~ ভাষা হোক উন্মুক্ত ~
"ভাই, এক্ষুনি কলেজে আসেন, গণ্ডগোল হইছে, মারামারি লাগবো ..."
আমার জানালা দিয়ে সবে মাত্র মিষ্টি এক চিলতে এসে রোদ পড়েছে বিছানায়। আরামদায়ক আলস্যে সকালের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কম্বলের নীচে গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিলাম, এই সময় রাসেদের ফোনটা এলো। চরম বিরক্তিভরা কন্ঠে "আসছি" - বলে ফোন রেখে দেই। উঠে গিয়ে শার্ট আর জ্যাকেট গায়ে দেই। এরপর বিছানার নীচ থেকে ছোট ট্রাঙ্কটা টেনে বের করি।
আমার স্মিথ এন্ড ওয়েসন রিভলবারটা বিট্রে করেনি কোনদিন আমার সাথে। চার ইঞ্চি ব্যারেল আর কাঠের গ্রিপের শাসনে বন্দি ছয় মৃত্যুদুত এক এক করে প্রতিবারেই ছুটে গেছে লক্ষ্যের দিকে। এটা হাতে নিলেই নিজেকে অনেক বেশী আত্মবিশ্বাসী লাগে। সাবধানে লোড করে জিন্সের পকেটে বাড়তি কয়েকটা গুলি নেই। রিভলবার কোমড়ে গুঁজে উঠে বসি বাইকে।
সবাই বলে - আমি বাইক চালাই না, ওড়াই। গতি আমার আজন্ম সাথী। মা বলতেন খুব দ্রুত কথা বলা, উঠে দাঁড়ানো আর হাঁটা শিখেছিলাম আমি। সাইকেল চালানো শিখেছিলাম এক দিনেই। সাতবছর বয়সে একা নদীতে সাতার কাটতে গিয়ে স্রোতের টানে চলে গিয়েছিলাম কয়েকমাইল দূরে।
দুরন্তপনার খ্যাতি অবশ্য তার আগে থেকেই জুটেছিল কপালে। সেই ধারায় স্কুলের গণ্ডি পার হবার আগেই ঠাণ্ডা মাথার ক্রিমিনাল খাতাবটা বাগিয়ে নিতে পেরেছিলাম। কলেজে উঠে এমপি চাচার কল্যানে দল থেকে পোস্ট আর অস্ত্র পেতে কোন সমস্যা হয়নি, তা না হলেও এই জিনিস যোগার করা একটু কঠিন হয়ে যেত।
ক্যান্টিনের পাশে পার্ক করি বাইকটা। রাসেদ, আরিফ, লিটন বসে ছিল থমথমে মুখে, আমাকে দেখে এগিয়ে আসে।
"বস্ - অবস্থা ভাল না, কামালরা কাইল রাইতে গেছে শাহীনের রুমে, গিয়া ট্যাহা চাইছে, পরে থাপ্পড় দিছে ..." - রাসেদকে থামিয়ে দেই হাত তুলে, আমি জানি কি ঘটেছে কাল রাতে। কলেজ এলাকায় নতুন কোন পাখি বাসা বাঁধলেও আমার অজানা থাকেনা। রাসেদকে থামিয়ে দিতে দেখে কথা বলে আরিফ - "একটু আগে কথা হয়েছে রানার সাথে, ওরা শো ডাউন করবে আজকে, আমাদের কাউকে পেলে মারবে, আর ওরা এইবার রেডি ..."। আরিফ ছেলেটাকে এই জন্যেই ভাল লাগে আমার, সে জানে আমি কতটুকি শুনতে চাই।
চায়ের কাপ হাতে দ্রুত চিন্তা করে নেই ... ওদের শো ডাউনের আগেই আমাদের যা করার করতে হবে।
সাধারন ছাত্রছাত্রীর সামনে অন্য কোন শক্তিকে মাথা তুলে দাঁড়াতে দেবার মানে আমাদের অবস্থান সামান্য হলেও নড়িয়ে দেয়া। আমি তা কোনভাবেই হতে দেবোনা। আবার দলের ছেলেদের কাছেও নিজের অবস্থানের প্রমাণ আরেকবার দেয়ার লোভ সামলাতেও কষ্ট হচ্ছে। কাজেই ... আমি নিজেই যাব, একা একাই। এক চুমুকে শেষ করি আগুন গরম চা, বাইকে উঠে বসার আগে আলতো করে হাত বুলাই কোমরে গোঁজা রিভলবারের ঠান্ডা হাতলে, আত্মবিশ্বাসের মাত্রাটা বেড়ে যায় কয়েকগুন।
সাধারনত বাইকটা এক বারেই স্টার্ট হয়, কিন্তু এখন কেন যেন চারবার কিক করার পরে স্টার্ট নিলো আমার বাহন। অশুভ কিছু ইঙ্গিত করছে কি প্রকৃতি? করলেও কিছুই করার নেই, আমাকে যেতেই হবে, জীবনে বহুবার চূড়ান্ত বিপদে পড়েছি, বেঁচে এসেছি সম্ভবত মায়ের দোয়ায়। মা আমার প্রতিবার নামাজ পরে দোয়া করেন, সন্তানের মঙ্গল চান। চোখ বন্ধ করে এক মুহুর্ত মা'র মুখটা কল্পনা করি, অশুভ চিন্তাটা উধাও হয়ে যায় মাথা থেকে। তারপর অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা ছেলেগুলোর মাঝ থেকে বেড়িয়ে আসি বাইক নিয়ে।
কলেজ এলাকা থেকে একটু দূরে ভুট্টোর চা দোকানে আড্ডা দেয় কামালরা। আমাদের কারনে কলেজের দিকে বেশী দুর এগুতে পারেনা ওরা, কিন্তু স্বপ্ন দেখে একদিন কলেজ ক্যান্টিনে আড্ডা জমাবার। কিন্তু এই অছাত্র গুলোকে কলেজে ঢুকতে দিয়ে কলেজের পরিবেশ খারাপ করতে দিতে নারাজ আমরা। যে কোন ভাবে ওদের রুখে দেয়ার জন্য চব্বিশ ঘণ্টা পাহারা থাকে কলেজে, মানে কলেজ এলাকায় আমাদের কেউ না কেউ থাকেই। একই ভাবে আমরাও ওদের আড্ডাস্থলের আশে পাশে যাইনা, এলাকাটা ওদের, অনেক কিছুই হতে পারে, সেই কারনে।
কিন্তু আজ আমি যখন ভুট্টোর দোকানের সামনে বাইকটা পার্ক করলাম, তখন কেন যেন হঠাৎ থমকে গেল পুরো এলাকা, অথবা আমার মনের ভুল। শীতের এই সকালে এমনিতেই রাস্তায় খুব বেশী মানুষের চলাচল করার কথা না।
"ভুট্টো, কেমন আছিস? এক প্যাকেট বেনসন দে তো" - হতভম্ব ভুট্টোর দিকে বাড়িয়ে দেই একশ টাকার নোট। "ভা... ভালা আছি ভাইজান ... দেই... আম্নে আছুইন কেমন ..."। ভুট্টোর গলার অস্বাভাবিক কাঁপুনিটুকু নজর এড়ায় না আমার।
আমি এমন কোন টেরর টাইপ ক্যারেক্টার না যে আমাকে দেখে তোতলাতে হবে ভুট্টোর। আর যাদের দোকানে পলিটিকাল আড্ডা হয়, সেই সব মুদী দোকানীরা খুব ভাল অভিনেতা আর শক্ত নার্ভ যুক্ত হয়, এরা এত সহজে ভয় পায়না কিছুতে। তাহলে ওর ভয় পাবার পেছনে কারন কি? ভুট্টোর বাড়িয়ে দেয়া হাত থেকে সিগ্রেট আর টাকা নিয়ে চা'এর অর্ডার দিয়ে দোকানের সামনের বেঞ্চিতে বসে পরি। যে কোন সমস্যাকে সামনে থেকেই ফেইস করার স্বভাব আমার।
ক্রমশ ... শেষ বিকেলের আলোয় ... (২)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।