিজ্ঞাপনের কোনটিই দর্শকদের মনিকোঠায় দূরে থাক ,মনের মাঝে বিন্দুমাত্র আঁচড়ও কাটতে পারেনি ।
ব্যাপারটি অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা প্রায় শতাধিক বিজ্ঞাপন নির্মাতা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান , বিজ্ঞাপনটির নির্মাতা , বিজ্ঞাপনের কলাকুশলীদের সাক্ষাৎকার নিই । এসব সাক্ষাৎকারগুলোর প্রতিটিই যেন ছিল অন্যটির হুবুহু নকল ।
এই অনন্য ঐকতানে অভূতপূর্ব একটি
বিষয় উঠে আসে ,অনুভব করতে পারি প্রতিটি বিজ্ঞাপনই বিশ্বমানের ধ্রুপদী বিজ্ঞাপন । এক বা দু'দশক পর মত The Shining এর পথ ধরে এসব বিজ্ঞাপন/নাটক দেশ এবং দেশের বাইরের মিডিয়ায় তুমুল হৈচৈ ফেলে দেবে ।
কি করে এসব বিশ্বমানের বিজ্ঞাপন নির্মিত হচ্ছে সেসব শোনা যাক তাঁদের মুখেই :
পরিকল্পনা:
প্রাথমিক পর্যায়ে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের কম্যুনিকেশন অফিসার ব মিডিয়া ম্যানেজার তাদের কোন পণ্যের বিজ্ঞাপন তৈরির অনুরোধটি
নিয়ে স্বনামধন্য বিজ্ঞাপন নির্মাতার কাছে ধর্ণা দেন ।
.....
বিজ্ঞাপনের প্রস্তাবটি সবসময়ই বিজ্ঞাপন নির্মাতার কাছে অভিনব হয় । এতে থাকে নতুনত্বের হাতছানি , পরিচালকের মনে হতে থাকে
বিজ্ঞাপনটি অন্য সব বিজ্ঞাপনের চেয়ে আলাদা ।
শাইনি হাউজিংয়ের বিজ্ঞাপনটির নির্মাতা মোস্তাফিজ আনওয়ার শাহরুখির ভাষায় "বিজ্ঞাপনটি নির্মাণের অনুরোধ পাবার পর রীতিমত এক্সাইটেড বোধ
করছিলাম। নতুন কিছু করার একটা ইচ্ছে ছিল , বুঝতে পারছিলাম এবার সেরকম কিছুই হতে যাচ্ছে"।
.....
পরের ধাপে বিজ্ঞাপন নির্মাতা কয়েকজনকে সাথে নিয়ে স্ক্রিপট লিখতে বসেন । আপাত দৃষ্টিতে ভীষণ তাড়াহুড়োর মাঝে দায়সারা স্ক্রিপ্ট লেখা হয় , তবে প্রকৃত অনুসন্ধানে জানা যায় , এসব স্ক্রিপ্টের প্রতিটিই প্রচলিত ধারার বাইরে নতুনত্ব থাকে ।
কাস্টিং
দেশের সহস্রাধিক নায়ক-নায়িকার মাঝে , বিজ্ঞাপনটির নায়ক-নায়িকা নির্বাচনের সময় কেবল সে দু'জনকেই নির্বাচিত করা হয় যারা এ বিজ্ঞাপনের জন্য সবচেয়ে বেশি যোগ্য ।
মোটকথায় এমন দু'জন যাদের জন্মই যেন এ বিজ্ঞাপনটি তৈরি করতে । সিলেকশন প্রক্রিয়ায় ঝক্কিও কম
নয় , অনেকক্ষেত্রে নির্মাতা এ বিজ্ঞাপনের জন্য ভুল সিলেকশন করে বসেন , তবে প্রকৃতি সেটা শুধরে দেয় । যেমন শাইনি নাকফুলের জন্য জন্ম নেয়া দু'জন মডেল নোবেল এবং বিজরী । কিন্তু সেটা অনুভর করতে ব্যর্থ হয়ে বিজ্ঞাপনে প্রাথমিক ভাবে সিলেক্ট করা হয় ইমন-বিন্দু জুটিকে । এত নিম্নমানের বিজ্ঞাপন করতে তারা অস্বীকৃতি জানালে
পরবর্তীতে নীরব-ইশিতাকে কাস্ট করা হয় ।
তবে নীরব লম্বা হাতাওয়ালা জামা পড়ে মডেলিং করতে অস্বীকৃতি জানালে নোবেল-বিজরীকে অনুরোধ করা হয় । এভাবে প্রাকৃতিক নিয়মে বিজ্ঞাপনটি তার পারফেক্ট ম্যাচ খুঁজে পায়।
.....
নায়ক-নায়িকা নির্বাচনের পর প্রতিবারই একটা সমস্যা দেখা দেয় । তাদের একজন বা দু'জনই সময় স্বল্পতার কারণে বা কাজের চাপে শিডিউল মেলাতে না পারায় , বিজ্ঞাপনটির নির্মাণে সাময়িক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা দেখা দেয় ।
.....
পরবর্তীতে অভিনব একটি উপায়ে এই অনিশ্চয়তার মেঘ কেটে যায় ।
রহস্যজনক বা আধ্যাত্মিক কোন কারণে নায়ক-নায়িকার কাছে বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট অসম্ভব পছন্দ হয়ে যায় । কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের মনে হতে
থাকে এমন বিজ্ঞাপনটি করার জন্যই জন্য ক্যারিয়ার হিসেবে মডেলিংকে
বেছে নিয়েছিলেন । বিজরির ভাষায় "শাম্মি নাকফুলের বিজ্ঞাপনটির স্ক্রিপ্ট পড়ার পরই ডিসিশন নিয়ে ফেলি , কাজটি যে করেই হোক আমাকে করতেই হবে । "
লোকেশন,অ্যাকশন
পরের ধাপে বিজ্ঞাপনের লোকেশন ঠিক হয় , বিজ্ঞাপনের পরিবেশের সাথে লোকেশন সবসময় দারুণভাবে মিলে যায় ।
.....
প্রতিটি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেই একটানা কাজ চলে ।
টানা তিন/চারদিন দিনরাত কাজ চলে । নোবেলের ভাষায় "নাকফুলের বিজ্ঞাপনটি
করতে আমরা টানা তিন/চারদিন গহীন জঙ্গলে ভোর পর্যন্ত একটানা কাজ করেছি"
.....
বিজ্ঞাপনের শ্যুটিংয়ের সময় অনেক মজার ঘটনা ঘটে । সাধারণত , শ্যুটিং ইউনিট আর সেটের সবাই মিলে অনেক মজা করেন। মডেলদের কাছে মজার ঘটনা জানতে চাইলে একাধিক মজার ঘটনার বর্ণনা
তারা দেন । বিজরী বলেন "নাকফুলের বিজ্ঞাপনে জংগলের মাঝে
হঠাৎ করেই আলো নিভে যায় , ভূতের কথা ভেবে আমি তখন শিউড়ে
উঠি" ।
.....
মডেলদের দু'জনের যে কোন একজনের সাধারণত প্রবল জ্বর থাকে । সাধারণত বৃষ্টির দৃশ্যে নাচতে গিয়ে মডেলদের কোন একজন জ্বর বাধিয়ে ফেলেন । তবে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর নিয়েও তারা সুচারুভাবে কাজটি
সম্পন্ন করেন।
.....
ইউনিটের মাঝে কোন একজন পুরো সেট মাতিয়ে রাখেন । বিজরি বলেন "ইশতিয়াক ভাই আমাদের সবাইকে সারাদিন মাতিয়ে রাখতেন , তাই কখনও ক্লান্তি অনুভব করিনি"।
.....
পারফেকশন নিশ্চিত করতে মডেলরা বেশ কিছু শট অসংখ্যবার দিয়ে থাকেন । পরিচালক শাহরুখীর ভাষায় "নোবেলকে দাঁড়িয়ে
থাকার শটটি ৪৭ বার দিতে হয়েছে , তবুও হাসিমুখে সে কাজটি করে
গেছে "
.....
বিপজ্জনক শটে মডেলগণ স্টান্ট ছাড়া কাজ করেন । বেশিরভাগ সময় তারা অল্পের জন্য বেঁচে যান ।
.....
মডেল জুটির দু'জনের আগে করা যদি অন্য বিজ্ঞাপন থেকে থাকে
সেক্ষেত্রে তাদের বোঝাপড়াটা খুব ভাল থাকে । বিজরী এ প্রসংগে বলেন "নোবেলের সাথে আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা দারুণ , আমি কি
করতে যাচ্ছি ও খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলে, আমি হাঁচি দিতে গেলে
ও আগে থেকেই দূরে সরে যায় , ও হাঁচি দিতে গেলে আমি দু'কান বন্ধ করে ফেলি" ।
.....
তবে , কাজটি যদি মডেল জু'টির নতুন কোন কাজ হয় , সেক্ষেত্রে
দু'ধরণের ঘটনা ঘটে । একজন শিল্পী সিনিয়র হলে , তিনি তেঁড়েফুঁড়ে
অন্যজনকে কাজ বুঝিয়ে দেন । মাহফুজ প্রসংগে নবাগতা তনিমা বলেন "মাহফুজ ভাই খুব যত্ন করে আমাকে প্রতিটা কাজ শিখিয়েছেন , দু'দিনেই তাকে খুব আপন মনে হচ্ছিল" । শিল্পীদের দু'জনই যদি
একই ক্যাটেগরীর হন , সেক্ষেত্রে দু'জনই দু'জনকে সাহায্য করেন ।
.....
বিজ্ঞাপনটি করতে গিয়ে মডেলরা তাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কাজে
লাগান , এরফলে তারা আরও চমৎকারভাবে বিজ্ঞাপনটির সাথে মিশে
যেতে পারেন ।
বাংলালিংক বিজ্ঞাপনটিতে জ্বরাবস্থায় হাস্যকরভাবে
মুখ ফুলিয়ে রাখার কথা জানতে চাইলে নোবেল বলেন "আমার জ্বর হলে আমি শীতে মুখ ঢোল বানিয়ে রাখি , এখানেও চেষ্টা করেছি জ্বরের আসল ফিলিংসটা আনতে "
.....
বিজ্ঞাপনটি নির্মিত হওয়ার পর সেটি দেখে মডেলরা সাধারণত অঝোর ধারয় কেঁদে ফেলেন । বিজরী বলেন "পর্দায় যেদিন প্রথম নাকফুলটা দেখি , সবার সাথে আমিও কেঁদে ফেলি" ।
.....
মডেলগণ বিজ্ঞাপনের ফাঁকে তাদের পারিবারিক এবং সামাজিক বন্ধন অটুট রাখেন । নোবেল বলেন , "আমার বউ প্রতিবেলায় ফোন করে আমার খোঁজ নিত" । হেলাল বিউটি-সোপের দৃশ্যে সম্প্রতি
কাপড় ছুঁড়ে দেয়া মডেল রাঁধন বলেন ...."আমার ফ্যামিলি ভীষণ কনজার্ভেটিভ , ওদের কথা মাথায় রেখে সবসময় কাজে হাত দিই"
শেষকথা
এসব ঘটনা পরিস্কারভাবে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন জগতে বিপ্লবেরই ইংগিত দেয় ।
হলিউডের The Shining সিনেমার পর শাইনি হোল্ডিং বা শাম্মি নাকফুলের বিজ্ঞাপনটির ২০২৫ সালে হিট হয়ে যাবার সম্ভাবনা একটি কথাই আবার পরিস্কার করে দেয় .........
হিস্ট্রি রিপিটস ইটসেলফ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।