আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাইকো-থ্রিলার ডাঃ মতিন

সময়ের সমুদ্রের পার--- কালকের ভোর আর আজকের এই অন্ধকার

ডাঃ মতিন ১ সুর্যাস্তের লাল আভাটা হঠাৎ করে সরে গেল। রাত নামল ঝুপ করে। আমাবস্যার রাতে কোন জ্বলন্ত কুপিকে যদি দপ করে নেভানো হয়, বিশেষ ধরণের একটা অন্ধকার হয়ে আসে। আজকের অন্ধকারটাও তেমন। কোন বিশেষ কিছু নির্দেশ করছে কি? ডাঃ মতিন কাপতে শুরু করলেন।

প্রচন্ড শীত লাগছে। এই সময়টা শীতের সময় নয়। অথচ তিনি কাঁপছেন। মাঘের শীতে বাঘে কাপে। তিনি কাঁপছেন কার্তিকের শীতে।

সিদ্ধান্ত নিলেন কখনো শিক্ষামন্ত্রী হতে পারলে বাংলা ব্যাকরণে বিশাল রদবদল আনবেন। মাঘের শীতে বাঘকে না কাপিয়ে লিখবেন, কার্তিকের শীতে বাঘে কাপে। অথবা কার্তিকের শীতে ডাঃ মতিন কাঁপে। তিনি আকাশের দিক থেকে চোখ সরালেন। এমন অদ্ভুত অন্ধকার হঠাৎ করে কেন নামল, ভাবতে ভাবতে তিনি পথ হাটছেন।

গন্তব্য পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ডিউটি আছে। নাইট ডিউটি। কাদের ভাইয়ের ডিউটিটার প্রক্সি দিচ্ছেন। কাদের ভাইয়ের বাবা অসুস্থ।

দেখতে গেছেন। গ্রাম থেকে ফিরলেই মতিনকে একদিন ডিউটি করে ঋণ শোধ দিবেন। সাধারন কেবিনে ঢুকে পড়লেন ডাঃ মতিন। কেবিনের ভেতর দিয়েই চেম্বারে যেতে হবে। এটা মতিনের একদম পছন্দ নয়।

এই কেবিনটা ক্যান্সার আর কলেরা রোগীদের জন্য। দুই মেরুর দুই বিপদজনক রোগীকে কেন একসাথে রাখা হয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। কলেরার রোগীদের আইসোলেশন করে রাখার কথা। সরকার যথেষ্ঠ টাকাও দিচ্ছে। অথচ এখানে নিয়ম মানা হয় নি।

এই অনিয়মটায় গতকালকে বিপত্তিটা ঘটিয়েছিল। ডাঃ মতিন গতকাল ডিঊটি করতে ঢুকছেন। কলেরা কেবিনটাতে এসে হঠাৎ হুমড়ী খেয়ে পড়ে গেলেন। পা পিছেলে গেছে। মেঝে থেকে ওঠার পর বুঝতে পারলেন আসল ঘটনা।

সারা শরীরে পায়খানায় মাখামাখি। কলেরা রোগীরা পায়খানা করে ঘর ভাসিয়েছে। পিচ্ছিল পায়খানায় তিনি তাল সামলাতে পারেন নি। পড়ার পর ছলকে এসে মনে হয় কিছু পায়খানা মুখেও ঢুকেছে। নোনতা নোনতা লাগছে কেন? পাতলা পায়খানায় মাখামাখি ডাঃ মতিনকে দেখে রোগীরা হাসাহাসি শুরু করে দিল।

সবাই মুখ টিপে হাসছে। এক বৃদ্ধ মুমুর্ষু রোগী হা হা করে শরীর দোলাতে শুরু করল। হাসির শব্দ খিচ খিচ টাইপ। মুমুর্ষু রোগীকে হাসানোর শক্তি স্ময়ং চার্লি চ্যাপলিনেরও নেই। এই হাঁসি একজন ডাক্তারই হাসাতে পারে।

কেউ ডাক্তারের পাছায় দুম করে একটা লাথি মারলে, মরা রোগীও শরীর দুলিয়ে হাসে। কিছুই করার নাই। হাতি গর্তে পড়েছে। ডাঃ মতিনের রাগ হওয়ার কথা। আশ্চর্য! একটুও রাগ লাগছে না।

বরং একটু খুশী খুশী লাগছে। নতুন অভিজ্ঞতা। কুকুরের প্রধান খাদ্যের স্বাদ আজকে কিছুটা পেলেন। অভিজ্ঞতা মন্দ না। ওয়াশ রুমে যাওয়ার সময় শরীর দোলানো রোগীকে একবার গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘বরাহ শাবক।

’ মুমুর্ষু রোগী আবার হেসে উঠল। খিচ খিচ হাঁসি। ডাঃ মতিনও মনে মনে হাসলেন। এই গালিটা ইচ্ছামত ব্যবহার করা যায়। সবাই বুঝতে পারে না।

‘শুয়োরের বাচ্চা” না বলে বরাহ শাবক। অথচ গালিতে পরিপুর্ন পরিতৃপ্তি। বিপরীত পক্ষের প্রতিক্রিয়াও শুন্য। কৃষ্ণের বাশিঁও বাজল না, রাধাও নাচল না। আজ সন্ধ্যায়, কেবিনে কোন রোগী নেই।

প্রথম বেডে মাত্র একজন লোক বসে আছে। পায়ের উপর পা রেখে ঝাঁকাচ্ছে। মনে হচ্ছে দখিনা বাতাস খাচ্ছে। দক্ষিন দিকের জানালাটাও খোলা। লোকটা বয়সে তরুন।

চোখে সানগ্লাস। রাতের বেলা চোখে সানগ্লাস পরা লোকরা সাধারনত পাগল বা অন্ধ হয়। এই তরুনকে পাগল পাগল লাগছে না। অন্ধ টাইপ কিছু হতে পারে। চোখে সানগ্লাসটা খুব সুন্দর মানিয়েছে।

মনে হচ্ছে সানগ্লাস গভীর রাতে পরার জন্যই তৈরি হয়েছে। ডাঃ মতিন অবাক হয়ে কিছুক্ষন তরুনটির দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভয়ংকর সুন্দর একজন তরুন। তার জীবনে দেখা সেরা সুন্দর ছেলেদের একজন। ভয়ংকর সৌন্দর্যে কিছুটা ত্রুটি থাকে।

সুন্দর প্রজাপতির জন্ম হয় বিদঘুটে শুয়োপোকা থেকে। বেলী ফুলের গন্ধে সাপ আসে। অতিসুন্দর গোলাপেও শক্ত কাটা থাকে। এই তরুন সুদর্শন ছেলেটিরও নিশ্চয় কাটা আছে। নিশ্চিত ভাবেই আছে।

এই মুহুর্তে কাঁটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ডাঃ মতিন তরুনটির কাছে এগিয়ে গেলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, 'পা ঝাকাচ্ছেন কেন? মৃগী রোগ আছে?’ তরুন ছেলেটি হেসে জবাব দিল, 'না। ' 'তাহলে ঘটনা কি ? এটা কি সিনেমা হল, যে আগে থেকে টিকেট কেটে বসে আছেন? রোগীদের বেড দখল করার মানে কি?' ডাঃ মতিনের দিকে তাকিয়ে তরুনটি আবার হাঁসি দিল। তিনি অবাক হলেন।

মুক্তো জিনিসটা এখনো দেখা হয় নি তার। এই হাঁসি মাখা দাতের কাছে মুক্তো নির্ঘাত ফেল। হাঁসি দেখে মনে হল আমাবস্যার গভীর অন্ধকারে এক সেকেন্ডের জন্য সুর্য উঠে আবার অস্ত গেল। এই বিরল দৃশ্য দেখে যে কারো মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা। আশ্চর্য! ডাঃ মতিনের মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল।

মেজাজের একটা গ্রেড তৈরি করা যেতে পারে। এখনকার মেজাজ নির্ঘাত এ গ্রেড। ছেলেটিকে ধমক দিয়ে বললেন, 'এখানে ক্লোজ-আপের বিজ্ঞাপন শুটিং হয় না। হাঁসি দিয়ে লাভ নাই। দাঁত বন্ধ।

দাঁত বন্ধ। ' তরুনের মুখে আবার হাঁসি। ডাঃ মতিনের মেজাজ আরো গরম হয়ে গেল। এবারকার মেজাজ এ গ্রেড ছাড়িয়ে এ প্লাস। সর্বোচ্চ সীমা।

স্ট্রোক হবার সমুহ সম্ভাবনা। ডাঃ মতিনের হাইপারটেনশন আছে। বংশগত। 'ওয়ার্ড বয়... ওয়ার্ড বয়...’ তিনি চিৎকার করে ওয়ার্ড বয়কে ডাকলেন। ওয়ার্ড বয় ছুটে আসল।

হতদ্বন্দ হয়ে বলল, 'কি মামা?' ডাঃ মতিনের মেজাজ আবার চরমে ঊঠল। 'আমি তোর কোন কালের মামা রে? আমার বাপের নাম জানিস?’ 'না। ' 'কি বলিস রে? দুলা ভাইয়ের নাম জানিস না, আমাকে মামা বলে ডাকছিস কেন? তোর বোনের নাম বল। ' 'সরি মামা। ' 'আবার?' 'দুঃখিত স্যার।

' ‘দুঃখিত হওয়ার এখানে কিছু হয় নাই। এই বদ পুলাটারে বিদায় কর। শুধু চোখের সামনে থেকে নয়। একেবারে স্বাস্থ্য-কমপ্লেক্স থেকে। ' 'কি কন মামা?' ডাঃ মতিন বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটা এভাবেই চলবে।

চতুর্থ শ্রেনীর কর্মচারীদের মাথায় 'মামা' চক্রটা ঢুকে গেছে। এই চক্র থেকে এরা কোনদিন বের হতে পারবে না। এরা বিশাল বেয়াদব। তরুন ডাক্তারদের বলে মামা আবার তরুনী ডাক্তারদের বলে আপু। আপু ডাকার সময় আলাদা একটা সুর বাজায়।

অমায়িক একটা হাঁসি দেয়। বিশাল বেয়াদব!! বিশাল বেয়াদব!! ডাঃ মতিন গম্ভীর স্বরে বললাম, ‘কি কন মামা নয়, ব্যাটা। এরে ধরে নিয়ে তিনতলায় যা। ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দে। ’ ‘হায় হায়, মামা!’ ‘হায় হায় করিস কেন বান্দর? তোকেও ফেলে দেওয়া দরকার।

নইলে ভালো হবি না। হারামী, তোরা সবকটা হারামী। হারামী বাচ্চা হারামী। ক্যাটক্যাট করে হাসবি না। পালা।

’ ‘আমি পালালে এরে ধাক্কা দিয়া ফেলবে কে?’ ডাঃ মতিন ধাক্কার কথা শুনে নিজেই ধাক্কা খেলেন। অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলবি?’ ‘এই বদ পুলাটারে। ’ ওয়ার্ড বয় আঙ্গুল তুলে তরুন সুদর্শন ছেলেটার দিকে ইঙ্গিত করল। ডাঃ মমিন চোখদুটো ছোট করে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কস কি মমিন? ধাক্কা দিয়ে ফেললে তো এ মরে যাবে। ’ ‘আপনিই তো কইলেন।

এই হারামজাদা রোগীটাকে ধাক্কা দিয়া পাঁচতলা থেকে ফেলে দিতে। ’ ‘আমি বলেছি নাকি? আমার সাথে হিড়িং বিড়িং? রোগীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলবি মানে কি?’ ‘আপনি তো কইলেন। ’ ‘আবার? আমি বললেই কি ধাক্কা দিয়ে ফেলে মারবি? রোগীর প্রতি তোদের ন্যুনতম শ্রদ্ধাবোধ নেই। মাফ চা। ’ ‘কি কন স্যার?’ মামা থেকে সম্বোধন এখন স্যারে পৌছেছে।

‘কি বলছি মানে? শুনতে পাস না?’ ওয়ার্ড বয় হতভম্ভ। পৃথিবীর নির্মমতা দেখে সে বিস্মিত। চোখে জল এসে পড়েছে। একজন অনাত্মীয় তরুন ছেলের চোখে জল দেখেও যে মেজাজ দেখায় সে মনুষ্য গোত্রের অন্তর্ভুক্ত নয়। এটা ডাঃ মতিনের নিজস্ব মতামত।

তিনি কিঞ্চিত লজ্জিত বোধ করলেন। লজ্জা চেহারায় ফোটানো যাবে না। এইসব ওয়ার্ড বয় কচ্ছপ শ্রেনীর। একবার দয়া দেখালে শরীর খামচে ধরে থাকবে। টেনে মাথা ছিড়ে ফেললেও ছাড়বে না।

কয়েকদিন পর যদি বলা হয়, ‘তুমি ডিউটি রুমে বসে কি করছ? বাইরে যাও। রোগীর কি দরকার জেনে নাও। ’ এরা ভ্রুক্ষেপ করবে না। লম্বা একটা হাই তুলে বলবে, ‘স্যার, আর কিছুক্ষন থাকি না স্যার। এসির বাতাস তো, মেলা ভালো।

বাইরে কি গরম! আমার আবার স্যার গরমে এলার্জি। ঘামাচি হয়। ’ যদি দয়া দেখানো হয়, আবার খামচে ধরবে। ছাতাটা দিলে ঘোড়াটাও চাইবে। কাছে এসে ওয়ার্ড বয় বলবে, ‘স্যার, আমার গায়ে বড্ড ঘামাচি।

মেরে দিন না। বউরে কইলে দেয় না। বেজার ভাবে। আইজ ওয়ার্ডে রোগী নাই। বইসা বইসা কি করেন? পীঠের ঘামাচি মারেন।

টাইম কামে লাগান। আল্লায় দিছে মাশাল্লাহ ভালো ঘামাচি আমার পীঠে। টিপবেন আর পট পট করে ফাটবে। শব্দটা মন্দ না, বড় মধুর। নেশা নেশা ভাব আইসা পড়ে।

কি কন, স্যার? এই রকম ওয়ার্ড বয় জন্মানো ঠিক হবে না। এদের ঝাড়ির উপর রেখে সোজা করতে হবে। লোহা গরম থাকতেই হাতুড়ী মারতে হবে। দয়াকে ঝাটাপেটা করে বিদায় করতে হবে। অবাধ্য ওয়ার্ড বয়দের জন্যও মোক্ষম ওষুধ আছে।

ডাঃ মতিন অষুধটা পুশ করলেন। সুদর্শন তরুনটার সামনে বললেন, ‘আজ আপাতত কোন কাজ নেই তোমার। ’ ওয়ার্ড বয়ের মুখে হাসির ঝিলিক। কাজ না থাকলে খুব খুশী। তিনি আবার বললাম, ‘‘দশ নাম্বার বেডের রোগীটার পিশাপ বন্দ হয়ে গেছে।

ক্যাথেটার করে দিয়ে যাও। ’ ওয়ার্ড বয় এবার হতভম্ভ হল। মুখটা হা হয়ে গেল। ঘোলা পানিতে এসে পড়লে মাছ যেমন উপরে উঠে খাবি খায়, তেমন করতে লাগল। একটা রোগীর সামনে এরকম ভাবে অপমান, সে ভাবতেও পারছে না।

একেবারে আত্ম-সম্মানের মুল ধরে টানাটানি করা হচ্ছে। মাথা নিচু করে ওয়ার্ড বয় চলে গেল। অষুদটা ভালো কাজ করেছে। অবাধ্য কর্মচারীদের জন্য কোরামিন ইঞ্জেকশন। ডাঃ মতিন তরুন রোগীটার দিকে তাকালেন।

মুখে এখনো হাঁসি। তার মেজাজ আরেকবার খারাপ হয়ে গেল। বিপদ আর মেজাজ দুইটা বিষয়ই সৃষ্টিকর্তার অদ্ভুত সৃষ্টি। একবার আসলে বারবার আসতেই থাকবে। একটা অদৃশ্য চক্র সৃষ্টি করে জড়িয়ে থাকে।

আমরা সবাই এর মধ্যে বন্দী হয়ে যাই। যতই বের হওয়ার চেষ্ঠা করে, ততই জালের মত পেঁচিয়ে যাই। সেটা হতে দেওয়া যাবে না। ডাঃ মতিন গলায় যথাসম্ভব মধু ঢাললেন। তরুনটির কাছাকাছি গিয়ে বললেন, ‘এই অধম ডাক্তার বান্দা হাজির।

বল বাবা, তোমার জন্য কি করতে পারি?’ ডাঃ সাহেবের অদ্ভুত ব্যবহারে সে ভড়কে গেল। মুখের হাঁসি বদলে গেল। অবাক হয়ে ডাক্তারের দিকে তাকাল। ডাঃ মতিন মনে মনে প্রচন্ড খুশী হলেন। আবেগ ছোঁয়াচে রোগ।

অবাক হওয়ার আবেগী বিষয়টা তরুনটির মধ্যে তিনি ছড়াতে পেরেছেন। এখন এই তরুন পেঁচিয়ে যাবে। ভড়কে যাওয়া মানুষের মুখ দেখতে ডাঃ মতিনের সব সময়ই ভালো লাগে। অদ্ভুত সুন্দর একটা বিষয় তখন মানুষের মুখে খেলা করে। ভড়কানোর জন্য সব ধরণের অস্ত্র প্রয়োগ করা শুরু করলেন।

‘তা বাবা, কি হেতু আসিয়াছ কহ বিস্তারিয়া?’ তরুন রোগী নিশ্চয় এমন ব্যবহার আশা করছে না। বাংলাদেশী ডাক্তাররা রোগীদের কাছে আসবে। দুই তিনটা ধমক দিবে। কান ধরে টানাটানি করবে। পেটের মাঝে স্টেথো লাগিয়ে গুতাগুতি করবে।

অসুখ অর্ধেক ভালো হয়ে যাবে। অথচ তার সামনের এই মেজাজী ডাক্তার তা করছে না। বিপদের সমুহ সম্ভবনা আছে। এই অবস্থায় তরুনটি আরো ভড়কে গেল। তার ভড়কানো মুখ উপভোগ করতে শুরু করলেন ডাঃ মতিন।

ফাইনাল ডোজ ও অব্যর্থ মরনাস্ত্রটা এবার বের করলেন। তীরটা তূনে লাগিয়ে নিক্ষেপ করলেন। ‘আপনি কি জানেন, এই বেডগুলো সাধারন রোগীদের জন্য নয়?’ তরুন মাথা নাড়াল। ‘জানেন? তাহলে এখানে বসে কার ...... ছিড়ছেন? (শুন্যস্থানে বুদ্ধিমান পাঠকরা ‘ব’ বর্গীয় শব্দ বসিয়ে নিয়েছেন নিশ্চয়?) হাসপাতাল হাওয়া খাওয়ার জায়গা না। বাইরে যান।

’ তরুনটি এবার মৃদু হাঁসি হাসল। ছোট্ট একটা আশাভঙ্গ হল ডাঃ মতিনের। তিনি তরুনকে ভড়কে দিতে ব্যর্থ হয়েছেন। এবার তিনি হাটা শুরু করলেন। চেম্বারে ঢুকবেন।

কিছুদূর যাওয়ার পর সুদর্শন তরুনটি পিছু ডাক দিল, ‘স্যার, আমি নিজেই রোগী। লিউকেমিয়া। আজ রাতেই ভর্তি হলাম। এই বেডটা আমার। ’ বিস্ময়ে হতভম্ভ হওয়া মানুষের মুখ দেখে ডাঃ মতি অভ্যস্ত।

অথচ তিনি নিজে বিস্মিত হয়ে গেলেন। আশ্চর্য! একটা সুদর্শন তরুন তাকে বিস্ময়ে হতভম্ভ করে দিল। ডাঃ মতিন সারারাত ডিউটি রুমে বসে থাকলেন। ঘুমাতে পারলেন না। শেষ রাতে মাকে ফোন দিলাম।

এতো রাতে ফোন পেয়ে ডাঃ মতিনের মা মিসেস সায়রা বানু ভয় পেয়ে গেলেন। বারবার জিজ্ঞাসা করছেন, ‘কি হয়েছে বাবা?’ ডাঃ মতিন হাসলেন। মিথ্যা হাঁসি হাসতেও যে কষ্ট করতে হয়, আজই প্রথম জানতে পারলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘তোমার সাথে কিছু কথা বলব মা। চুপচাপ শুনে যাবে।

আমি তোমার কাছে কোন সিদ্ধন্ত নিতে চাই না। সিদ্ধান্ত আমি আগেই নিয়েছি। ‘কি বাবা?’ ‘মা তোমার মনে আছে, আমাদের বাসার বিড়ালটার কথা? অসুস্থ ছিল? ওটার অসুস্থতা সহ্য করতে না পেরে অদ্ভুত একটা কান্ড করেছিলাম?’ ‘আছে বাবা। ’ মিসেস ছায়রা বানু শিউরে উঠলেন। তার ছেলে অনেক দিন আগের একটা সাধারন ঘটনা আবার তাকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে কেন? গভীর রাতে গরমের মধ্যেও তার শরীরে কাটা দিয়ে উঠল।

কার্তিক মাসের গরমে শরীরে কাটা দেওয়ার কথা নয়। তিনি বললেন, ‘তুই কি করেছিস বাবা?’ ‘আমি তোমাকে চুপ থাকতে বলেছি মা। আর প্রত্যেকটা কথায় “বাবা বাবা” বলবে না। নিজেকে বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে। বাচ্চা মানুষরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।

আমি নিয়েছি। জীবনের সবচাইতে বড় সিদ্ধান্তটা কিছুক্ষন আগেই নিয়েছি। ‘কি হয়েছে তোর বাবা?’ ডাঃ মতিন প্রচন্ড কষ্ঠে কান্না চেপে বললেন, ‘তুমি কেমন আছো মা?’ মধ্যরাতে একজন বাইশ বছরের তরুন যদি মাকে ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে বুঝতে হবে বিষয়টা মারাত্মক কিছু। মিসেস ছায়রা বানু ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মনে হল জীবন থেকে কিছু একটা হারিয়ে গেল।

হারানো জিনিসটা কি হতে পারে? শেষরাতে ডাঃ মতিন একা একা চেম্বারে বসে আছেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এতো রাতে বাইরের কেউ থাকার কথা না। কর্মচারীরা ঘুমিয়ে পড়েছে। জেগে আছে তিনজন পুরুষ। ডাঃ মতিন, ওয়ার্ড বয় ও তরুন রোগী।

ডাঃ মতিন ভাবতে শুরু করলেন। কিছুখন পরপর মুখ মুছছেন। গরম লাগছে। ঘেমে যাচ্ছেন। দুনিয়ার সবকিছুই আজব।

এই ঠান্ডা এই গরম। কিছুক্ষন আগেও তাকে প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছিল। তিনি বাংলা ব্যাকরনের রদবদল করার সিদ্ধান্ত বদলালেন। “কার্তিকের শীতে ডাক্তার মতিন কাপে” কথাটা আবার বদলাতে হবে। সঠিক বাক্য হবে, “কার্তিকের গরমে, ডাঃ মতিন ঘামে”।

আহ! ছন্দ জ্ঞান মন্দ নয়! উপমার একেবারে ঠিক ঠিক প্রয়োগ। প্যাঁচে প্যাঁচে প্যাচানো। তিনি ভাবছেন। ভাবনা এখন দর্শনের পথ অতিক্রম করছে। সৃষ্টিকর্তা মানুষের সৃষ্টি করেছেন অনেকগুলো প্যাঁচের মাধ্যমে।

পেটের ভেতর নাড়ী-ভুড়ির প্যাঁচ, মাথায় নিউরনের প্যাঁচ, কানের ফুটোর মধ্যে প্যাঁচ, চিন্তার প্যাঁচ। জন্মের পর প্যাঁচানো একটা পৃথিবীতে আমাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। প্যাঁচ খুলতে গিয়ে আরও পেঁচিয়ে যাই। তার ধারনা, তার নিজের কান আর মস্তিষ্কের প্যাঁচটা নেই। একটা লম্বা ফাপা টানেলের মতো।

আবেগের কিছু সহসেই সরাসরি মাথায় ঢুকে যায়। একজন সুদর্শন তরুন এভাবে একটা মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হতে পারে, ডাঃ মতিন মানতে পারছেন না। জীবনের সবচাইতে সুন্দর সময়টাতে এসে তাকে শেষ দিনের জন্য অপেক্ষা করতে হচ্ছে। নিশ্চিত মৃত্যুর পথ চেয়ে বসে থাকতে হবে। মন কোনভাবেই সায় দিচ্ছে না।

তিনি জানেন, এই অসুখটা তরুন বয়সেই বেশী হয়। খুব ভালোভাবেই জানেন। লিউকেমিয়া নামক পরিচিত রোগটা তার চিন্তাধারাকে বদলে দিল। দীর্ঘদিন হাসপাতালে আসা-যাওয়া করছেন। মৃত্যু বিষয়টা এতদিনে তার কাছে ডাল-ভাতে মতো হওয়া উচিৎ ছিল।

কিন্তু হলো না। হয়েছে নতুন গাভীর দুধের পায়েস। এই পায়েস বছরে একবারই হয়। ছোট্ট একটা জীবন। একে সুন্দর করে সাজানোর দায়িত্বও মানুষের।

নিশ্চিত নিদ্রাদেবীর কোলে আমাদের সবাইকে ঢলে পড়তে হবে। অনন্তকাল সবাইকে ঘুমাতে হবে। ইহজগতের ঘুমে যেমন স্বপ্ন দেখে মানুষ, পরজগতের ঘুমেও সেইভাবে স্বপ্ন দেখবে। নিশ্চিতভাবেই দেখবে। ডাঃ মতিন চাচ্ছেন, সুন্দর কিছু মুহুর্ত আর সুন্দর কিছু মানুষের ছবি সাজানো থাকুক মাথায়।

অনন্তকাল একা একা শুয়ে থাকবে আর স্বপ্ন দেখবে। ছোট্ট জীবনে এরকম বিয়োগের স্মৃতিগুলো মাথায় না থাকুক। থাকুক না জমা কিছু সুন্দর মুহুর্ত। সুদর্শন তরুন ছেলেটির মৃদু হাসিটায় থাক, রোগ আর মৃত্যুভিতীটা নয়। ডাঃ মতিন দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন।

কোথাও যেতে হবে তাকে। দুঃখের কাছ থেকে, দুঃখময় জিনিসগুলোর কাছ থেকে অনেক দূরে। শুরু করতে হবে বিশেষ একটি নাটক। যে নাটকটি তিনি মঞ্চস্থ করলেন কিছুক্ষন আগে। নাটকের প্রধান তিনটি চরিত্র ডাঃ মতিন, ওয়ার্ড বয় ও সুদর্শন তরুন।

মানুষের প্রধান দুর্বলতা হলো, সবাই দুঃখের কাছ থেকে পালাতে চায়। বিষয়টা মন্দ না। বাঁচতে হলে পালাতে হবে। ডাঃ মতিনও পালাবে। য পলায়তি, স জীবতি এই পর্যন্ত কথাগুলো বলে থেমে গেল ভোলানাথ।

২ আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পানির সাথে আলোকসজ্জা। ঘনঘন বিজলী চমকাচ্ছে। মীকাইল ফেরেসতাকে সৃষ্টিকর্তা কি নির্দেশ দিয়েছেন অনুমিত করা যাচ্ছে না।

দীর্ঘদিন থেকে এরকম বৃষ্টি হয় নি। হুড়মুড় করে আকাশ ভেঙ্গে পড়া বৃষ্টি। বারান্দায় বসে বসে আমি বৃষ্টি দেখছিলাম। বাসায় কেউ নেই। আমার স্ত্রী বাচ্চা-কাচ্চাদের নিয়ে তিন দিনের সফরে গেছে।

গন্তব্যস্থল তার বাবারবাড়ী। যাওয়ার সময় কিছু কড়া কথাও শুনিয়ে গেছে। একজন মধ্যবয়স্ক অসুস্থ মানুষের সাথে এক ছাদের তলায় ভালোবাসাবাসি করা তার পক্ষে অসহ্য। মৃত্যু পথযাত্রীর সাথে থাকাতো আরও ভয়ানক। আমার স্ত্রী চায় না, আমার অকাল মৃত্যুতে তার বাচ্চারা গভীর শোক পাক।

বাচ্চা-কাচ্চাদের কচি মনে শোকের বাতাস লাগলে তারা মানুষ হতে পারবে না। তার ধারনা অসময়ে পিতৃহারা ছেলেরা মানুষ হয় না। গুন্ডা হয়। রাত দুপুরে রাস্তাঘাটে খুন-খারাবী করে বেড়ায়। এরশাদ শিকদারের বাবা নাকি বাল্যকালে মারা গেছে।

আশ্চর্য! আমার একটুও খারাপ লাগছে না। বউ-বাচ্চাছাড়া জীবনটা মন্দ যাচ্ছে না। একা একা থাকার মাঝে গভীর জীবনবোধ আছে। আমি সেই বোধের সন্ধান পাচ্ছি তিনদিন থেকেই। ক্যান্সারের সাথে বসবাস করছি।

কিছুদিনের মধ্যেই কুলহীন সাগরে পাড়ী জমাব। ভজঘন্ট পৃথিবীতে আর থাকতে হবে না ভেবেই ভালো লাগছে। মনের মাঝে একটা স্ফুর্তি স্ফুর্তি ভাব চলে এসেছে। আমি গুনগুন করে গাইলাম, ‘ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে...’ ঘরের চাবি ভাঙ্গার কি আছে বুঝলাম না। তালা ভাঙ্গা যেতে পারে অথবা দেয়াল।

কবিদের মন বোঝা বড় দায়। আমি কবিদের মন বোঝার মতো মস্তিষ্ক নিয়ে জন্মাই নি। আমাকে একজন মেথর সম্প্রদায়ের মানুষ বুঝতে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। গল্পকথক ভোলানাথ একজন মেথর। লোকটাকে আমি কিছুদিন থেকে দেখছি।

সিটি কর্পোরেশনের পেশাদার লোক। কয়েকদিন আগেই চাকুরী পেয়েছে। আমাদের মহল্লার দায়িত্বে আছে। চেহারা ভদ্রলোকের মতো দেখে বাসায় ডেকে এনেছি। বাথরুমের সেফটি ট্যাঙ্কটা পরিষ্কার করাব বলে।

অনেক কাজের লোক। সেফটি ট্যাঙ্কের কথা বলতেই রাজী হয়ে গেল। দুই একদিন পরেও আসতে পারত। তা করে নি। আগাম না জানিয়েই আজকে বৃষ্টির দিনে এসেছে।

এসেই সেফটি ট্যাঙ্কটা খুলে রেখেছে। আমি দুর্গন্ধে নিঃশ্বাস নিতে পারছি না। মেথররা সেফটি ট্যাঙ্ক খুলে তাতে কেরোসিন ঢেলে রাখে। তাতে দুর্গন্ধ অনেকটা কমে যায়। ভোলানাথ কোরোসিন ঢালে নি।

কাজটা যে খুব আগ্রহ করছে তাও মনে হচ্ছে না। নাক কুচকানো দেখেই মনে হচ্ছে এই লোক সেফটি ট্যাঙ্ক পরিষ্কারের জন্য পৃথিবীতে আসে নি। কেন এসেছে সেটা ধাধা। আমার সামনেই মাটিতে বসে আছে ভোলানাথ। মুখ থেকে ভকভক করে মদের গন্ধ আসছে।

চেলা মদের মতো গন্ধ। মেথরদের একমাত্র শক্তি মদ। প্রচলিত আইনে জমি কিনতে পারে না তাই উপার্জনের সমস্ত অর্থ এরা মদ আর নারীর পেছনে ঢালে। মদ না খেলে নেশা হবে না। নেশা না হলে সেফটি ট্যাঙ্ক পরিষ্কার হবে না।

নেশা করার পর এরা কবর থেকেও লাশ তোলে। আমাদের গ্রামে একবার একটা খুন হলো। একটা সুন্দরী তরুনীকে কেটে দুই টুকরো করা হয়েছে। দাফন করার তিনদিন পর পুলিশ আসল। লাশ তুলতে হবে।

নতুন করে পোস্ট মর্টেম হবে। এক মেথর প্রচুর মদ্যপানের পর কবরে নামল। কবরে নেমেই তার নেশা চরম আকার ধারন করল। কবর থেকে লাশ উঠল কিন্তু মেথর উঠবে না। তার শেষ ইচ্ছা, খালি কবরে যেন তাকে মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়।

কবর নাকি খুব ঠান্ডা। এসির মতো ঠাণ্ডা। তার বাড়ীতে এসি নেই। যারা নিজেরা গোছানোভাবে সুন্দর কথা বলতে পারে না, তাদের একটা বদভ্যাস থাকে। অন্যদের ডেকে ডেকে গল্পের আসর বসানো।

আমি নিজে এই শ্রেনীর। সাজিয়ে কথা বলতে পারে বলে কাজের আগে ভোলাকে ডেকে গল্প করছি। ভোলা সাজিয়ে গল্প বানাতে পারে। ভোলার গল্প শেষে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ডাক্তার মতিন কিসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? কিছু বুঝতে পারলাম না। ’ ভোলা বলল, ‘ডাক্তারী ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত।

’ ‘কেন?’ আমি চোখ সরু করে জিজ্ঞাসা করলাম। ‘এটা এমন আর কি যে ডাক্তারী ছেড়ে দেওয়া লাগবে? হর-হামেশায় তো ঘটছে ব্যাপারগুলো?’ আমি ভোলার দিকে তাকালাম। তার চোখগুলো টকটকে লাল। চেলা মদের গুন। নেশা জমে যাচ্ছে।

ভোলা চোখ বন্ধ করল, ‘অবশ্যই ঘটছে। কিন্তু সব ঘটনার গতিপথ এক হবে কি?’ ‘তা হবে না। কিন্তু সামান্য একটা লিউকেমিয়ার রোগী দেখে তো আর দুঃখে এমন একটা পেশা ছেড়ে দেওয়া যায় না। ’ ভোলা একটু কাছে এসে বসল, ‘যায় না কে বলেছে। কারো কারো কাছে যায়।

এরা পৃথিবীর সত্যিকারের রুপটা বুঝতে পারে। প্রচন্ড সাহসী আর একরোখা হয় এরা। এদের কাছে ডাক্তারীও যা মেথরিগিরিও তা। ’ আমি মাথা ঝাকাতে শুরু করলাম। ‘এই কথা মানা যায় না, তবুও খটকা লাগছে।

’ ভোলা কিছুক্ষন সেফটি ট্যাঙ্কটার দিকে তাকিয়ে থাকল। আস্তে করে উত্তর দিল, ‘খটকা লাগারই কথা। আমারও লেগেছিল। সুদর্শন তরুন একটা ছেলে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করতে পারে না। অপেক্ষার মুহুর্ত বড় কষ্টকর।

এই কষ্ঠ দেখতেও কষ্ট। অপেক্ষা শুরুর আগেই ডিউটি ডাক্তার সেই কষ্ঠ দূর করে দিয়েছে। ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জে বাতাস ভরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেই রাতেই তরুনটির অপেক্ষার মুহুর্ত ফুরিয়েছে। ’ আমি হাহা করে হেসে উঠলাম।

সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন রকিং চেয়ারে। দীর্ঘদিন যাবত তিনি নিজেও ক্যান্সারে ভুগছি। কোলন ক্যান্সার। এই টাইপের ক্যান্সার অভিজাত সম্প্রদায়ের। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর কোলন ক্যান্সার বিখ্যাত হয়ে গেছে।

অভিজাত শ্রেনীতে নাম লিখিয়েছে। আমি বললেন, ‘বাহ! বেশ ভালো গল্প। ডাক্তার সাহেব সাইকো রোগী ছিলেন। মৃত্যু পথযাত্রী রোগীর মৃত্যুর অপেক্ষা সহ্য করতে পারতেন না। রোগীর কষ্টের কথা ভেবে পরোপকার করেছেন।

রোগীকে মেরে ফেলেছেন। ডাক্তার সাহেব সমাজ সেবী সাইকো রোগী। তুমি কি সাইকো বোঝ? সহজ ভাষায় বলা হয় মাথায় গণ্ডগোল। ’ ভোলা কন্ঠটাকে গম্ভীর করল। একটু কাছে এসে বলল, ‘অসম্ভব।

ডাক্তার মতিন সাইকো রোগী হতে পারে না। সব কিছু সাজানো গোছানো ছিল। সেদিনের হাসপাতালের হাজিরা খাতায় ডাঃ মতিনের জায়গায় ডাঃ কাদেরের স্বাক্ষর ছিল। পুলিশ ডাঃ কাদেরকে ধরে ফেলে। কিছু টাকা খাইয়ে ওয়ার্ড বয়কে মিথ্যা কথা বলতে বাধ্য করেছিল মতিন।

’ আমি হুড়মুড় করে উঠে পড়লাম। কিছু একটা ঘটছে। খুব অগোচরে। বোঝা যাচ্ছে না। তবে কাজটা যে খুব গোছানো তা বুঝতে আমার দেরী হলো না।

আমি উৎকন্ঠা মাখানো কন্ঠে বললাম, ‘তুমি কিভাবে জানো এতো কিছু। আমার মনে হচ্ছে এটা কোন গল্প নয়। ’ ভোলার চোখগুলো ধক করে জ্বলে উঠল। হিসহিস করে উঠল তার গলা। দাড়িয়ে পড়ল।

এগিয়ে আসল আমার দিকে। ভরাট গলায় বলল, ‘নিজের গল্প সে নিজে জানবে না তা কি করে হয়?’ আমি বিস্ময়ে ফেটে পড়লাম। দ্রুত বুঝতে পারলাম কি ঘটতে যাচ্ছে। সুদর্শন তরুনের ব্যাপারটা ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। একজন সাইকো রোগীর মানসিক যন্ত্রনার উপশম।

সাইকো রোগীদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো একই ঘটনা এরা বারবার ঘটানোর চেষ্ঠা করবে। সুদর্শন তরুনটিরও ক্যান্সার ছিল, আমারও আছে। দুজনই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আজকের ঘটনা কি একই সুত্রে গাথা হচ্ছে? হতেও পারে। ভোলানাথ আমার দিকে আরো এগিয়ে আসছে।

আমি প্রচন্ড ভয়ে চিৎকার করে বললাম, “তুমি কে?’ হীম শীতল গলায় ভোলা উত্তর করল, ‘তাতে কি আসে যায়? ভোলানাথকে নিশ্চয় ডাঃ মতিন ভাববেন না। একজন মেথর কি ডাঃ মতিন হতে পারে?’ আমি আবার প্রচণ্ড জোরে চিৎকার ছেড়ে বললাম, ‘পারে...... হতে পারে......। ’ আমার গলার শব্দ শুনে আমি নিজে ভয় পেয়ে গেলাম। শব্দের পরিবির্তে শুধু ফিসফিস করে বাতাস বের হচ্ছে মনে হল। আশেপাশে কেউ নেই।

চিৎকার দিয়েও লাভ নেই। কেউ আসবে না এই সময়। প্রচন্ড বৃষ্টি হচ্ছে। অন্ধকারে ডুবে আছে মহল্লা। সেফটি ট্যাঙ্ক দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।

আশেপাশের মানুষজনকে কোটি টাকা দিলেও আসবে না। কেউ জানবে না এখানে কি ঘটছে। নাটকের জন্য সুন্দর একটা সাজানো সেট। কেউ নিপুন হাতে সাজিয়েছে। আমি অপেক্ষা করছি।

ভোলা আমার দিকে এগিয়ে আসছে। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সে মিথ্যা বলে নি। তার চোখে স্পষ্ট পরিচয়। ডাক্তার মতিন। ডাঃ মতিন আমার দিকে এগিয়ে আসছে।

আমি তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। হাতে একটা শাবল। সেফটি ট্যাঙ্ক খুলতে এই শাবল ব্যবহার করা হয়। ৩ ডায়েরীর পাতা বন্ধ করলেন হাশেম আলী। ডায়েরীটা তার ব্যাঙ্কার বন্ধু জয়নাল সাহেবের।

তিনি আশ্চর্য হয়ে আছেন। এটা কিভাবে সম্ভব? একজন মানুষ এই রকম কঠিন পরিস্থিতিতে ডায়েরী কিভাবে লিখবে? তিনি ঘটনার স্বপক্ষে যুক্তি খুজতে শুরু করলেন। অত্যন্ত বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য তিনি কোন যুক্তি জানেন না। তিনি ছাত্রাবস্থায় বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। হাশেম আলী ডায়রীটা পেয়েছেন জয়নালের রকিং চেয়ারের নিচে।

পুলিশের চোখ এড়িয়ে খুব সাবধানে তুলে নিয়েছেন। ডায়েরীটা খোলা অবস্থায় পড়ে ছিল। কয়েকদিন আগে তার একমাত্র ব্যাঙ্কার বন্ধু জয়নাল খুন হয়। খুন হয়েছে নিজের বাসায়। রকিং চেয়ারে লাশটা পড়ে ছিল।

মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখে বোঝা যায়, আঘাতটা রডের। শাবল-টাবল কিছু একটা হতে পারে। Written By: রাজীব হোসাইন সরকার

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।