আমার সম্পর্কে বলার মতো কিছু নেই।
ড. ফ্লোরা জাইবুন মাজিদঃ
ছোট বেলা থেকেই খুব গাছপালা ভালবাসতেন। কিন্তু তারপরও '৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় উদ্ভিদবিদ্যাকে পাঠ্যবিষয় হিসেবে বেছে নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন ড. ফ্লোরা। মাত্র দেড় বছর বয়সে পোলিওতে আক্রান্ত এই কৃতি ছাত্রী বুঝতে পারছিলেন না, ফিল্ডওয়ার্ক নির্ভর এই বিষয়ে পড়াশোনাটা তিনি শেষ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারবেন কিনা। উদ্ভিদবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করা মানেই হলো অনেক ঝক্কি-ঝামেলা; নানা জায়গা থেকে নানা ধরনের গাছপালা সংগ্রহ করা অথবা গাছ পালা দেখার জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো৷ অভয় দিলেন মা 'তোর বোটানিতে এত আগ্রহ তুই বোটানিতেই ভর্তি হ৷ গাছপালা, লতাপাতা যা যা সংগ্রহ করার আমিই করে দেব'।
ফ্লোরা সাহস পেলেন, ভর্তি হয়ে গেলেন বোটানিতে। মা তাঁর জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নিয়ে আসেন মাশরুম, বিভিন্ন রোগাক্রান্ত গাছ। একবার করাচি থেকে নিয়ে এলেন সামুদ্রিক শ্যাওলা। 'মায়ের কালেকশন দিয়েই আমি সর্বোচ্চ মার্কস পেয়ে গেলাম'-পড়াশোনায় মায়ের অবদানের কথা স্মরণ করতে গিয়ে বললেন, ড. ফ্লোরা জাইবুন মাজিদ।
মা নাজমান্নেছা মাজিদ যদি তাঁর পোলিও আক্রান্ত মেয়ের জন্য এই ত্যাগটুকু স্বীকার না করতেন, তাহলে ফ্লোরা হয়তোবা আজকের কৃতী বিজ্ঞানী ড.এফ জেড মাজিদ নাও হতে পারতেন।
বাংলাদেশে হয়তো তৈরি হতো না প্রকৃতির এক বিস্ময়কর খাদ্য 'স্পিরুলিনা'৷ বাংলাদেশের আবহাওয়ায় স্পিরুলিনার সফল চাষে নেতৃত্ব দিয়ে ড. ফ্লোরা হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক বিজ্ঞানী। গবেষণা কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ চার চারবার স্বর্ণপদকে ভূষিত হয়েছেন। দেশের অন্যতম প্রধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে'র চেয়ারম্যান পদ অলঙ্কৃত করেছেন। এই পদে সব সময় বাইরে থেকে চুক্তিভিত্তিক চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হতো। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে ড. ফ্লোরা প্রথম বারের মতো ঐ প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের মধ্য থেকে পদোন্নতি পেয়েছিলেন।
মহিলাদের মধ্যে তিনিই প্রথম এ প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ নির্বাহী পদে আসীন হয়েছেন। শৈশবে পোলিও রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর ডান পা দুর্বল হয়ে পড়ে, তিনবার দুর্ঘটনায় পতিত হন । সর্বশেষ ১৯৮৯ সালের দুর্ঘটনার পর দুটি ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। এই অবস্থাতেও তিনি দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে বিদেশে গেছেন। শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও বিজ্ঞানী হিসেবে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন বলেই ১৯৯৫ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত 'বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে'র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সফলতার সাথে দায়িত্ব পালনের স্বীকৃতি হিসেবে চাকরির মেয়াদ ছয় মাস বাড়িয়ে তাঁকে চেয়ারম্যান পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।
জন্ম
ড. ফ্লোরা জাইবুন মাজিদ ১৯৩৯ সালের ৬ ডিসেম্বর ঢাকা জেলার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোল্লা আব্দুল মাজিদ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচেলর স্নাতক। ব্রিটিশ আমলে তিনি বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন এবং ১৯৫৫ সালে সচিব হিসেবে তত্কালীন পাকিস্তানে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। তখন পাকিস্তানে সুদ কর্মকর্তার ঘাটতি ছিল বলে সরকার তাঁকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেন।
অতঃপর ১৯৬১-৬২ সালে তিনি পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে পুনরায় অবসর গ্রহণ করেন৷ অবসর গ্রহণ করলেও তিনি ১৯৬৯ পর্যন্ত বিভিন্ন সম্মানসূচক (Honourary) পদে কর্মরত ছিলেন। ডায়াবেটিস না থাকলেও তিনি ডায়াবেটিক সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন। মৃত্যূর সাত দিন পূর্বেও তিনি বিছানায় শুয়ে সমিতির নথিতে স্বাক্ষর করেছেন। মৃত্যূকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
মাতা বেগম নাজমান্নেছা মাজিদ ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী।
রানী এলিজাবেথের সিংহাসনে আরোহণের সময় তিনি সমাজসেবার স্বীকৃতিস্বরূপ পদক পান। ১৯৫০ এর দাঙ্গার সময় প্রাণভয়ে ভীত হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে তিনি আশ্রয় দেন। অনুরূপভাবে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের দুস্থ ও অসহায় নরনারীকে তিনি আশ্রয় দেন। ১৯৫৪ সালে ময়মনসিংহের প্রথম প্রসূতি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ঢাকা মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ফকিরাপুল বস্তির গরীব ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং (সেলাই, তাঁতের কাজ, ঝিনুকের কাজ প্রভৃতি) -এর ব্যবস্থা করেন।
১৯৫০ এর দশকের ভয়াবহ বন্যার সময় তিনি গ্রামে গিয়ে দুস্থদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন এবং পর্দানশিন মহিলাদের ইঞ্জেকশন দিতেন। সমাজসেবা ছিল তাঁর রক্তে। এটি তিনি হাতে কলমে অর্জন করেন ভিকারুন্নেসা নুন ও বেগম শাহাবুদ্দীনের (তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শাহাবুদ্দীনের স্ত্রী) সঙ্গে কাজ করে। ছেলে মেয়েদের সাংস্কৃতিক কাজে তিনি সাহায্য সহযোগিতা করেছেন নানাভাবে। রিহার্সেল করার জায়গার অভাব হলে তিনি তাদের জন্য নিজ বাড়ির কক্ষ ছেড়ে দিয়েছেন।
নৃত্য শিল্পী গওহর জামিল, মাস্তান প্রখ্যাত সুরকার সমর দাস প্রমুখ ব্যক্তিরা তাঁর বাড়িতে রিহার্সেল করেছেন। এসব কাজে তাঁর স্বামী জনাব মাজিদ কখনো বাধা দেননি।
ফ্লোরার দাদা মোল্লা সাদাত্ আলী নরসিংদীর আশরাফপুর গ্রামে অনেক জমি-জমার মালিক ছিলেন। নানা খান বাহাদুর দলিল উদ্দীন আহমদ ম্যাজিস্ট্রেট হলেও তাঁর লেখা ইংরেজি গ্রামার ও ট্রান্সলেশন বই প্রকাশিত হয়েছিল। নানী ফায়জুন্নেসা সমাজসেবী ছিলেন।
কঠোর পর্দার অন্তরালে থেকেও তিনি গরীব-দুখীদের সাহায্য করতেন। গ্রামের অনেক ছেলে তাঁর বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার সময় তিনি উভয় সম্প্রদায়ের লোকজনকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান করেছেন।
সাত ভাই বোনের মধ্যে ফ্লোরার স্থান চতুর্থ। বড় বোন রুবি রহমান কূটনীতিক স্বামীর সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
সম্ভবত তিনিই প্রথম বাঙালি নারী শিল্পী যিনি চীনা পদ্ধতিতে জল রঙে ছবি এঁকেছেন। তাঁর ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলেছেন চীনের নিসর্গ ও প্রাকৃতিক সুষমা যা মুগ্ধ করেছে কামরুল হাসান ও মুস্তাফা মনোয়ারের মতো প্রথিতযশা শিল্পীদের। তাঁর লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন সুফিয়া কামাল। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে দামাস্কাস-বৈরুতের পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যূবরণ করেন।
মেজ বোন ডোরা রহমান ১৯৭০ দশকে উদয়ন স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন।
তাঁর স্বামী ড. আনিসুর রহমান অর্থনীতিবিদ, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশারদ ও শিল্পী। সেজ বোন নোরা হাবিব গৃহবধু, সূচিকর্মে পারদর্শী ছিলেন। তাঁর স্বামী সৈয়দ হাবিবুল্লাহ খাদ্য অধিদপ্তরে কর্মরত ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ বোন রোজি মাজিদ আহসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক। তাঁর স্বামী ড. ইকরামুল আহসান (কৃষি অর্থনীতিবিদ) পাবলিক এ্যাডমিনিষ্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টার (পি এ টি সি)-এর প্রাক্তন রেক্টর এবং ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্রাজুয়েট স্টাডিজ ইন এগ্রিকালচার (ইপসা)-এর প্রাক্তন রেক্টর৷ ছোট ভাই জামিল মাজিদ কূটনীতিবিদ, জাপানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে অবসর গ্রহণ করে বর্তমানে ফরেন সার্ভিস একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন। তাঁর স্ত্রী রেবেকা মাজিদ (লিপি) সানবীম স্কুলের শিক্ষক।
সর্বকনিষ্ঠ ভাই মানজুর মাজিদ অর্থনীতিবিদ, মাস্টার মাইন্ড স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি স্কুলের শিক্ষকতা ছাড়াও সার্বিক ব্যবস্থাপনার সাথে যুক্ত আছেন তাঁর স্ত্রী স্বাতী ফরাসী ভাষার শিক্ষক।
শৈশব কাল
ঢাকায় জন্ম হলেও ফ্লোরা মাজিদের শৈশব কেটেছে কলকাতা শহরে। বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসে চাকরির সুবাদে তাঁর পিতা সেখানে কর্মরত ছিলেন। সে আমলে টেলিভিশন আবিষ্কৃত হয়নি, তাই তাঁরা সময় কাটাতেন মাটির হাঁড়ি পাতিল ও মায়ের হাতে সেলাই করা কাপড়ের পুতুল দিয়ে খেলা করতেন।
মাটির চুলায় মাটির পাতিলে গাছের পাতা দিয়ে মিছিমিছি তরকারি রান্না করতেন। পানি দিয়ে ইট ঘষে তরকারির ঝোল তৈরি করা হতো। বাড়িতে মুরগি, পাখি ও গরু ছিল। শৈশবে স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগে তাঁদের সাথে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন ফ্লোরা।
১৯৪৫ সালে ফ্লোরা কলকাতার St. John's Dioscesan Girls' High School (Dio) - K.G. II তে ভর্তি হন।
আসলে ১৯৪৪ সালে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার সময়ই স্কুলে ভর্তি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু দেড় বছর বয়সে পোলিও হওয়ায় ফ্লোরাকে ডান পায়ে লম্বা ব্রেস পরতে হতো। এ অবস্থায় মেয়ের অসুবিধার কথা ভেবে এবং ক্লাসে সহপাঠী ছোট ছেলে মেয়েরা নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে এই আশঙ্কা করে মা নাজমান্নেসা তাঁর স্কুল জীবন এক বছর পিছিয়ে দিলেন। ছোট বোন রোজী যখন মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে নার্সারি শ্রেণিতে ভর্তি হলো তখন মন খারাপ হয়ে গেল বড় বোন ফ্লোরার। রান্নাঘরে রন্ধনরত পুরাতন ভৃত্য করমালীর কাছে বসে মন খারাপ করে শ্লেট ভরে 'ঈ' অক্ষরটি লিখেছিলেন, তা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে তাঁর।
১৯৪৫ সালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় Dio তে K.G. শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের দুপুরে স্কুলে ঘুম পাড়িয়ে রাখার প্রথা চালু ছিল। ফলে প্রায় সারাটি দিন তাঁকে বাড়ির বাইরে থাকতে হতো। এই বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর দেশ ভাগ হওয়ার কারণে তিনি ঢাকা চলে আসেন। সেই ১৯৪৫ সালে বাড়ির বাইরে থাকার জীবন শুরু হয়, আর শেষ হয় ১৯৯৭ সালে চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পর। তারপর থেকে আবার শুরু হলো ঘরে থাকার জীবন।
শৈশবে পরিবারের সবার সাথে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে সিনেমা দেখে, পুরানো আমলের গ্রামোফোন রেকর্ডে 'টিপু সুলতান', 'সিরাজদ্দৌলা' প্রভৃতি শুনে, ছুটির দিনে সবাই মিলে বাড়ির উঠানে বসে আড্ডা মেরে বেশ আনন্দেই সময় কাটতো। পারিবারিক গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহে ভারতের ইতিহাস বর্ণিত রেকর্ড অভ্যুদয় ' যোগ হয় ১৯৪৭ সালে। এই রেকর্ডটি ফ্লোরার খুব প্রিয় ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্লোরার বাবা Air Raid Precaution-এর Controller ছিলেন। পরিবারের সবাইকে রেখে তিনি হাওড়া যেতেন।
সে সব স্মৃতি এবং বোমা বর্ষণ, হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, একদিকে 'নারায়ে তকবীর, আল্লাহু আকবর' অন্যদিকে 'জয় হিন্দু ' প্রভৃতির স্মৃতি কিছুটা ঝাপসা হয়ে এলেও ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ -এ মহাত্মা গান্ধির হত্যাকাণ্ডের ঘটনা স্মৃতিপটে আজও জ্বলজ্বল করছে। বড়রা তখন খুব মনোযোগ দিয়ে রেডিও শুনতেন। 'রঘুপতি রাঘব রাজা রাম, পতিত পাবন সীতারাম' এবং ' আছে দুঃখ আছে মৃত্যূ' গান দুটো তখন রেডিওতে ঘনঘন বাজতো। তাঁর মা নাজমান্নেছা মাজিদ গান্ধিজীর অন্ধ ভক্ত ছিলেন। ফ্লোরার নানা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে আসামের শিলচরে কর্মরত থাকার সময় গান্ধিজী সেখানে গিয়েছিলেন।
স্কুল পড়ুয়া মা নাজমান্নেছা তখন গান্ধিজীর কোলে বসার সুযোগ পান, যে স্মৃতি তিনি আজীবন অন্তরে লালন করে গেছেন। গান্ধিজীর মৃত্যূর পর জওহর লাল নেহেরুর নামটি রেডিওতে শুনে ঐ নামের সাথে প্রথম পরিচয় হয় ফ্লোরার।
শিক্ষা জীবন
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পরিপ্রেক্ষিতে ড. ফ্লোরা '৪৮ সালে কলকাতা ছেড়ে ঢাকার ইডেন স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। আজকের বাংলাদেশ সচিবালয় যেখানে, ঐ সময় সেখানে ইডেন স্কুল, কলেজ ও হোস্টেলের তিনটি ভবন ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সচিবালয় করার উদ্দেশ্যে সরকার ঐ স্থান অধিগ্রহণ করেছিল।
ফলে ইডেন স্কুল ও ইডেন কলেজকে টিকাটুলিতে অবস্থিত কামরুন্নেছা স্কুল ও কলেজ ভবনে স্থানান্তরিত করা হলো। সকালের শিফটে কামরুন্নেসা স্কুল ও কলেজের এবং দুপুরের শিফটে ইডেন স্কুল ও কলেজের ক্লাস হতো। ইডেন স্কুলের ছাত্রীদের আনা নেয়ার জন্য প্রধানত ঘোড়ার গাড়ি চালু ছিল। একটি মাত্র বাস ছিল যা দূরের ছাত্রীদের আনা নেয়ায় ব্যবহৃত হতো। কিন্তু ছাত্রীদের তুলনায় যানবাহন কম থাকায় দুই ট্রিপে ছাত্রীদের আনা নেয়া করতে হতো।
প্রথম ট্রিপে যে সমস্ত ছাত্রী স্কুলে পৌঁছাতো তাদেরকে দুপুরে ক্লাস শুরু না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। দ্বিতীয় ট্রিপের ছাত্রীদের ক্লাস শেষ হওয়ার পর স্কুলে বসে থাকতে হতো বাস/ঘোড়ার গাড়ি প্রথম ট্রিপের ছাত্রীদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত। ফলে ইডেন স্কুল ও কলেজের সকল ছাত্রীকে অযথা অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হতো এবং অনেক বেশি ভোগান্তি পোহাতে হতো।
১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি সময় 'ইডেন স্কুল' ও 'কামরুন্নেসা স্কুল' একত্রিত করে 'কামরুন্নেসা স্কুল' নাম দিয়ে টিকাটুলিতে একত্রিত করা হলো। ঐ একই সময়ে 'ইডেন কলেজ' ও 'কামরুন্নেসা কলেজ'কে একত্রিত করে বক্শীবাজারে 'ইডেন কলেজ' স্থানান্তরিত করা হলো।
সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোড় ছাত্রী নেত্রী নাদেরা চৌধুরী (মুনির চৌধুরী, কবীর চৌধুরী ও ফেরদৌসী মজুমদারের বোন) অ্যাসেম্বলীর সময় ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন এবং ছাত্রীদের নিয়ে মিছিল বের করে ইডেন ভবনে (বর্তমান সচিবালয়) বিক্ষোভ করতেন। মিছিলের শ্লোগান ছিল, 'ইডেন-কামরুন্নেসা এক করা চলবে না'। ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুদিন পর একবার ফ্লোরা মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রেস পরে হাঁটার কারণে তাঁর জন্য টিকাটুলি শেষ হওয়ার আগেই মিছিলের গতি মন্থর হয়ে এসেছিল। নাদেরা চৌধুরী বিষয়টি লক্ষ্য করে টিকাটুলির একটি বাড়িতে এক বয়স্ক ভদ্রমহিলার কাছে তাকে রেখে যান।
কথা ছিল মিছিল শেষ করে ফেরার সময় তাকে স্কুলে ফিরিয়ে নেয়া হবে। সেই বাসায় তিনি সারাদিন না খেয়ে বসেছিলেন কিন্তু মিছিলের দেখা মেলেনি। বিকেলের দিকে বাড়ির কর্তা ফিরে এসে সব জানতে পেরে তাঁর ব্যক্তিগত রিক্সা দিয়ে তাঁকে স্কুলে পাঠিয়ে দেন। ফ্লোরা স্কুলে এসে দেখেন ছোট বোন রোজী তার আপার দেখা না পেয়ে কেঁদে অস্থির। আসলে তাঁকে কোন বাড়িতে রেখে এসেছিলেন, এটা মিছিলকারীরা ভুলে গিয়েছিলেন।
অনেক পরে তিনি জানতে পারেন, মিছিলের সময় যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সে বাড়িটি ছিল কামরুন্নেসার শিক্ষয়িত্রী জয়নাব আপার বাড়ি। ঐটাই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ মিছিলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। শারীরিক কারণে তিনি আর কখনো মিছিলে যেতে পারেননি। অবশ্য ছোট বোন রোজী নিয়মিত মিছিলে যেতেন।
হারিয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ঐটাই প্রথম ছিল না।
স্কুলের প্রথম দিন বাসে করে বাসায় ফেরার পথে ঘটে এক মজার কাণ্ড। ফ্লোরা জানেন বাসা তোপখানা রোডে, এই নামটি পাকিস্তান হওয়ার পর সবে চালু হয়েছিল। ড্রাইভার জানতেন ঐ এলাকার নাম সেগুনবাগিচা৷ তোপখানার নাম তিনি শোনেননি বলে ফ্লোরা ও তাঁর তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া বোন রোজীকে তেজগাঁও ফার্মে নিয়ে যান। বাসের দ্বিতীয় ট্রিপ হওয়ায় বাস যখন তেজগাঁও ফার্মে পৌঁছে তখন সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। কাকতালীয়ভাবে ঐ সময় আবার বাসের পেট্রোলও শেষ হয়ে গিয়েছিল।
ড্রাইভার তার হেলপারকে লক্ষ্মীবাজার পাঠান পেট্রোল আনার জন্য। বাসের মধ্যে তখন ফ্লোরা, রোজী ও স্কুলের দাই। চারদিকে খোলা মাঠ ও শিয়ালের ডাক৷ তাঁরা হারিয়ে গেছেন এবং জীবনে বাসায় ফিরতে পারবেন না একথা ভেবে ফ্লোরা ভয় পেয়েছিলেন। রোজী তখন একনাগাড়ে কাঁদছিল। তাকে সামাল দেয়ার জন্য নিজেকে শক্ত হতে হয়েছিল।
পেট্রোল আনতে রাত হয়ে গেল তারপর লোকজনকে জিজ্ঞেস করে ড্রাইভার যখন তাঁদেরকে বাড়িতে নিয়ে এলেন, তখন বাজে রাত ৮ টা। ড্রাইভার বললেন,'তোপখানা রোড না বলে সেগুনবাগিচা বললেই পারতেন, তা হলে তো এত কাণ্ড ঘটতো না। ' বাসায় তখন রীতিমতো হুলস্থুল চলছিল। তাঁদের দেরি দেখে মা স্কুলে গিয়েছিলেন খবর নিতে৷ স্কুলে গিয়ে দেখেন, কেউ নেই কারণ, তারা অনেক আগেই বাসে করে রওয়ানা হয়েছিল।
যাহোক মিছিলের ঘটনায় আবার ফিরে আসি।
নাদেরা চৌধুরীর পরিচালনায় বহু প্রতিবাদ সত্ত্বেও তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের পক্ষে ঐ দাবী মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি, কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাদে ঢাকা শহরে তখন সচিবালয় করার উপযোগী আর কোনো বড় ভবন ছিল না সুতরাং ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝি ইডেন স্কুল ও কামরুন্নেসা স্কুলের সমন্বয়ে গড়ে উঠল টিকাটুলিতে অবস্থিত বর্তমান কামরুন্নেসা স্কুল এবং ইডেন কলেজ ও কামরুন্নেছা কলেজের সমন্বয়ে বক্শীবাজারে গড়ে ওঠে ইডেন কলেজ। ১৯৬০ এর প্রথম দিকে বক্শীবাজার থেকে ডিগ্রি সেকশনটিকে আজিমপুরে নতুন ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। ইন্টারমিডিয়েট সেকশনটি বক্শীবাজারেই থেকে যায়। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ব্শীবাজারের কলেজটিকে বদরুন্নেসা কলেজে রূপান্তরিত করা হয় এবং আজিমপুরের ডিগ্রি কলেজকে ইডেন কলেজ নাম দেয়া হয়। কামরুন্নেছা স্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে ফ্লোরা প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
ম্যাট্রিক পাশ করে ফ্লোরা বকশীবাজারে অবস্থিত ইডেন কলেজে আই.এস.সি-তে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯৫৭ সালে তিনি প্রথম বিভাগে আই.এস.সি পাশ করেন।
শৈশবে অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না বড় হয়ে কি বিষয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করবেন। আবার অনেকে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ, চাকরির নিশ্চয়তা প্রভৃতি কারণে পছন্দের বিষয়ে পড়াশুনা না করে অন্য বিষয়ে পড়াশুনা করেন। ফ্লোরা মাজিদের বেশি পছন্দের বিষয় ছিল উদ্ভিদবিদ্যা।
কিন্তু পোলিও রোগে আক্রান্ত ডান পা নিয়ে মাঠে ঘাটে ঘোরাফেরা করে উদ্ভিদ, গাছপালা, লতাপাতা ইত্যাদি কতটুকু সংগ্রহ করতে পারবেন, তা নিয়ে তাঁর মনে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। তাঁর মমতাময়ী মা সাহস দিলেন, ভরসা দিলেন, উদ্ভিদ সংগ্রহ করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। সেই ভরসাতে ১৯৫৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হলেন। মা তাঁর জন্য বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করতেন মাশরুম, বিভিন্ন রোগাক্রান্ত গাছ ইত্যাদি। মায়ের সহায়তায়ই ড. ফ্লোরা মাজিদ জীবনে এত উঁচুতে উঠতে পেরেছেন।
আরো অনেকেই তাঁকে নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন, যাঁদের অবদানের কথা তিনি সর্বদা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। তেমন একজন ছিলেন তাঁর বড় আপা, তাঁর চেয়ে নয় বছরের বড় রুবি রহমান। কলকাতার Dio তে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা দিতে হতো না। ক্লাস ওয়ার্কের ভিত্তিতেই প্রমোশন দেয়া হতো। কাজেই কামরুন্নেছা স্কুলে এসে চতুর্থ শ্রেণির অর্ধবার্ষিকী পরীক্ষার সময় ফ্লোরা এক বিপদের সম্মুখীন হন।
কারণ পুরা গ্রীষ্মের ছুটি তিনি কাটিয়েছেন কড়ি ও গুটি খেলে। পরীক্ষার আগের রাতে রুবি আপা প্রশ্ন করে দেখেন যে তাঁর পরীক্ষার কোনো প্রস্তুতি নেই। তাই তখনি বসে কোনো রকমে দরকারি জিনিসগুলি শিখিয়ে দেন। তারই ভিত্তিতে পরীক্ষা দিয়ে ক্লাসে চতুর্থ হন। যদিও পরীক্ষা দেয়ার অভ্যাস হতে সময় লেগেছিল অনেকদিন।
ভূগোল পরীক্ষায় দেশের প্রধান প্রধান ফসল কী তার উত্তরে শুধু ধান লিখে পরীক্ষা শেষ হওয়ার অনেক আগেই বেরিয়ে গিয়েছিলেন। ভূগোল শিক্ষক নূরজাহান আপা বকা দিয়ে ক্লাসে ঢুকিয়ে দিলে ধান ও পাট লিখে বেরিয়ে আসেন৷ বেশি লেখার ভয়ে প্রশ্নপত্র উল্টে দেখতেন না।
রুবি আপার প্রেরণায় শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা প্রস্তুতির সমস্যার সমাধান হয়। তিনি বলেছিলেন পরীক্ষায় প্রথম হতে পারলে এক বাক্স ব্ল্যাক ম্যাজিক চকলেট দিবেন। চকলেটের লোভে পরের বছর (১৯৪৯ সালে) গ্রীষ্মের ছুটিতে ঠিকমতো পড়াশুনা করে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন।
রুবি আপা তখন করাচিতে থাকায় সে চকলেট আর পাননি৷ চকলেট না পেলেও পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার আনন্দে পড়াশুনা চালিয়ে যান এবং পরবর্তী শিক্ষা জীবনে কোনোদিন আর দ্বিতীয় হননি। প্রথমদিকে ইংরেজি ব্যাকরণের সমস্যা ছিল। মেজবোন ডোরা আপা ইংরেজি মিডিয়ামের ছাত্রী ছিলেন৷ তাঁকে দিয়ে ইংরেজি প্রশ্নোত্তর লিখে নিতেন এবং তা মুখস্ত করে পরীক্ষায় অনেক নম্বর পেতেন। সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর ইংরেজি শিক্ষক হেলেনা আপা ইংরেজি Tense সম্বন্ধে প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিলেন। তাঁর সহযোগিতায় মুখস্থ ছাড়াই শুদ্ধভাবে ইংরেজি লেখা শুরু করেন।
ডোরা আপা জোর করে ইংরেজি ও বাংলা গল্পের বই পড়াতেন। এর ফলে ভবিষ্যতে দুটি ভাষার উপরই মোটামুটি ভালো দখল আসে। ছোট বোন রোজীর কাছেও তিনি শিক্ষা জীবনে ঋণী। ছবি আকঁতে পারতেন না বলে ইন্টারমিডিয়েট বিজ্ঞানের ব্যবহারিক খাতার সব ছবি তিনি এঁকে দেন। সেই খাতায় ফ্লোরা ভালো নম্বর পান।
স্কুল জীবনে অঙ্কন ও সেলাইয়ে দুর্বলতা ছিল। ড্রয়িং খাতায় রোজীর আঁকা এবং সালেহা নামের এক বান্ধবীর সাহায্যে সেলাই সমস্যার সমাধান হয়। সেলাই কোনোদিনই শেখা হয়নি। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বাধ্য হয়ে ড্রয়িং শিখতে হয়েছিল, কারণ ব্যবহারিক খাতায় শিক্ষকরা ক্লাসেই স্বাক্ষর দিতেন।
বড় আপা সাহিত্যিক ও চিত্রশিল্পী ছিলেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা এম রহমানের সহধর্মিনী হিসেবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাস করলেও আদরের বোন ফ্লোরাকে সব সময়ই অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন। ১৯৬৫ সালে দামাস্কাস-বৈরুতের পথে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় যখন তিনি মারা যান তখন ফ্লোরা মাজিদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচ.ডি করছিলেন। বড় আপার মৃত্যূতে তিনি এতটাই মুষড়ে পড়েন যে পড়াশুনা অর্ধসমাপ্ত করে দেশে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। সে সময় তাঁর মেজর প্রোফেসর সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, 'তুমি দেশে ফিরে যেতে পার, তবে ডিগ্রি না নিয়ে গেলে তোমার বাবা খুব কষ্ট পাবেন। ' বাবা, মা এবং দুলাভাই এম রহমানও ফোনে একই কথা বলেন।
ফলে তখন তিনি দেশে ফেরেননি, একবারে পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরেছেন।
১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'উদ্ভিদবিদ্যা' বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতক (সম্মান) পাশ করেন ফ্লোরা। পরের বছর অর্থাত্ ১৯৬১ সালে উদ্ভিদবিজ্ঞানে এম.এস.সি তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে তাঁর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের স্নাতক (সম্মান) থেকে কেউই প্রথম শ্রেণি পাননি। এই প্রথম শ্রেণি কিন্তু সহজে পাওয়া যায়নি।
বিভাগীয় সকল শিক্ষক, বিশেষ করে জনাব এম এ ওয়াদুদ ফ্লোরাকে প্রথম শ্রেণি দেয়ার ব্যাপারে তত্কালীন বিভাগীয় প্রধান ড. মজিদ আহমেদের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। তিনি মনে করতেন উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকে (সম্মান) প্রথম শ্রেণি পাওয়া উচিত নয়। মাত্র তিন নম্বর বেশি পেয়ে তিনি প্রথম শ্রেণি পান। পরবর্তী বছর ড. মজিদ আহমেদ ভিজিটিং প্রোফেসর হিসেবে বিলেতে থাকায় ড. আশরাফুল হক ভারপ্রাপ্ত বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় মাত্র তিনজন ছাত্র স্নাতক (সম্মান)-এ প্রথম শ্রেণি পান। প্রোফেসর এম এ ওয়াদুদের তত্ত্বাবধানে মাইকোলজিতে স্পেশাল পেপার নিয়ে এম এস সি পাশ করার আগেই কায়েদে আযম কলেজে ফ্লোরা চাকরি শুরু করেন।
জনাব ওয়াদুদ বিদেশে পিএইচ.ডি করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি যখনই নতুন কোনো তথ্যের সন্ধান পেতেন, তখনই ছাত্রছাত্রীদের ডেকে শেখাতেন। ফুলব্রাইট স্কলারশিপের ফরম পূরণের সময়ও তিনি ফ্লোরাকে সাহায্য করেন। পরবর্তী কালে একই বছরে (১৯৬৫ সালে) মিশিগান স্টেট ইউনিভাসিটি, ইস্ট ল্যান্সিং থেকে ফ্লোরা মাজিদ এবং টেক্সাস এ এন্ড এম, কলেজ স্টেশন থেকে জনাব ওয়াদুদ পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন। ফ্লোরার পিএইচ.ডি ডিগ্রী অর্জনের খবর পেয়ে আমেরিকা থেকেই তিনি তাঁকে অভিনন্দন জানান।
পরবর্তীকালে নাইজেরিয়াতে শিক্ষকতাকালে ফ্লোরার পরিচিত একজনকে জানান যে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ফ্লোরাই ছিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল ছাত্রী। দীর্ঘকাল যোগাযোগ না থাকা সত্ত্বেও প্রথম আলোতে ড. ফ্লোরার উপর লেখা পড়ে ড. ও মিসেস ওয়াদুদ দুজনেই ফোনে আন্তরিক আনন্দ প্রকাশ করেন।
১৯৬৩ সালে মর্যাদাপূর্ণ ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ল্যান্সিং এ ভর্তি হন। ফল (Fall) সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল সেপ্টেম্বরে, কিন্তু আরেকটি সুযোগ পাওয়ায় তিনি আগষ্টে ঢাকা ত্যাগ করেন। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সে দেশের এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (USAID) অর্থায়নে 'এক্সপেরিমেন্ট অন ইন্টারন্যাশনাল লিভিং' নামে একটি কর্মসূচী ছিল।
এটা ছিল তাদের 'হোম-স্টেট ওরিয়েন্টেশন' কর্মসূচী। এছাড়াও 'শিপবোর্ড ওরিয়েন্টেশন কর্মসূচি' নামের আরেকটি কর্মসূচী ছিল। তিনি দুটি কর্মসূচীতেই অংশ নেয়ার জন্য এক মাস আগেই চলে যান। প্রথম দিকে তিনি কিছুটা স্নায়ুচাপে থাকলেও, পিতার উত্সাহ পেয়ে তিনি ওই কর্মসূচীতে যোগদান করেন। 'শিপবোর্ড ওরিয়েন্টেশন' কর্মসূচীর অধীনে তাঁদেরকে একটি আলাদা জাহাজে করে প্যারিস থেকে নিউ ইয়র্কে নিয়ে যাওয়া হয়৷ মাস্টার্স ও পিএইচ.ডি করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র ছাত্রীরা দশ দিনের এই কর্মসূচীতে অংশ গ্রহণ করার জন্য ঐ জাহাজে একত্রিত হয়েছিলেন।
সেখানে তাদের নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হতো, সাথে ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এর ফলে বৃত্তিধারীরা ক্লাস শুরুর আগেই অনেক বিষয় জানতে পারতেন। নিউ ইয়র্কে পৌঁছার পর এ কর্মসূচী শেষ হয়৷ তারপর শুরু হয় এক্সপেরিমেন্ট অন ইন্টারন্যাশনাল লিভিং' কর্মসূচী। ঐ কর্মসূচীতে অংশ নেয়ার জন্য ফ্লোরা মিশিগান যান। একটি আমেরিকান পরিবারের সঙ্গে এক মাস থাকতে হয় এই কর্মসূচীর আওতায়।
তিনি যেহেতু বড় পরিবার থেকে এসেছেন, তাঁকে একটা বড় পরিবারের সাথে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। Dr. C W Pohly এবং Mrs Marjorie Pohly দু'জনেই ছিলেন শিক্ষক। তাঁদের পাঁচ সন্তান ছিল। পিএইচ.ডি ক্লাস শুরুর আগে ফ্লোরা এক মাস এ পরিবারের সাথে বসবাস করেন। তাঁরা দু'জন ছিলেন ফ্লোরার আমেরিকান বাবা-মা।
আমেরিকায় দু'বছর থাকাকালীন সময়ে প্রতিটি ছুটিই তিনি ঐ পরিবারের সাথে কাটিয়েছেন। মাঝে মধ্যে তাঁরা এসে ফ্লোরাকে তাঁদের বাসায় নিয়ে যেতেন। এক মাসের কর্মসূচী তাঁর জন্য ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সাতাশ বছরে গড়ায়। ব্যবসার কাজে যখনই ড. পোহলি এ অঞ্চলে এসেছেন, তখনই তিনি তার বাংলাদেশী কন্যাকে দেখে গেছেন, তাঁদের পরিবারের সাথে থেকেছেন। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ১৯৬৫ সালে তিনি মাত্র দু'বছরে উদ্ভিদ বিদ্যায় পিএইচ.ডি অর্জন করেন।
কর্মজীবন
ড. ফ্লোরা মাজিদের কর্মজীবন শুরু হয় এম.এস.সি পাশ করার আগেই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬১ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় মাস্টার্স ডিগ্রির তাত্ত্বিক পরীক্ষা দেয়ার পর তাঁর সহপাঠীরা যখন ব্যবহারিক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখন একদিন ঢাকার তত্কালীন 'কায়েদে আযম বেসরকারি কলেজের' অধ্যক্ষ জনাব ফাতমী টেলিফোনে ফ্লোরার শিক্ষক জনাব এম এ ওয়াদুদকে জানান যে উদ্ভিদবিদ্যার শিক্ষক ছাড়াই আই.এস.সি ও বি.এস.সি-র ক্লাস চলছে৷ জনাব ওয়াদুদ তখন ফ্লোরাকে বলেন, 'কলেজে যোগদান কর, ভবিষ্যতে এ অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে। ' এর পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ব্যবহারিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই শিক্ষকতা শুরু করেন। জনাব ওয়াদুদ আরো বলেন, 'কলেজে ছাত্র সংখ্যাই বেশি আর ছাত্রদের অভ্যাস আছে শিক্ষকদের জব্দ করার। দেড়শ জন আই.এস.সি-র ছাত্র যখন এক সঙ্গে জুতা পরা পা মেঝেতে ঘষতে থাকবে তখন শিক্ষকের বক্তৃতা শোনা যাবে না।
ক্লাসে মাইকের ব্যবস্থাও নেই। ' তাঁর সতর্ক বাণী ফ্লোরাকে সাহায্য করেছিল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ছাত্রদের কোনো গোলমালের আভাস পেলেই তিনি 'সারপ্রাইজ টেস্ট' নেয়া শুরু করতেন। প্রথম দিকে কিছু ছাত্রছাত্রী ছিল যারা নীরবে লেখা শুরু করতো। পরে অন্যরাও এই বিষয়টিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
এভাবেই তিনি এ সমস্যার সমাধান করেছেন।
দুজন ছাত্র ছাত্রী নিয়ে ফ্লোরার বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এক ছাত্রী ছিলেন এল.এম.এফ পাশ করা ডাক্তার। কনডেন্সড্ কোর্সে এম.বি. বি.এস পরীক্ষা দেয়ার আশায় তিনি আই.এস.সি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তাঁর ছোট বোন ফ্লোরার চেয়ে ৪/৫ বছরের বড় ছিলেন।
তাঁর বাবা করাচিতে ফ্লোরার বাবার বস ছিলেন। তাদের পরিবারের সাথে ফ্লোরাদের পরিবারের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল। এ কারণ এ ছাত্রী ও শিক্ষয়িত্রী উভয়ের মধ্যে বেশ সংকোচ দেখা দেয়। অবশ্য এ পরিস্থিতি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি, কারণ কয়েক মাস পর তিনি পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে চলে যান। এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির অবসান ঘটে।
দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা হয়েছিল অধ্যক্ষ ফাতমী সাহেবের ছেলেকে নিয়ে। সে ছিল আই.এস.সি প্রথম বর্ষের ছাত্র। ফাতমী সাহেব প্রথমেই ফ্লোরাকে বলেছিলেন যে, অধ্যক্ষের ছেলে বলে যেন তাকে কোনো বাড়তি সুবিধা দেয়া না হয়। ফ্লোরা তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ শুরু করেন৷ ব্যবহারিক ক্লাসের শুরুতে উপস্থিতি রেকর্ড করার পরই সে ক্লাস ত্যাগ করতো। দুএকদিন সেটা লক্ষ্য করে তিনি নিয়ম পরিবর্তন করে ব্যবহারিক ক্লাস শেষে উপস্থিতি রেকর্ড করা শুরু করেন।
পরপর কয়েক দিন ছেলেটিকে অনুপস্থিত হিসেবে রেকর্ড করা হলো। ফলে একদিন ফাতমী সাহেবের ঘরে ফ্লোরার ডাক পড়ে। এ কথা সে কথা বলে তিনি বললেন, আপনি নাকি আমার ছেলেকে ক্লাসে অনুপস্থিত হিসেবে রেকর্ড করছেন ? উত্তরে তিনি বললেন, "সে আগে ক্লাস না করেই উপস্থিতি রেকর্ড করছিল। ক্লাসের অন্য ছেলেরা তাহলে কি দোষ করেছে ? সবার বেলায় এক নিয়ম করার কথা তো আপনিই বলেছেন"৷ ভদ্রলোক একেবারে চুপ করে গেলেন। তারপর আর কোনো সমস্যা দেখা দেয়নি।
পরবর্তীকালে ফ্লোরা জানতে পেরেছিলেন যে ছাত্রদের মাঝে তিনি 'ম্যাডাম হারকিউলেস' ও 'মাসকুলার হিউম্যান বিয়িং' এই দুটো নামে পরিচিত ছিলেন। ক্লাসে গিয়ে যখন তিনি দেখতেন যে ছাত্রছাত্রীদের বসার বেঞ্চ এলোমেলো হয়ে আছে, তখন পিয়নের অপেক্ষা না করে নিজেই সেগুলি ঠিকমতো রাখতেন, যা তাঁর শরীরের শক্তির পরিচয় দিতো। এজন্যই ছাত্ররা আড়ালে এ নাম ব্যবহার করতো।
কায়েদে আযম কলেজ থেকে ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে তিনি ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ করেন। ১৯৬১ সালের মে থেকে নভেম্বর পর্যন্ত মোট সাত মাস তিনি কলেজটিতে শিক্ষকতা করেন।
সেগুনবাগিচা থেকে রিক্সায় লক্ষ্মীবাজার যাতায়াত করতে যথেষ্ট সময় ব্যয় হতো, যদিও তখন ইদানীং কালের মতো এতটা ট্রাফিক জ্যাম ছিল না। কলেজে তাঁর বেতন ছিল মাত্র ২৬৮ টাকা। তারপরও এই সাত মাসের অভিজ্ঞতার জন্য তিনি জনাব ওয়াদুদের কাছে কৃতজ্ঞ। দেড়শত ডানপিটে ছেলেকে পড়াবার পর ইডেন সরকারি কলেজে যখন তাঁর চাকরি হলো, তখন মনে হলো এর চেয়ে আরামের আর কী হতে পারে। সেখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি।
কায়েদে আযম কলেজের 'সারপ্রাইজ টেস্ট' -এর সুফল দেখে তিনি ঐ পদ্ধতি ইডেনেও অব্যাহত রাখেন। ফলে প্রথম বছরেই (১৯৬২-৬৩) কলেজের উদ্ভিদবিদ্যা পরীক্ষার ফল খুবই ভালো হয়েছিল, যা তাঁকে যথেষ্ট সুনাম এনে দেয়। ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত সহজ ও মধুর।
এক বছর আট মাস শিক্ষকতা করার পর ফুলব্রাইট স্কলারশিপ পেয়ে ডক্টরেট করার জন্য তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ল্যানসিং-এ যান। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ডক্টরেট অর্জন করে দেশে ফিরে পুনরায় তিনি ইডেন কলেজে যোগ দেন।
ডক্টরেট ডিগ্রী থাকায় তিনি প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু সেখানে গবেষণা করার সুযোগ একেবারেই ছিল না বলে শিক্ষকতা ছেড়ে দিয়ে ১৯৬৬ সালের ২৫ মার্চ থেকে তিনি তত্কালীন পাকিস্তান বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদে (পি সি এস আই আর, বর্তমান বি সি এস আই আর) -এর পূর্বাঞ্চলিক গবেষণাগারে উর্ধ্বতন গবেষণা কর্মকর্তা পদে যোগদান করেন। আওয়ামী লীগের বর্তমান নেত্রী 'অগ্নিকন্যা' নামে পরিচিত মতিয়া চৌধুরী তাঁর ছাত্রী ছিলেন। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি যখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে রক্ত দিয়ে ফিরছিলেন, তখন মতিয়া চৌধুরী শহীদ মিন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।