কত আজানারে জানাইলে তুমি, কত ঘরে দিলে ঠাঁই দূরকে করিলে নিকট,বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।
আমি যা চেয়েছি তাই পেয়েছি, আমার বাবার বিশাল বইয়ের লাইব্রেরীর প্রায় প্রতিটি বইএর সাথে আমি সময় পার করেছি। আমি এই বিশ্বের বহু দেশ ঘুরেছি । একা একা। প্রিতিটি পদক্ষেপে আত্মবিশ্বাস ও আত্মনির্ভরশিলতা তৈরীর আপ্রান চেষ্টা ছিল আমার বাবা মার।
তারা পেরেছে আমাকে সেই ভাবে তৈরী করতে। ‘পারবনা’ শব্দটা আমি আমার অভিধান থেকে বাদ দিয়েছিলাম। ভয় কি জিনিস আমি চিনি না শুধু ঐ একটি ছাড়া , তাই আমি ছিলাম শুধু ছেলেদের ব্যাপারে কঠোর।
হ্যাঁ এক কথায় আমি অসামান্য হয়েই বড় হচ্ছিলাম। আমার বাবা মা আমার স্মৃতি থেকে সেই দুঃস্বপ্ন মুছে ফেলার জন্যই আমাকে এভাবে বড় করেছে।
আমি যখন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম,আমার বাবা তখন উঠে পরে লাগলেন আমার বিয়ে দিতে। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া এক ছেলের সাথে। তার নাম রিয়াজ। সে তখন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। এই ছেলের পরিবার ও আমাদের পরিবারের সম্পর্ক বেশ মধুর।
এই মধুর সম্পর্ককে আরও গভীর করবার জন্যই এই ব্যবস্থা।
বিয়ে!! আমার চমকে উঠার পালা। বিয়ে মানেই তো সামাজিক ভাবে স্বীকৃত যৌন সম্পর্ক। আমার অনুভুতি কাউকে বোঝাতে পারি না। মাকে বললে- মা শুধু হাসে, কত কি বুঝায়, তার স্বপ্নের কথা বলে।
আমি শুধু ভেসে যাই এক ভয়ার্ত অন্ধকারের দিকে। বাবা তার অনন্য সুন্দর ক্ষমতা দিয়ে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে আমার সম্মতি আদায় করে। দাদুকে বললাম-- দাদু আমি বিয়ে করব না এখন, আমার সামনে অনেক পথ আমি সেই পথ পাড়ি দেব।
বাবা দাদুকে বুঝালেন--- আমি যে মানসিক অবস্থানে আছি, আরও একটু বয়স হলে আমাকে আর তারা বিয়ে দিতে পারবে না।
নিরুপায় আমি রিয়াজের সাথে দেখা করি।
তাকে খুব করে বুঝালাম আমি বিয়ে করব না। সে আমাকে বলল উপযুক্ত কারন পেলে সে অবশ্যই আমাকে বিয়ে করবে না।
কিন্তু উপযুক্ত কারনটা কি, তাই তো তাকে বলতে পারলাম না। তার সামনে বসে নিজেকে উন্মুক্ত করতে পারলাম না, আমার যুক্তি সে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিল।
আমার বয়স যখন তিন বছর চার মাস সাত দিন সেই দিনের কথা আমি বলছি।
সেই দিন থেকে শুরু আমার দুঃস্বপ্ন দেখা । আজ আমি সাতাশ বছর পার করছি এই দুঃস্বপ্ন থেকে আমার মুক্তি হলো না। মাঝে মাঝে বাবার কাছে ছুটে যেয়ে বলি ---তোমার এত ক্ষমতা আমাকে একটু মুক্তি দাও এই দুঃস্বপ্ন থেকে। তখন ডাক্তার আসে আমাকে দিনের পর দিন ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, আমি আবারও সেই স্বপ্ন দেখি।
আমাদের বাসার কাজের লোক বাবার সাথে খেলবার জন্য এসেছিল।
সে বড় হয়েও আমাদের বাসায় ছিল । বাবার সাথে শহরে চলে এসেছে। আমার সাথে সারাদিন খেলত।
সেদিন সকালে আমি তার সাথে খেলছি। --হটাৎ সে আমার প্যান্ট খুলে দেয়, আমাকে চেপে ধরে, প্রচন্ড ব্যাথায় আমি চিৎকার করতে চাইলে সে আমার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে।
এরপর যখন আমি চোখ মেলি, তখন আমি মার কোলে হাসপাতালে।
বাসায় এসে প্রচন্ড অস্থিরতার একটা চিঠি লিখলাম রিয়াজ কে। আমার প্রথম প্রেম পত্র। তাকে লিখলাম আমার সব কথা যা জানে আমার পরিচিত জনদের মধ্যে মাত্র ছয় জন। আজ রিয়াজ জানল, এই নিয়ে সাত জন।
কুরিয়ার সার্ভিসে পোস্ট করলাম সেই চিঠি। পরদিন দুপুরে রিয়াজ আমাকে ফোন করে বলল “আমি টি এস সির সামনে অপেক্ষা করছি তুমি আস, আর যদি না আস তবে যতদিন আসবে না আমি এখানেই বসে থাকব। “
একেই বোধ হয় বলে প্রেমে পরা । আমার ভেতরের সব সংকোচ সব ভয় কোথায় যেন উড়ে চলে গেল? এই প্রথম মনে হল, কেন আমি জানি না কোন জামাটা পরলে আমাকে বেশি মানায়? একটু লিপস্টিক কি দেব ঠোঁঠে? কেন আমি চুল বাঁধতে পারি না?
আমি জানি না ও কি বলবে আমাকে? তবু মনে হচ্ছে ও যেন ওর হৃদয় থেকে আমাকে ডেকেছে। আমি গেলাম তার সামনে, দেখি ফুটপাথে বসে চা খাচ্ছে।
আমাকে দেখে পিচ্চিকে ডেকে বলল,- আর এক কাপ চা দিতে।
আমি আর ও সেদিন প্রচন্ড রোদ মাথায় করে সারা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর হেঁটে বেড়িয়েছি। সন্ধ্যায় রিক্সায় করে বাসায় ফেরার সময় আমার হাত ধরে বলেছে ---তুমি বোকা মেয়ে, কোন বুনো শুয়োর যদি কাউকে আক্রমন করে তবে আমি বুনো শুয়োরকেই আঘাত করব । তুমিতো ছিলে শিশু কেন মনে রেখেছ তা, ভুলে যাও। জীবনটা খুব সুন্দর, তাই সেখানে কাঁটা থাকে।
সেই কাঁটা কাউকে কাউকে আঘাত করে তাই বলে কি সবাই কাঁটার আঘাতের ক্ষত নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তোমার সুযোগ আছে সেই ক্ষত সারাবার। তা তুমি সারিয়ে তোল। এস জীবনকে সুন্দর করি।
আমি শুধু ওর কথা শুনেছি আর কেঁদেছি।
এভাবে আমি কখনও কাঁদিনি।
এরপর তারা সুখে জীবন কাটাতে শুরু করিল। গল্পের কাহিনী এমন হলেই বোধ হয় ভালো হতো। কিন্তু গল্পটা যে শেষ হয়েও হয় না শেষ ।
আমি মা হতে চাই, বিবাহিত জীবনের দশ বছর পরও সেই দুঃস্বপ্ন আমাকে নতুন করে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
এই পৃথিবীর কোন ডাক্তার কোন ক্ষমতাবান ব্যাক্তি পারবেনা আমাকে মা বানাতে। এমনকি টেষ্টটিউব বেবী নেবার মত ক্ষমতা আমার নেই। সবাই বলে দিয়েছে তোমার জীবনের সেই দুর্ঘটনা তোমার মা হবার সমস্ত ক্ষমতা হরন করেছে।
আমি চাই একটি শিশু আমার গর্ভে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠুক আমি তাকে পলে পলে ক্ষনে ক্ষনে আনুভব করব। বলতে পারেন আমার অপরাধটা কী? কিসের শাস্তি আমি পাচ্ছি।
একটি শিশু তার মুষ্ঠিবদ্ধ হাত তুলে চিৎকার করে কাঁদছে। আর আমার কানে এসে বাজছে “তুমি আমার মা হবে?? তুমি আমার মা হবে?” মা হব না আবার-- মা হবার জন্য এই বিশ্বসংসার আমি তন্নতন্ন করে ঘুরেছি। এই শরীরটাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ক্ষত বিক্ষত করেছি।
আমি তোমারই মা হব।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।