রিপোর্ট টি ছাপা হয়েছে দৈনিক আমাদের সময়ে । ৭ মে ২০০৯ বৃহস্পতিবার।
পড়ুন । জানুন আমাদের রাজ্যতস্করদের কিছু আমলনামা।
%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%%
সাত ভিআইপির বিদেশে পাচার করা অঢেল অর্থ ফেরত আসছে
অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে: আইনমন্ত্রী
এমএকে জিলানী:
---------------------------
বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে অনেকখানি এগিয়েছে সরকারের পক্ষে এটর্নি জেনারেলের কার্যালয়।
দুবাই, হংকং, সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ মিউচুয়াল লিগ্যাল এসিসটেন্স রিকোয়েস্টের (এমএলএআর) মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা এগমন্ডের (এগমন্ড গ্র“প) সদস্য হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় শতাধিক দেশের সঙ্গে এমএলএআর চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এছাড়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে এফবিআই ও যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের তিন কর্মকর্তা বাংলাদেশে অবস্থান করে বিভিন্ন বিষয়ে সহায়তা করছেন।
সূত্র জানায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালের ১৩ মে সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও এমপি আলী আজগর লবী, ১৫ মে সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ২০ মে ব্যবসায়ী গিয়াসউদ্দিন আল মামুন, ২ জুন সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা এবং বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সাবেক মন্ত্রী এম মোর্শেদ খান ও তার ছেলে ফয়সাল মোর্শেদ খানের বিদেশে পাচার করা অর্থের তথ্য প্রমাণসহ জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী সংস্থায় (ইউএনসিএসি) পাঠানো হয়। ইউএনসিএসি থেকে সেই তথ্যপ্রমাণগুলো সংশ্লিষ্ট দেশে পাঠিয়ে অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে বলা হয়।
মঞ্জু, লবী, মোশাররফ, মামুন, মওদুদ এবং হুদার বিরুদ্ধে পাঠানো অভিযোগ সংশ্লিষ্ট দেশ তদন্ত করে বাংলাদেশকে জানিয়েছে, তারা অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পেয়েছে। অচিরেই অর্থগুলো ফিরিয়ে দিতে বাংলাদেশকে আইনসহ সবরকম সহযোগিতা করা হবে।
আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল এই প্রতিবেদক বলেন, মঞ্জু, লবী, মোশাররফ, মামুন, মওদুদ ও হুদার বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক আমলে এবং বর্তমান সরকারের সময় মোর্শেদ খান ও ফয়সাল মোর্শেদ খানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ ইউএনসিএসিতে পাঠিয়ে অর্থগুলো ফেরত আনতে সহযোগিতা চাওয়া হয়। এরই মধ্যে ইউএনসিএসি থেকে আমরা ব্যাপক সহযোগিতা পেয়েছি। মঞ্জু, লবী, মোশাররফ, মামুন, মওদুদ এবং হুদার অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়টি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে।
তিনি আরো বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা অর্থ যে প্রক্রিয়ায় ফেরত আনা হচ্ছে তাদেরটাও একই প্রক্রিয়ায় হবে।
আইনমন্ত্রী বলেন, এফবিআই ও যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের তিন কর্মকর্তা বাংলাদেশে অবস্থান করে অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আমাদের আইনজীবীদের প্রশিক্ষণসহ টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিচ্ছে।
এটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে ইউএনসিএসিতে মঞ্জু, লবী, মোশাররফ, মামুন, মওদুদ ও হুদার বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগেপত্রে তাদের সকলের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ দায়ের হওয়া সকল মামলার বিবরণ পাঠানো হয়। সেই সঙ্গে তাদের কোন দেশে কী কী সম্পদ আছে তারও বিস্তারিত বিবরণ দেয়া হয়।
ইউএনসিএসিতে পাঠানো চিঠি থেকে জানা গেছে, মওদুদ আহমেদের ছেলে আমান মমতাজ মওদুদ এবং মেয়ে আনা কাশফিয়া পি মওদুদ দুজনই দেশের বাইরে থাকেন।
আমান মমতাজ ব্রিটেনের নাগরিক (ব্রিটশি পাসপোর্ট নম্বর জিবি ০২৫১১৯৫৯৬) এবং আনা কাশফিয়া যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক (ইউএস পাসপোর্ট নম্বর জেড ৭৬৬৭২৫৫। তাদের দু’জনের ব্যাংক একাউন্টেই প্রচুর অর্থের খোঁজ পাওয়া গেছে।
র্যাবের একটি তদন্ত থেকে জানা গেছে, মন্ত্রী থাকাকালে এক ব্যবসায়ীকে টেন্ডারে কাজ পাইয়ে দিয়ে ১৫ কোটি টাকা ঘুষ নেন তিনি। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী থাকাকালে জেলা ভূমি কর্মকর্তা এবং কাজী নিয়োগে দুর্নীতি করে প্রচুর অবৈধ অর্থ উপার্জন করেন। এ বিষয়ে পৃথক একটি তদন্ত চলছে।
তদন্ত কর্মকর্তারা মওদুদ আহমেদ এবং তার স্ত্রী হাসনা মওদুদের নামে যুক্তরাজ্যে একাধিক ব্যাংক একাউন্ড চিহ্নিত করতে পেরেছে। হাসনা মওদুদের নামে বারক্লেস ব্যাংক পিএলসিতে দু’টি একাউন্ট আছেÑ একাউন্ট নম্বর ৯০৪৩৬১৯৪ ও ১০৪৮৬০৪৩। মওদুদ আহমেদের নামে বারক্লেস ব্যাংকে থাকা একাউন্ট নম্বর ৯০০৮৫৮৪৭। আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান যুক্তরাজ্যের নটিংহামের ইকানো ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিডেটে মওদুদের এলডার অ্যাক্ট কার্ড সার্ভিসেস নম্বর ০৮৭০-২৪০-৩২৯১, কার্ড নম্বর ৯৮২৬-১৪১২-৪৪৬৭-৯৯৩৭। ২০০৭ সালের ১৪ এপ্রিল মওদুদ আহমেদের বাসা তল্লাশির সময় দেখা যায়, ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট বিভাগের রিলেশনশিপ ম্যানেজার আমান্ডা ওয়াতকিন এবং ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার অপরেশ রনজিৎ এর সঙ্গে বাণিজ্যিক বৈঠকটি ১১ এপ্রিল বাতিল করা হয়।
ইউএনসিএসিতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বিরুদ্ধে পাঠানো অভিযোগপত্র থেকে জানা গেছে, ২০০১ সালের জুনে তার স্ত্রী তাসমিমা হোসেন বারক্লেস ব্যাংকের একাউন্টে ১২ কোটি ৪৯ লাখ ৯৯ হাজার ১৩৯ ডলার জমা করেন। একই ব্যাংকে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি জমা করেন ১২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। জমা করা এই অর্থের বিবরণ তিনি তার আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি। বারক্লেস ব্যাংকে অর্থ জমা করার সময় তিনি উল্লেখ করেন, এজিস স্পিনিং মিলস, এজিস টেক্সটাইল মিলস, এজিস কটন মিলস এবং মাস্ট প্যাকেজিং এন্ড পেপার কনভারটিংয়ের তিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ২০০৪/০৫ সালে এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে যৌথভাবে প্রায় এক লাখ ২৮ হাজার পাউন্ড আয় হয়।
দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে দেখা যায়, বারক্লেস ব্যাংকে দেয়া এসব প্রতিষ্ঠানের তথ্যগুলো মিথ্যা। কেননা এসব প্রতিষ্ঠানের হিসাব নিরীক্ষা বিবরণীতে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানকে অলাভজনক দেখানো হয়েছে।
২০০৭ সালে তাসমিমা বারক্লেস ব্যাংকের উপদেষ্টার সঙ্গে ব্যবসায়ীক চুক্তি নিয়ে আলোচনা করেন। ২০০৭ সালের আগস্টে তিনি এই ব্যাংক থেকে ১২ লাখ পাঁচ হাজার ইউএস ডলার তার মেয়ে মনিজা হোসেন এবং তার জামাতার নামে থাকা বইরুতের ব্লোম ব্যাংকে স্থানান্তরের জন্য কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। ৫৮-৫৯ হাইড পার্ক গেইট, লন্ডন, এসডব্লিউ৭ ৫ইডিতে ২০০৩ সালে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেন (ফ্লাট নম্বর ১২)।
যার বর্তমান বাজার মূল্য ৪ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড।
লন্ডনের ডব্লিউ২ ১এসওয়াই ৬৬ সেন্ট মেরিস মেনসনের ৬৬ নম্বর ফ্ল্যাটে তার মেয়ে আনুশেহ হোসেন থাকেন। ফ্ল্যাটটি ২০০১ সালে তাসমানিয়া প্রপার্টিজ (জিবরালটার) লিমিটেডের নামে ক্রয় করা হয়। এখন পর্যন্ত তাসমানিয়া প্রপার্টিজ (জিবরালটার) লিমিটেড সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। ফ্ল্যাটটির বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় পাঁচ লাখ পাউন্ড।
নাজমুল হুদার নামে পাঠানো এমএলএআর-এ বলা হয়েছে, তার মেয়ে ১৯ বছর বয়সী শ্রাবন্তী হুদা ও ২৭ বছর বয়সী অন্তরা হুদা বিট্রেনে পড়াশোনা করেন। শ্রাবন্তী হুদার নামে বিট্রেনের এইচএসবিসি এবং অন্তরা হুদার নামে ব্রিটেনের নেট ওয়েস্ট ব্যাংকে একাউন্ট আছে।
সিগমা হুদা এবং তার মেয়ে অন্তরা হুদার নামে যৌথভাবে ১৫৩ দ্য ওয়াটার গার্ডেনস, বুরউড প্লেস, লন্ডন ডব্লিউ২ ২ডিই-তে ২০০৩ সালে একটি বাড়ি ক্রয় করা হয়। বাড়িটি অন্তরা হুদার নামে দুই লাখ ৮৫ হাজার পাউন্ডে ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড থেকে মর্টগেজ নিয়ে তিন লাখ ৮০ হাজার পাউন্ডে ক্রয় করা হয়। দুই লাখ ৫০ হাজার নগদ পাউন্ড দিয়ে ৪ হেনলি কোর্ট, ডেনহাম রোড, এগহাম, সুরে টিডব্লিউ২০ ৯কিউজেড-এ ২০০৬ সালের নভেম্বরে একটি বাড়ি ক্রয় করা হয়।
নাজমুল হুদা এবং সিগমা হুদার নামে যৌথভাবে বারক্লেস ব্যাংকে দু’টি একাউন্ট আছে (হিসাব নম্বর ৭০৬৬০৯৬৫, শর্ট কোড ২০-৪৭-৪২ এবং হিসাব নম্বর ৪০০৭২০৩৬, শর্ট কোড ২০-৪৭-৪২)।
ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নামে পাঠানো এমএলএআর-এ বলা হয়েছে, তার স্ত্রী বিলকিস আক্তার হোসেনের নামে ২০০১ সালের ৪ জুলাই এক হাজার পাউন্ড জমা দিয়ে এইচএসবিসি ব্যাংক পিএলসি, হেনডন, লন্ডনে একটি একাউন্ট খোলা হয় (নম্বর ০১৩৪০১২৩, শর্ট কোড ৪০-০৩-২৬)। ২০০৩ সালের ২৭ মে এই একাউন্টে তিন লাখ ৯৪ হাজার ২০২.২০ পাউন্ড জমা দেয়া হয়। তার ছেলে খন্দকার মারুফ হোসেনের নামেও এইচএসবিসি ব্যাংক পিএলসিতে একাউন্ট আছে (নম্বর ০১৩৪৯০৯০, শর্ট কোড ৪০-০৩-২৬)। ৫৯ হিলডা ভেলে রোড, কেন্টের এই বাড়িটি ক্রয় করার জন্য ২০০৪ সালের ফেব্র“য়ারিতে এই একাউন্টে দুই লাখ ১২ হাজার পাউন্ড পাঠানো হয়।
বাড়িটি বিলকিস আক্তারের নামে ক্রয় করা হয়। ২০০৭ সালের ৫ অক্টোবর বাড়িটি দুই লাখ ১০ হাজার পাউন্ডে মো. আবদুর রহিম মিয়ার কাছে বিক্রি করা হয়। খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও তার স্ত্রী বিলকিস আক্তার হোসেনের নামে আইসল্যান্ডের দু’টি ব্যাংক একাউন্টে মোট ১৫ লাখ পাউন্ড জমা আছে।
আলী আজগর লবীর নামে পাঠানো এমএলএআর-এ বলা হয়েছে, তিনি ২০০৫ সালে দুবাইয়ের আবুধাবী রোডের জাবেলা এলাকায় ছয় লাখ দিরহাম দিয়ে একটি প্লট কেনেন এবং লন্ডনের লুটনে লয়েডস ব্যাংকের একাউন্টে তার নামে প্রায় ১০ হাজার পাউন্ড আছে। লবীর পাসপোর্ট নম্বরের কোড ব্যবহার করে এই ব্যাংকে লেনদেন করতে হয়।
লবীর নামে দুবাইয়ের দায়েরাতে গোল্ডেন সন্স নামে একটি এবং ব্যাংককে রবীনসন মার্কেটের পেছনে একটি বাড়ি আছে। লবীর ছেলে সাকীব আজগরের নামে দুবাইয়ের বারদুবাইয়ে বাদরী বিল্ডিং নম্বর ১-এ একটি (৭১৫ নম্বর) এপার্টমেন্ট এবং দুটি গাড়ি আছে। দুবাইয়ের দায়েরাতে মাস্ট ট্রেডিং এন্ড রিয়েল স্টেট নামে সাকীবের রিয়েল স্টেট ব্যবসা আছে। এছাড়া সিঙ্গাপুরের বাসিন্দা আজম কলিয়ার সঙ্গে লবীর স্ত্রী খোসনুদ আজগরের ব্যবসায়ীক স্থাপনা আছে। স্থাপনাগুলো সিঙ্গাপুর, দুবাই ও পাকিস্তানে।
বিভিন্ন সময় খোসনুদ আজগরের নামে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আসতো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।