ড. আতিউর রহমান যখন বাংলাদেশের গভর্ণর হিসেবে নিয়োগ পেলেন তখন তার জীবনী নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছিল। সেখানে আমরা দেখতে পেয়েছিলাম যে তার একজন শিক্ষক তার ক্যাডেট কলেজের বেতন যোগানোর জন্য বাজারে গিয়ে মানুষের কাছে হাত পাতেন। মহান সেই শিক্ষকের এই অসামান্য ভূমিকার কারণেই আজকের আতিউর রহমানের জন্ম। এখান থেকে আমরা সহজেই তৎকালীন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক সম্বন্ধে ধারণা লাভ করতে পারি।
ব্রিটিশ আমল বা মুঘল আমল বা তারও আগে ভারতীয় উপমহাদেশে শিক্ষার্থীরা জ্ঞানার্জনের লক্ষ্যে গুরুগৃহে বসবাস করত।
সেখানে গুরু বা শিক্ষক তার মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী পাঠদান করতেন এবং নানা বিদ্যা শেখাতেন। সেসময়ে গুরুর সেবা-যত্ন করত শিষ্যরা। সেখানেই তাদের খাবারের বন্দোবস্ত হত। পড়া না পারলে গুরু বা শিক্ষক বেধড়ক পেটাতেন। এমনকি ব্রিটিশ আমল বা তারপরে পাকিস্তান আমলে গ্রাম-বাংলার পাঠশালাগুলোতে শিক্ষার্থীরা পড়া না পারলে শিক্ষকগণ বেধড়ক মারধর করতেন।
কিন্তু মজার ব্যাপার হল, এতে কিন্তু শিক্ষার্থীরা মোটেও মনক্ষুণ্ণ হত না। শিক্ষা গবেষকদের বিভিন্ন গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। ইতিহাসও সেরকমই বলে। এখন প্রশ্ন হল, কেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষক কর্তৃক প্রহারের শিকার হয়ে অপমানবোধ করত না? উত্তর খুব সহজ। শিক্ষার্থীরা খুব ভাল করেই জানত যে শিক্ষক বা পণ্ডিত মশাই তাদের ভাল'র জন্যই পেটাতেন।
তারা যেন লেখাপড়ায় মনোযোগী হয়, ঠিকমত প্রতিদিনের পড়া পড়ে আসে সেজন্যই শিক্ষকের এই প্রহার। এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে যে তখনকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি সমঝোতা বা বোঝাপোড়া (rapport) ছিল। আরেকটি প্রশ্ন থেকে যায় মনে যে, কীভাবে শিক্ষার্থীরা বুঝত যে শিক্ষক তাদের মঙ্গল চান? এ প্রশ্নের উত্তর আমি কয়েকটি ঘটনার মাধ্যমে বলতে চাইছি।
উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে গ্রাম-বাংলার হাইস্কুলগুলোতে ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ কোচিংয়ের ব্যবস্থা করতেন প্রধান শিক্ষকগণ। সেজন্য কোন অতিরিক্ত খরচ ছাত্রদের দিতে হত না।
পরীক্ষার আগে প্রধান শিক্ষক পরীক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নজরদারি করতেন যে তার ছাত্ররা পড়াশোনা করছে কিনা। তার হাতে থাকত বেত। কোন পরীক্ষার্থীর বাড়ির কুপি বন্ধ থাকলে সে পরীক্ষার্থীর পিঠে পড়ত বেতের বাড়ি। মহান সেই হেডস্যারেরা নিজের গরুর খাঁটি দুধ পরীক্ষার্থীদের খাওয়াতেন। অভাবী ছাত্রদের পরীক্ষার খরচের ব্যবস্থা বিদ্যালয় থেকেই করা হত।
সে সামর্থ্য না থাকলে হাত পাততেও পিছপা হতেন না মহান সেই শিক্ষকগণ। এখন আপনারাই বলুন, সেই শিক্ষকগণের বেতের বাড়ি খেলে কেন শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হত না? কোন ছাত্রের বাবা মৃত হলে তার খাওয়া-পরা এবং শিক্ষার যাবতীয় খরচও অনেক সময়ে শিক্ষকগণ বহন করতেন। শিক্ষার্থীদের পারিবারিক সমস্যার সমাধানও শিক্ষকগণ নিজ গরজে করতেন অনেকক্ষেত্রে। এমন ইতিহাসও আছে যে অসুস্থ ছাত্রকে ঘাড়ে করে শিক্ষক হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যকার এই সম্পর্কের কারণেই তখনকার দিনে নাজুক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যেও শিক্ষার্থীরা মানুষের মত মানুষ হওয়ার সুযোগ পেত।
ব্যাপারটা ছিল অনেকটা এমন যে বাবা-মা যেমন সন্তানদের আদর করেন আবার বিপথে গেলে শাসন করেন তেমনি শিক্ষকেরও অধিকার আছে সোহাগ এবং শাসনের। "শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে"- কথাটির সার্থকতা বোধহয় এখানেই।
এবার আসি বর্তমানে। শিক্ষকগণ বাবা-মার মত, সেই ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে শিক্ষার্থীদের শাসন করাটা কোনভাবেই হালাল করা যায় না। কেননা বর্তমানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক অনেকটাই বাণিজ্যিক।
শিক্ষকরা এখন খুব কম ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীদের অন্তর থেকে ভালবাসেন। তাদের শাসনটাও তাই ছাত্রের "ভাল'র জন্যের" পরিবর্তে "নিজের ক্ষোভ মেটানোর মত" হয়ে গিয়েছে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে শিক্ষক ক্লাসের বেয়াড়া ছেলেটি বা মেয়েটিকে ভালবেসে কাছে টেনে নেয়ার পরিবর্তে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকের ব্যক্তিত্ত্বের দুর্বলতাই প্রকাশিত হয়। কেননা শিক্ষক যদি ভালবাসা দিয়ে শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতা বা শ্রেণীকক্ষে বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হন তাহলে বলতে হবে যে শ্রেণীকক্ষ ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা তার নেই।
শিক্ষকের আচরণ হবে এমন যে শিক্ষার্থীরা তাকে ভালবেসে বা শ্রদ্ধা করে ক্লাসে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে না। একজন শিক্ষক তার ব্যক্তিত্ত্ব এবং সহানুভূতিপূর্ণ মনোভাবের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আপন করে নেবেন। ভয়ভীতি নয় বরং দায়িত্ববোধ থেকেই শিক্ষার্থীরা ক্লাসে গণ্ডগোল করা বা পড়া না পড়ে আসা থেকে বিরত থাকবে। এ বোধ জাগ্রত করার দায়িত্ব মহান শিক্ষকের। নিজের ব্যক্তিগত আক্রোশ যেন শিক্ষার্থীর উপর না পড়ে সে ব্যাপারে তাকে সচেতন হতে হবে নইলে সে তার কাছে জ্ঞানার্জনের নিমিত্তে আসা শিশুর উপর চরম অবিচার করবেন।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় যে, শ্রেণীতে অবস্থাপণ্ণ পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদেরকে অনেক সময়ে আর্থিকভাবে ততটা সচ্ছ্বল নয় এমন শিক্ষকেরা হীনমন্যতাবোধ থেকে ইচ্ছে করে অপমান-অপদস্থ করেন। এটি একটি গুরুতর অন্যায়। এর জন্য শাস্তির বিধান থাকা উচিৎ বলে মনে করি। শিক্ষক হবেন একই সাথে বন্ধু এবং অভিভাবক। বাবা-মা তার সন্তানকে নিজের কোল ছেড়ে বিদ্যালয়ে পাঠিয়েছে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যে।
বিদ্যালয়ে বাবা-মা'র সেই সন্তানদের ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব শিক্ষক নামক মহান পেশাজীবি সমাজের সদস্যদের। বিদ্যালয়ে পড়তে আসা এই আমানতদের খিয়ানত করাটা উচিৎ নয় কখনই। সেজন্য তাকে দায়ী থাকতে হবে চিরকাল।
পরিশেষে, বাংলাদেশে একটি সুন্দর ও যুগোপযোগী শিক্ষাব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি আর দশটা বাংলাদেশির মত। সেই সাথে শ্রেণীকক্ষে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীদের উপর সকল প্রকার শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধের দাবি জানাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।