জীবন্ত মানব সত্তার অস্তিত্বই নিঃসন্দেহে মানবের সকল ইতিহাসের প্রথম আরম্ভ...
গত কয়েক দিন ধরে ব্লগে রাজনীতি হিসাবে মাওবাদী তৎপরতা নিয়ে প্রচুর তোলপাড় চলছে। সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত ল্যাম্পপোষ্ট নামক সংগঠনটিকে নিয়ে ব্যাপক বিশ্লেষনের সুত্রেই মাওবাদী পন্থা নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে প্রচুর আলোচনাও দেখা যাচ্ছে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে চীনের সমর্থন ছিল আমাদের বিপক্ষে, পাকিস্থানী জান্তার স্বপক্ষে। এদেশের কম্যুনিষ্ট পার্টির সেই অংশ যারা মাওবাদী (বা চীনপন্থি) নামে পরিচিত ছিল তারা প্রত্যাক্ষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করে নাই, তাদের বিরুদ্ধে এটা একটা জনপ্রিয় অভিযোগ। যদিও সেই সময় চীনপন্থী (এখানে মাওপন্থী বা মাওবাদী নয়) এদেশীয় কমিউনিস্টরা প্রতক্ষ্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিল।
কেবল মাত্র হক-তোয়াহা বাদে সকলেই যুগপৎ লড়াই করেছিল। ইপিসিপি(এম এল) এর টিপু বিশ্বাস, ওয়াহিদুর রহমান(পরে আ.লীগ এর নেতা, এম পি) দের আত্রাই যুদ্ধ ইতিহাস খ্যাত। সিরাজ শিকদারের পেয়ারা বাগান অভ্যুত্থান পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্ত ঘাটি এলাকার লড়াই। দেবেন শিকদার, জীবন মুখার্জী, অমল সেন এরা সকলেই প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। মুলতঃ সেখান থেকেই চীন সম্পর্কে আমাদের নেতিবাচক মনোভাব এর শুরু...
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে চীনের ভূমিকা নিয়ে গত বছরের ডিসেম্বর মাসের দিকে পি মুন্সী “রাষ্ট্র ভাবনাঃ একাত্তরে চীন কেন আমাদের সমর্থন করতে পারে নাই” নামে দুই পর্বে সমাপ্ত একটা লেখা লিখেছিলেন।
সে লেখার মুল সুর ছিল নির্দিষ্ট একটা সীমানা ঘেরা ভুখন্ড যখন রাষ্ট্র হিসাবে কনষ্টিটিউট অর্থে গঠিত হয়, তখন নিজ সীমানার বাইরে যে কোন রাষ্ট্রকেই সে শক্রু (তার নিজস্ব স্বার্থের বিরোধী এই অর্থে) জ্ঞান করে। পি মুন্সীর ভাষায়ঃ ওমুকে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র - এটা একটা জেনেশুনে করা বাকচাতুরি। রাষ্ট্রের বাইরে রাষ্ট্রের কোন বন্ধু নাই, হতে পারে না। কম শত্রুতাকে, তাও আবার সাময়িক কোন সময়ের পরিপ্রক্ষিতে দাড়িয়ে, ডিপলোমেটিকভাবে ঘুরিয়ে বলি বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র, একটা আপতিকভাব ফুটিয়ে তুলি মাত্র। এতে রাষ্ট্রের স্বার্থ ও তার শত্রুতার সংজ্ঞায় কোন হেরফের হবে না।
অর্থাৎ একটা রাষ্ট্রের কাছে (তা সে কম্যুনিষ্ট অথবা বহুদলীয় গনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীন হোক) সবসময় তার নিজস্ব এজেন্ডা, তার নিজস্ব স্বার্থই প্রধান। সেটাকে অবহেলা করে তার নিজ রাষ্ট্রস্বার্থের বিপরীতে বন্ধু রাষ্ট্রের কোন স্বার্থ থাকতে পারে না।
৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে চীনের অবস্থান বুঝতে এবং তা ব্যাখা করার জন্য উল্লেখিত রাষ্ট্রের এই বৈশিষ্ট্য আমাদের খুব সাহায্য করবে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জন্মকাল ১৯৪৪ সালে যে পাঁচজন স্হায়ী সদস্য নিয়ে তা গঠিত হয়েছিল - আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, বৃটেন ও ফ্রান্সের সাথে পঞ্চম দেশটি ছিল তাইওয়ান, মানে সে আমলের অবিভক্ত চীন।
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য হিসাবে তখন ছিল তাইওয়ান, তার নাম মুছে দিয়ে তার স্থলে নিজকে প্রতিস্থাপিত করার দি্কটা রাষ্ট্র হিসাবে চীনের দিক থেকে ছিল গুরুত্ত্বপুর্ণ।
আমেরিকার সাথে সে সময় কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার জন্য এ বিষয়ে দূতিয়ালীর কাজটা করেছিল পাকিস্তান।
এরই ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ (General Assembly) মানে, সব সদস্যদেরকে নিয়ে বাৎসরিক সভায়, ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবর এক আলবেনীয় প্রস্তাবের উপর গৃহীত ভোট ৭৬ বাই ৩৫ (১৭ জন বিরত ভোটসহ) ফলাফলে জয়লাভ করে; বেইজিং বা নয়াচীন প্রথম জাতিসংঘের সাধারণ সদস্যপদ পায়, ফলে তাইওয়ানের বদলে নিরাপত্তা পরিষদের স্হায়ী সদস্যপদে অভিষিক্ত হয়। আর তাইওয়ান? তাইওয়ান সেই থেকে জাতিসংঘের সাধারণ সদস্যপদ থেকেই বহিস্কৃত হয়।
এদেশে চীনপন্থী কম্যুনিষ্টদের তৎপরতা বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখা পি মুন্সীর সেই পোষ্টে আছে। প্রাসঙ্গিক হিসাবে যে কেউ তা পড়তে পারেন।
ইতিমধ্যে আমার প্রিয় ব্লগার খারেজি মাওবাদ নিয়ে আর একটি নতুন পোষ্ট দিয়েছে আমার ব্লগে।
ভারতীয় উপমহাদেশের পশ্চাদপদ জনগোষ্ঠীগুলোর কাছে ক্রমশঃ জনপ্রিয় হয়ে ওঠা মতবাদ হিসাবে মাওবাদের ভাল একটা বিশ্লেষন হিসাবে লেখাটি আমার ভাল লেগেছে এবং এটা নিয়ে আরো আলোচনার জন্য পুরো পোষ্টটাই এখানে তুলে দেওয়া হলো।
খারেজির পোষ্ট ঃ চিনপন্থীরা কী চিজ!
চীনপন্থী, পিকিংপন্থী (পিকিং-এর নামটা বেইজিং রূপে বহুল প্রচার হবার আগেই এই টার্মটাই অপ্রচার হয়ে যাওয়ায় হয়তোবা পিকিং এর নামেই এই পন্থীরা স্মরিত হন!), মাওবাদী বা মাওপন্থী বলে একদল দুঃখী লোক এই ধরায় বাস করে, অধুনা তাদের সংখ্যা বিলুপ্তির পথে বলে কেউ তাদের দুঃখ বুঝে না। নিজেদের মাথায় ছাতা ধরিবারও তাদের কেহ নাই বলেই হয়তো অন্য প্রজাতির ভাবাদর্শধারীদেরও তাহাদের নামে ট্যাগিং করে মাওবাদী বেচারাদের হেনস্থা করা হয়। অন্য কিছু না, স্রেফ পথচারী হিসেবেই এই গণধোলাই মর্মান্তিক মনে হওয়াতে দু’চার কথা কই।
প্রথমেই বলে নেয়া ভাল যে এই মস্কোপন্থী-পিকিংপন্থী নামের মহা বিতর্ক সম্পর্কে আমি কোন বিশেষজ্ঞ নই, (আমার আগ্রহের জায়গা এটি না একদমই) স্রেফ কৌতুহলবশতঃ কিছু পড়েছিলাম, তাও বহু আগে। ফলে ভুল করার সম্ভাবনা আছে কিছু, তাই একেববারে (কাণ্ডজ্ঞানের বাইরে) সিদ্ধান্তসূচক বক্তব্য সাধারণত পরিহার করাই আমার পক্ষে উত্তম হবে। আর খোদার কিরা, আমি যাদের এ বিষয়ে ভাল জানেন বলে জানি, তারা কেউ এগিয়ে এলে এ গুরুভার কিছতেই নিতাম না, কেননা তারা হেসেখেলে এ কাজটি কর্তে পারতেন।
প্রথমে বলা দর্কার, মস্কো-পিকিং বিতর্কের শুরু ১৯৬০ দশকের একেবারে শুরুতে। স্তালিনের মৃত্যুর পর নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্ষমতায় এসে আন্তর্জাতিকক কম্যুনিস্ট রাজনীতিতে অনেকগূলো বিতর্কের সূচনা করেন।
তার একটা বড় প্রসঙ্গ ছিল তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে সশস্ত্র বিপ্লব বা বলপ্রয়োগের আর তেমন প্রয়োজন নেই, অধনবাদী সমাজতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ উত্তরণ সম্ভব; এবং তা ঘটবে পুঁজিবাদের তুলনায় সোভিয়েত অর্থনীতির শেষ্ঠত্বের কারণে
মাও সে তুং এর নেতৃত্বে চিন এর প্রতিবাদ করে। চিনা নেতৃবৃন্দ মনে করেন যে, পুঁজিবাদ যতই সংকটের মধ্যে থাকুক না কেন, তাতে তার পতন হবে না,বরং শ্রমিকশ্রেণীর পক্ষ থেকে বলপ্রয়োগ করে তাকে উচ্ছেদ করতে হবে।
যতদূর মনে পড়ে এটাই ছিল এই বিতর্কের প্রধান বিন্দু। মূল বির্তকের আরো অনেক ডালপালা ছিল। চিন অভিযোগ করে যে সোভিয়েত ইউনিয়নে আসলে সামরিক-সিভিল মধ্যবিত্ত তৈরি হয়েছে, সোভিয়েত রাষ্ট্রটি তারই দখলে চলে গিয়েছে।
এদের স্বার্থ দেখার জন্যই সোভিয়েতরা বিশ্ববিপ্লবের বদলে শান্তির পথে বিপ্লবের কথা বলছে।
এখন এই বিতর্কের ফলশ্রুতিতে দুনিয়ার বহু দেশে কমুনিস্ট পার্টিতে বিভক্তি দেখা দেয়। সোভিয়েত পার্টি ক্ষমতাবান এবং তার সাথে সম্পর্ক লাভজনক হলেও বহু দেশেই আদর্শিক কারণেই পার্টির উল্লেখযোগ্য অংশ বিরুদ্ধ পক্ষে চলে যান। এই তত্ত্বের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক ছিল সোভিয়েত নির্দেশে স্থানীয় জাতিয়তাবাদী দলগুলোতে কর্মীদের ডেপুটেশনে (!) প্রেরণ এবং তাদের গড়ে উঠতে সহায়তা দান, তাদের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন; আরেকটি ছিল তাদেরকেই প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক মদদ দান। বাংলাদেশে মস্কোপন্থী কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের সম্পর্কের সূচনা তখন থেকেই, আর সামাদ আজাদ কিংবা আরও অনেক নেতাই আসলে কম্যুনিস্ট পার্টির দায়িত্ব পেয়েই সেখানে অংশ নিয়েছিলেন।
সোভিয়েত পার্টির এই নির্দেশমত চলার আরেকটা উদাহরণ হল ইরানের কম্যুনিস্ট পার্টি শাহবিরোধী প্রত্যক্ষ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েও ‘জাতিয়তাবাদী শক্তি’ হিসাবে মোল্লাতন্ত্র এবং তার চূড়ামনি খোমেনিকে প্রায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতায় তুলে ধরা (আমি একটা রিপোর্টে দেখেছিলাম, পুরো গণঅভ্যুত্থানে অল্প কয়েকজন ডানপন্থী গ্রেফতার বা হতাহত হয়েছিলেন, তেমন অধিকাংশ ই ছিলেন ছাত্র বা ট্রেড ইউনিয়ন কর্মি, ফেদাইন, যারা প্রায় সকলেই সাধারণ মানুষ বা কম্যুনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত। ) কিন্তু ক্ষমতায় পোক্ত করেই খামেনির প্রথম কাজটি হল কম্যুনিস্টদের শেকড় ধরে উচ্ছেদ। বাংলাদেশ নিয়ে মন্তুব্য আজ এড়িয়ে গেলাম মস্কো-পিকিং বিষয়ক বিতর্কে গূরুত্ব দেয়ার জন্য।
এই বিতর্কের আরেকটা ফলাফল হল টিকে থাকার জন্যই চিনকে দ্রুত শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিনত হওয়ার দর্কার পড়ল। এ নিয়ে শুরু হল আরেকটা নতুন বিতর্ক।
পরবর্তীকালে ক্ষমতাসিন দেংশিয়াওপিং একটা তত্ত্ব দিলেন, বেড়াল সাদা না কালো তা দেখার দর্কার নাই, দেখতে হবে বেড়াল ইঁদুর মারে কি না । (চিনাদের এই এক মজার বিষয়, তারা সব কিছুকে এমন প্রবাদ-প্রবচনের আকারে প্রকাশ কর্তে পারে, চিনা রাজনৈতিক ইতিহাস পড়তে গেলেও তাদের প্রজ্ঞার পরিচয় পাবেন এক একটা গল্পের শিরোনামে, যা থেকে এক একটা পুরো রাজনৈতিক অবস্থান বা দর্শন বা বক্তব্য বা ইতিহাস উঠে আসবে, যেমন বোকা বুড়ো পাহাড় সরালো, ড্রাগনপুজারীর মৃত্যু! )। এখন এই ইদুরের সারমর্ম হল এই যে, দ্রুত ক্ষমতাবান হতে হলে শিল্পায়নের ধরন সমাজতান্ত্রিক না অসমাজতান্ত্রিক না নিয়ে ভাবলে চলবে না, দেখতে হবে উৎপাদন বাড়ে কিনা। বিরোধীরা, খাটি মাওবাদীরা আবার বললেন, না, শিল্পায়নটা এমন ভাবে করতে হবে, যাতে তার গতি একটু ধীর হলেও সেখানে যেন আমলাতান্ত্রিকতা তৈরি না হয়, সেখানে যেন নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণী জন্ম না নেয়। (তাদের প্রজ্ঞাগল্পটা হল এই: সংক্ষিপ্ত পথে দয়িতের কাছে পৌছাতে এত নোংরা রাস্তা বেছে নিলে যে পৌছে গিয়ে দেখলে তোমাকেই আর চেনা যাচ্ছে না।
)
এই বিতর্কে জয়ী হলেন দেং। পোস্ট লম্বা হয়ে যাচ্ছে, তাই এবার সংক্ষেপ করি, কেননা আধুনিক মাও বাদীদের নিয়াও দুই চারি কথা বলিতে আকাঙ্খা করি। দু/তিনটে সিদ্ধান্ত টানা যায় এখান থেকে:
১. পিকিংপন্থী বা মাওবাদীরা তারাই, যারা চূড়ান্ত দ্বন্দ্বের মিমাংসা শান্তুপূর্ণ হবে না, এই মত গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীতে নানা হঠকারীতায় ডুবলেও তাদেরই তাই দেখা যাবে পাকিস্তান প্রশ্নে চূড়ান্ত অবস্থান সবার আগে নিত।
২.ক্ষমতা প্রশ্নে এই তত্ত্বটি চিনের নিজের কোন উদ্ভাবন নয়, মার্কসবাদীদের নিজেদের মাঝেই এই বিতর্ক ছিল আগেও; আর মার্কসের জন্মের আগেও এই বিতর্ক ছিল।
(লেখার পর মনে হল এই প্যারাটা আজকের প্রসঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক)
৩. এখন আর চিন নিজেই পিকিংপন্থী বা মাওবাদী নেই। ফলে আজ চিনের স্বার্থের সাথে জড়িত কাউকে মাওবাদী বা চিনপন্থী বলাটা অর্থহীন। এই পরিভাষাটা একটা ঐতিহাসিক বিতর্কের সাথে যুক্ত হয়ে আছে। আর সেই চিন বহু আগে নিজেই সোভিয়েত ইউনিয়নের লাইন গ্রহণ করেছে।
৪. শেষত: মাওবাদী বা মস্কোপন্থা কোন স্থাননামের সাথে খুব বেশি যুক্ত নয়।
(কে জানে, বাক্যটা শুদ্ধ হল তো!) এটা একটা আদর্শিক বিতর্ক, ওই আদর্শে যুক্ত না থাকলে দেশ বা ব্যক্তি কাউকে ওই নামে ডাকা অসঙ্গত।
এবার আসি ভারতসহ নানান স্থানে মাওবাদীদের নিয়ে আলোচনায়। একটা সহজ বিষয় খেয়াল করলে দেখা যাবে, নকশাল বাড়ী পরবর্তী এই প্রায় সবগুলো স্থানের একটা সাধারণ সাদৃশ্য হচ্ছে এগুলো গ্রাম প্রধান বা জঙ্গলাকীণী এলাকা। যাতায়াত দুর্গম। আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হল এসব স্থানে এমন সব আদিবাসীদের বাস যাদের ভাষা, সংস্কৃতির পার্থক্য রয়েছে।
সাধারণত দেখা যায়, এদের নৃতাত্ত্বিক ভিন্নতার সুযোগ নিয়ে এদের ওপর বর্বর নিপীড়ন চলে, এদের জন্য মূল জাতির সুশীল অংশের মায়া কান্না থাকে কমকম, আর এসব স্থানের বনজ বা খনিজ সম্পদ এখরনও পুঁজি পুরোপুরু হজম করতে পারে নাই। এছাড়া আছেন জাতীয় বা বহুজাতিক কর্পরেট পুঁজির ধাক্কায় ক্রশশঃ খাঁচাবন্দী হতে থাকা কৃষককূল।
এবার দেখুন, নিজেদের জীবন ও জীবীকা এবং সন্মান ও সংস্কৃতি রক্ষায় লড়াই করে নাই, এমন জাতি মাও আর মার্কসের আগেও ছিল না,পড়েও নাই। বিষয় শুধু এই যে, কালে কালে এই লড়াই নতুন নতুন চেহারায় হয়েছে, মার্কস দেখিয়েছেন উত্তর আফ্রিকায় ফরাসী-বৃটিশদের বিরুদ্ধে নানান ধর্মীয় সংস্কারা আন্দোলনের ছলে উপনিবেশবিরোধী লড়াই-ই চলেছে, এবং তারা নিজেদের অধিকার যতদূর রক্ষা করতে পেরেছে, তা ওই বলপ্রয়োগের হুমকি দেখিয়েই। সিদু-কানহুর বিদ্রোহের চেহারাও একদিকে ধর্মীয় হলেও আদতে তো তা মহাজন আর শোষকদের থেকে নিজেদের জনগোষ্ঠিকে রক্ষারই চেষ্টা!
আজ আর সেই ধর্মীয় সংস্কারের দুনিয়া নাই (খারেজি একা খালি আছে, হা হা হা); আধুনিক স্কুল-কলেজে যাওয়া আদিবাসী সন্তানরা নিজেদের গালে যখনই বৃহৎ রাষ্ট্রের চড়টা আবিষ্কার করেন, বাপকে জীবিকা থেকে উচ্ছেদ হতে দেখেন কিংবা নিজেদের সংস্কৃতিকে হীন বলে শোনেন, তার যে প্রতিক্রিয়া, প্রকাশের ভাষা, তা আজকের জমানায় কমরেড মাওয়ের নামে হয়।
মাওয়ের কৃষকবাহিনীর অসম সাহসী বিজয়ের কল্যাণে সারা দুনিয়ার বহু জঙ্গলবাসি, পাহাড়ী আদিবাসী তাদের লড়াইকে মাওয়ের নামে উৎসর্গ করেন এই ভাবে।
কথা সত্য, এই সব লড়াই গুড়িয়ে দেয়া হয়, নারীরা শতে শতে ধর্ষিত হন, সন্মানিত ব্যক্তিদের গাছে ঝুলিয়ে পেটান হয়, শিশুদের বুটে মাড়িয়ে যাওয়া হয় (বিএসএফ কর্তৃক মনিপুরে নারীদের ধর্ষণের প্রতিবাদে একটা সেখানকার নারীদের একটা আত্মঅবমাননা কর প্রতিবাদের পন্থা দেখে তাদের অপমানের তীব্রতাটা বুঝতে পেরেছিলাম। ); আর এ কথাও সত্য যে, মাও নিজে হলেও বুঝতেন যে চিনে যে লড়াই মূলজাতিগোষ্ঠী লড়ছে, সেই লড়াই সংখ্যালঘুরা জিততে পারবে না… কিন্তু সেই লড়াইকে শ্রদ্ধা না করে উপায় কি, তাদের স্যালুট না জানিয়ে কি করে পারি! কখনো কখনো আত্মহননই প্রতিবাদের একমাত্র ভাষা হতে পারে, হয়তো লাখে লাখে স্তুপ জমলে সাজোয়া যানের গতি একটু ধীর হয়!
আমি যদি আদিবাসী হতাম, নিশ্চয়ই আমি মাওবাদী হতাম, নিশ্চিত পরাজয় জেনেও তা হতাম। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই অহসায় কান্নাকাটির মৃত্যুর চেয়ে হাতে বানানো স্ললমাইন শত্রুর জন্য পুঁতে রাখায় কম অপমান থাকে।
….
সংযোজন:
হুড়মুড় করে লেখা এই নিবন্ধটায় একটা কথা যুক্ত করা যায়, সেটা হল আদিবাসী সংস্কৃতির সাথে সমাজতান্ত্রিক যৌথ-কৃষির সাদৃশ্য সম্ভবত তাদেরকে রাজনৈতিকভাবে আকর্ষণ করে।
এছাড়া আছে খনিজ ও বনজ সম্পদ উত্তোলনের নামে তাদের অস্তিত্ব ধ্বংসের রাষ্ট্রীয় ও বহুজাতিক আয়োজন। অন্যদিকে অ-আদিবাসী কৃষক এলাকাতেও জমির মালিকানার একচেটিয়াকরণ ও মূল্য-না-পাওয়া, বহুজাতিকের বিনিয়োগে উচ্ছেদকৃত কিংবা বীজ-সার-কীটনাশক এর ফাদে আটকা পড়া কৃষকরা রাজনৈতিক দাবি হিসেবে ভূমি সংস্কারকে রাজনৈতিক দাবি হিসাবে উত্তাপন করে। আর ভূমির ইস্যুটাকে মস্কোপন্থীদের তুলনায় মাওবাদীরা ঐতিহাসিকভাবেই বেশি সামনে এনেছে, এটা সব মিলে অ-শহর অঞ্চলগুলোতে মাওবাদীদের প্রাধান্যের কারণ হতে পারে। ভারত, ফিলিপাইন, ল্যাতিন আমেরিকান বহু অঞ্চলে মাওবাদীদের বিকাশকে হয়তো এভাবেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
…
সংযোজন দুই:
বাড়িতে ফিরা আরেকটা কথা মনে পড়লো, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে চিনের সর্বদা নিজ স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়াটাও তার নিজের মাওবাদী অবস্থান থেকে সরে আসার ফল।
‘৭১ সালে মাও নিজেও বৃদ্ধ হলও জীবিতই ছিলেন। ফলে মাওবাদাকে ব্যক্তির সাথে না মিলিয়ে তত্ত্বের গূরুত্বটাকে দেখতে হবে, যা থেকে হয়তো ঐ নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা দেশ সরে এসেছে। আর এখন তো চিন আফ্রিকার বহু এলাকায় যা তৎপরতা শুরু করেছে, তাকে আর সব বহুজাতিক কোম্পানির কারবার থেকে কিছুতেই আলাদা করা যাবে না।
খারেজির পোষ্ট সমাপ্ত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।