আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার গান শোনা

সৃষ্টিকর্তার সকল অপূর্ব সৃষ্টির মাঝে একমাত্র খুঁত সম্ভবত তাঁর সেরা সৃষ্টি ...

ছেলেবেলায় সংগীতের ওপর ভয়াবহ বিতৃষ্ণা ছিল আমার। জানি না কেন, আব্বার কেনা ক্যাসেট প্লেয়ার থেকে নাকি সুরে বিড়ালের কান্নার মতো আওয়াজ বেরিয়ে আসতে শুনলেই আমার গায়কগুলোকে স্কুলের শাহজাহান স্যারের মতো চরম একটা বেতানি দেবার প্রবল ইচ্ছে জাগতো। আব্বা আবার রবি বাবু এবং তাঁর সৃষ্ট সংগীতের বিশাল ভক্ত। এবং আম্মার পছন্দ হল নজরুল আর আধুনিক গান। কাজেই অনিচ্ছে সত্ত্বেও প্রাইমারি স্কুল পাশ করবার আগেই আমি বাংলা গান সম্পর্কে যে পরিমাণে জ্ঞান অর্জন করে ফেলেছি তা সহপাঠীদের শুনিয়ে টাশকি লাগিয়ে দিতে পারতাম।

বিশেষ করে যারা তখন শিশু একাডেমিতে বাসার ঠেলায় বাড়তি শিক্ষাক্রমের চর্চার(এক্সট্রা কারিকুলার একটিভিটিজ) অংশ হিসেবে গানের তালিম নিচ্ছে তাদের। কিন্তু এ জ্ঞান সংগীত সুধার প্রতি আমার আগ্রহ জন্মানোর জন্য কোন সাহায্য করে নি। বরঞ্চ বিতৃষ্ণার ভাগই বাড়িয়ে তুলেছিল জ্যামিতিক হারে। তবে স্কুলে স্যারদের বেতের বাড়ি যেমনটি একসময় গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল, এভাবেই স্বরস্বতী দেবী আমার মস্তিষ্কে যখন প্রথম দোলা দিতে শুরু করেন তখন আমি অষ্টম ক্লাসে উঠে গেছি। রবি বাবুর গান তখনো নাকি কান্নাই মনে হতো, হয়তো বাংলা বইয়ে তাঁর সাহিত্যের আধিক্যই তাঁর প্রতি আমার বৈরাগ্যের কারণ ছিল।

যাহোক তখনই লুকিয়ে চুরিয়ে শুনতে শুরু করলাম আম্মার পছন্দের গানগুলো অর্থাৎ আধুনিক গান। মান্না দে, হেমন্ত, সতীনাথ, সন্ধ্যা মুখার্জী, শ্যামল মিত্র, সাগর সেন, বর্মন ভাতৃদ্বয়, কিশোর কুমার, অঞ্জন, শ্রীকান্ত, আশা-লতা বোনেরা আমার ফ্রি সময় দখল করে নিতে লাগলেন। গানের কথাগুলি থাকতো সহজ আর সুরগুলিও সেই ছোটবেলাতেই মনে আটকে যেতে লাগলো। রুবী রায়ের জন্য আমার মনেও আঁকুপাকু করতে লাগলো বা আকাশে প্রদীপ জ্বাললে প্রিয়া কেন লজ্জা পেতে পারে বুঝতে শুরু করলাম খানিকটা। শুরু হল গানের রাজ্যে আমার প্রথম পাঠদান।

নাইনে ওঠার পর হঠাৎই আবিষ্কার করলাম স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোতে যে ভিনজাতীয় ভাষায় নাচ-গান হয় সেটা আসলে হিন্দী এবং এতদিন শূনতে শুনতে আমিও কিছু কিছু বুঝতে পারছি। তখন আবার বন্ধূ মহলে হিন্দী সিনেমা দেখার আইলা শুরু হয়ে গেছে। হিন্দী সিনেমাদের প্রাণহরিণী, গা গরম করা চিত্র পোলাপানের পকেটে খুঁজলেই পাওয়া যেতো। জোয়ারে গা ভাসিয়ে ধূমসে শোনা শুরু করলাম হিন্দী - আর সত্যি বলতে কি খুবই ভালো লাগা শুরু করল। "আশিকি" ছবির গান শুনে কুমার শানুর রীতিমতো অন্ধ ভক্ত হয়ে গেলাম।

বাসায় খুঁজে দেখলাম আব্বা-আম্মার কাছেও সংগ্রহ বড় কম নেই, আর টিভিতে এত্তোগুলো চ্যানেল কি কাজে আছে? চটুল গানগুলোই বেশি ভালো লাগো অস্বীকার করবো না। তবে টেনে উঠার পর স্কুলে কয়েকজন বন্ধুকে দেখলাম খুব ভাব নিয়ে ইংলিশ গান নিয়ে আলোচনা করছে। আমি জিজ্ঞেস করতে গেলে এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন পুজোর মাঝে বামুন ছুয়ে ফেলেছি, এখুনি গোবর খেতে হবে! যাহোক পরে নরম স্বভাবের এক বন্ধূ আমাকে মায়াবশত একটা সিডি দেয়(কম্পিউটার কিন্তু সিক্সে থাকতেই বাসায় হাজির)। তো সেই গান শুনে তো আমি পুরা পাঙ্খা। আবার শুরু হল নতুন ট্রেন্ড - ইংলিশ রক আর পপ।

ব্যাকস্ট্রিট বয়জ, ওয়েস্টলাইফ, বয়জোন, এন সিঙ্ক, ব্রিটনি, জন মেয়ার, ক্রেইগ ডেভিড, অডিও স্লেভ, নিকেলব্যাক, পিঙ্ক ফ্লয়েড, নির্ভানা আর ক্রিড আমার গানের ড্রাইভে দখল নিতে থাকে। স্কুল পাশ দেবার পরই হিপহপ কালচার দখল করে রাখে আমাকে অল্প কিছুদিন - ফিফটি, টু-প্যাক, আশার, শ্যাগি, ব্ল্যাক আইড পিস, স্নুপ ডগ আর এমিনেমে মজে যাই। গানের ভাব আনার জন্য কেনা হতে থাকে ঢোলা টি শার্ট, ক্যাপ আর হাজারো পকেট আলা ব্যাগি প্যান্ট। তবে মনে আছে হিপহপ দৌরাত্ম বেশিকাল স্থায়িত্ব হয় নি। কারণ এর মাঝেই এক বন্ধুর কল্যাণে একটা দারুণ গান শুনি।

গানটার শুরুটা এরকম ... New blood joins this earth and quickly he's subdued through constant pain & disgrace the new boy learns their rules আপনাদের জন্য কুইজ: এটা কোন গানের লাইন? যাহোক, শূনেতো আমি পুরোই বিমোহিত। আমার ঐ বন্ধুটি ভাব নিয়ে বলতো সে নাকি মেটাল গান শোনে, একবার আমাদের শুনিয়েছিলও। কিন্তু চিল্লাফাল্লা শুনেতো আমরা বাকিরা ব্যাপক হাসাহাসি। কিন্তু হঠাৎ করে এই গানটা শুনে মনে লাগলো। তারপর শুরু হলো ব্যাপক হারে মেটালিকা, আয়রন মেইডেন, জুডাস প্রিস্ট, মেগাডেথ, ম্যান-ও-ওয়ার শোনা হতে থাকে।

বুয়েটে আসার পর আরো মেটাল প্রেমীদের সাথে মিশে থ্যাশের জগতে পদার্পন ঘটে চিলড্রেন অফ বডম দিয়ে। তারপর একে একে আসে ক্র্যাডল অফ ফিলথ, স্লিপনট, প্যানটেরা, ল্যাম্ব অফ গড, ইন ফ্লেইমস, ওপেথ, ক্যানিবাল কর্পস এবং আরো অনেকে। ঐ মেটাল প্রিয় বন্ধুটিই হালের বাংলা গান বিশেষ করে দেশের ব্যান্ডগুলোর প্রতি আগ্রহ তৈরী করে। পিসিতে সনিক সিন্ডিকেট, অ্যাজ আই লে ডাইং, ব্রেকিং বেঞ্জামিন আর ডিস্টার্বড এর পাশাপাশি জায়গা করে নেয় ওয়ারফেইজ, আর্টসেল, শিরোনামহীন, অর্থহীন, ভাইব, ওয়াটসন ব্রাদার্সরা। আমার একটি রুমমেট আবার খুব একটা গান-টান শোনে নি।

তো একদিন কোথা থেকে একটা সিডি নিয়ে আসলো, আমরা খুব একটা পাত্তা দিলাম না - কিন্তু স্পীকারে যখন "মনে পড়ে রুবী রায়" বেজে উঠল তখন মাথায় যেন কেউ একটা ঘন্টা বাজালো। আমার গান শোনার হাতে খড়ির সময়কার গানগুলি মিস করছিলাম এতোদিন!! রুমে এবার ধুমসে বাজতে থাকে পুরনো দিনের গান .... আর এতদিনে রবিবাবু অন্যান্য তরুণের মতো আমার মনেও জেঁকে বসেছেন। কাজেই নিয়ম করে অংক করবার সময় র্ামস্টিন আর স্ট্যাটিক এক্স, আর ঘুমানোর সময় বন্যা আর সাগর সেন সঙ্গ দিতে থাকেন। এভাবে দেশ বিদেশের কোলাবরেশনে শোনা হচ্ছে নানা ধরনের গান। এখন সব গানই ভালো লাগে।

লালন সাঁইয়ের দশটা গান বাজানোর পর দুম করে কুয়ো ভেডিস বা স্লেয়ারের গান বেজে উঠলেও আর রুমমেটরা অবাক হয় না। গানের রসনার দৈর্ঘ্য বাড়ছেই ... শুনে যাচ্ছি আর মনের কোণায় টুকে রাখছি প্রিয় গানগুলো .... পুনশ্চ ১: এখন শুনছি ইসরায়েলি মেলো ডেথ ব্যান্ড অরফ্যানড ল্যান্ডের গান ... আর ঘুমানোর আগে লালন সাঁইকে সালাম জানিয়ে যাবো। পুনশ্চ ২: একটা অতি সহজ প্রশ্ন করেছিলাম - আশা করি উত্তর দেবেন সকলেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।