"আকাশে নক্ষত্র দেখে নক্ষত্রের মতন না হয়ে পারিনি আমি / নদী তীরে বসে তার ঢেউয়ের কাঁপন, / বেজেছে আমার বুকে বেদনার মত / ঘাসের হরিৎ রসে ছেয়েছে হৃদয়"। _আহমদ ছফা
লেখাটা লিখব বলে ভেবেছিলাম ১৭ মে। ১৭ তারিখ বাংলাগানের দুজন মহান শিল্পীর মৃত্যুদিবস। একজন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অন্যজন মুকুন্দ দাস। দুজনকে নিয়ে একটা ছোট লেখা দেব বলে ভেবেছিলাম।
কিন্তু সময় করে উঠতে পারিনি। ঢাকার বাইরে যেতে হল, ফিরে এসে এত আলসেমীতে পেয়ে বসল যে লেখা দূরে থাক, যে বইটা পড়ছিলাম (দিলীপ কুমার রায়ের 'উদাসী দ্বিজেন্দ্রলাল'), তাও আর পড়া শেষ হল না। ভাবলাম, থাক, তারিখ চলে গেছে, লিখে আর কি হবে!
সম্প্রতি ব্লগে টিপাই বাধ নিয়ে দু'একজন লেখার চেষ্টা করছেন। তাদের কারো কারো মন্তব্যে ভারত-বিরোধিতার মূল কারণ মনে হল সাম্প্রদায়িক মনোভাব। কারো কারো লেখায় আর্থ-রাজনৈতিক কারণ, খানিকটা হলেও উঠে এসেছে।
এ বিষয়ের সূত্র ধরেই, আমাদের দেশপ্রেম-দেশাত্মবোধ, রাজনীতিবিদ-বুদ্ধিজীবীদের দেশপ্রেম ইত্যাদি নিয়েও বেশ কিছু কথা চালাচালি হয়েছে। তাই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একটি ঘটনা সবার সাথে ভাগাভাগি করার ইচ্ছা হল।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একাধারে ছিলেন কবি, নাট্যকার, গীতিকার এবং সুরকার। একই সাথে তিনি সুগায়কও ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আগে তিনিই প্রথম ইউরোপীয় (আইরিশ, স্কচ ও ইংরেজি) গানের সুর বাংলাগানে সংযুক্ত করে বাংলাগানের সুরভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছিলেন।
পরে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ব্যবহার করা সুরগুলোই নতুন বাণী দিয়ে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন। বয়সে তিনি রবীন্দ্রনাথের দুই বছরের ছোট ছিলেন (জন্ম : ১৯ জুলাই ১৯৬৩)। রচনা করেছেন প্রায় ৫০০ গান, ৬টি নাটক, অসংখ্য কবিতা। তাঁর গানের মধ্যে যেটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তার একটি হল হাসির গান (প্যারডি / স্যাটায়ার), আর দ্বিতীয়টি আগেই বলেছি, বাংলাগানে ইউরোপীয় সুরের ব্যবহার। দেশপ্রেমের গান তো আছেই।
মাত্র ৫০ বছর বয়সে ১০১৩ সালের ১৭ মে তাঁর মৃত্যু হয়।
বাংলাগানে তাঁর ভূমিকা মূল্যায়ন করতে গিয়ে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন, "... দ্বিজেন্দ্রলাল মূলত সুরকার বা কম্পোজার। তাঁর গান খুব নিরপেক্ষভাবে অনুধাবন করলে বোঝা যায় বাণীরচনায় তাঁর প্রতিভা ছিল মধ্যম রকমের কিন্তু সুরসৃজনে তাঁর কারুকৃতি ছিল প্রথম শ্রেণীর। কম্পোজার হিসাবে দ্বিজেন্দ্রলালের মহিমা বুঝতে গেলে একটু ইতিহাসের দিকে চাইতে হবে। রবীন্দ্রনাথ আর দ্বিজেন্দ্রলালের আগে বাংলা গান স্বনির্ভর ছিল না।
কোনো বিশিষ্ট হিন্দুস্থানী গানের স্ট্রাকচারের ওপর বাংলা বাণী বসিয়ে আগেকার বাংলা গান বাঁধা হত। কথা ও সুরের অন্যোন্য সম্পর্কে গান গড়ে উঠতো না। রবীন্দ্রনাথ আর দ্বিজেন্দ্রলাল সর্বপ্রথম গানকে কম্পোজ করলেন তার একক স্বাতন্ত্র্যে। সে-স্বাতন্ত্র্য এমনই যে রাগরাগিণীর আভাস থাকলেও তার প্রাধান্য থাকতো না। হয়ে উঠতো এক নতুন সৃজন।
দ্বিজেন্দ্রলালের স্বদেশী গানে তাঁর কম্পোজার-রূপ সবচেয়ে ফুটেছে। " (বাংলা গানের সন্ধানে)
গল্পটা, অবশ্য গল্প না বলে ঘটনাটা বলাই ভাল, দ্বিজেন্দ্রলালের স্বদেশী গানগুলোর মধ্যে এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় গান 'বঙ্গ আমার ! জননী আমার ! ধাত্রি আমার ! আমার দেশ !' নিয়ে।
সময়টা ১৯০৮ সাল। বঙ্গভঙ্গ-রোধের দাবিতে আন্দোলন তখন তুঙ্গে। কবি একে একে রচনা করলেন জাতীয়তাবাদী আবেগদীপ্ত নাটক 'প্রতাপ সিংহ' (১৯০৫), 'দুর্গাদাস' (১৯০৬), 'নূরজাহান' ও 'মেবার পতন' (১৯০৮)।
মেবার পতন' নাটকে একটি গান ছিল 'মেবার পাহাড়া, মেবার পাহাড়' (সুর অনেকটা নজরুলের 'শাতীল আরব শাতীল আরব' ধাঁচের, অবশ্যই নজরুল অনেক পরে এটি রচনা করেছেন, আমি সুরের ধাঁচটি বোঝাতে উল্লেখ করলাম)। ওই সময় কবি ছিলেন গয়াতে। বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু সেখানে বেড়াতে যান। কবি তাঁকে 'মেবার পাহাড়া' গানটি গেয়ে শোনান।
গান শুনে জগদীশচন্দ্র বলেন, "আপনার এ গানে আমরা কবিত্ব উপভোগ করিতে পারি, কিন্তু যদি মেবারের লোক হতেম তাহলে আমার প্রাণ দিয়ে আগুন ছুটত।
তাই আপনাকে অনুরোধ করি আপনি এমন একটি গান লিখুন যাতে বাঙ্গালার বিষয় ও ঘটনা -- বাঙ্গালীর বিষয় ও ঘটনা থাকে। "
এর কিছুদিন পর। একদিন দুপুর বেলা খাওয়া সেরে কবি বিশ্রাম নিচ্ছেন, সঙ্গে ছিলেন দেবকুমার রায়চৌধুরী।
হঠাৎ ...
"দেখ, আমার মাথার মধ্যে একটা গানের কয়েকটা লাইন আসিয়া ভারি জ্বালাতন করিতেছে। তুমি একটু বসো ভাই, -- আমি সেগুলো গেঁথে নিয়ে আসি।
আধ ঘণ্টার মধ্যে রচিত হয় বিখ্যাত গান 'বঙ্গ আমার জননী আমার'। গান তাঁকে এতটাই উজ্জীবিত করতে পারত যে ঐ তীব্র হতাশার জীবনেও (মূলত কবিপত্নীর মৃত্যুতে এবং সরকারি চাকুরির যাকে তিনি 'দাস্য' বলতেন, তার থেকে প্রসূত হতাশা *) তিনি আর কিছু না বলিয়া, হাততালি দিতে দিতে, সারাটা ঘরময় ঘুরিরা-ঘুরিয়া, নাচিয়া-নাচিয়া, আবার গাহিতে লাগিলেন --
কিসের দুঃখ কিসের দৈন্য কিসের লজ্জা কিসের ক্লেশ?
সপ্ত কোটি মিলিত কণ্ঠ ডাকে যখন আমার দেশ?" (দেবকুমার রায়চৌধুরীর স্মৃতিচারণ)
এই গান দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের জীবনে অত্যন্ত গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাঁর জীবনীকার নবকৃষ্ণ ঘোষের মতে, এই গান কবির জীবনে নিয়তির মতো এসেছিল। 'বঙ্গ আমার' গাইতে গেলেই কবি সংযম হারাতেন, আক্রান্ত হতেন উচ্চ রক্তচাপে।
নবকৃষ্ণ ঘোষের জবানীতে, "এই গীতটি গায়িতে গায়িতে একদিন স্যার কৈলাসচন্দ্র বসু মহাশয়ের বাটীতে দ্বিজেন্দ্রের মস্তিষ্কে রক্তাধিক্য হয়, আর একদিন ইভনিং ক্লাবে এই গানটি শিক্ষা দিবার সময়, পরে পুনরায় একদিন ঝামাপুকুরে তদীয় মিত্র শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের ভবনে ঐ গানটি গায়িতে গিয়া দ্বিজেন্দ্রের মস্তিষ্কে শোণিতাধিক্য হয় এবং প্রতিবারই তাঁর সংজ্ঞাশূন্য হইবার উপক্রম হয়।
ইহাই দ্বিজেন্দ্রর প্রাণান্তকারী সন্ন্যাস রোগের সূত্রপাত। "
কবি নিজে এ গান সম্পর্কে বলতেন, "ও গানটা গায়িতে গেলে আমার কেন জানি না, ভয়ানক মাথা গরম হয়ে উঠে। "
কবির এ ঘটনাটা আমাদের দেশপ্রেম-দেশাত্মবোধ সম্পর্কে কি খানিকটা ব্যঙ্গ ছুড়ে দেয় না?
আর সবশেষে কবির একটি গভীর আকাঙ্ক্ষা বা আশাবাদের কথা উল্লেখ করে লেখাটা শেষ করি। পুত্র দিলীপকুমার রায় (যিনি নিজেও পরে একজন্য অনন্য শিল্পী হয়েছিলেন)-এর সাথে কথোপকথনে তিনি বলেছিলেন, "না রে না, আমাকে কি রবিবাবুকে ভুলে যাবে না। আর কেন যাবে না জানিস?--এইজন্যে যে, আমরা রেখে যাচ্ছি যা বাঙালীর প্রাণের জিনিস -- সুরে বাঁধা গান।
আমি যে কী সব গান বেঁধে গেলাম সেদিন তুইও বুঝবিই বুঝবি। "
জানি না, বাঙালি কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে কতটা মনে রেখেছে, কিন্তু ভুলেছে যে অনেটা তা টের পাই, যখন শুনি কেউ (নাম করা গায়ক/গায়িকারাই) 'ধনধান্যেপুষ্পেভরা'। অথচ কবি লিখেছিলেন 'ধনধান্যপুষ্পভরা'।
আর কবির হাসির গানগুলোও কাউকে গাইতে শুনি না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।