আমার শৈশব-কৈশোরের শহর বরিশাল গিয়ে এই এবারই প্রথম নিজেকে আউট সাইডার মনে হল। অথচ এই শহরটিতেই কেটেছে কত গুলো দিন, বছর। অবশ্য এবার ছিলাম মাত্র কয়েক ঘন্টা, বাসায় গিয়েছিলাম বড়জোর এক ঘন্টার জন্য। এবার আসলে বরিশালে যাওয়ার উদ্দেশ্যটাই ছিল একটু ভিন্ন। এ ছিল এক অন্য ধরনের অভিযাত্রা।
শুধু বরিশাল নয়, পুরো দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ-ঐতিহ্যবাহী বি এম কলেজ ক্যাম্পাসে ভাস্কর্য নির্মাণের দাবিতে গত তিন মাস ধরে টানা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে বরিশালগামী একদল কবি-শিল্পীর এই অভিযাত্রায় শামিল হয়েছিলাম প্রানের টানে। কবি ও শিল্পী কফিল আহমেদ, অভিজিৎ দাস, নৃপ অনুপ, জন রোমেল, শশ্মান ঠাকুর, মেহেদী হাসান স্বাধীন, গানের দল মনোস্মরণী'র প্রবর রিপন, মুয়ীজ মাহফুজ ও রাজি, চিৎকার-এর পদ্ম, অতনু শর্মা সহ অন্যান্য অভিযাত্রীরাও যে বোধের দায়বদ্ধতা থেকেই এসেছিলেন, সে ব্যাপারে আমি অন্তত নিশ্চিত। নিশ্চিত ভাবে কফিল আহমেদই ছিলেন ১৫ জনের এই দলটির অলিখিত কমান্ডার/কান্ডারী।
রোববার (৩১মে, ০৯) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বিপরীতের ছবির হাট থেকে আমরা যখন বরিশালের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করি তখন আকাশ গুরু-গম্ভীর, অঝোর কান্নায় ভেজাচ্ছে সব। কেউ কাক ভেজা, আবার কেউবা আধ ভেজা হয়ে সদর ঘাট পৌঁছে আমরা আবহাওয়া আরো খারাপ আর নদীর পরিস্থিতি উত্তাল হওয়ার আশঙ্কা নিয়েই লঞ্চে উঠে বসলাম।
এমভি সুন্দরবন-০৮ নামের লঞ্চটিতে ৩ টি মাত্র ডাবল কেবিন দখল করে যাত্রা শুরুর পর বুঝলাম যে আমাদের সে আশঙ্কা যে কতটা অমূলক ছিল। রাতের আবহাওয়াটা শুধু ভালো নয়, বেশ ভালো ছিল। নদী থেকে ছুটে আসা হু হু বাতাস, স্রোত কেটে চলার শব্দ, পিদিম জ্বালানো মাছ ধরা নৌকার সাঁড়ি, মেঘের কোল থেকে উঁকি দেয়া আধ ফালি চাঁদের সাথে গিটার-গানের কোরাসে- রাতের মতই দ্রুত ফুরোয় নিশাচর পথ। সোমবার (১ জুন,০৯) ভোর সাড়ে চারটা নাগাদই আমরা পৌছে যাই বরিশাল। সেই সাত সকালেই বরিশাল লঞ্চঘাট এসে আমার পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেন- বি এম কলেজে ভাষ্কর্য নির্মাণ আন্দোলন কমিটির আহবায়ক-তরুন কবি আব্দুল্লাহ/আগন্তুক মাহফুজ অভি ও কবি মিছিল খন্দকার/রিয়াজ।
তাদের পিছু পিছু নগরী হাসপাতাল রোডের হোটেল প্যারাডাইসে গিয়ে ণিকের বিশ্রাম, এরপর সদর রোডের রেস্তোরা সকাল-সন্ধ্যা’য় নাস্তার পাট চুকিয়ে সকাল সাড়ে দশটার মধ্যেই আমরা সদলবলে বি এম কলেজ ক্যাম্পাসে উপস্থিত। ততক্ষনে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছেন বরিশাল চারুকলা বিদ্যালয়ের প্রানপুরুষ সুসান্ত ঘোষ।
ক্যাম্পাসে পৌছানোর পর মনে হল, কলেজের গেট থেকে শুরু করে জীবনানন্দ চত্ত্বর, আন্দোলন মঞ্চ- সবাই যেন আমাদেরই অপেক্ষায় ছিল। আমরা পৌছানোর পরপরই শুরু হয় অনুষ্ঠান। সেদিনই প্রথমবারের মত আন্দোলন মঞ্চে আসেন কলেজ অধ্যক্ষ।
সাধারন শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি পূর্ণ সম্মান প্রদর্শনের আশ্বাস দিয়ে সেদিন তিনিই প্রথম ভাষন দেন। দাপ্তরিক কাজের চাপে অনুষ্ঠান স্থলে তাকতে পারবেন না জানিয়ে সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেন- এ ব্যাপারে কলেজের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত উপাধ্যক্ষ ঘোষণা করবেন। অধ্যক্ষের বক্তব্য শেষে আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্বতা প্রকাশ করে বক্তব্য দেন বরিশালের প্রবীণ সংগঠক-মুক্তিযোদ্ধা আক্কাস আলী। এরপরই আন্দোলনকারীদের সাথে সংহতি প্রকাশে কফিল আহমেদের নেতৃত্বে মঞ্চে ওঠে আমাদের সেই অভিযাত্রী দলের সদস্যরা। এ সময় অভিযাত্রীরা সমস্বরে গেয়ে ওঠে কফিলেরই একটি গান-“বানিয়েছি ডুগডুগি, বাজাও বাজাও...”।
এ সময় উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীরাও উদ্বেল-উচ্ছাসে তাদের বরন করে নেয়। তাদের এই উচ্ছাস অভিযাত্রীদের উপহার দেয় এক মোহনীয় অনুভুতি। এরপর কফিল আহমেদ সহ একে একে সংগীত পরিবেশন করেন- রাজু, অভিজিৎ দাস এবং গানের দল মনোস্মরণী ও চিৎকার। গানের ফাঁকে ফাঁকে বক্তব্য প্রদান-আবৃত্তিও চলছিল। এরই মধ্যে বক্তব্য প্রদান করেন কলেজের উপাধ্য।
তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই কলেজের সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী সভায় মুক্তিযুদ্ধ, মহাত্মা অশ্বিণী কুমার দত্ত ও কবি জীবনানন্দ দাসের ভাস্কর্য/(অবলিক) সৃত্মিফলক নির্মাণ করা হবে”। তার এই বক্তব্যের পর আন্দোলনকারীরা খুশি হওয়ার বদলে উল্টো খেপে যায়। তাদের শ্লোগানেই জানা যায় যে তারা সৃত্মিফলক জাতীয় কিছু নির্মাণ করতে রাজি না। তারা ভাষ্কর্যই চায়। এ সময় বক্তব্য দিতে গিয়ে আন্দোলন কমিটির আহবায়ক মাহফুজ বলেন, “আমাদের দাবির মধ্যে তো কোন ‘/(অবলিক)’ ছিল না।
কিন্তু কতৃপক্ষের সিদ্ধান্তে এই ‘/(অবলিক)’ এর উপস্থিতি কেন? এ আবার কাদের সাথে আপোষের ষরযন্ত্র? এই ভাষ্কর্য নিয়ে কোন টাল-বাহানা চলবে না। ” এ সময় মাহফুজ ঘোষণা দেন যে, ভাষ্কর্য নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পূর্ব পর্যন্ত তাদের এই আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। এসময় উপস্থিত সকলেই এই আন্দোলনের শেষ অবধি একাত্ম থাকার কথা পূণর্ব্যক্ত করেন। পুরো ক্যাম্পাস প্রকম্পিত হয় একটি শ্লোগানে- “ভাস্কর্যের দাবিতে, আমরা সবাই এক সাথে”। পরে আবারও গান ধরেন কফিল আহমেদ।
ফের উদ্বেল হয় সব। উজ্জীবিত হয় নব প্রেরণায়।
আন্দোলন মঞ্চের এই অনুষ্ঠান শেষ হয় দুপুর ২টার দিকে। এরপর জীবনানন্দ চত্ত্বরে কিছুণ আড্ডা মেরে আমরা চলে গেলাম নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকার খাবারের হোটেল ধানসিঁড়িতে। সেখানে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর সবাই একটু ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হল।
কেউ চলে গেলেন হোটেলে বিশ্রাম নিতে, কেউ পূর্বপরিচিতদের সাথে দেখা করতে, আবার কেউ স্রেফ ঘুরে বেড়াতে। অভিযাত্রীদের দলের মধ্যের ‘বরিশাইল্লা’ আমি ও অভিজিৎ দাস তখনই কেবল একটু সময়ের জন্য সুযোগ পেয়েছিলাম নিজেদের বাসায় যাওয়ার। অবশ্য সন্ধ্যা ৬টায় হোটেল প্যারাডাইসেই আবার সবাই এক হলাম। সেখান থেকে লঞ্চঘাট ফেরার পূর্বে আমরা ঘুরে এলাম সেই বাড়ির উঠোন থেকে, যেটি ছিল কবি জীবনানন্দের বরিশাল শহরের আবাসস্থল। সেই সাথে দেখে এলাম বরিশাল চারুকলা বিদ্যালয়ের সংগ্রহশালা।
লঞ্চঘাটে আমাদের বিদায় দিতে দল বেঁধে হাজির হল বি এম কলেজে ভাষ্কর্য নির্মাণ আন্দোলন কমিটির কর্মীরা। মাহফুজ, মিছিল বা রাহাতের মত আন্তরিক এই ছেলে গুলোর আতিথিয়তায় মুগ্ধ চিত্তেই বিদায় নিয়েছি আমরা। সেই সাথে ওদের প্রতি ছিল অন্তরের অন্ত:স্থলের শুভ কামনা। তাছাড়া আন্দোলনটির যে সফল রুপ, তাতে সব মিলিয়ে তৃপ্তির এক ঢেঁকুর তুলে নিশ্চিন্তেই ঢাকা ফিরে ছিলাম আমরা।
তবে আজ দুপুরে (২ জুন,০৯) ওদের খবর নিতে ফোন করে সুসংবাদের বদলে দু:সংবাদই পেলাম।
ওদের আন্দোলন আজ এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। শুনলাম, আজ বিএম কলেজের অধ্যর সাথে দেখা করে যে কোন মূল্যে ক্যাম্পাসে ভাষ্কর্য নির্মাণ ঠেকানোর হুমকী দিয়েছে স্থানীয় মৌলবাদি গোষ্ঠি। কোরআন-সুন্নাহ রক্ষা কমিটির ব্যানারে এই ষড়যন্ত্রকারীরা এখন ঝামেলা পাকানোর তালে আছে। তাদের এই আগ্রাসী আচরনে আতঙ্ক বাড়ছে। আন্দোলনকারীদের সাথে এই মৌলবাদি গোষ্ঠির সংঘর্ষেরও আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এই অবস্থায় আশঙ্কা আর হুমকীর ভয়ে কলেজ কতৃপক্ষ আবার ভাস্কর্য নির্মাণ প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রাখবে কিনা তা’ই ভাবছি। আর একটা প্রশ্ন কেবলই খুব ঘোর-পাক খাচ্ছে মাথার ভিতর। কেউ বলতে পারেন- এমন প্রক্ষাপটে এই মুহুর্তে আমাদের কি করা উচিত..? অনেক গুলো উত্তরো অবশ্য মাথায় আসছে। তবে কোনটা ঠিক বুঝতেছিনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।