সকল অন্ধকারের হোক অবসান
স্বর্গ নয়। তবু স্বর্গ বলেই মনে হয়। এতো সুন্দর সুনীল আকাশ। বিস্তৃত সবুজ মাঠ। ফসলী ক্ষেত।
টলটলে জলের পুকুর। তার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঝিরিঝিরি বাতাস। ফসল দুলে ওঠে। যেন সমুদ্রের ঢেউ । ইংল্যান্ডের সাফোক অঞ্চলের একটি গ্রাম ইস্ট বার্গহল্ট।
গ্রামের পাশেই উপত্যকা, নাম ডেডহাম ভ্যালি। এই গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতটাই যে ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যান জন কনস্টেবল। তিনি জন্মেছেন এই গ্রামেই ১৭৭৬ সালের ১১ জুন। শৈশব থেকেই তাঁর চোখ জুড়ে ছিল গ্রামের চারপাশের দৃশ্য, যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে শিল্পী করে তোলে। চমৎকার চমৎকার সব ল্যান্ডস্কেপ।
ল্যান্ডস্কেপ মানে, যে পেইন্টিং-এ থাকে বিস্তীর্ণ মাঠ-তে-আকাশ। থাকে দিগন্ত। থাকে আকাশ জমিনের মিলে যাওয়া।
কনস্টেবল বন্ধু জন ফিশারকে ১৮২১ সালে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে তিনি বলেন: “আমার উচিৎ আমার জন্মস্থানের পেইন্টিং-ই ভালো করে করা।
পেইন্টিং হলো অনুভূতির আরেক নাম। ” জন কনস্টেবল তাঁর জন্মস্থানের ছবি এতো নিষ্ঠার সঙ্গে এঁকেছেন যে তাঁর চোখেই এখন সেই গ্রামকে মানুষ দেখে আর মুগ্ধ হয়। এখন তো সে গ্রামের নামই হয়ে গেছে “কনস্টেবল কান্ট্রি”।
ডেডহাম ভ্যালি (১৮০২), দি হে ওয়েন (১৮২১), দি কর্নফিল্ড (১৮২৬) প্রভৃতি কনস্টেবলের বিখ্যাত পেইন্টিং। এছাড়াও তাঁর রয়েছে বহু সিস্কেপ, মানে সমুদ্রের ছবি।
কিন্তু বিশ্বজোড়া কনস্টেবলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে তাঁর অসাধারণ সুন্দর ল্যান্ডস্কেপগুলোর কারণেই। ইংলিশ রোমান্টিক পেইন্টারদের মধ্যে তিনি অন্যতম। রোমান্টিক বলা হত কারণ- রোমান্টিসিজম আন্দোলন যেসব দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করত কনস্টেবলও সেসব নিজের কাজের মধ্যে প্রকাশ করতেন। রোমান্টিসিজম আন্দোলন শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে পশ্চিম ইউরোপে। এই আন্দোলনের ঢেউ লাগে সাহিত্যে, সঙ্গীতে, শিল্পকলায়।
এসময় পুরনো ধ্যানধারণার বাইরে এসে সাহিত্যিক ও শিল্পীরা সৃষ্টি করতে থাকেন নতুন ধরনের কবিতা, অভিনব সব পেইন্টিং এবং অভূতপূর্ব সঙ্গীত।
জন কনস্টেবলের বাবা গোল্ডিং কনস্টেবল, মা এ্যান কনস্টেবল। তাঁদের ছিলো ভুট্টার ব্যবসা। কনস্টেবলের বাবার ছিল দুটি মিল এবং একটি ছোট জাহাজ। আর্থিক স্বচ্ছলতা তাঁদের ছিল।
কিন্তু সমস্যাও ছিল। সেটা হল কনস্টেবলের বড় ভাইকে নিয়ে। বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে কনস্টেবল বুঝতেন- বড় ভাই যেহেতু মানসিকভাবে অসুস্থ অতএব তাঁকেই নিতে হবে বাবার ব্যবসার দায়িত্ব। তিনি যখন ডেডহামের এক স্কুলে ভর্তি হন তখন স্কুল শেষে তাঁর সাহায্য করতে হত বাবাকে। তবে শেষ পর্যন্ত কনস্টেবলের ছোট ভাই ব্যবসার দায়িত্ব বুঝে নেয়।
কনস্টেবল হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। কারণ তাঁর পেন্সিলে স্কেচ করতেই বেশী ভালো লাগে। প্রকৃতির কাছাকাছি থাকতে আরো ভালো লাগে। কী সুন্দর সব দৃশ্য! পানির ফোয়ারা, বিশাল বৃরে সারি, বনানীর মাঝে লাল ইটের বাড়ি আরো কত কী! কনস্টেবল প্রকৃতিকে দেখেন, বিস্মিত হন আর এঁকে চলেন। এভাবেই তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন বিশ্বের প্রথম সারির পেইন্টার।
তরুণ বয়সে বড় বড় পেইন্টারদের বিভিন্ন পেইন্টিং দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর। এসময় পেশাদার পেইন্টার জন টমাস স্মিথের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়। স্মিথ বলেন, “তুমি বাবার ব্যবসা নিয়েই থাক, পেইন্টিংকে পেশা হিসেবে নিও না। ” কিন্তু সে কথা কনস্টেবল শুনবেন কেন?
১৭৯৯ সালে বাবাকে মনের ইচ্ছা বললেন কনস্টেবল। আর্টের ওপর পড়াশোনা করবেন তিনি।
বাবা তাতে রাজী হলেন, হাত খরচও দিলেন। কনস্টেবল ভর্তি হলেন রয়েল একাডেমী স্কুলে। সেখানে তিনি থমাস গেইসবোরো, কদ লরেইন, পিটার পল রুবেনস প্রমুখের পেইন্টিং দেখে মুগ্ধ হন এবং প্রভাবিত হন। পাশাপাশি পড়ে ওঠেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার লেখা। যত দিন যায়, তাঁর পেইন্টিং হয়ে ওঠে সকলের চেয়ে আলাদা, স্বতন্ত্র।
ব্রাশের স্ট্রোক, রঙের ব্যবহার, কম্পোজিশন, আলোর প্রক্ষেপন সকল কিছুতেই নতুনত্ব।
কাজের স্বীকৃতিও পান তিনি। ১৮১৯ সালে তাঁকে রয়েল একাডেমীর এসোসিয়েট করা হয়। ১৮২৪ সালে প্যারিসের এক প্রদর্শনীতে তাঁর “দি হে ওয়েন” জিতে নেয় সোনার মেডেল। ফ্রান্সেই তাঁর অধিকাংশ পেইন্টিং বিক্রি হয়, ইংল্যান্ডে নয়।
ততদিনে অবশ্য কনস্টেবল বিয়ে করেছেন। ১৮১৬ সালে তিনি বিয়ে করেন বাল্যকালের বন্ধু মারিয়াকে। ১৮৩১ সালের পর থেকে রয়েল ইনস্টিউট-এ পেইন্টিং, বিশেষ করে ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিং-এর ইতিহাসের ওপর বক্তৃতা শুরু করেন। এসময় তিনি আর্ট সম্পর্কে তিন স্তরের এক তত্ত্ব দেন: এক. কবিতার মতই ল্যান্ডস্কেপ পেইন্টিঙে-ও বিজ্ঞান আছে; দুই. বাস্তবতাকে বাদ রেখে কল্পনা কখনো একা শিল্পকর্ম তৈরী করতে পারে না; তিন. কোনো মহান পেইন্টারই নিজে নিজে শেখেননি।
বিশ্ববিখ্যাত এই ইংলিশ পেইন্টার মারা যান ১৮৩৭ সালের ৩১ মার্চ রাতে।
স্ত্রী মারিয়ার পাশেই হ্যাম্পস্টিড-এর সমাধিস্থলে তাঁকে শায়িত করা হয়। আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে জন কনস্টেবল শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেও তাঁর ল্যান্ডস্কেপগুলো যে এখনো শিল্পীর মনে আত্মবিশ্বাস যোগায় তাতে কোনো সন্দেহ নাই।
.......
(লেখাটি কিশোবেলার ২য় সংখ্যায় লেখকের ছদ্মনাম নিয়ে প্রকাশ হয়)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।