আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মরণ নিয়ে খেলছি খেলা

কেউ কেউ একা

রশিদ মিয়া। বয়স প্রায় ৭০ ছুঁই ছুঁই করছে। মাঠে কাজ করতেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিড়ির প্রতি আসক্ত। বাবার সাথে মাঠে কাজ করতে করতে বাপবেটা একসাথে বিড়ি খেতেন।

কদিন আগে তার ফুসফুসে ক্যান্সার ধরা পড়েছে। ডাক্তার সাফ বলে দিয়েছেন, তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। রশিদ মিয়ার আজকের এই পরিস্থিতির জন্য বিড়িকেই দায়ী করেছেন ডাক্তার। রশিদ মিয়া জানতেন না তামাকের বিড়িতে এত ক্ষতি করে। ছোটবেলা বিড়ি ধরা শখ করে।

তারপর নেশা। নেশা থেকে আজকের এই পরিস্থিতি। ১৯৬২ সালে বৃটেনের রয়্যাল কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স ধূমপানের সাথে শারীরিক অসুস্থ্যতার সম্পর্ক নির্ণয় করে। আমেরিকার সার্জন জেনারেল ১৯৭০ এ উল্লেখ করেন 'ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর'। বিশ্ব সংস্থার বিশেষজ্ঞগণ ১৯৭৮ এ প্রমাণ করেন পরিবেশযোগ্য অসুস্থ্যতা ও অকালমৃত্যুর কারণসমূহের মধ্যে ধূমপান অন্যতম।

ধূমপান ও তামাক গ্রহণের বিরুদ্ধে দিন দিন জেগে ওঠে সমাজের সচেতন অংশ। গৃহীত হয় বিভিন্ন পদক্ষেপ। সুইডেন, ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ইত্যাদি দেশে ধূমপানের বিরুদ্ধে গড়ে তোলে আইনগত প্রতিরোধ। এ প্রেক্ষপটে ১৯৭৮ সালে বিশ্ব সংস্থার নজরে পরে বিষয়টি। তামাকের বিরুদ্ধে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি ও সামাজিক আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে ৩১ মে কে বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস ঘোষণা করে।

সেই থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সকল সদস্য দেশে প্রতি বছর দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও তামাকের বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছে সামাজিক প্রতিরোধ। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা হয় দিবসের শ্লোগানে। বিভিন্ন বছর শ্লোগানের ভিন্নতা থাকে। এ বছরের শ্লোগান ছিল তামাকজাত দ্রব্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী প্রদান।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৮ সালের এক জরিপে বাংলাদেশ অন্যতম ধূমপায়ী দেশ হিসেবে চিহ্নিত। এখানে জনসংখ্যার প্রায় ৭০% ধূমপান করে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ধূমপানের ফলে বিভিন্ন রোগে মারা অসংখ্য মানুষ। আমেরিকায় মারা যায় ১লক্ষ, জার্মানিতে ১ লক্ষ ৪০ হাজার, ইটালিতে ৭০ হাজার এবং অস্ট্রেলিয়াতে ২৫ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০০৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী উন্নয়নশীল দেশে ধূমপায়ীর ৪২% পুরুষ ও ৬% নারী।

ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সালের ভেতরে তামাক মানুষের মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের প্রধান কারণ হিসেবে পরিণত হবে। বিশ্বব্যাপী ধূমপানের ফলে মৃত্যুর হার বেড়ে তিনগুণ হবে। বাংলাদেশে অনেক জেলাতে তামাকের চাষ হয়। অন্যান্য ফসলাদি চাষের চেয়ে কৃষক মনে করে তামাক চাষ লাভজনক ফসল। বিভিন্ন তামাকজাত পণ্য বাজারেজাত করার জন্য তামাক চাষিদের নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয় তামাকজাত দ্রব্য প্রস্তুত কোম্পানিগুলো।

সেই সুযোগ-সুবিধা পেয়ে চাষি নিজের জমিতে চাষ করে মরণ নেশার তামাক। তামাক একটি উদ্ভিদ যার পাতা ব্যবহার করে সারা বিশ্বের প্রায় ১ বিলিয়ন লোক নানাভাবে সেবন করে। যে কারণে তামাক প্রায় শতাধিক দেশ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হয়ে থাকে। চীন, ভারত, ব্রাজিল, আমেরিকা, তুর্কি, জিম্বাবুয়ে এবং মালয়েতে শতকরা ৮০ ভাগ উৎপাদন হয়ে থাকে। তারমধ্যে ৩৫ শতাংশই শুধুমাত্র চীনে উৎপাদন হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং স্বাস্থ্য সচেতনমূলক অনেক প্রতিষ্ঠানের সচেতনতামূলক কার্যক্রমে এর ব্যবহারকারীর উন্নত বিশ্বে এর ব্যবহারকারীর সংস্থা কমে যাচ্ছে কিন্তু মোট ব্যবহাকারীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। বিশ্বের শতকরা ৮০ ধূমপায়ী নিম্নআয়ী এবং মধ্যআয়ী দেশগুলোতে। আর আর ব্যবহারের ফলে প্রতি বছর ৫.৪ মিলিয়ন লোক মারা যাচ্ছে। গড়ে প্রতি সেকেন্ডে ১জন করে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে শুধুমাত্র ধূমপানের কারণে। যেখানে প্রতি ১০ জনের ১ জন যুবকের মুত্যু ঘটে।

বিশ্ব সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ৮ মিলিয়ন লোক মারা যাবে ধূমপানের কারণে। যার শতকরা ৮০ ভাগ লোকই শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশের নাগরিক। উন্নয়নশীল দেশে তামাকা ব্যবহারীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় এখানে এর উৎপাদনও বেড়ে চলছে। দৃশ্যত লাভের কারণে দেশের অনেক চাষিরাই খাদ্যশস্যের পরিবর্তে তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে পড়ছে। তামাক চাষে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার ব্যবহারের ফলে মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা হ্রাস পায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষকারী সংস্থ্যাগুলো তামাক চাষের বিরুদ্ধে প্রচার চালালে অসংখ্য নারী শিশুদের কর্মসংস্থান এবং সিগারেট বিড়ি, জর্দা, গুল, সেবনের বহুমাত্রিক ব্যবহার অভ্যাস বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে ক্রমে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশের মত উন্নয়নশীল দেশে যেখানে ব্যাপক সংখ্যক মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো খাবার পায় না সেখানে ধূমপান খাতে শত শত কোটি টাকা ব্যয় সত্যি মর্মপীড়া দেয়। ধূমপান খাতে অপচয় অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে সংকটের সৃষ্টি করে। যিনি নিয়মিত সিগারেট পান করেন তার এ খাতে মাসিক অপচয় হয় কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার টাকা। এ অপচয় না হলে তা পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য চলতে বা কল্যাণমুখী কাজ করে ওই টাকাটা ব্যয় করতে পারত।

সিগারেটপায়ীদের অসুস্থতার খাতেও কম অর্থ খরচ হয় না আমাদের মত এই গরিব দেশে। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ অশিক্ষিত। তারা তামাকের ক্ষতিকর দিগগুলো সম্পর্কে অবগত নয়। মুখে ক্যান্সার, ফুসফুসে ক্যান্সার, মূত্রথলিতে ক্যান্সার, খাদ্যনালীতে ক্যান্সার, আগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় তামাকজাতীয় পণ্যে। এছাড়া শ্বাসকষ্ট, হজমে গণ্ডগোল, পেটে আলসার, কাশি, রক্তে নানা ধরনের সমস্যা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, বুকের নানা ধরনের অসুখের জন্য সিগারেট, বিড়ি, গুল অর্থাৎ তামাকই দায়ী।

সবার ভেতরে সচেতনতা বাড়াতে বিশ্বে তাই ৩১ মে আন্তর্জাতিক তামাক দিবস পালিত হয়ে আসছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।