অদ্ভুত এক সমস্যার মুখোমুখী হয়েছে বর্তমান বিশ্ব। "শ্যাম রাখি না কূল রাখি" এই অবস্থায় আদতে নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে আমাদের ভবিষ্যত শক্তির উৎস কেমন হওয়া উচিত। কোনো দেশের উন্নয়নের পরিমাপ এখন সে দেশ কি পরিমাণ বিদ্যৎ ব্যবহার করে। বিদ্যুৎ একধরণের শক্তি, এবং সেটা অন্য কোনো শক্তিকে রূপান্তরিত করেই উৎপাদন করতে হয়। এই প্রক্রিয়ায় অন্তত ২০ থেকে ৮০ শতাংশ অপচয় হবে এবং যে শক্তি অপচয় হবে তা শব্দ, তাপ এবং কম্পণজাতীয় শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে পৃথিবীতেই থেকে যাবে।
খনিজ জ্বালানীর ব্যবহার বেড়েছিলো প্রচন্ড ভাবে, এবং এরই প্রভাবে পৃথিবীতে গ্রীন হাউস গ্যাসের নির্গমণ বেড়ে যায়। খনিজ জ্বালানী ব্যবহার করলে উপজাত হিসেবে উৎপন্ন হয় কার্বন ডাই অক্সাইড, এবং এই গ্যাসকে দায়ী করা হচ্ছে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ক্রশম কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন বন্ধ করতে চেষ্টা করছে, অর্থ্যাৎ তারা গ্রীন ফুয়েল ব্যবহার করতে চাচ্ছে কিংবা তারা চাচ্ছে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে, রাস্তায় বিদ্যুৎ চালিত গাড়ী ব্যবহার করতে।
নাগরিক জীবনের প্রাত্যহিক ব্যবহারের অধিকাংশ সামগ্রীই এখন বিদ্যুৎচালিত। যোগাযোগের জন্য যা কিছু ব্যবহার করছি তাও বিদ্যুৎচালিত।
গাড়ীতে ব্যবহার করছি ডিজেল, পেট্রোল অকটেন। সেসব খনিজ জ্বালানী ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে আনবার অর্থ হলো অন্য কোনো বিকল্প শক্তির সন্ধান করা। যা পরিবেশ বান্ধব।
গাড়ীর জন্য বিকল্প হিসেবে এসেছে বায়োডিজেল, যা কৃষিজমিতে উৎপাদন করা সম্ভব। পামওয়েলকে রুপান্তরিত করে গাড়ীর উপযুক্ত জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা যায়, এবং অনেক গাড়ী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিজেদের ইঞ্জিনের ধরণ বদলে বায়োডিজেলে চলবার উপযোগী করে নির্মাণ করেছে।
ঠিক একই সময়ে সবাই প্রতিরোধ শুরু করলো। আমাদের শহরগুলোতে যে পরিমাণ গাড়ী চলাচল করে তাদের সবার জ্বালানী যদি বায়োডিজেল হয় তবে খাদ্যউৎপাদনের জন্য পর্যাপ্ত জমি পাওয়া যাবে না। সুতরাং আমাদের একটা মধ্যম পন্থা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের বিশ্বের ৬০০ কোটি মানুষের জন্য খাদ্য উৎপাদন করতে হবে এবং একই সাথে জমিতে কোটি কোটি গাড়ী, ট্রাক, লরী এবং প্লেনের জন্য জ্বালানী উৎপাদন করতে হবে, কারণ আশংকজনকভাবে কমে যাচ্ছে খনিজ জ্বালানীর মজুত। এবং যদি বর্তমান ব্যবহারের উর্ধমুখী ধারা চলমান থাকে তবে ২১ শতকে কোনো খনিজ জ্বালানী থাকবে না।
এখানে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিডেল ক্যাস্ট্রো বললেন, এটা পূঁজিবাদী চক্রান্ত তারা মানুষের পেটের খাওয়ার কেড়ে নিয়ে গাড়ীর চাকা ঘোরাতে চায়। এটাকে প্রতিহত করতে হবে।
অবশ্য গাড়ী নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ চালিত গাড়ীর নক্সা অনেক আগে প্রণয়ন করলেও সেটা নিয়ে গবেষণা চলছিলো না তেমন ভাবে, কারণ খানিজ জ্বালানীর সহজপ্রাপ্যতা। কিন্তু জ্বালানীভিত্তিক গাড়ীর ভবিষ্যত প্রায় শূণ্য, বিকল্প হলো বিদ্যুৎচালিত গাড়ী। সেটা রিচার্জেবল ব্যাটারীর মতো, গাড়ীকে সময় সময় চার্জ করতে হবে, সে চার্জ শেষ হলে পুনরায় চার্জ করতে হবে।
এমনও যদি হয় তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এখনও খনিজ জ্বালানীর ব্যবহার সবচেয়ে বেশী। কিন্তু সেটাও গ্রীন হাউস গ্যাস নির্গমন করে, সুতরাং আরও পরিবেশ বান্ধব জ্বালানী ব্যবহার করতে হবে।
খানিজ জ্বালানীর বিকল্প কি? পারমাণবিক শক্তি, পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প, তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প, সমুদ্রের স্রোতের শক্তিকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প, বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প এবং সৌরবিদ্যূৎ উৎপাদন প্রকল্প।
বায়ুবিদ্যুৎ কিংবা সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পে উৎপাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব না, এমন কি বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদা পুরণের সাথে সাথে ভবিষ্যত বিদ্যুৎ চাহিদাকে পুরণ করবার জন্য অব্যাহত উন্নতি করতে হলেও পৃথিবীর বিশাল একটা অঞ্চলে আমাদের সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল বসাতে হবে।
কিংবা প্রতিটা গ্রামে কিংবা প্রতিটা মহল্লায় একটা করে বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্রস্থাপন করতে হবে। এবং এরপরও আশাবাদী হওয়া যাবে না যে সেটা আমাদের চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে। আমাদের কয়েকটি বিকল্প ব্যবস্থা রাখতে হবে, রাখতে হবে উৎপাদিত বিদ্যুৎকে সংরক্ষণ করবার ব্যবস্থা।
পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রও এমন একটি পরিবেশবান্ধব প্রকল্প বিবেচনা করা হলেও সেটা পরিবেশের বিপর্যয় ডেকে আনে, এখানে পানির সঞ্চিৎ স্থিতিশক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তরিত করা হয়। এবং এই সব প্রকল্প স্থাপন করা হয় উঁচু স্থানে, এবং জলাধার নির্মাণ করতে হয়, সেখান থেকে নিয়ন্ত্রিত উপায়ে পানি ছেড়ে সে পানিতে টার্বাইন ঘূরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে।
এই উঁচু এলাকায় পানি সংরক্ষণ করতে হলে সেখানের বিস্তৃর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে যাবে, পরিবেশের ক্ষতি হবে।
পারমাণবিক শক্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন একটা বিকল্প পন্থা, যেখানে গ্রীন হাউস গ্যাস উৎপাদিত হয় না কিন্তু সেটা খুব বেশী প্রচলিত নয়, এর ঝুঁকি এবং সাম্ভাব্য ক্ষতির কারণ বিবেচনা করে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিষাক্ত নিউক্লিয়ার বর্জ্য সংরক্ষণের বিষয়টি। সেটা যেখানে সেখানে ফেলে দেওয়া যাবে না। পৃথিবীতে অতিগভীর গর্ত খুঁড়ে লুকিয়ে না রাখলে সেটার বিষাক্ততা পৃথিবীর জীবজগতকে আক্রান্ত করবে।
পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো পারমাণবিক পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপক্ষে, তারা পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিপক্ষে, তারা বায়োডিজেলের বিপক্ষে। তারা খনিজ জ্বালানী ব্যবহারের বিপক্ষে।
এখন এই অবস্থায় একটা সিদ্ধান্তই নেওয়া প্রয়োজন , আমাদের বিদ্যমান যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আমরা কি ভাবে পরিবর্তিত করবো। ইমেইলের পরিবর্তে আমরা কি ঘোড়ার ডাক কিংবা কবুতরের পায়ে চিঠি বেধে যোগাযোগ রাখবো?
আমরা কি খনিজজ্বালানী ব্যবহার করে গাড়ী চালাবো না কি আমরা গরু ঘোড়া খচ্চর গাধায় টানা গাড়ীতে চলাচল করবো। আমাদের বর্তমাণ অবস্থায় হয়তো সীমিতভাবে আকাশপথে যোগাযোগ রাখা সম্ভব।
আমরা পালতোলা নৌকায় চলাচল করবো সমুদ্রপথে।
মানুষ যন্ত্রের উদ্ভাবন করবার পর থেকেই পরিবেশর উপর মানুষের প্রভাব সব সময়ই ধ্বংসাত্মক। তারা নিজেরাই পরিবেশের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা পরিবেশের উপরে খবরদারি করতে গিয়ে যা করছে সেটা পরিবেশের জীববৈচিত্র এবং পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। আমাদের বিলুপ্ত এবং বিলুপ্তপ্রায় জীবগুলোর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন কারণ আমরা পরিবেশকে এমনভাবে পরিবর্তিত করেছি যা কোনোভাবেই আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা সম্ভব না।
এরসাথে এখন যুক্ত হয়ে ক্ষমতার ধারণা, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো সবই বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং ব্যবহারে অন্য দেশগুলোর তুলনায় এগিয়ে। তারাই বিশ্বের ৮০ শতাংশ কার্বড ডাই অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী। তারা যখন এই খনিজ জ্বালানীর বিকল্প হিসেবে অন্য কোনো ব্যবস্থা গ্রহন করবে সেটাও পরিবেশের জন্য সমান রকম ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। হয়তো সমুদ্রপৃষ্টি পানির উচ্চতা বাড়বে না কিন্তু স্থানীয় ইকোসিস্টেম ধ্বংস হবে ।
তারা নিজেদের সংস্কৃতি এবং বিদ্যুৎ ব্যবহারের হার না কমালে আমাদের বিশ্ব সব সময়ই হুমকির মুখোমুখী থাকবে।
আমাদের সামনে প্রশ্নটা মূলত এখানেই, মানুষকে ভিন্ন ধরণের জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে উদ্বুদ্ধ করা। আমরা বিশ্বের সকল নাগরিক একাট্টা হয়ে যদি পরিবেশের জন্য বিপর্জয়কর সকল বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থাকে বন্ধ করতে চাই তবে আমাদের দৈনন্দিন চাহিদার ১০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে না।
এটা বেছে নেওয়ার বিষয়, আমরা পুনরায় ফিরে যাবে কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থায়, আমরা দা কুড়াল তীর ধনুক নিয়ে শিকার করবো। নগরে কোনো উঁচু ইমারত থাকবে না, আমাদের বাসস্থান হবে সবুজ। আমরা খড়কুটো আর শুকনো পাতায় ঝলসে খাবো আমাদের শিকারের প্রাণী।
আমরা কবুতর পুষবো, ঘোড়া গাড়ী নিয়ে যাবো, গরু গাড়ীতে ঘুরবো, এমন পরিবেশ বান্ধব ব্যবস্থায় আমাদের অভ্যস্ত হতে হবে।
কিংবা আমাদের অন্য তৃতীয় কোনো বিকল্পের সন্ধান করতে হবে। আমাদের উঁচু মন্দির তৈরি করে ইশ্বরের ভজনা করতে হবে, অনন্ত শক্তির আধার পাঠাও ইশ্বর, কিংবা পাঠিয়ে দাও বিদ্যুৎ এর অনন্ত নহর।
আমাদের বর্তমান বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা মেনে নিতে না পারলে এইসব বিকল্পকে মেনে নেওয়া ভালো, কারণ যেকোনো শক্তি উৎপাদন প্রকল্পই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক হবে। আমরা ক্ষতির ব্যপকতা কমাতে পারি, এর প্রভাবে হয়তো ক্ষুদ্র একটি জাতিসত্ত্বার সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে , বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের এই কোরবানি মেনে নিতে হবে।
আমাদের পৃথিবীতে ১০০ কোটি মানুষ অনাহারে ঘুমাতে যাবে, তবুও আমরা বায়োডিজেলের ব্যবহার প্রসারের আহ্বান জানাতে পারি। আমরা আফ্রিকার অনুন্নত দেশের উপকুলে পারমাণবিক বর্জ্য ফেলে এসে সেখানে ক্যান্সার ছড়িয়ে দিতে পারি, কারণ মাটির কয়েক মাইল নীচে গর্ত খুঁরে নিউক্লিয়ার বর্জ্য লুকিয়ে রাখবার চেয়ে এটা অনেক বেশী নিরাপদ পন্থা। আমরা পানিবদ্যুৎ উৎপাদনের অনুমতি দিয়ে কয়েক হাজার বর্গমাইল এলাকাকে জলমগ্ন করতে পারি, প্রতিবছর অন্তত ১ লক্ষ মানুষকে উদ্বাস্তু করতে পারি,
সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। আমরা প্রতিরোধ করতে পারি। মেনে নিতে হবে রাষ্ট্র আমাদের বিপক্ষে থাকবে সব সময়ই, রাষ্ট্র বৈশ্বিক বিবেচনায় তার ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখতে চাইলে এইসব ছোটোখাটো ক্ষতি মেনে নিবে।
অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে টিকে থাকতে হলে এইসব ছোটোখাটো প্রতিরোধকে দমন করবে রাষ্ট্র নিষ্ঠুর ভাবে কিংবা কৌশলে। কিন্তু রাষ্ট্র এই আয়োজন থেকে পিছিয়ে আসবে না।
পরিবর্তন করতে হবে আমাদের নিজস্ব জীবনযাপনের ধারা ও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি।
আমরা সবুজ পৃথিবীর সবুজ নাগরিক হয়ে বাঁচি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।