মুক্তমন। █▓▓▓▒▒▒░░░░
২০১৫ সাল। জানুয়ারীর কোনও এক গভীর রাত। ঘড়ির কাটা অবিরাম টিক্ টিক্ শব্দে হেটে চলেছে। প্রায় সাড়ে তিনটা।
চারিদিকে শীতেল আবহাওয়া। কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। আশপাশের কিছু কিছু বাসার অলিন্দে গুটি কয়েক বাতি জ্বলছে। আলো আধারির মাঝে এক মায়াবী রজনী। অথচ গা ছমছম পরিবেশ।
পাশেই একটি হাইওয়ে। বহুক্ষণ পর পর দু-একটা গাড়ী সাঁ-সাঁ শব্দে দূরে হারিয়ে যায়।
আমার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। কেমন যেনো গরম অনুভূত হচ্ছে। লেপ সরিয়ে পায়ের তলায় ফেললাম।
শুয়ে শুয়ে ভাবছি- মাঘের মাঝামাঝি কুহেলিকায় ঘেরা এই হিমেল রাতে এতো গরম! কারণ কী? ঘুমানোর আগে তো এমন ছিলনা! কিচেনে গিয়ে এক গ্লাস পানি পান করলাম। নাহ! পানি তো নয়। যেনো বরফ কণা শিরশির করে গলা দিয়ে ঢুকছে। বারান্দায় এসেছি। শশশশশশশশ্... একঝাঁক শৈত্য প্রবাহ এসে আমায় আঘাত করল।
দ্রুত বেডরুমে আসলাম। কী ব্যপার! রুমটা এখনও গরম হয়ে আছে। নাহ! বাতিটা জ্বালতেই হবে। ইদানিং এই বাসাটায় কী সব অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে যার মাথামুণ্ডু কিছুই উদ্ধার করতে পারি না। কোনও একসময় অপার্থিক জগতের গল্প লিখতাম।
আজ কি তাহলে অপার্থিব কিছু ঘটতে যাচ্ছে! আমি সুইচ বোর্ডের কাছে গেলাম। কিন্তু সুইচে হাত দেবার আগেই আমি যেন আড়ষ্ট জমে গেলাম। কেউ একজন আমার হাতটা চেপে ধরেছে! অথচ আমি দেখছিনা। এসব কী হচ্ছে? আমি কি জেগে আছি? না স্বপ্ন দেখছি? নাতো... আমি যে একটু আগেই বারান্দায় গিয়েছিলাম!
"বাতি জ্বালার প্রয়োজন নেই। " একটি কণ্ঠ শোনা গেল।
মেয়ে কণ্ঠ। বিছানার দিক থেকে। আমি তাকালাম সেদিকে। হুমম. আমি যেখানটায় শুয়েছিলাম। ঠিক সেখানেই।
একটি ঘন ছায়া দেখা যাচ্ছে। সে আবার বলল- “এদিকে এসো... আমার পাশে বসো”। আমি ভয় পাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম রুম থেকে বেরিয়েই এক ছুটে পাশের ফ্লাটে যাব। শুভকে ডেকে তুলব।
সে যেন আমার মন ঘুরে এলো। বলল- তুমি বোধ হয় খুব ভয় পেয়ে গেলে? একটু থেমে আবার বলে- “আমি জানতাম না তুমি এতো ভীতু”। আমি প্রচুর ঘামছিলাম। সে আবার বলে- “বলেছি না কাছে এসো! কোনও ভয় নেই”। আমি সভয়ে জিজ্ঞেস করলাম- কে তুমি? এখানে কী করো? কেনো এসেছো? আমার কাছে কেনো?
আমি দাড়িয়ে।
সে চুপ। পিনপতন নিরবতা।
মিনিটখানেক পর। সে আবেগঘণ কণ্ঠ বলে- “তুমি আমার কাছে আসবে না”?
তার এই কথা আমার কানে বাজছে। যেনো বহুদূর থেকে সে করুণ স্বরে বলছে।
আর তা বাতাসের বাঁকে বাঁকে, তরঙ্গের স্রোতধারায় ফিরে ফিরে আমার কাছে আসছে। দেয়ালের সাথে বাঁধা পেয়ে রিনিরিনি শব্দে বেজে উঠছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সামনে এগিয়ে যাই। বিছানার দিকে। ছায়ামানবীর পাশে বসি।
সে বলল- “এবার দু’চোখ বন্ধ করো”। আমি চোখ বুঁজলাম। সাথে সাথেই আমি অনুভব করলাম- সম্মোহিত এই আমাকে কেউ একজন উষ্ণ আবেশে জড়িয়ে ধরেছে। একই সে বলে উঠল- “চোখ খোলো”। আমি চোখের পাতা মেললাম।
আমি অভভূত হয়ে গলোম। পুরোটা ঘর জুড়ে আলো আধারির খেলা। গোলাপী অথচ সাদা রঙের আলোর পাখিরা যেনো ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছে, আলোর মেঘেরা যেনো চারিদিকে ঢেউ ছড়াচ্ছে; আর আমাকে জড়িয়ে আছে রূপকথার কোনও রাজকন্যা। আমি কেবলি চেয়ে আছি। তার পানে শুধু তাকিয়েই আছি।
অপলক নেত্রে। আমি ভুলে গেছি- আমি পৃথিবীর রক্তে মাংসে গড়া মাটির মানুষ। আমার অনুভূতি শক্তি আমাকে বলছে- আমি ভূ-মন্ডলে নেই। আছি স্বর্গধামে। অথবা কোনো এক অজানা অথচ চিরচেনা গ্রহে।
এখন আমি ভীতিশূন্য। আমি দেখছি। আমার চোখের এক সেন্টিমিটার দূরে তার চোখের ঘণকোমল পাপড়ীগুলো। তার আবেগঘন মায়াবী দু'টি নয়ন পল্লব। তার রেশমি সোনালী লম্বা ঘনচুল।
অন্তরচ্ছেদীয়া উজ্জ্বল দৃষ্টি দিয়ে আমার চোখে তাকিয়ে। আমার শিরায় শিরায় রক্ত চলছে ২০০০ মাইল বেগে। সে আমায় বলে- জানতে চাও- আমি কে? আমি কিছুই বলতে পারি না। সে বলে- "আমি এঞ্জেলিকা। মহাশূন্যের পরী।
মাঝে মাঝেই আমি পৃথিবীতে আসি। তোমার কাছে। তোমার লেখনীর ডাক আমায় টানে। তাই আমি না এসে থাকতে পারি না। আমি তোমার আশেপাশেই থাকি।
তোমায় পাহারা দেই। কিন্তু তুমি আমায় দেখতে পাও না। গত পরশু তুমি বসুন্ধরা সিটি থেকে বেরিয়ে দেখলে- তোমার গাড়ীটা বোমা বিষ্ফোরণে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আর দশ সেকেন্ড পূর্বে আসলে তুমিও হয়তো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে। তোমার কি মনে পড়ে? লিফ্ট থেকে বেরিয়ে আসার সময় তোমার সাথে কারো ধাক্কা লাগার কথা? সেই মেয়েটা আমিই ছিলাম"।
সে হাসে। তার চেহারায় গোলাপের লালিমা। দাঁতগুলো যেনো মুক্তার দানা। চিক চিক করছে। যেনো আলোর বিকিরণ ঘটছে।
আমি জানতে চাইলাম- তুমি আমার কাছে কেনো আস? সে বলে- "পৃথিবীর মানুষ আমাদের বাস্তবতাকে মেনে নিতে না। তারা আমাদের রূপকথায় সীমাবদ্ধ রাখতে পছন্দ করে। তাই আমরাও সাধারণতঃ ভূ-মন্ডলে আসি না। আসলেও লোকচক্ষুর অন্তরালেই থাকি। ইচ্ছে করেই।
কিন্তু যারা আমাদের নিয়ে ভাবে; আমাদের নিয়ে লেখে, আমরা তাদের কাছেই যাই। তুমি আমাদের নিয়ে অনেক গল্প লিখেছো। আমাদের নিয়ে তোমার লেখা গল্পগুলো আমার অনেক অনেক ভালো লাগে। তোমাকে আরও বেশি ভালো লাগে। তাই আমি তোমার কাছেই আসি।
"
কখন যে রাত শেষ হয়ে এলো টেরই পেলাম না। সে আমায় বলল- আজ আর নয়। আরেকদিন কথা বলবো। তুমি ভালো থেকো... আমি কিছু বলার আগেই সে হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। কিছুটা সময় পর পুরোটা রুম আবার অন্ধকারে ছেয়ে গেল।
নাহ! আমি পৃথিবীতেই আছি। এখন শীতকাল। লেপ মুড়ি দিয়ে শুতে হবে। অনেক ঘুম পাচ্ছে। একটু ঘুমাবো।
... ... ... ... ...
প্রায়ই রাতে এঞ্জেলিকা আসে। আমরা কতো কথা বলি! কতো খুনসুটি হয়! এদিকে বাবা মা আমার জন্য মেয়ে দেখে। হুমম. জুনের ৮ তারিখে আমার বিয়ে। এঞ্জেলিকা খুব মন খারাপ করে। এখন আর সে আমার সাথে আগের মতো কথা বলে না।
তার চেহারাটা যেনো আজন্ম উদাসের চিহ্ন।
শেষবার যখন তাকে দেখি। সে আমার সাথে কোনও কথা বলেনি। বিয়ের ১ দিন আগে। কয়েক মিনিটের জন্য এসেছিল।
খুব কেঁদেছিল।
আমি বিয়ে করেছি। নাহ. এঞ্জেলিকা আর আসেনি। এখন আর তার উপস্থিতিও টের পাই না। বউ নিয়ে সুখে আছি।
এবার দেশের অবস্থা বলি। জনগণের স্বার্থে সংবিধান পূণরায় সংশোধন করা হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে। প্রত্যেকটা যুদ্ধাপরাধীকে খুঁজে খুঁজে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছে।
বাচ্চু রাজাকার আর কাদের মোল্লাও বাদ যায়নি। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নিজেদের ভুল স্বীকার করে জামায়াতকে বর্জন করেছে। দেশের মানুষ ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াতে ইসলামী কে সম্পূর্ণরূপে বয়কট করেছে। উক্ত সংগঠনের সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। আদালত কর্তৃক জামায়াত-শিবিরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
জঙ্গি সংগঠন তালেবানের সাথে জড়িত থাকার কারণে সমগ্র বিশ্বে জামায়াতের প্রতি তীব্র নিন্দা ও ঘৃণা জানানো হচ্ছে। এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাঙ্গালীদের উপর অত্যাচার, নির্যাতনের অপরাধে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য জাতিসংঘ কর্তৃক পাকিস্তানকে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এবং নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর ক্ষমা না চাওয়া হলে এর পরিণতিও তাকে ভোগ করতে হবে।
===================================================
২৫ বছর পর। লন্ডন।
স্বয়ং বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী তাঁর জন্মদিনে আমাকে আমন্ত্রণ করেছেন। সেই সাথে আমাকে নোবেল পুরষ্কার দেয়া হলো। জীন-পরীদের অনেক অজানা তথ্য মানব জাতির কাছে উন্মোচন করায়। আমি নিজেকে গর্বিত মনে করিনা। কারণ, আমি জানি- এই পাওয়ার পেছনে আমি কী হারিয়েছি! তবে আমি ভাবি- এই পঁচিশ বছরে আমার বাংলাদেশ কী পেয়েছে।
হুমম. প্রাপ্তি অনেক! আজ বাংলাদেশ বিশ্বের ৭ম শক্তিশালী দেশে পরিণত হয়েছে। শুধু কি তাই? একটি আদর্শ রাষ্ট্র। সেখানে কোনও রাজনৈতিক হানাহানি নেই। সরকারী এবং বিরোধী দল চেনার নেই কোনো উপায়। সবাই দেশের স্বার্থে কাজ করে যায়।
কোথাও কোনও দূর্নীতি নেই। অপরাধী সে যেই হোক- তার নেই কোনও ক্ষমা। আজ বাংলাদেশের এক টাকার মান ১.৭০ মার্কিন ডলার।
খুব ক্লান্ত লাগছে। সকালের ফ্লাইটেই আবার বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে।
হাতে আছে মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। একটু ঘুমিয়ে নেই।
বিছানায় একটি মেয়ে। জানালা দিয়ে বাইরে দূরে তাকিয়ে আছে। মনে রাতের আকাশ দেখছে।
সোনালী চুলগুলো পিঠ পেরিয়ে মনে হয় খাটে বিছানো। নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী হবে। কিন্তু... কিন্তু এখানে তো কোনও মেয়ে থাকার কথা নয়!!! আরে... এখানে তো আমি ছাড়া আর কেউই ছিলনা? তাহলে এই মেয়ে আসল কোথা থেকে? এইসব তেরো চৌদ্দ ভাবছি যখন- ঠিক তখনই মেয়েটা পেছনে ফিরল। ভাবলেশহীন অবয়বে আমার দিকে চেয়ে আছে। চেনা চেনা মনে হয়।
কোথাও দেখেছি কি? হুমম. বোধ হয় দেখেছি...। এমনই সময় সে বলে উঠল- "আমাকে তুমি চিনতে পারোনি?" তার কথায় আমি চমকে গেলাম! অতি পরিচিত কণ্ঠ। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছিনা। আর কতো! বায়ান্নতে পা দিয়েছি। এই বয়সে কি এতো কিছু মনে থাকে? বয়সের ভার বলে কথা।
কিন্তু একটি যুবতী মেয়ে আমার মতো একটা পঞ্চাশোর্ধ বয়স্ক লোককে "তুমি" করে সম্বোধন করে কিভাবে- সেটাই তো আমার মাথায় ধরছে না! আমি ভাবনায় হারিয়ে গেলাম। সে আবার বলে- "তোমার কি মনে পড়ে না- তোমার বিয়ের আগের কথা? যখন আমি প্রায় রাতেই তোমার কাছে আসতাম?" আর বলতে হলোনা। আমার সব মনে পড়েছে। এঞ্জেলিকা ফিরে এসেছে।
আমি তাকে বললাম- হুমম. মনে পড়েছে।
এতোদিন পর। এতোটা বছর কোথায় ছিলে?
সে বলল- "তুমি তো বিয়ে করে সুখী হয়েছিলে। তাই আর তোমাকে জ্বালাতন করতে চাইনি। কিন্তু তোমাকে আমি চোখে চোখে রেখেছি। যেন তোমাকে দেখে আমি সান্ত্বনা পাই।
"
> "এখন কী মনে করে দেখা দিলে?"
> "আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আমি তোমাকে বিয়ে করবো। "
> "শোন এঞ্জেলি! আমি চাইলেই তো আর তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না।
> "কেনো?" তার চেহারায় হতাশার ছায়া।
> "কারণ, আমার স্ত্রী আছে।
আছে তিন তিনটে ছেলেমেয়ে। তাছাড়া আমি বুড়ো হয়ে গেছি। সেটা কি তুমি দেখতে পাওনা?"
> "আমি কিছুই বুঝতে চাই না। প্রয়োজনে তোমাকে আমি যুবক বানিয়ে দেবো। তোমার পরিবারকে আমি রাজি করাবো।
আমি সব কিছু মানিয়ে নেবো। তবু আমি তোমার কাছে মিনতি করছি। তুমি শুধু একবার বলো- আমায় তুমি ভালোবাসো। "...
পাঠক! গল্পের এর পর কী হলো! তা আমি লিখতে চাইনা। পরের ঘটনা আপনিই ভেবে নিন।
অতিপ্রাকৃত গল্পটি শ্রদ্ধেয় ইমন জুবায়ের ভাইকে উৎসর্গ করছি। যাঁর লেখা আমার অনেক প্রিয় ছিল।
সবাইকে ফাগুনের শুভেচ্ছা। বিশেষ করে এঞ্জেলিকা ও তার মানব সঙ্গীকে।
© ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো
ইহা শুধুই গল্প।
যাহা অতিপ্রাকৃত। জীবিত বা মৃত, বাস্তব কিংবা অবাস্তব কাহারো জীবনের সঙ্গে মিলিয়া গেলে নিজ গুণে ক্ষমা করিয়া দিবেন। অন্যথা লেখকের কোনও দায়বদ্ধতা নাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।