যখন বিকাল হতে থাকে, হতে হতে সূর্যটা ঢলে পড়ে, পড়তে থাকে
যারা ঘর থেকে বহুদিন বাইরে থেকেছে, আমার তাদের মত থাকতে হয়নি। আমার বাবা বিশাল ছায়া-বিস্তার করে সবাইকে তার পালকের ভেতরে নিয়ে বসবাস করতে চাইতেন। যারজন্য ছাত্রাবস্থায় আমার শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যেতে সময় লাগতো পাঁচমিনিট। পারলে হয়তো তিনি স্কুল, কলেজের মধ্যে বাসা নিতেন। ফলে ছোটবেলা থেকে উল্টো বাসা থেকে পালানোর উপসর্গ দেখা দিয়েছিলো।
আমার প্রথম পলায়ন এইচএসসির পরে। উদাসী বৈরাগ্যে কখনও বুদ্ধদেব গুহের নায়েকারা আমার তখন হিরো, কখনও লোটাকম্বলের পিন্টু। বিপ্লবী পর্যটক। একদিন নেমে পড়লাম রাস্তায়। আমাদের বাড়ীতে সুখ-শান্তি আর নিয়ম-নীতি হাতে হাত ধরে চলতো, ফলে একঘেয়েমীতাপূর্ণও।
প্রতিসন্ধ্যার গানের আসর, বাবা-বোনদের সুমিষ্ট সংগীতও কেমন যেন নৈয়মিক শৃংখল মনে হতো। এর চেয়ে সাইকেল মিস্ত্রি আমার আদর্শ ছিল, রিকশাচালক হয়ে উঠেছিল জীবনের পরিব্রাজক। কাউকে কিছু না বলে আমি গিয়ে উঠলাম অন্য একটা শহরে বাল্যবন্ধু আতিকের হলে। এইচএসসিতেই সে হলবাসী হয়েছিল। সাতদিন হন্যে হয়ে খুঁজে যখন বাবা আমাকে উদ্ধার করলেন, তার আগ পর্যন্ত মনে হয়েছিল জীবনকে উপভোগ করেছিলাম তাড়িয়ে তাড়িয়ে।
এর পাঁচ বছর পরে আমি আবার পালালাম। এইবার পালিয়ে এলাম ঢাকা। ৯৫ সাল হবে। মহসিন হলের ৬২১ বা ৫২১ নম্বর রুমে থাকতো জুরিখ। ছোটবেলার বন্ধু।
পনের বিশ দিন পালিয়ে থাকতে পেরেছিলাম তার সাথে। তারপরে কিভাবে যেন আমাকে উদ্ধার করলো – চার-পাঁচজন এসে মোটামুটি হ্যান্ডক্যাপ পড়িয়ে নিয়ে তুললো বরিশালের লঞ্চে। কিন্তু যেক’দিন ঢাকায় ছিলাম জুরিখ ও অন্যান্যদের হলজীবন দেখে ইর্ষাকাতর হয়ে পড়তাম। কি তুঘলকী জীবন, যখন ইচ্ছে ঘুমাচ্ছে, যখন ইচ্ছে উঠছে। কবে এমন একটা বর্নিল জীবন আমার কপালে জুটবে তাই ভেবে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলতাম।
পড়াশুনা শেষ করে আরো অস্ট্রে-পৃষ্ঠে জরিয়ে গেলাম পরিবারের ভেতরে। কোনভাবেই নিষ্কৃতি নেই। অথচ পলায়ন-প্রবৃত্তি এখনও আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যারা শৈশব থেকে হোস্টেল-হলে কাটিয়েছে তাদের দেখে সৌভাগ্যবান মনে হয়। হয়তো এইবার তাদের ঘরে ফেরার পালা।
কিন্তু নিজেকে নিয়ে ভয় হয়, মাঝেমাঝে এখনও সেই পুরাতন উপসর্গ দেখা দেয়। কখনও তীব্র হয়, মনে হয় সব কিছু ছেড়েছুড়ে পালিয়ে যাই – এই বিপুলা ধরনীতে যে মুক্ত বিহঙ্গের মত বাঁচতে না শিখলো, তার আবার কিসের জীবন। নিজেকে খুবই শৃংখলিত মনে হয়। শওকত হোসেন মাসুম ভাইয়ের পোস্ট পড়ে সেজন্য হিংসা হয়, ঘরের বাইরে এতদিন থাকলে হয়তো ঘরের লোভটা এখন প্রকট থাকতো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।