আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বলয় ভাঙার রাজনীতি, বৃত্তের ভেতরের মানুষেরা



বলয় ভাঙার রাজনীতি, বৃত্তের ভেতরের মানুষেরা ফকির ইলিয়াস ------------------------------------------------------------------- চিরবিদায় নিয়ে চলে গেলেন দেশের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়া। তার একটা পরিচয় ছিল, তিনি জাতির জনক বঙ্গবু শেখ মুজিবুর রহমানের জামাতা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী। অত্যন্ত মেধাবী এই মানুষটি ছিলেন খুই নিভৃতচারী। কোন মোহ, কোন লোভ তাকে কখনই স্পর্শ করতে পারেনি।

তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জাতি তার একজন মেধাবী সন্তানকে হারিয়েছে। ড. ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যু সংবাদ শুনে ‘সুধাসদনে’ ছুটে গিয়েছিলেন বিরোধীদলের নেতা বেগম খালেদা জিয়া। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পাশে একান্তে সময় কাটিয়েছেন ২০ মিনিট। এ সংবাদটিও জাতির জন্য আশার সঞ্চার করছে। চরম দু:সময়ে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে­ এটাই মানবিক শক্তি এবং প্রত্যয়।

নি:সন্দেহে বলা যায়, বেগম জিয়া একটি ভাল কাজ করেছেন। রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকতেই পারে, কিন্তু কিছু কিছু বিষয়ে ঐক্য-সংহতি প্রকাশে অসুবিধা কি? অন্যদিকে বেগম জিয়ার সেনানিবাসের বাড়ির বিষয়টির শুনানিতে বিব্রত বোধ অব্যাহত রয়েছে। এই কথাটি অনেকের কাছেই বোধগম্য হচ্ছে না, মাননীয় বিচারকরা দেশের আইন অনুসরণ করে অগ্রসর হচ্ছেন না কেন? তারা কেন বার বার বিব্রত বোধ করছেন। পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে- লন্ডনে অবস্খান করলেও বিএনপির সব নীতিনির্ধারণে অগ্রণী ভূমিকা রাখছেন তারেক রহমান। তার নির্দেশেই সেনানিবাসের বাড়ি নিয়ে আন্দোলন চাঙ্গা করার কাজ এগিয়ে যাচ্ছে।

রিপোর্টে বলা হচ্ছে, সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এই বছরের মাঝেই দেশে ফিরতে পারেন তারেক রহমান। নতুন করে ধরতে পারেন দলের হাল। তারেক রাজনীতিতে ফিরে আসবেন­ তা সময়ের ব্যাপার মাত্র। কারণ বাংলাদেশে পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির ধারা আরও দীর্ঘকাল চলবে তা প্রায় নিশ্চিত। আর এক্ষেত্রে বি. চৌধুরী, সাইফুর রহমানরা কিছুটা অকৃতকার্য হলেও বড় দুটি দলের নেতৃত্ব থেকে যাবে দুই শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পারিবারিক বলয়ে।

আমরা পত্রপত্রিকায় এ সংবাদ দেখছি, শেখ রেহানা রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হওয়ার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনিও জাতির জনকের কন্যা। আগামী কাউন্সিলে শেখ হাসিনা যদি আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ থেকে সত্যি সরে দাঁড়ান তবে কে সভাপতি হচ্ছেন তা নিয়ে জল্পনা তো রয়েছেই। মোট কথা হচ্ছে দেশ এগিয়ে যাবে একটি নিয়মতান্ত্রিক পারিবারিক রাজনৈতিক ধারায়। বাংলাদেশে প্রথা ভাঙার রাজনীতির কথা আমরা কম শুনিনি।

কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এরশাদের জাতীয় পার্টি থেকে শুরু করে, বি. চৌধুরীর বিকল্প ধারা, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম কোন দলেই হালে পানি পায়নি। পারেননি কর্নেল অলি, জে. ইবরাহিম, ড. ফেরদৌস কোরেশীর মতো পরিচিত রাজনীতিকরাও। নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস সাহস করতে পারেননি। মহাজোটের শক্তি নিয়ে জাসদ কয়েকটি আসন পেয়েছে।

সেটাকেও বৃত্তভাঙার রাজনীতি বলা যাবে না। চেষ্টা করা হয়েছে ওয়ান ইলেভেনের মাধ্যমেও। যারা সংস্কারের কথা বলে নাব্য নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন তারাও ছিটকে পড়েছেন। এভাবে গত সাঁইত্রিশ বছরে বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক ধারা, অনেক রাজনৈতিক নেতার অকাল মৃত্যু হয়েছে রাজনীতির ময়দানে। এর মাধ্যমে মানুষ কি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে? আদৌ কোন অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে কি না সে প্রশ্নটিও থেকে যাচ্ছে প্রকারান্তরে।

দুই. বাংলাদেশে যে পীড়াদায়ক পরিস্খিতিটি জনমানুষকে সবচেয়ে বেশি বিব্রত করেছে তা হচ্ছে ইতিহাস বিকৃতি। এটা স্বীকার্য বিষয়, জাতির জনক শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণাটি পাঠ করেছিলেন সে সময়ের একজন মেজর জিয়াউর রহমান। জিয়া তার জীবদ্দশায় কখনই দাবি করেননি তিনি স্বাধীনতার ঘোষক। পঁচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর বিভিন্ন অভ্যুথান, পালটা অভ্যুথান পেরিয়ে ক্ষমতার স্পর্শ পান তৎকালীন সামরিক বাহিনীর উপপ্রধান জে. জিয়াউর রহমান। তারপর রাজনীতিতে তার উত্তরণের প্রক্রিয়া, সিঁড়ি এবং ধারাবাহিকতা দেশবাসীর অজানা নয়।

সেই জিয়াউর রহমান আরেকটি সামরিক ক্যুতে নিহত হওয়ার পরই তাকে ‘অবতার’ বানাবার চেষ্টা করা হয়। মূলত মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমান, কালের প্রক্ষেপণে রাষ্ট্রপতি হওয়ার অর্থ এই নয় যে, তিনিই হয়ে গেলেন ইতিহাসের মহানায়ক। অথচ তাই করা হয়েছে। আজকের প্রজন্মকে ভ্রান্ত ইতিহাস বলে ‘ব্রেনওয়াশ’ করা হয়েছে, হচ্ছে অথবা চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা গোটা জাতির জন্যই বড় মর্মবিদারক।

সেনানিবাসের বাড়িটি যে জিয়া পরিবারকে দেয়া হয়েছিল সে সময়ের জিয়া পরিবার আর আজকের জিয়া পরিবার কি সমান? না সমান নয়। বিত্তবৈভবে তারেক-আরাফাতরা এখন অনেক শক্তিশালী। তারপরও তাদের এই সেনানিবাসের অভ্যন্তরে থাকার খায়েশ কেন? তা ছেড়ে দিতে এতো কঠোর হচ্ছেন কেন জিয়া পরিবার? স্মৃতির তপস্যার জন্য? সেনানিবাসে বসবাসের স্মৃতি তো বাংলাদেশের অন্যান্য অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ও তাদের পরিবারেরও রয়েছে। বিভিন্ন সংশোধনী, বিভিন্ন প্রজ্ঞাপন, বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় খাতের তোয়াজ করে সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান এই দেশে যে জঞ্জাল তৈরি করে গেছেন তার খেসারত আজও দিতে হচ্ছে গোটা জাতিকে। তার দল এখনও এই দেশে রাজাকার-আলবদরকে বাঁচাবার জন্য নানা ফন্দি ফিকির করছে।

বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লেবাসে মূলত জিয়া এই দেশে কি কি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছিলেন এর পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার এই প্রজন্মের পক্ষ থেকে। শেষ পর্যন্ত একাত্তরের চিহ্নিত রাজাকার গো. আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অন্যদের আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ অর্থাৎ বর্তমান সরকার এসব চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের ব্যাপারে কতটা আন্তরিক তা দেখার সময় আসছে। বিচার করা যাবে কি না এমন সংশয়ও প্রকাশ করছেন কেউ কেউ। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র।

রাষ্ট্রের আইন, সংবিধান, প্রশাসন, আইন প্রয়োগকারী সংস্খা সবই আছে। তাই কোন মিছিল-মিটিং, হুমকি ধমকিকে পরোয়া না করে সুষ্ঠু বিচার কার্য সম্পন্ন করাটাই কালের-প্রজন্মের দাবি। একটা সময় এসেছে এই ব্যাত্বের বলয় ভাঙার। একটা সময় এসেছে বৃত্তের ভেতরে আটকে পড়া মানুষদের উদ্ধার করার। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্য সম্পন্ন করার মাধ্যমে সেই সত্যটিই প্রতিষ্ঠিত হোক।

১২ মে ২০০৯ -------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ। ঢাকা। ১৫ মে ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি - জুলি জোনস

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।