আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

। হিজড়া, প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের এক দুর্ভাগা শিকার !

``চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল। ' -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
স্মৃতি হাতড়ালে এখনো যে বিষয়টা অস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে, শৈশবের অবুঝ চোখে সেইকালে বুঝে উঠতে পারতাম না, কারো বাড়িতে সন্তান জন্ম নিলে শাড়ি পরা সত্ত্বেও বিচিত্র সাজ-পোশাক নিয়ে কোত্থেকে যেসব মহিলা এসে নাচগান বা ঠাট্টা-মশকরা করে তারপর বখশিস নিয়ে খুশি হয়ে চলে যেতো, এদের আচার আচরণ ও বহিরঙ্গে দেখতে এরা এমন অদ্ভুত হতো কেন ! শৈশবের অনভিজ্ঞ চিন্তা-শৈলীতে পুরুষ ও নারীর পার্থক্যের জটিলতা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা না জন্মালেও স্বাভাবিকতার বাইরে দেখা এই অসঙ্গতিগুলো ঠিকই ধরা পড়েছে, যা প্রশ্ন হয়ে বুকের গভীরে জমে ছিলো হয়তো। পরবর্তী জীবনে তা-ই কৌতুহল হয়ে এক অজানা জগতের মর্মস্পর্শী পীড়াদায়ক বাস্তবতাকে জানতে বুঝতে আগ্রহী করে তুলেছে। আর তা এমনই এক অভিজ্ঞতা, যাকে প্রকৃতির নির্মম ঠাট্টা বা রসিকতা না বলে উপায় থাকে না ! অনিঃশেষ ট্র্যাজেডি দেহ ও মানসগঠনে পূর্ণতা পেলে প্রাণীমাত্রেই যে মৌলিক প্রণোদনায় সাড়া দিয়ে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সেটা যৌন প্রবৃত্তি।

অনুকুল পরিবেশে এই প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা যেকোন স্বাভাবিক প্রাণীর পক্ষেই অত্যন্ত সাধারণ একটা ঘটনা। মানব সমাজের প্রমিত বা ভদ্র উচ্চারণে এটাকেই প্রেম বা প্রণয়ভাব বলে আখ্যায়িত করি আমরা। পুরুষ (male) ও স্ত্রী (female), লিঙ্গভিত্তিক দুই ভাগে ভাগ হয়ে পড়া প্রাণীজগতে এই মৌলিক প্রণোদনার সমন্বিত সুফল ভোগ করেই বয়ে যায় প্রাণীজাত বংশধারা। অথচ প্রকৃতির কী আজব খেয়াল ! কখনো কখনো এই খেয়াল এতোটাই রূঢ় ও মর্মস্পর্শী হয়ে উঠে যে, এর কোনো সান্ত্বনা থাকে না। মানবসমাজে প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালের সেরকম এক অনিঃশেষ ও দুর্ভাগা শিকারের নাম ‘হিজড়া’(hijra)।

সেই আদি-প্রণোদনায় এরা তাড়িত হয় ঠিকই, কিন্তু তাদের জন্মগত লিঙ্গ-বৈকল্যধারী অক্ষম ক্লীব (neuter) বা নপুংশক দেহ যা তৃপ্ত করতে সম্পূর্ণ অনুপযোগী ! এরা ট্রান্সজেন্ডার (trans-gender), না-পুরুষ না-স্ত্রী। অর্থাৎ এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থা যা দৈহিক বা জেনেটিক কারণে মেয়ে বা ছেলে কোন শ্রেণীতেই পড়ে না। আমার অফিস পাড়ায় সপ্তাহের একটা নির্দিষ্ট দিনে দেখি সালোয়ার-কামিজ বা শাড়ি পরিহিত তরুণীর মতো এদের কয়েকজন এসে প্রতিটা দোকান থেকে অনেকটা প্রাপ্য দাবির মতোই ঠাট্টা-মশকরা করতে করতে দু’টাকা-চার টাকা-পাঁচ টাকা করে স্বেচ্ছা-সামর্থ অনুযায়ী তোলা নিয়ে যায়। এই তোলাটুকু দিতে কোন দোকানির কোনো আপত্তিও কখনো চোখে পড়েনি। বরং সহযোগিতার মায়াবি সমর্থনই চোখে পড়েছে বেশি।

পুরনো কৌতুহলে আমিও তাদের সেই রহস্যময় গোপন জগতের সুলুক-সন্ধানের চেষ্টা করি। তাদের নীল কষ্টগুলো সত্যিই নাড়া দিয়ে যায় কোন এক কষ্টনীল অনুভবে। মুছে যায় পুরনো পরিচয় জন্মের পর পরই যে ত্রুটি চোখে পড়ে না কারো, ধীরে ধীরে বড় হতে হতে ক্রমশই স্পষ্ট হতে থাকা সেই অভিশপ্ত ত্রুটিই একদিন জন্ম দেয় এক অনিবার্য ট্র্যাজেডির। সমাজ সংসার আত্মীয় পরিজন পরিবার সবার চোখের সামনে মুছে যেতে থাকে একটি পরিচয়। আপনজনদের পাল্টে যাওয়া আচরণ, অবহেলা, অবজ্ঞাসহ যে নতুন পরিচয়ের দুঃসহ বোঝা এসে জুড়তে থাকে দেহে, তাতে আলগা হতে থাকে পরিচিত পুরনো বন্ধন সব, রক্তের বন্ধন মিথ্যে হতে থাকে আর ক্রমেই মরিয়া হয়ে একদিন সত্যি সত্যি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় পরিবার থেকে সে।

অভিশপ্ত নিয়তি এদের ফেরার পথটাও বন্ধ করে দেয় চিরতরে। কারণ অভ্যস্ত সমাজের বাইরে তার একটাই পরিচয় হয়ে যায় তখন- হিজড়া ! কই যায় সে ? সেখানেই যায়, যেখানে তাদের নিজস্ব জগতটা নিজেদের মতো করেই চলতে থাকে, বেদনার নীল কষ্টগুলো ভাগাভাগি করে নীল হতে থাকে নিজেরাই। হিজড়া পল্লী। কেননা পরিবারের মধ্যে থেকে বড় হতে হতে তার যে পরিবর্তনগুলো ঘটতে থাকে, তা অন্য কারো চোখে স্পষ্ট হয়ে ওঠার আগেই ধরা পড়ে যায় ভ্রাম্যমান অন্য হিজড়াদের চোখে। তাদের দুর্ভাগ্যের আগামী সাথী হিসেবে আরেকটা দুর্ভাগা প্রাণীকে তারা ভুলে না।

এরা উৎফুল্ল হয় আরেকজন সঙ্গি বাড়ছে বলে। একসময় এরাই তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যায় তাদের নিজেদের পল্লীতে। পল্লী মানে সেই বস্তি যেখানে সংঘবদ্ধ হয়ে গোষ্ঠীবদ্ধভাবে বাস করে হিজড়ারা। যেখানে তাদের নিজস্ব সমাজ, নিজস্ব নিয়ম, নিজস্ব শাসন পদ্ধতি, সবই ভিন্ন প্রকৃতির। অন্য জীবন যে সমাজ তারা ছেড়ে আসে সেই পুরনো সমাজ এদের কোন দায়-দায়িত্ব নিতে আগ্রহী নয়, তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দিতে প্রস্তুত নয় কিংবা সামাজিক স্বীকৃতি দিতে ইচ্ছুক নয় বলে তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে যায় মানুষের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে সাহায্য ভিক্ষা করা।

এভাবে অন্যের কৃপা-নির্ভর বেঁচে থাকার এক অভিশপ্ত সংগ্রামে সামিল হয়ে পড়ে এরা। স্বাভাবিক শ্রমজীবীদের মতো উপার্জনের কাজে এদেরকে জড়িত হতে দেখা যায় না। নিজস্ব পদ্ধতিতে হাটে বাজারে তোলা উঠানোর পাশাপাশি বিনামূল্যে ভোগ্যপণ্য সংগ্রহ করেই এরা জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কৌতুককর মনোরঞ্জনকারী হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে নাচগানে অংশ নিয়ে থাকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিকৃত যৌনপেশাসহ নানান অপরাধের সাথেও জড়িয়ে পড়ে।

হিজড়াদের সমাজে প্রতিটা গোষ্ঠীতে একজন সর্দার থাকে। তারই আদেশ-নির্দেশে সেই গোষ্ঠী পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে হিজড়াদের সংখ্যা প্রায় দেড় লাখ বলে জানা যায়। তবে এই ক্ষেত্রে হিজড়াদের প্রকৃত জনসংখ্যা নিয়ে কিছুটা ধুয়াশা থেকেই যায়। কারণ নিজেদেরকে আড়ালে রাখা অর্থাৎ বহিরঙ্গে অপ্রকাশিত হিজড়াদের পরিসংখ্যান এখানে থাকার সম্ভাবনা কম।

বাইরে থেকে যে চেহারাটা প্রকট দেখা যায় সেই লিঙ্গে আত্মপ্রকাশ করে এই বিরূপ সমাজে অনেকেই নিজেদেরকে সযত্নে ঢেকে রাখেন বলে বাইরের মানুষ তা জানতে পারে না। যে ক্ষেত্রে এই বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট অর্থাৎ ঢেকে রাখার মতো নয় এবং বাইরে থেকে বুঝা যায়, কেবল সেক্ষেত্রেই মানুষ নিজেকে হিজড়া হিসেবে প্রকাশিত করে এবং পরিবার থেকে বের হয়ে যায়। রাজধানী ঢাকাতে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় পনের হাজার। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অবস্থানরত হিজড়ারা পাঁচ থেকে পঞ্চাশজন হিজড়া সর্দারের নিয়ন্ত্রণে গোষ্ঠীবদ্ধ রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রের তথ্য। সর্দারদের নিজস্ব এলাকা ভাগ করা আছে।

কেউ অন্য কারো এলাকায় যায় না বা তোলা ওঠায় না, এমনকি নাচগানও করে না। একেকজন হিজড়া সর্দারের অধীনে অন্তত অর্ধশতাধিক হিজড়া রয়েছে। হিজড়া সর্দারের অনুমতি ছাড়া সাধারণ হিজড়াদের স্বাধীনভাবে কিছু করার উপায় নেই। এমনকি সর্দারের আদেশ ছাড়া কোন দোকানে কিংবা কারো কাছে হাত পেতে টাকাও চাইতে পারে না এরা। সর্দারই ৫/৬ জনের একেকটি গ্রুপ করে টাকা তোলার এলাকা ভাগ করে দেয়।

প্রত্যেক সর্দারের অধীনে এরকম ৮ থেকে ১০ টি গ্রুপ থাকে। প্রতিদিন সকালে সর্দারের সঙ্গে দেখা করে দিক নির্দেশনা শুনে প্রতিটি গ্রুপ টাকা তোলার জন্য বের হয়ে পড়ে। বিকেল পর্যন্ত যা টাকা তোলা হয়, প্রতিটি গ্রুপ সেই টাকা সর্দারের সামনে এনে রেখে দেয়। সর্দার তার ভাগ নেয়ার পর গ্রুপের সদস্যরা বাকি টাকা ভাগ করে নেয়। প্রতি সপ্তাহে বা নির্দিষ্ট সময় পর পর হিজড়াদের সালিশী বৈঠক বসে।

১৫ থেকে ২০ সদস্যের সালিশী বৈঠকে সর্দারের নির্দেশ অমান্যকারী হিজড়াকে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় বেত দিয়ে পেটানোসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক নির্যাতন এবং কয়েক সপ্তাহের জন্য টাকা তোলার কাজ বন্ধ করে দেয়া হয়। কখনো কখনো জরিমানাও ধার্য্য করা হয় ৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। দণ্ডিত হিজড়াকে তার নির্ধারিত এলাকা থেকে তুলে এই টাকা পরিশোধ করতে হয়। এই শাস্তি হিজড়ারা মাথা পেতে মেনে নেয় এবং কেউ এর প্রতিবাদ করে না।

হিজড়া কেন হিজড়া ? চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্মপরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, মূলত তারাই হিজড়া। জীবনের স্বাভাবিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত হিজড়াদের কামনা বাসনা আছে ঠিকই, ইচ্ছাপূরণের ক্ষেত্রটা নেই কেবল। এদের শারীরিক গঠন ছেলেদের মতো হলেও মন-মানসিকতায় আচার আচরণে সম্পূর্ণ নারীর মতো (she-male)। তাই তাদের সাজ-পোশাক হয়ে যায় নারীদের সালোয়ার কামিজ কিংবা শাড়ি। অনেকে গহনাও ব্যবহার করে।

কৃত্রিম স্তন ও চাকচিক্যময় পোশাক ব্যবহার করতে পছন্দ করে এরা। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, হিজড়াদের নাকি বৈশিষ্ট্যগতভাবে দুইটি ধরন রয়েছে, নারী ও পুরুষ। নারী হিজড়ার মধ্যে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য থাকলেও স্ত্রীজননাঙ্গ না থাকায় তার শারীরিক গঠন অস্বাভাবিক। পুরুষ হিজড়াদের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। তবে হিজড়ারা নারী বা পুরুষ যাই হোক, নিজেদেরকে নারী হিসেবেই এরা বিবেচনা করে থাকে।

সারা বিশ্বে প্রকৃতি প্রদত্ত হিজড়াদের ধরন একইরকম। শারীরিকভাবে পুরুষ, কিন্তু মানসিকভাবে নারীস্বভাবের হিজড়াদেরকে বলা হয় ‘অকুয়া’। অন্য হিজড়াদেরকে বলা হয় ‘জেনানা’। এছাড়া সামাজিক প্রথার শিকার হয়ে আরব্য উপন্যাসের সেই রাজ-হেরেমের প্রহরী হিসেবে পুরুষত্বহীন খোজা বানানো মনুষ্যসৃষ্ট সেইসব হিজড়াদেরকে বলা হয় ‘চিন্নি’। হিজড়া থেকে কখনো হিজড়ার জন্ম হয় না।

প্রকৃতিই সে উপায় রাখে নি। কুসংস্কারবাদীদের চোখে একে সৃষ্টিকর্তার অভিশাপ কিংবা পিতামাতার দোষ বা প্রকৃতির খেয়াল যাই বলা হোক না কেন, আধুনিক বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা অন্যরকম। চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুযায়ী মাতৃগর্ভে একটি শিশুর পূর্ণতা প্রাপ্তির ২৮০ দিনের মধ্যে দুটো ফিমেল বা স্ত্রী ক্রোমোজোম এক্স-এক্স প্যাটার্ন ডিম্বানু বর্ধিত হয়ে জন্ম হয় একটি নারী শিশুর এবং একটি ফিমেল ক্রোমোজোম এক্স ও একটি মেল বা পুরুষ ক্রোমোজোম ওয়াই মিলে এক্স-ওয়াই প্যাটার্ন জন্ম দেয় পুরুষ শিশুর। ভ্রূণের পূর্ণতা প্রাপ্তির একটি স্তরে ক্রোমোজোম প্যাটার্নের প্রভাবে পুরুষ শিশুর মধ্যে অণ্ডকোষ এবং মেয়ে শিশুর মধ্যে ডিম্বকোষ জন্ম নেয়। অণ্ডকোষ থেকে নিঃসৃত হয় পুরুষ হরমোন এন্ড্রোজেন এবং ডিম্বকোষ থেকে নিঃসৃত হয় এস্ট্রোজন।

পরবর্তী স্তরগুলোতে পুরুষ শিশুর যৌনাঙ্গ এন্ড্রোজেন এবং স্ত্রী শিশুর যৌনাঙ্গ এস্ট্রোজনের প্রভাবে তৈরি হয়। ভ্রূণের বিকাশকালে এই সমতা নানাভাবে বিঘ্নিত হতে পারে। প্রথমত ভ্রূণ নিষিক্তকরণ এবং বিভাজনের ফলে কিছু অস্বাভাবিক প্যাটার্নের সূচনা হতে পারে। যেমন এক্স-ওয়াই-ওয়াই অথবা এক্স-এক্স-ওয়াই। এক্স-ওয়াই-ওয়াই প্যাটার্নের শিশু দেখতে নারী-শিশুর মতো।

কিন্তু একটি এক্সের অভাবে এই প্যাটার্নের স্ত্রী-শিশুর সব অঙ্গ পূর্ণতা পায় না। একে স্ত্রী-হিজড়াও বলে। আবার এক্স-এক্স-ওয়াই প্যাটার্নে যদিও শিশু দেখতে পুরুষের মতো, কিন্তু একটি বাড়তি মেয়েলি ক্রোমোজম এক্সের জন্য তার পৌরুষ প্রকাশে বিঘ্নিত হয়। একে পুরুষ হিজড়াও বলে। প্রকৃতির খেয়ালে হোক আর অভিশাপেই হোক, এই হিজড়াত্ব ঘোচাবার উপায় এখন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের নাগালে।

চিকিৎসকদের মতে শিশু অবস্থায় চিকিৎসার জন্য আনা হলে অপারেশনের মাধ্যমে সে স্বাভাবিক মানুষের মতো পরিবারের মধ্যে থেকেই জীবন-যাপন করতে পারে। হয়তো সে সন্তান ধারণ করতে পারবে না, কিন্তু পরিবার ছেড়ে বেরিয়ে পড়বে না হয়তো। দেখা গেছে যে অসচ্ছল নিম্নশ্রেণীর পরিবার থেকেই বাইরে বেরিয়ে যাবার প্রবণতা বেশি। তখন তাদের জীবনধারা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এরা না পারে নারী হতে, না পারে পুরুষ হতে।

ফলে অন্যান্য অনেক অসঙ্গতির মতো হোমোসেক্স বা সমকামিতায় অভ্যস্ত হয়ে যায়। হিজড়া কি মানুষ নয় ? মানবাধিকারের সার্বজনীন ঘোষণা হলো- দাসত্ব থেকে মুক্তির অধিকার, ভোটের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, কাজের অধিকার, মানসম্মত জীবন-যাপনের অধিকার, আইনের আশ্রয় ও নির্যাতন থেকে মুক্তির অধিকার এবং বিবাহ ও পরিবার গঠনের অধিকার। এইসব অধিকার পরিপন্থি কর্মকাণ্ডকে প্রতিরোধের জন্য আরো বহু চুক্তি ও সনদও রয়েছে। কিন্তু এসব অধিকারের ছিটেফোটা প্রভাবও হিজড়াদের জীবনে কখনো পড়তে দেখা যায় না। মানবাধিকার বঞ্চিত এই হিজড়ারা তাহলে কি মানুষ নয় ? মানুষের জন্মদোষ কখনোই নিজের হয না।

আর হিজড়ারা নিজেরা বংশবৃদ্ধিও করতে পারে না। এ অপরাধ তাদের নয়। স্বাভাবিক পরিবারের মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে তাদের জন্ম। তবু প্রকৃতির প্রহেলিকায় কেবল অস্বাভাবিক লিঙ্গ বৈকল্যের কারণেই একটা অভিশপ্ত জীবনের অপরাধ সম্পূর্ণ বিনাদোষে তাদের ঘাড়ে চেপে যায়। প্রকৃতির বিচিত্র খেয়ালে একটা মেয়ে যদি ছেলে হয়ে যায়, কিংবা একটা ছেলে ঘটনাক্রমে মেয়ে হয়ে গেলেও এরকম পরিণতি কখনোই নামে না তাদের জীবনে, যা একজন হিজড়ার জীবনে অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া হয়।

খুব অমানবিকভাবে যৌনতার অধিকার, পরিবারে সম্মানের সঙ্গে বসবাসের অধিকার, চাকরির অধিকার, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার ইত্যাদি মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে যায় এরা। কিন্তু এসব অধিকার রক্ষা ও বলবৎ করার দায়িত্ব ছিলো রাষ্ট্রের। কেননা রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযাযী রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে- ‘সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত আওতাধীন কারণে অভাবগ্রস্ততার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার’ প্রতিষ্ঠা করা। আদৌ কি কখনো হয়েছে তা ? অথচ পরিবার হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া হিজড়ারা প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তার অভাবে পৈতৃক সম্পত্তির বা উত্তরাধিকারীর দাবি প্রতিষ্ঠা থেকেও বঞ্চিত থেকে যায়। এমন বঞ্চনার ইতিহাস আর কোন জনগোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের হয়েছে কিনা জানা নেই।

প্রকৃতির নির্দয় রসিকতার কারণে হিজড়াদের গতানুগতিকতার বাইরে ভিন্ন পদ্ধতির অনিবার্য যৌনতাকেও ইসলাম প্রধান দেশ হিসেবে সহজে মেনে নেওয়া হয় না। এমনকি ব্রিটিশ আমলেও এদেশে হিজড়াদের বিতাড়িত করা হয়েছে বলে জানা যায়। যৌনতার বিরুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় আইনে হিজড়াদের যৌনতাকে ‘সডোমি’ অর্থাৎ অস্বাভাবিক ও অনৈতিক হিসেবে চিহ্ণিত করে পেনাল কোড (১৮৬০) এর ৩৭৭ ধারায় এটাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তাদের মানবাধিকার রক্ষাকল্পে রাষ্ট্রীয় কোন উদ্যোগ কখনো হাতে নেয়া হয়েছে বলে শোনা যায় নি। তাই বিবেকবান নাগরিক হিসেবে এ প্রশ্নটাই আজ জোরালোভাবে উঠে আসে, হিজড়ারা কি তাহলে রাষ্ট্রের স্বীকৃত নাগরিক নয় ? রাষ্ট্রের সংবিধান কি হিজড়াদের জন্য কোন অধিকারই সংরক্ষণ করে না ? তবে খুব সম্প্রতি গত ০২ জুলাই ২০০৯ ভারতে দিল্লী হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ যুগান্তকারী এক রায়ের মাধ্যমে ‘প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সমকামী সম্পর্ক’ ফৌজদারী অপরাধের তালিকাভুক্ত হবে না বলে ঘোষণা করেছে।

ভারতের নাজ ফাউন্ডেশনের দায়ের করা এই জনস্বার্থমূলক মামলাটির রায়ে আদালত সমকামীদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির অপপ্রয়োগকে মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি, গণতন্ত্রের পরিপন্থি এবং অসাংবিধানিক বলে অভিমত দিয়েছে। আদালতের মতে এই প্রয়োগ ভারতীয় সংবিধান স্বীকৃত কয়েকটি মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি, যেগুলো হলো- আইনের দৃষ্টিতে সমতা (অনুচ্ছেদ ১৪), বৈষম্যের বিরুদ্ধে সুরক্ষা (অনুচ্ছেদ ১৫), জীবনধারণ ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার (অনুচ্ছেদ ২১)। রায়টির অব্যবহিত পরেই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রায়টিকে স্থগিত করার জন্য সুপ্রীম কোর্টের কাছে আবেদন করা হয় যা মঞ্জুর হয়নি (সূত্রঃ )। এই রায় ভারতের হিজড়া সম্প্রদায়ের জন্য এক বিরাট আইনি সহায়তার পাশাপাশি আমাদেরর দেশের জন্যেও একটা উল্লেখযোগ্য নমুনা হিসেবে উদাহরণ হবে। কেননা সেই ব্রিটিশ ভারতীয় এই আইনটিই আমাদের জন্যেও মৌলিক অধিকার পরিপন্থি হয়ে এখনো কার্যকর রয়েছে।

তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি নয় কেন ? যুগ যুগ ধরে ফালতু হিসেবে অবজ্ঞা অবহেলা ঘৃণা টিটকারী টিপ্পনি খেয়েও বেঁচে থাকা ছোট্ট একটা বঞ্চিত জনগোষ্ঠী এই হিজড়াদের জন্য রাষ্ট্রের কোন বাজেট বা কোন পুনর্বাসন কার্যক্রম আদৌ হাতে নেয়া হয় কিনা জানা নেই আমাদের। আমরা শুধু এটুকুই জানি, পরিবার ও সমাজের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া হিজড়ারা বেঁচে থাকার তাগিদেই দলবদ্ধভাবে বসবাস করে বা করতে বাধ্য হয়। মানুষ হিসেবে তাদেরও যে অধিকার রয়েছে, তা সুপ্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য নিয়ে হিজড়াদের উন্নয়নে হাতে গোনা কয়েকটি সংগঠন খুব ছোট্ট পরিসরে হলেও মাথা তুলে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বন্ধু সোস্যাল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন, সুস্থ জীবন, বাঁধন হিজড়া সংঘ, লাইট হাউস, দিনের আলো ইত্যাদি সংগঠনের নাম কম-বেশি শোনা যায়। এদের কার্যক্রম ততোটা জোড়ালো না হলেও এইডস প্রতিরোধসহ কিছু উন্নয়ন কার্যক্রমে এরা যুক্ত রয়েছে বলে জানা যায়।

সেখানে রাষ্ট্রের কোন অনুদান নেই। তাই রাষ্ট্রের কাছে হিজড়াদের প্রধান দাবি আজ, তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি। কেননা এই লিঙ্গস্বীকৃতি না পেলে কোন মানবাধিকার অর্জনের সুযোগই তারা পাবে না বলে অনেকে মনে করেন। তবে আশার কথা যে, এবারের ভোটার তালিকায় এই প্রথম হিজড়াদেরকে অন্তর্ভূক্ত করার প্রশংসনীয় একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশনের এই উদ্যোগ বিবেকবান মানুষের সমর্থনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থারও প্রশংসা কুড়িয়েছে।

আমরাও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবু প্রায় এক লাখ হিজড়াকে এবারের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তির ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা এখনো রয়ে গেছে বলে জানা যায়। কেননা তাদেরকে তাদের নিজের পরিচয় হিজড়া হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়নি বা করা যায়নি। হয়েছে ছেলে বা মেয়ের লিঙ্গ পরিচয়ে, যেখানে যা সুবিধাজনক মনে হয়েছে সেভাবেই। ফলে এতেও হিজড়া হিসেবে সবকিছু থেকে বঞ্চিত এই সম্প্রদায়ের আদতে কোন স্বীকৃতিই মেলেনি।

ফলে হিজড়াদের প্রাপ্য অধিকার ও মানুষ হিসেবে পুনর্বাসনের জন্য বিশেষ আইনের দরকার হয়ে পড়েছে আজ, যেখানে যৌক্তিক কারণেই তাদের হোমোসেক্স বা সমকামিতার অধিকার প্রতিষ্ঠাও জরুরি বৈ কি। আর এজন্যেই আজ অনিবার্য হয়ে উঠেছে হিজড়াদেরকে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মানবিক দাবিটাও। প্রিয় পাঠক, আপনার স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততার ফাঁকে হঠাৎ করেই কোন হিজড়ার সাথে দেখা হয়ে গেলে হয়তোবা স্বতঃকৌতুহলি হয়ে ওঠবেন আপনি। এই কৌতুহলের মধ্যে অজান্তেও কোন কৌতুক মেশাবার আগেই একটিবার অন্তত ভেবে দেখবেন কি, এই না-পুরুষ না-স্ত্রী সত্তাটি আপনার আমার মতোই সবক’টি নির্দোষ দৈহিক উপাদান নিয়েই কোন না কোন পারিবারিক আবহে জন্মেছিলো একদিন। মানবিক বোধেও কোন কমতি ছিলো না।

কিন্তু প্রকৃতি তাকে দিয়েছে ভয়াবহ বঞ্চনা, যা আপনার আমার যে কারো ক্ষেত্রেই হতে পারতো ! অসহায় পরিবার ত্যাগ করেছে তাকে, অবিবেচক সমাজ করেছে প্রতারণা। নিয়তি করেছে অভিশপ্ত, আর রাষ্ট্র তাকে দেয়নি কোন সম্মান পাবার অধিকার। কোন অপরাধ না করেও ভাগ্য-বিড়ম্বিত সে কি আপনার আমার একটু সহানুভূতি থেকেও বঞ্চিত হবে ? | তথ্য-কৃতজ্ঞতা : হিজড়া সম্প্রদায় তৃতীয় লিঙ্গ নয় কেন/ঝর্ণা রায়/সাপ্তাহিক ২০০০,বর্ষ১১ সংখ্যা২৭, ১৪ নভেম্বর ২০০৮| [Image: from internet except the top.]
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।