ভালো আছি
হঠাৎ চমকে ওঠেন শার্লক হোমস অনুরাগীরা। শার্লক হোমস নাকি আর নেই! না, না এ হতেই পারে না। সোচ্চার হলেন অসংখ্য হোমস অনুরাগী। এ অসম্ভব! অবিশ্বাস্য! অকল্পনীয়! সত্যিই তাই । হোমস অনুরাগীদের কাছে এ এক চরম আঘাত ।
শার্লক হোমসের মৃত্যু তারা ভাবতেই পারে না। কিন্তু তবু তার মৃত্যু হলো।
কুখ্যাত প্রফেসর জেমস মরিয়াটির সাথে লড়াই করতে গিয়ে মারা গেলেন তিনি। দুরন্তু জলপ্রপাত। বরফ-গলা সেই হিমশীতল পানিতে পড়ে তলিয়ে গেলেন দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা শার্লক হোমস।
চূড়ান্ত সমস্যার সুরাহা করতে গিয়ে চরম পরিণতি ডেকে আনলেন দুর্দান্ত সাহসী আর প্রখর বুদ্ধির অধিকারী গোয়েন্দা হোমস। রাইকেনবাকের সেই ভয়ঙ্কর খাদের কিনারে দাড়িয়ে দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয় শার্লক হোমস এবং শয়তান প্রফেসর জেমস মরিয়াটির মধ্যে । লড়াই করতে করতে পাহাড়ী নদীর খরস্রোতের মধ্যে পড়ে গেলেন হোমস। একই সাথে মরিয়াটিও। ‘ফাইনাল প্রবলেম’ গল্পে এভাবেই মৃত্যু হলো বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমসের।
না, তার দেহ পাওয়া যায়নি। ইচ্ছাকৃতভাবে ওখানে একটু ফাঁক রেখেছিলেন স্যার আর্থার কোনান ডয়েল। ফলে হোমস অনুরাগীরা বিশ্বাসই করলেন না যে হোমসের মৃত্যু হয়েছে। তা ছাড়া, তাদের কাছে শার্লক হোমস অমর, অবিনশ্বর নাম, তাকে মারতে পারে না তার স্রষ্টাও। তাই হোমস অনুরাগীদের চাপে আর প্রকাশকদের অনুরোধে শার্লক হোমসকে আবারও ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হলেন খোদ কোনান ডয়েলই।
হোমসের স্রষ্টা ফেরালেন তার সৃষ্টিকে। ফিরে এলেন সেই অমর চরিত্র ‘দ্য রির্টান অভ শার্লক হোমস’-এ। দেখা গেল আবার হোমসের উজ্জ্বল উপস্থিতি। বিশ্বসাহিত্যে এরকম নজির আর দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ।
হোমস পর্ব লিখতে লিখতে বিরক্ত, বীতশ্রদ্ধ, কান্ত ডয়েল আরও একবার চেষ্টা করেছিলেন শেষ করে দিতে শার্লক হোমসের গোয়েন্দা জীবন।
তাই ১৯১৪ সালে তিনি লিখলেন ‘হিজ লাস্ট বাউ’। এখানে তিনি দেখালেন, গোয়েন্দাগিরিতে বীতশ্রদ্ধ হোমস মৌমাছি চাষে মেতে উঠেছেন। গোয়েন্দাগিরি তার আর ভালো লাগছে না । তাই লাস্ট বাউয়ে লেখক শার্লক হোমসের মুখ থেকে বলিয়ে নিলেন, ‘এ আমার শেষ তদন্ত অভিযান’। কিন্তু না, হলো না।
শেষ হলো না হোমসের গোয়েন্দাগিরি। হবে কী করে? তার ল ল অনুরাগীরা হোমসকে কি ছাড়তে পারে কখনও? তা বোধ হয় সম্ভবও নয়। আর হোমস পালাবেনই বা কোথায়। যতই তিনি সরে পড়বার চেষ্টা করুন, তাকে ফিরে আসতেই হবে । নিস্তার নেই তার স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েলের ।
নিজেরই সৃষ্টির জালে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। হোমসের কাছ থেকে এত সহজে মুক্তি নেই তার । ইচ্ছে করলেই তো আর মুক্তি পাওয়া যায় না । খ্যাতির বিড়ম্বনা যাবে কোথায়? সুতরাং আবারও আবির্ভাব হলো শার্লক হোমসের । ফিরে এলেন ‘দ্য কেস বুক অভ শার্লক হোমস’-এ।
এ এক অদ্ভুত প্রত্যাবর্তন।
আসলে গোয়েন্দা কাহিনী লিখতে লিখতে কান্ত হয়ে পড়েছিলেন কোনান ডয়েল । কান্ত হওয়াটা স্বাভাবিক। কেননা এ ধরনের লেখার জন্য প্রচুর চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন। একই বিষয়ে কত আর নতুন চিন্তা মাথায় আসে।
তা ছাড়া এেেত্র সময়ও ব্যয় হয় প্রচুর। লেখক নিজেও চেয়েছিলেন নতুন কিছু লিখতে। শুধুই রহস্য সৃষ্টি আর রহস্যভেদ করতে করতে একঘেয়ে হয়ে ওঠেন কোনান ডয়েল। কিন্তু হলে কী হবে, এ থেকে সরে আসবার উপায়ও নেই। কারণ কোনান ডয়েল এবং শার্লক হোমস দু’জনেই তখন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছেন ।
কাল্পনিক চরিত্র হয়ে উঠেছে প্রায় রক্তমাংসের মানুষ। এখানে স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টি অনেক জনপ্রিয়। তাই স্রষ্টাকে বারবার ফিরতে হয়েছে সৃষ্টির কাছে।
১৯৩০ সালে মৃত্যু হয় স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের। স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টিরও শেষ পরিণতি ঘটে অর্থাৎ ওখানেই থেমে যায় তার সৃষ্ট চরিত্রের জীবন।
তা আর এগোতে পারে না । স্রষ্টা না থাকলে সৃষ্টির প্রশ্নই ওঠে না । কিন্তু অবাক ব্যাপার, এেেত্র তা ঘটেনি। শার্লক হোমস থেমে যাননি। শেষ হয়নি তার কার্যকলাপ ও রহস্যভেদের অভিযান।
এগিয়ে এলেন নতুন প্রজন্মের নতুন লেখকরা শার্লক হোমস লিখতে । একের পর এক তারা লিখলেন হোমসের নতুন নতুন কাহিনী । আবারও একবার জীবন ফিরে পেলেন বিখ্যাত গোয়েন্দা শার্লক হোমস। বিস্ময়, সত্যিই বিস্ময়।
শার্লক হোমস যে একটা কাল্পনিক চরিত্র, একথা আজও অনেকে বিশ্বাস করে না।
এখনও তার নামে ২২১/বি, বেকার স্ট্রিটের ঠিকানায় সপ্তাহে গড়ে ৫০-৬০ খানা চিঠি আসে । সেসব চিঠি তো আর তার সহকারী বন্ধু ওয়াটসনের হাতে পড়ে না, তবুও চিঠির উত্তর পায় সকলে। উত্তর দেওয়া হয় ‘হোমস সোসাইটি’- এর প থেকে । জানানো হয়, আমরা দুঃখিত। শার্লক হোমস এখন গোয়েন্দাগিরি করছেন না, তিনি তার পেশা ছেড়ে মৌমাছি পালনে ব্যস্ত।
শার্লক হোমস ওই পত্র লেখকদের কাছে নিঃসন্দেহে জীবন্ত মানুষ। তিনি যে লেখকের কল্পনার চরিত্র, একথা মানতে চায় না তারা । সত্যিই এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। যেন এক মজার খেলা।
শার্লক হোমসকে নিয়ে গবেষণা চলেছে গোটা বিশ্ব জুড়ে।
তাকে ঘিরে পৃথিবীর সেরা দুটি শিা প্রতিষ্ঠান কেমব্রিজ এবং অক্সফোর্ডের মধ্যে দ্বন্দ্ব-যুদ্ধ চলেছে বহু বছর । দুই প্রতিষ্ঠানেরই দাবি, হোমস ছিলেন তাদের ছাত্র। দীর্ঘ লড়াইয়ের পর পাল্লা ভারী হয় অক্সফোর্ডের দিকেই। হোমস নাকি তাদেরই ছাত্র ছিলেন ।
হোমসের জন্ম সাল নিয়েও রয়েছে কিছুটা তর্ক-বিতর্ক।
মোটামুটি ভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে ১৮৮৭ সালে তার জন্ম। কেননা ওই বছরই ‘আ স্টাডি ইন স্কারলেট’ উপন্যাসে প্রথমবারের মত আবির্ভাব ঘটে শার্লক হোমসের । একটি কাল্পনিক চরিত্রের যেন জীবন্ত আবির্ভাব। তখন ওই উপন্যাসে হোমসের বয়স ছিল ৩৩ বছর। এ কারণে অনেকেই মনে করে ১৮৫৪ সালে হোমসের জন্ম।
তাই ১৮৫৪ আর ১৮৮৭ সালেই গোটা ব্রিটেন এবং প্রথিবীর অন্যান্য দেশেও শার্লক হোমসের শতবর্ষ পূর্তি সাড়ম্বরে পালিত হয়। একটা কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে সুশিতি, সুসভ্য ব্রিটিশদের এরকম পাগলামি বা মাতামাতি ভাবা যায়! তবুও মাতামাতি হয়েছিল। কারণ কাল্পনিক এ চরিত্রটি সাধারণ মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছিল স্থায়িভাবে। আর এ জন্যই শার্লক হোমস নামটি অমর হয়ে আছে আজও। যতদিন মানব সভ্যতা থাকবে, ততদিন শার্লক হোমসও থাকবেন।
পৃথিবীর প্রায় সব ভাষাতেই অনুবাদ হয়েছে শার্লক হোমসের গল্প-উপন্যাস। বাংলাতে হোমস প্রথম অনুবাদ করেন কুলদারঞ্জন রায়। তিনি অনুবাদ করেছিলেন মাত্র তিনটি বই। বইগুলো হলো, বাস্কারভিলের কুক্কুর(হাউন্ড অভ বাস্কারভিল), শার্লক হোমস-এর বিচিত্র কীর্তি(অ্যাডভেঞ্চার অভ শার্লক হোমস), এবং শার্লক হোমস-এর নথি(দ্য কেস বুক অভ শার্লক হোমস)। এর মধ্যে প্রথম দুটি বই প্রকাশিত হলেও, তৃতীয় বইটি আজও অপ্রকাশিত।
ডয়েলের ছেলের আপত্তির কারণে প্রকাশক তৃতীয় বইটি প্রকাশ করতে পারেনি সে সময়। পরবর্তীকালে ডয়েলের গ্রন্থ-স্বত্ব চলে যাবার পর বাংলাতে অনেকবার অনুবাদ হয়েছে হোমস কাহিনী।
শুধু অনুবাদই নয়, শার্লক হোমসের চরিত্র অবলম্বনেও বাংলা সাহিত্যে লেখা হয়েছে অসংখ্য কাহিনী। পরশুরাম তো তার মত এক শখের গোয়েন্দাই বানিয়ে ছাড়লেন। যার নাম দিলেন ‘সরলা হোম’।
এ ছাড়াও পাঁচকড়িদের ‘হরতনের নওলা’, প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘জলার পেতœী’ এবং হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘চতুর্ভূজের সার’-এসব গোয়েন্দা কাহিনীতে আর্থার কোনান ডয়েলের প্রভাব সুস্পষ্ট। এই প্রভাব কোনও দোষের নয়। একে সাহিত্যের চুরিও বলা যাবে না । বরং বলা উচিত শার্লক হোমস তার অসাধারন মতার জোরে অনায়াসে ঢুকে পড়েছেন বাংলা সাহিত্যের আঙিনায়।
১৯৩০ সালে কোনান ডয়েলের মৃত্যুর পর থেকেই লেখা শুরু হয়েছে শার্লক হোমসকে নিয়ে নতুন কাহিনী, নতুন লেখকদের কলমের ছোঁয়ায় হোমস ফিরে এসেছেন নানাভাবে, নানারুপে।
১৯৫২ সালে অর্থাৎ ডয়েলের মৃত্যুর ২২ বছর পরে হোমসকে নিয়ে প্রথম প্রকাশিত হয় একটি কাহিনী সংকলন ‘দ্য এক্সপ্লয়েন্ট অভ শার্লক হোমস’। কোনান ডয়েলের না লেখা বহু অভিযানের কাহিনী এতে পাওয়া যায়। যারা লিখেছেন তাদের মধ্যে একজন ডয়েলের ছেলে অ্যাড্রিয়ান কোনান ডয়েল। অন্যজন ঔপন্যাসিক জন ডিকসনকার। দ্বৈত প্রচেষ্টায় বইটি অসাধারণত্বে বুঝি ডয়েলকেও ছাড়িয়ে গেছে।
পাঠকরা মুগ্ধ, আভিভূত। এর পরে শার্লক হোমসের অকথিত অভিযান নিয়ে অপূর্ব গোয়েন্দা কাহিনী লিখেছেন বহু বিখ্যাত লেখকরা। জন টমসনের ‘দ্য সিক্রেট ফাইলস অভ শার্লক হোমস’, হেনরি লেজার্ডের ‘দ্য সেভেন পার্সেন্ট সলিউশন’ এবং মাইকেল ডিবডিনের ‘দ্য লাস্ট শার্লক হোমস স্টোরি’ বইগুলোতেও নতুন হোমসের আত্মপ্রকাশ দেখা যায়। সেই চলন-বলন, ভাবভঙ্গি, প্রখর বুদ্ধিমত্তা সবকিছুই দেখা যায় নতুন শার্লক হোমসের মধ্যে। ‘দ্য ফাইনাল প্রবলেম’ গল্পে কুখ্যাত অপরাধী প্রফেসর জেমস মরিয়াটির সঙ্গে লড়াই করতে করতে জলপ্রপাতে তলিয়ে গিয়েছিলেন শার্লক হোমস।
ঠিক ওখান থেকেই শুরু হয় ডিবডিনের রহস্য-উপন্যাস ‘দ্য লাস্ট হোমস স্টোরি’। এ উপন্যাসে দেখা যায় চলতি সময়ের ইউরোপের কুখ্যাত নারীহন্তা জ্যাক দ্য রিপারকে তাড়া করছেন হোমস। এক অসাধারণ গোয়েন্দা কাহিনী।
বেশ কয়েক বছর আগে বেরিয়েছে ‘ম্যামথ বুক অভ নিউ শার্লক হোমস অ্যাডভেঞ্চারস’। আবারও নতুন করে ফিরে এলেন হোমস পাঠককুলে।
এই সংকলনটির সম্পাদক মাইক অ্যাসলে। নতুন প্রজন্মের গোয়েন্দা কাহিনী। কিন্তু গল্পে গোয়েন্দা সেই চিরপুরনো শার্লক হোমস। এখানে শার্লক হোমসের অনেক না বলা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন ডা. ওয়াটসন । এভাবেই বারবার হারিয়েও আবার ফিরে আসেন প্রিয় গোয়েন্দা হোমস।
প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জনপ্রিয়তার শীর্ষে বসে থাকবেন তিনি । তার আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমেনি এবং কমবেও না পাঠকদের কাছে। অবিস্মরণীয় এই গোয়েন্দা চিরজীবী। তার মূত্যু নেই।
তথ্যসূত্র: (সংগৃহীত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।