সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
মংডু। মিয়ানমারের(বার্মা) একটি জেলা শহরের নাম। যা আমাদের টেকনাফ সীমান্তের ঠিক ওপারেই অবস্থিত। কয়েক বছর আগে আমি একবার মংড়ু ভ্রমনে গিয়েছিলাম। আমার অন্য ভ্রমন পিয়াসী বন্ধুরা বলে-"ভিন্ন দেশের রাজধানীতে না গেলে সেই দেশ ভ্রমনের তালিকায় স্থান দেয়া ঠিকনা"।
আমি ওদের কথার সাথে একমত নই। আমি আমার ভ্রমনের তালিকায় মংডুকেও একটা দেশের মর্যাদা দিয়ে রেখেছি। পরবর্তীতে আমি অবশ্য ব্যবসায়ীক কারনে মিয়ানমারের রাজধানী ইয়াংগুন(রেংগুন) ভ্রমন করেছি ৩ বার।
নাফ নদীর ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন(পুর্বের নাম আরাকান)রাজ্যের একটি জেলা শহরের নাম মংডু। পাঁচ লক্ষাধিক জনসংখ্যার মধ্যে ৭৫% মুসলিম, বাকিরা বৌদ্ধ ধর্মামবলী মগ জাতির বসবাস।
মংডু প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভুমি নাহলেও শাল-শেগুন-চন্দন গাছের অত্যন্ত সুন্দর বাগান ঘেড়া শহর, অত্যন্য আকর্ষনীয় স্থান। যদিও মিয়ানমারের সামরিক সরকার পর্যটকদের তেমন ভাবে মিয়ানমার ভ্রমনের আগ্রহ দেখায়না তবে বানিজ্যিক উদ্ধেশ্যকে সাধুবাদ জানায় জান্তা সরকার। মিয়ানমার নিদেন পক্ষে মংডু ভ্রমন করতে অনেক সাহসের দরকার। সেই হিসাবে আমাকে একজন সাহসী মানুষ ভাবতে পারেন। কারন, আমি একবার নয় তিন বার মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন এবং একবার মংডু ভ্রমন করেছি।
মংডু ভ্রমনের জন্য একধরনের বিশেষ ভিসা(পাস) প্রয়োজন। বাংলাদেশ সরকারের স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে মংডু ভ্রমনের জন্য একটা পাস বই নিতে হবে। যাতে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার ইমেগ্রেশন কর্মকর্তাদের অনুমোদন এবং স্বাক্ষর রয়েছে। বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে স্থল বন্দর কর্তিপক্ষের নিকট থেকে ৩ দিনের এনট্রি পাস(শুধু মাত্র মংডু শহরের জন্য) নেবার পর কাস্টমস কর্মকর্তা এবং বি ডি আর'র তল্লাশী শেষে ট্রলারের মংডু পৌঁছবেন। মংডু পৌঁছতে জোয়ারের সময় খরস্রোতা নাফ নদী পার হতে সময় লাগবে ৪৫ মিনিট এবং ভাটীর সময় দেড় ঘন্টার মত।
মংডু শহরটি অত্যাধুনিক শহর নয়। অনেকটা আমাদের বরিশাল কিম্বা ময়মনসিং'র মত অনেক পুরনো শহর। নৃতাত্তিক জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কে অনেক কিছু জানার জন্য এই শহরের ঐতিয্য রয়েছে। শুনেছি বাংলাদেশ থেকে নৃবিজ্ঞানের শিক্ষক-ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষা সফরে মংডুতে আসেন বাস্তব জ্ঞান এবং তথ্যানুসন্ধানের জন্য। মিয়ানমারের সরকারের প্ররোচনায় সর্বত্রই মুসলিম খেদাও প্রচলিত থাকলেও শুধু মাত্র মংডুতে ইসলাম এবং বৌদ্ধ ধর্মাম্বলীদেরে মধ্যে চমতকার সহাবস্থান বজায় আছে যুগ যুগ ধরে।
হতে পারে-এখানকার মুসলমানেরা মিয়ানমারের অন্যান্য স্থানের মুসল্মানদের চাইতে বেশী সংগঠিত-তাই এখানকার মুসলমানদের ঘাটাতে সাহস পাচ্ছেনা নাসাকা বাহিনী।
মংডুর লোকেরা তান্ত্রিকতায় খুব বিশ্বাসী। এরা এখনো মুমুর্ষ অবস্থা নাহলে ডাক্তারের কাছে সহজে যায়না। এরা ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজে বিশ্বাসী মানুষ। এখানকার বাড়ি ঘরগুলো সব শেগুন কাঠের তৈরী-দোচালা, তিন চালা টিনের ঘরগুলো দেখতে অনেকটাই ক্যাং ঘরের(বৌদ্ধদের উপাশনালয়) মত।
কোনটা যে ক্যাং ঘর আর কোনটা মানুষের বসত বাড়ি দূর থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। বিশাল আকৃতির প্যাগোডা আছে ১২ টি। আছে অসংখ্য ভাঙ্গাচোরা মাদ্রাসা মসজিদ। জান্তা সরকার এখানে মসজিদ, মাদ্রাসার সংস্কার করতে দেয়না। বরং সুযোগ পেলেই ভেঙ্গে দেয়।
চারিদিকে শুধু বিশাল বিশাল শাল-শেগুন আর চন্দন গাছের বাগান। এখানে এখনো মক্তব, মাদ্রাসা এবং মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। মংডুবাসীরা রাখাইন এবং আদী চাটগাঁইয়া ভাষায় এবং কিছু কিছু উর্দু ভাষায় কথা বলে। এখানে চা'র দোকানকে বলে ইয়ং নী, ভাতের হোটেলকে বলে বাতং নী। মুসল্মানদের হোটেলে ভাত, ভর্তা, মাছ মাংশ সবই পাওয়া যায়।
তবে এরা সবাই শুঁকটী খেতে অভ্যস্ত। মগরা স্থানীয় ভাবে তৈরী মদ পানে অভ্যস্থ। এখানে মদের দাম পানির দামের চাইতে শস্তা। টেকনাফ এলাকায় বার্মীজ মদের বিশাল বাজার। জেলা শহরে উল্ল্যেখ যোগ্য সরকারী অফিসের মধ্যে আছে মিয়ানমার বানিজ্য মন্ত্রনালয়ের জেলা অফিস, বর্ডার চেম্বার অব কমার্স অফিস এবং মিয়ানমার ইমিগ্রেশন এন্ড পপুলেশন ডিপার্ট্মেন্ট অফিস।
মংডু মুলত শেগুন এবং অন্যান্য উন্নতমানের কাঠের বিশাল মার্কেট। বাংলাদেশী কাঠ ব্যবসায়ীরা এখান থেকেই কাঠ এবং মাছ ইম্পোর্ট করে থাকে। মিয়ানমার রত্ন পাথরের জন্য প্রসিদ্ধ। বিদেশী দেখলেই স্থানীয় মগরা রত্ন পাথড় বিক্রয়ের জন্য পিছনে পিছনে ঘুড়ঘুড় করবে। আপনি ইচ্ছে মত আপনার পছন্দের পাথর খুব কম দামে(ডলারে)কিনতে পারবেন।
মংডুতে প্রবেশের পুর্বে নাসাকা বাহিনী এবং মংডুর ইমিগ্রেশন বিভাগে লিখিত অংগীকার নামা দিয়ে ঢুকতে হবে-যে আপনার সাথে কোন ইলেক্ট্রনিকাস দ্রব্য বিশেষ করে সেল ফোন এবং ক্যামেরা নেই। ওখানে বিদেশীদের জন্য এইসব জিনিষ বহন নিষিদ্ধ। যদিও ফোন করা নিয়ে তেমন সমস্যা নেই-কারন ওখানে বাংলাদেশের গ্রামীন এবং এক্টেল সেল ফোনের নেটওয়ার্ক আছে। আপনি ইচ্ছে করলেই লুকিয়ে নেয়া ফোনে প্রয়োজনীয় কাজ সারতে পারবেন। ওখানকার সকল চোরা কারবারীদের কাছে আমাদের ফোনের সীম কার্ড আছে।
মংডু থেকে আপনার পারমিশান থাকলে আকিয়াব যেতে পারবেন। আকিয়াব যাবার কারন হতে হবে অবশ্যই ব্যবসায়ীক। সাথে থাকতে হবে ট্রেড লাইসেন্স, চেম্বার অব কমার্সের মেম্বারশীপ ইম্পোর্ট লাইসেন্স। আকিয়াব যেতে জাহাজে সময় লাগে ১২ ঘন্টা। যাদের মিয়ানমার যাবার ভিসা আছে-তারা জাহাজে করেই ইয়াঙ্গুন যেতে পারবেন-সময় লাগবে ৪ দিন।
মংডু যাবার খরচপাতি এবং করনীয়ঃ আমাদের স্বরাস্ট্র মন্ত্রনালয়ের পাশ বই ফি (সোনালী ব্যাংকে চালানের মাধ্যমে জমা দেয়া) ৫০০ টাকা। ভ্রমন কর ৫০০ টাকা। বন্দর শুল্ক ৫০ টাকা। ট্রলার ভাড়া ১০০x২=২০০টাকা(আসা যাওয়া)। মংডুতে প্রতিদিন থাকা খাওয়া সর্বোচ্চ ৬০০ টাকা।
ওখানে থাকার জন্য আছে-কেন্নাহ, সুওই, ওহো ইত্যাদি রেস্ট হাউজ। আমাদের এক টাকার সমান মিয়ানমারের ১৬ টাকা। সংস্কৃতি প্রেমীদের জন্য মংডু সত্যিকারের উপভোগ্য ভ্রমনের এলাকা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।