একমুখাপেক্ষি না হয়ে যা কিছু ভাল তা গ্রহন করা উচিৎ...
একধরনের ক্ষোভের কারনেই ব্লগ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম মাসখানেক আগে। ক্ষোভটা কার উপর বা কিসের উপর আমি ঠিক নির্দিষ্ট করে হয়তো বলতেও পারবো না। তবে লেখালেখিটা একেবারেই অর্থহীন মনে হচ্ছিল। যেহেতু ফিরে এসেছি তাই আশা করছি লিখে যাবো, লিখেই যাবো. . .
দৃশ্যপট ১-
১৮ জুন ২০০৯। সবকিছু ঠিকঠাক, কক্সবাজার যাবো শপথ গ্রহণ করতে।
মা যেতে নিষেধ করছিলো। মা বলছিলো এই ধরনের অনুষ্ঠানে বড় বড় মানুষজন আসবে, সেখানে জঙ্গিরা আক্রমণ করতে পারে, বোমাও মারতে পারে। আমি মার কথায় কান দিতে চাইলাম না। মায়ের মন সবসময়ই একটু নেগেটিভ চিন্তা করবে, এটাই স্বাভাবিক। আমি রওনা দিয়েই দিলাম।
কক্সবাজার যখন পৌছলাম তখন আমি অনেক ক্লান্ত। ক্লান্তি নিয়েই ঘুমুতে গেলাম, আর ভাবতে লাগলাম, কি আনন্দের বিষয়, কালকে শপথ গ্রহণ করবো, কত বড় বড় মানুষের দেখা পাবো। আমার কাছে কেমন যেন উৎসব উৎসব মনে হতে লাগলো। ঘটনা তেমন না পেচিয়ে বলেই ফেলি ’আমি ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম. . .’
দৃশ্যপট ২-
১৯ জুন ২০০৯।
আমি অন দ্যা স্পট. . .
লাখ লাখ মানুষ কক্সবাজারে. . . এতো এতো মানুষ দেখে অবাক হয়ে গেলাম! অনেক ভিড়ের মাঝে একসময় আবিষ্কার করলাম জাফর ইকবাল স্যার শপথ বাক্যের স্টেজে দাড়িয়ে আছেন।
আরও অনেক সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। ব্যাপারটা আমার কাছে কেমন যেনো স্বপ্নের মতো মনে হলো। আপনাদের কাছে হয়তো মনে হতে পারে ব্যাপারটা মোটেও স্বপ্নের মতো নয়, কিন্তু ব্যাপারটা সত্যিই স্বপ্নের মতো. . . কেননা জাফর ইকবাল স্যার হঠাৎ আমাকে ইঙ্গিত করলেন স্টেজে আসার জন্য. . . আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না. . . আমি ভাবলাম একদৌড়ে স্টেজে চলে যাই, পরক্ষনে ভাবলাম একটু ভাব নিয়ে ধীরে ধীরে যাই. . . এমনোতো হতে পারে স্যার আমাকে ইঙ্গিত না করে অন্য কাউকে ইঙ্গিত করছেন. . . আমি স্টেজে উঠে গেলাম, সকল শংকা দূর হলো. . আমি আর স্যার পাশাপাশি এবং কাছাকাছি. . . স্যার শপথ বাক্য পাঠ করা শুরু করলেন. . . “বদলে. . . যাবো. . . বদলে . . . . দেবো. . . .”
হঠাৎ. . . . কে যেনো ভারি কন্ঠে বলে উঠলো, “পেছনে বঙ্গেপসাগর, উত্তাল, উত্তাল, উত্তাল. . ধেয়ে আসছে. . .”। কন্ঠটা আমার কাছে কেমন যেনো পরিচিতো মনে হলো। কার কন্ঠ হতে পারে তা আমি মনে করার চেষ্টা করলাম, খুব কষ্টে মনেও পড়লো।
গ্রমীণফোনের বেশীরভাগ বিজ্ঞাপনেই এইলোকের কন্ঠ আমি শুনতে পাই, “পাশেই থাকুন, গ্রামীনফোন. . .”
“এই ছেলে এই, কিছুতো করতে হবে. . .”। আমি কিছুটা ভাবলেশহীন হয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। ওমা, জাফর ইকবাল স্যার। স্যার আপনি কাঁপছেন কেনো? আরে বোকা ছেলে সমুদ্র ধেয়ে আসছে। আমার তখন মনে পড়লো যে আমিতো শপথ গ্রহণ করতে এসেছিলাম।
শপথ গ্রহণ স্টেজে আমি আর কাউকেই দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞস করলাম, স্যার আর সবাই কোথায়? সবাই যে যার মতো পালিয়ে গেছে। আমিতো অবাক হয়ে গেলাম, শুধু স্যার যাননি। নিশ্চয়ই আমার জন্য যাননি। আমার জানামতে জাফর ইকবাল স্যার একজন অত্যন্ত ভালো মানুষ, কিন্তু উনি এতটাই ভালো যে তা কল্পনা করতেই শ্রদ্ধায় চোখে পানি এসে যাচ্ছে। স্যার হঠাৎ একা একাই বলতে লাগলেন, কোন ফাযিলটা যে আমার দাড়ানোর জায়গাটিতে ফেভিকল ফেলে রেখেছে!! নয়তো আমিও চলে যেতে পারতাম. . .!!
আমি স্যারের পায়ের দিকে তাকালাম, কিন্তু পা দেখতে পেলাম না।
কেননা, সমুদ্রের পানি হাঁটু পর্যন্ত উঠে গেছে। আমার হাটুও পানিতে ডুবে গেছে। স্যার নড়তে পারছেন না, কিন্তু আমি নড়তে পারছি. . . আমরা দু’জনেই কাঁপছি. . . পানি ঢেউ ঢেউ করে বাড়ছে. . . দু’জনেই নির্বাক. . .
নিরবতা ভাঙার জন্য আমিই বলে উঠলাম, “স্যার, আমি ’অনেক সবুজের প্রান্তে. . .’ ঐ যে আপনাকে মেইল করতাম. . . আপনার লেখার আলোচনা-সমালোচনা করে. . . আপনি কি আমার মেইলগুলো পড়তেন?” স্যার ভ্রুঁ কুঁচকে আমাকে মনে করার চেষ্টা করছেন. . . ঐ যে আমি একবার আপনাকে বলেছিলাম, মইন-উ আহমেদের মতো আপনিও যদি আনুষ্ঠানিকতা করে বলেন সাত কোটি নারীর অধিকার আদায়ের জন্য আমাদেরকে একযোগে কাজ করতে হবে, তাহলে আপনার সাথে আমি তার পার্থক্য করবো কিভাবে? মনে পড়ছে না? আচ্ছা স্যার, আপনি আমাকে একবার মেইল করে বললেন যে আমি কি বোঝাতে চেয়েছি তা পয়েন্ট আউট করতে গিয়ে আপনার ব্রেইন ফেল করেছে. . .
ও আচ্ছা, আচ্ছা. . . তুমি. . .
স্যার আপনি নির্ভয়ে থাকেন, যে করেই হোক, আমি মরে গেলেও আপনাকে বাঁচাবো. . . স্যার যেনো একটু হতাশ হয়ে হাসলেন!!
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমাদের গলা পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। আমি জাফর স্যারকে বলছি, স্যার, আপনার পা ছুঁয়ে একটু সালাম করতে চাই। আপনিতো অনেক মেধাবী।
বাংলাদেশের মতো গরীব দেশে আপানার মতো মধোবীদের অনেক প্রয়োজন। আমি যদি পারতাম তবে আমি মরে গেলেও আপনাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম, এদেশের জন্য, এদেশের মানুষের জন্য. . . এদেশের মানুষ আপনার মতো মানুষদের কাছ থেকে অনেক কিছুই আশা করে।
সমুদ্র তখন অ----নে----ক উত্তাল. . . . স্যার ফেল ফেল করে তাকিয়ে আছেন গোধূলীবেলার সেই রক্তিম আকাশের দিকে. . .
দৃশ্যপট ৩-
দৃশ্যপট-১ এবং দৃশ্যপট-২ কল্পনামাত্র।
২০ জুন ২০০৯ রোজ শনিবার। সকালে ঘুম থেকে উঠে যথারীতি পত্রিকার পাতায় চোখ রাখলাম।
দেখলাম বড় করে লেখা “লাখে শপেেথ বদলের অঙ্গিকার”। প্রথম পাতায় বড় বড় দুটো ছবিও দেখলাম, একটিতে লাইন ধরে শপথ নিয়ে দাড়িয়ে আছে কতিপয় অচেনা মানুষজন। আর একটিতে বেশকিছু পরিচিতো মুখ এবং শপথ গ্রহনের নেতৃত্বে দাড়িয়ে শপথ পাঠ করছেন স্বয়ং জাফর ইকবাল স্যার। আমি কিছুটা অবাক হলাম। বিষ্ময়ভাবটা কমিয়ে লেখাটা পড়তে শুরু করলাম. . . শুরুটা এরকম ছিলো. . .
“পেছনে বঙ্গোপসাগরের গর্জন।
সামনে প্রিয় বাংলাদেশ” এইটুকু পড়ার পরই আমার কাছে মনে হলো এই বঙ্গোপসাগর যদি বাংলাদেশের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করে তবে এইসব মানুষের কি হবে! লেখাটা আর তেমন পড়া হলো না। শপথ নিয়ে আগের লেখাগুলো পড়ে শুধু বিরক্তই হয়েছিলাম। শপথ গ্রহনের মতো অনুষ্ঠান এবং এর আনুষ্ঠানিকতা আমার একেবারেই ভালো লাগেনি। যদিও কিছুটা হলেও মানুষকে বদলানোর একটা ভালো চেষ্টা বলা যেতে পারে। কিন্তু আমি কখনোই মানতে পারিনা শপথের ধারে বদলে যাবে দেশ।
এটা কখনোই সম্ভব নয়।
একটা ব্যাপার বলি, একজন ভিক্ষুক নিজেকে কোটিপতি ভাবতে পারেন. . কিভাবে ভাবতে পারেন? তিনি ভাবেন, এক টাকাতো কারোই কখনো গায়ে লাগে না। আজকাল ফকিরকে অনেকেই পাচ-দশ টাকা দিয়ে থাকেন। বাংলাদেশের প্রতি ১৪ জন মানুষ থেকে একজন মানুষ যদি তাকে এক টাকা করে দেন তবেই কিন্তু তিনি কোটিপতি হয়ে যান। এই ভিক্ষুক খুবই চতুর।
এরমতো সবাই চতুর হতে পারে না এবং নিজেকে স্বান্তনাও দিতে পারেন না! আর এই ভিক্ষুক ভালো করেই জানেন যে এরকমটা কখনোই ঘটবে না। কেননা, ১৪ কোটিতো নয়ই, এক কোটি মানুষকেও সে কখনোই একসাথে পাবে না! কোটিপতি অথবা লাখোপতি কোনটাই সে হতে পারবে না।
কোটিকোটি মানুষের এই দেশে প্রতিদিন কোটিকোটি ভালো কাজ যেমন হয় তেমনি কোটিকোটি খারাপ কাজও হয়! ভালো-খারাপ কাজ মানুষকে তার চারপাশের পরিবেশ, সার্বিক পরিস্থিতি অথবা স্বার্থ বুঝে করতে হয়। ভালো-খারাপ কাজের দ্বারা একটা দেশের পরিবর্তন করাটা মুখে বলাই সম্ভব, বাস্তবে একেবারেই অসম্ভব। একটা দেশকে পরিবর্তন করতে হলে তার সার্বিক কাঠামোগত দিকগুলো বিবেচনা করে প্রধান সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করে তার সমাধানের পথ খোঁজা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ এখন যেভাবে চলছে এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ কখনোই উন্নত দেশ হিসেবে মাথা তুলে দাড়াতে পারবে না। প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনার। প্রয়োজন সঠিক পদক্ষেপের। আর এক্ষেত্রে আমি আগের মতো আবারো বলবো একটা দেশের সার্বিক উন্নয়নে সবচেয়ে বেশী ভ’মিকা রাখতে পারে সরকার। সরকার না চাইলে অথবা সরকারের গাফলতি করলে দেশ কখনোই উন্নত হতে পারবে না।
শপথ গ্রহনের মাধ্যমেতো অবশ্যই না। প্রথম আলোর শপথ গ্রহণ একধরনের আনুষ্ঠানিকতা মাত্র!!! শপথ গ্রহনের দিনতো প্রথম আলো আমাকে দেখাতে পারলো না যে দশজন দুর্নীতিবাজ শপথ গ্রহণ করছে অথবা দশজন সন্ত্রাসী শপথ গ্রহন করছে। উল্টো তারা কতিপয় ভালো মানুষকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন শপথ পাঠ করানোর জন্য।
যে দেশের জনসংখ্যাই দেশের জন্য প্রধান সমস্যা সেদেশ শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বদলে যাবে!!?? তাই একধরনের ক্ষোভ থেকে লেখালেখিই বন্ধ রেখেছিলাম মাসখানেক। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যে ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি সে ব্যাপারটা কেনো জাফর ইকবাল, আনিসুল হক, আবুল হায়াত, আব্দুর নুর তুষারের মতো মানুষেরা বুঝতে পারছিলেন না!! তারা কেনো বুঝতে পারছিলেন না যে শপথের ধারে এদেশের বিদ্যুতের সমস্যার সমাধান হবেনা, পানির সংকট সমস্যার সমাধান হবে না, যানযটের মতো ভয়াভহ সমস্যার সমাধান শপথের মাধ্যমে কখনোই দূর করা যাবে না!!! আমি বুঝতে পারিনি. . . . . . . . . . আমি এখনো বুঝতে পারিনা. . . . .
---------------------------------------------------------------------------
পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস, জনসংখ্যা, যানজট, বেকারত্ব = শপথ??
---------------------------------------------------------------------------
কতিপয় শ্রেনীর ভেতরের ও বাইরের মানুষটার শপথ এবং প্রশ্ন শপথ কি শুধুই ভালো মানুষদের জন্য?
আমাদের শপথেই কি বদলে যাবে বাংলাদেশ? ”প্রথম আলো” কি তাই মনে করে. . . .(!)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।