ঢেকে রেখো হিংস্র ঢাল তলোয়ার। সৈনিক, এবার কলম চালাও... আদু ভাইয়ের টিউশানি(ছোটগল্প)
মোবারক হোসেন রুবেল
তিনটি বেড। সিলিং ফ্যান। মধ্যহ্ন। আমি ঘুমাচ্ছিলাম।
স্বপ্নে বিভোর। আমার এই আরেকটা স্বভাব আমি দিবা স্বপ্নে আন্দোলিত। রাতে সচরাচর স্বপ্ন দেখি না। কারণ ঘুমাই কম, বড়জোর ঘন্টা তিনেক।
মোবারক! মোবারক!! মোবারক!!! জুনিয়রদের এই আরেকটা স্বভাব।
দরজা বন্ধ করে ঘুমানো। আরে ব্যটা ঘুমাইবি তুই ঘুমা। তাই বলে দরজা বন্ধ করে? মোবারক! বাঘের গর্জন নিজ কানে শুনিনি। কিন্তু রাসেল ভাইয়ের গর্জন তো শুনতে পারি। ভয়ে ভয়ে দরজা খুললাম।
স্লালামালাইকুম ভাইয়া..আরে বেটা সালাম পরে দে। আগে তোর সাইকেলের চাবিটা দে.. রাসেল ভাইয়ার পথ পানে চেয়ে রইলাম।
মোহাম্মদ রাসেল মিয়া। সবাই বলে রাছেল ভাই। আচ্ছা স কে তারা ছ উচ্চারণ করে কেন? সাবানকে তো কেউ ছাবান বলে না।
সুইটি কে তো কেউ সুইটি বলে না, বলে ছুইটি। আবার সোনিয়াকে কেউ সোনিয়া বলে না বলে ছনিয়া। আমার জানা মতে বাংলা বানাণ রীতির দুটি নিয়ম আছে-একটি বাংলা একাডেমি কর্তৃক, অপরটি এনসিটিবি মানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক। অনেক গবেষনা করেও স কে ছ উচ্চারণ করার কোন নির্দিষ্ট কারণ খুজে পেলাম না। না, বাবা আমি এসব জঠিলতায় নাই।
আমার সোজাসাপ্টা সম্বোধন-ভাইয়া।
রোম নং ৪১৬
পূর্বাঞ্চলীয় ছাত্রাবাস,
এম, সি কলেজ, সিলেট।
পড়াশোনার তাগিদে বিভিন্ন এলাকা থেকে আমরা গুটিকয়েক বিদ্যার্থী। তন্মধ্যে নির্দিষ্ট এলাকা থেকে আমি আর রাছেল ভাই ছিলাম। একই এলাকার কৃত শিক্ষার্থী।
সবাই বলে রাছেল ভাই। আজ পর্যণ্ত কাউকে রাছেল বলতে শুনি নি। কারণ তিনি ছিলেন আদু ভাইয়ের ফটোকপি। ঐ সেই আদু ভাই!! লেখক আবুল মনসুর আহমদ এর শ্রেষ্ট চরিত্র। নূতন পুরাতন হয়, জুনিয়র সিনিয়র হয়।
কিন্তু রাছেল ভাইয়ের কোন পরিবর্তন নাই। বেশ কয়েকবার ছাত্রাধিনায়ক হওয়ার চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু যোগ্যতা বলে হতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথের একটি বিখ্যাত কবিতাকে প্যারোডি করে তিনি প্রায়ই বলতেন-
সাতবার নির্বাচন করিলাম আমি এমসি হোস্টেলে
ছাত্রাধিনায়ক হতে পারিনি আমি যোগ্যতা নাই বলে।
রাত প্রায় একটা বাজে।
আন্তর্জাতিক হিসেবে তেরটা(বিপরীতক্রমে)। বিজ্ঞানী ডাল্টন হয়তো বদ্ধ পাগল ছিলেন কিংবা তিনি পাগল হলে তার সূত্র গুলো ছিল নেহাত পাগলামী। তার পাগলামীর নমুনা পড়ছি। ১ম পত্র। রসায়ন বিজ্ঞান।
মোবারক, আমার রোমে আসো। কে বলল? আমার এই একটা সমস্যা। কারো কন্ঠ মনে রাখতে পারিনা। মাঝে মধ্যে ফোনে বাবাকেও জিজ্ঞেস করি, কে বলছেন প্লিজ? বেরিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। রাছেল ভাইয়ের দরজার শব্দ শুনতে পেলাম।
লাইট জ্বলছে। পুকুরের পাড়ে সোডিয়াম বাতি। ঠান্ডা বাতাস।
রোমে ডুকে সালাম দিয়েই দাতে জিব কাটলাম! ভাইয়ার নিষেদ ছিলো রাত ১২.০০টা পর সালাম না দিতে। যতটুকু ধর্মীয় বিধিমতে জানি নামাজে থাকাবস্থায় কিংবা খাওয়ায় থাকাবস্থায় সালাম দেওয়াটা নিষেদ কিন্তু রাত ১২.০০টার পরে সালাম দেওয়াটা নিষেদ তা কখনো শুনিনি।
আমাদের হোস্টেলের কুদ্দুস ভাই ব্যাপারটা বললেন- কোনো একদিন গরমের রাতে রাছেল ভাই খালি গায়ে পুকুরের পাড়ে বসে ছিলেন। হটাত এক জুনিয়র ছেলে রাছেল ভাইকে সালাম দিল। আশেপাশে কেউ নেই। ডিবডিবে অন্ধকার। রাসেল ভাই ভয় পেয়ে পুকুরে দিলেন ঝাপ!! সেই থেকে রাছেল ভাইকে রাতে সালাম দেওয়াটা নিষেদ ছিল।
কারণ তাঁর সেই বিভতস স্মৃতি তাঁকে এখনো যে তাড়ায়...সেই জুনিয়র আজ সিনিয়র হলো। কিন্তু রাসেল ভাইয়ের কোন পরিবর্তন নেই।
বসো, মোবারক !!মুখে ক্লান্তির ছাপ। ক্ষুধার্ত কিবা তৃষ্ণার্ত। খুব ভয়ে ছিলাম।
রাত ১২.০০টার পর সালাম দেবার অপরাধে কপালে দু:খ থাকতেই পারে!
ছোট্ট টেবিল। ওপরে পত্রিকা। চাকরীর খবর। একটি মগ। কিছু পুরাতন বই।
ক্যাসেট প্লেয়ারে গান বাজছে। বাংলা গান... আমার চন্দনা মরে গেছে...টেবিলের পায়ে রাছেল ভাইয়ের নিজ হাতে সেটিং করা কফি হিটার। কফি বানানো হচ্ছে। চা-খাবে? মোবারক? একজন বড় ভাই আমাকে চা খাবার জন্য বলছেন। বিশ্বাস হচ্ছে না।
যে রাছেল ভাই নিজ মুখে বলতেন-সিনিয়রদের পাশে বসে চা খাওয়াটা বেয়াদবী। আজ সেই রাছেল ভাই আমাকে চা খাওয়ার জন্য অফার করছেন। কিন্তু তিনি তো বানাচ্ছেন কফি! চায়ের কথা বললেন কেন? এটাকে কফিও বলতে পারো। কারণ ঠান্ডা চায়ের মধ্যে কফি ঢেলে গরম করে নিলাম। মানে চা-কফি মিক্সড।
খুবই টেষ্টি!!
আমার মিক্সড প্রায় শেষ পর্যায়ে। রাছেল ভাই এর হাতে মগটা যেমন আছে ঠিক তেমনি। বিছানায় হেলান অবস্থায়। খুব অসহায় মনে হচ্ছে ভাইটাকে।
মোবারক তোমার সাইকেলটা কেন নিয়েছিলাম জানো?- প্রশ্ন করলেন আমাকে আর উত্তরটা দিলেন নিজেই।
রাছেল ভাইয়ের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। কোন একদিন আমার মাথা ব্যথা করলে আমি প্রচন্ড কেদেছিলাম। তিনি আমাকে শান্তনা দিয়ে বললেন কান্নাকাটি করনা, কান্নাকাটি করে মেয়েরা আর বোকারা। আমি কি রাসেল ভাইকে সেই কথা বলে শান্তনা দেব?!
ক্যাসেট প্লেয়ারটা বন্ধ করে নিজেই ক্যাসেট প্লেয়ারের মতে বলতে লাগলেন।
: একটি টিনশেড বাসায় টিউশানি করি।
হেটে যাই। হেটে আসি। ক্লাস ফোর, মাইনে ৫০০ টাকা, যেতে লাগে চল্লিশ মিনিট। আসতে ত্রিশ মিনিট। স্টুডেন্টকে সময় দেই দেড় ঘন্টা।
সর্বমোট দৈনিক ১৬০ মিনিট। সপ্তাহে ৬দিন। মানে মাসে ৪১৬০ মিনিট। এক্ষেত্রে ৫০০ টাকা একেবারেই সামান্য। তাও কোন দু:খ ছিলনা।
যদি মাইনেটা সময় মতো পাওয়া যেত।
রাসেল ভাইয়ের মুখ বিমর্ষ থেকে বিমর্ষ হচ্ছে। পানি ঠান্ডা হয়ে বরফ হয় জানি। কিন্তু কফি বরফ হয় কিনা জানিনা। রাসেল ভাইয়ের হাতের কফিটা বরফ না হলেও তলানীতে খাদ জমেছে নিশ্চিত।
আজ করলো কি জানো? প্রায় দেড় মাস পর ছাত্রের মা কাজের বুয়াকে দিয়ে ৪৯০টাকা পাঠালো। বলল, আর দশ টাকা পরে নিতে। আপনি কি সেই দশটাকা আনার জন্য আবার গিয়েছিলেন? মনে মনে খুব হাসি পাচ্ছি। কিন্তু হাসতে সাহস পাচ্ছিলাম না। অন্য কোন বিষয় হলে এরকম প্রশ্ন করলে নিশ্চিত ভাইয়া কষে একটা থাপ্পর দিতেন।
কিন্তু আজ আর এমনটি হচ্ছেনা। দূরে মেঘের গর্জন শুনা যাচ্ছে...
নারে ভাই, সেই দশ টাকা আনার জন্য আবার যাইনি। আমাকে যে টাকাটা দিয়েছিল তন্মধ্যে একটি দশটাকার নোট ছেড়া ছিলো। সেটা বদলিয়ে আনার জন্যই সেখানে গিয়েছিলাম!! মোবারক ছেড়া নোট বদলীয়ে আনতে যাবার বিষয়টিকে তুমি আমার নিচুতা মনে করোনা। এই পৃথিবী একটা বিরাট আয়না।
তুমি হাসলে, সেও হাসবে। তুমি কাদালে সেও কাদাবে। ভবিষ্যতে তুমি অনেক বাস্তবতার মুখোমুখি হবে। আমি চাইনা তুমি আমার মতো বাসায় বাসায় গিয়ে টিউশানি করো। যদি কখনো করতেই হয় তবে মনে রেখো: যদি কেউ তোমার সাথে আন্তরিক ব্যবহার করে তবে তুমিও তার সাথে আন্তরিক ব্যবহার করবে।
যদি কেউ তোমার সাথে পেশাদারী আচরণ করে তবে তুমিও তাদের সাথে পেশাদারী আচরণ করবে।
পেশাদারী কিংবা আন্তরিক বিষয়টা তখন খুব বেশী একটা বুঝতে পারতাম না। আজ জীবনের একটি সন্ধিক্ষনে এসে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে রাসেল ভাইয়ার সেই কথাগুলো হাড়ে হাড়ে ঠের পাচ্ছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।