আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আইন না মানার কারণেই এমনটি হয়েছে

সাভার ট্র্যাজেডির আগের দিন ভবনের ক্ষতি চিহ্নিত করা হয়েছিল। হারতাল বা অন্য কোনো কারণে যদিও মালিক বা অন্যরা বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হতে পারেননি। একটি উল্লেখ করার মতো দিক হলো, যেখানে সাধারণ মানুষ এ ধরনের ঝুঁকির বিষয় আগে অনুধাবন করতেই পারেনি, সেখানে তারা নিজেরাই ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ভবন থেকে মানুষজন বের করে দিল, যা আমাদের মতো পেশাজীবীদের দারুণ অনুপ্রাণিত করেছিল।
কিন্তু পরদিন সকালে ভবনধসের পর দেখা গেল, সেই ভবনে হাজার হাজার মানুষ ছিল। আগের রাতে যে ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলো, কোনো রকম বিশেষজ্ঞ মতামত না নিয়ে সেখানে হাজার হাজার মানুষকে কীভাবে ঢোকানো হলো? এটি আমাদের মর্মাহত করে।


পেশিভিত্তিক রাজনীতি, কিছু কিছু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর অবাঞ্ছিত জ্ঞানদান দেখা গেল। একজন স্থপতি নিশ্চয় ক্যানসারের চিকিৎসা করতে পারেন না, সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মত দেওয়ার এখতিয়ার। কিন্তু এখানে দেখলাম, ইউএনও ইমারত-বিশেষজ্ঞের মতো মত দিচ্ছেন। এই অভ্যাসটা আমাদের মধ্যে বাসা বেঁধেছে। কোনো বিষয়ে অজ্ঞ হয়েও সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ মত দেওয়া।

মূলত ইউএনও, ভবনমালিক বা কারখানার মালিকদের জন্যই এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটেছে।
আমরা অহরহ বিজিএমইকে দোষারোপ করি তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপের জন্য। কিন্তু সাভারের এ ঘটনায় সংগঠনটি কঠোর ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তারা সর্তকবার্তা দিয়ে বলেছিল, বুয়েটের বিশেষজ্ঞ মতামত না নিয়ে কারখানা চালু করা যাবে না। মালিকপক্ষ তা মানেনি।

বিজিএমইএর তার সদস্যদের নির্দেশ মানানোর ক্ষমতা নেই। হতে পারে, সংগঠনটি সদস্যদের নির্দেশ দেওয়ার আস্থা বা বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি।
কিন্তু আমরা এর মাধ্যমে বিজিএমইএর পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি, বিশেষ করে তাজরীনের ঘটনার পর। যদিও এটি তাদের মানসিক পরিবর্তন নয়। এই পরিবর্তন আনতে তারা বাধ্য হয়েছে নিজেদের বাঁচার স্বার্থেই।

দেশে ও দেশের বাইরে নিজেদের ব্যবসা, মুনাফার প্রবাহ বজায় রাখার জন্য শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করা জরুরি। সংগঠনটির প্রতি মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে, যার বহিঃপ্রকাশ সাধারণ শ্রমিকেরা বিজিএমইএ ভবনে হামলার মাধ্যমে দেখিয়েছেন।
আমরা বিজিএমইএর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করেছি। তাদের বিভিন্ন কারখানা পরিদর্শন করে আমরা অনেক সুপারিশ দিয়েছি। এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেক হ্রাস করা যেত।

কিন্তু সংগঠনটি বাস্তবায়ন করেনি। তাদের তোড়জোড় দেখা যায় হতাহতের পর।
রানা প্লাজার মতো ভবন অহরহ নির্মিত হচ্ছে। আদৌ কি এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্মাণ বন্ধ করা যাবে? কোনো কর্তৃপক্ষ আছে তা নিয়ন্ত্রণে? আজ থেকে ৪০ বছর আগেও বহুতল ভবন বলতে হাসপাতাল, সিনেমা হল, স্কুল বা কলেজের ভবনগুলোকেই দেখা যেত। দোতলার বেশি আবাসিক ভবন চোখে পড়ত না।

বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটতে থাকে। সঙ্গে বেড়ে যেতে থাকে বিশাল এলাকা নিয়ে গড়া বহুতল ভবন।
গার্মেন্টস কারখানা শুরু হয়েছিল আবাসিক এলাকায়, যা আইনের দৃষ্টিতে অপরাধ। কারণ, গার্মেন্টসের কাঁচামাল অনেক স্পর্শকাতর বস্তু। যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

দুর্ঘটনা থেকে শ্রমিকদের বাঁচানোর ব্যবস্থা এসব ভবনে সাধারণত থাকে না। আমাদের দেশে এই অনিয়ম দ্রুতগতিতে বেড়ে গেছে। কারণ, গার্মেন্টস-শিল্পটি সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠেনি। শ্রমিক সংগ্রহ ও ব্যবসা যত দ্রুতগতিতে বেড়েছে, অবকাঠামো উন্নয়ন সেই গতিতে হয়নি। এই গতিশীল শিল্পটিতে কী ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তার জন্য কোনো পরিকল্পক, বিশেষজ্ঞ মত নেয়নি সরকার।

এটা সরকারের অদূরদর্শিতা।
একটি আবাসিক ভবন নির্মাণ করা হয় কয়েকজন মানুষের জন্য। কিন্তু সেখানে কারখানা স্থাপন করলে যে সংখ্যায় মেশিন বসে বা শ্রমিক কাজ করেন, তা চিন্তা করে কিন্তু ভবনটি নির্মাণ করা হয়নি। এ ভবনটি তখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। কিছুদিন যেতেই নানা দুর্ঘটনা যখন এই ভবনগুলোয় দেখা গেল, তখন অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু আধুনিক ভবন নির্মাণ করলেন।

কিন্তু আগের ভবনটি থেকে গেল। আমরা এই ভবনগুলো এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। আমরা বলেছি আবাসিক এলাকার বাইরে চলে যেতে। সরকার বা সংশ্লিষ্ট পক্ষকে আমরা ধীরে ধীরে সরিয়ে নেওয়ার কথা বলছি। আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি এই শিল্পগুলোকে বিভিন্ন জেলায় নিয়ে যেতে।


গার্মেন্টস কারখানায় দুর্ঘটনার মাত্রা ভয়াবহ। এটা নিয়ে রাজনীতি না করে উচিত প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া। শ্রমিকদের অগ্নিনির্বাপণের ব্যাপারে সচেতন শুধু নয়, তাদের একেকজনকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী হিসেবে গড়ে তোলা দরকার। শুধু সরকার নয়, মালিকদেরও এ বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত। এভাবে দুর্ঘটনা ঘটতে থাকলে কিছুদিন পর আর গার্মেন্টসের মালিকেরা সমাজে নিজেদের পরিচয় দিতে পারবেন না।


এই ভবনটি যে ভেঙে গেল, তা কীভাবে তৈরি হলো, তার দেখভাল কে করল? ভবন নির্মাণসংক্রান্ত আমাদের কিছু আইন জানা থাকা দরকার। বাংলাদেশের পৌরসভাগুলোকে এই অধিকার দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ২০১০ সালে ড্যাপের আওতায় ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, সাভার, টঙ্গী, গাজীপুর পৌরসভা সেই ক্ষমতা হারায়। এখন এই ক্ষমতা রাজউকের ওপর ন্যস্ত। এ আইন রাজউক বা সংশ্লিষ্ট পৌরসভা জানে, কিন্তু বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেয়নি।

কিছু উপরি টাকা পাওয়ার আশায় অধিকারবহির্ভূতভাবে পৌরসভাগুলো বেআইনি অনুমোদন দিয়েছে। রাজউকের কাছে অনুমোদন নিতে ভোগান্তির অভিযোগ তোলা হয়। অন্যদিকে রাজউকের কথা, তাদের লোকবল নেই। যদি লোকবল না-ই থাকে, তবে কেন তারা এই দায়িত্ব নিল? বিশেষজ্ঞ মত ছাড়া এ ধরনের ভবন নির্মাণ বেআইনি।
এই ভবনটির অনুমোদন দিয়েছে সাভার পৌরসভা।

সাভার পৌরসভায় বিশেষজ্ঞ কেউ আছেন বলে জানা নেই। রাজউকের চেয়ারম্যান মারফত জেনেছি, সাভার পৌরসভা পাঁচতলা নির্মাণের অনুমতি দেয়। কিন্তু মালিক দশতলা নির্মাণের ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন। যত তলা নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া হোক না কেন, সাভার পৌরসভার যেখানে অধিকারই নেই অনুমোদন দেওয়ার, সেখানে তারা কীভাবে এটা দিল? অবশ্যই এটি আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে করা হয়েছে।
আবার একজন প্রকৌশলী হলেই ভবন নির্মাণ করার অধিকার রাখেন না।

কারণ, কাঠামো-প্রকৌশলী হতে হলে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে আসতে হয়।
এসব বিষয়ের দেখাশোনার দায়িত্ব এখন রাজউকের। গোড়ায় রাজউকের প্রধান দায়িত্ব ছিল ভবন নির্মাণ ঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তার তদারকি করা। সেই সঙ্গে নগরে রাস্তা বা ভবন বানানোর তদারকিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে দেখলাম, জনতা টাওয়ার এরশাদ সাহেব কুক্ষিগত করতে রাজউককে ব্যবহার করেছিলেন।

প্লট বা জমি পাওয়ার জন্য সব সরকারই রাজউককে ব্যবহার করছে। রাজউকের প্লট বা আবাসন-সুবিধার প্রকল্প থেকে সুশীল সমাজের অনেকেই সুবিধা নিয়েছেন।
সমস্যা এখানেই যে, একটি ভবনের নকশা বিখ্যাত কোনো প্রকৌশলীকে দিয়ে করানো হলো। কিন্তু নির্মাণের সময় যদি নিম্নমানের কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়, তখন দুর্ঘটনা নিশ্চিত। এই দায় কিন্তু নকশাকারী প্রকৌশলীর ওপর বর্তায় না।

এ জন্য বাজারে প্রচলিত নির্মাণসামগ্রীর মান নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। বাজারে যে রড, সিমেন্ট পাওয়া যায়, তার মান সম্পর্কে সাধারণ মানুষ কতটুকু জানে? সরকারি মান নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বিএসটিআই কখনো স্টিল বা রড কারখানায় অভিযান চালিয়েছে বলে শুনিনি।
আবার সঠিক কাঁচামাল পেলেও তা যদি সঠিকভাবে মেশাতে না পারি, তাহলেও কিন্তু সমস্যা থেকে যাচ্ছে। অর্থাৎ ভবন নির্মাণের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ নজরদারি থাকতে হবে।

শুধু কিছু অর্থ সাশ্রয়ের জন্য নিশ্চিত ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। সাভারের ভবনে দেখা যায়, বিম বা কলামগুলোর কংক্রিট সঠিকভাবে মেশানো হয়নি। আমার বিশ্বাস, সেখানে কোনো মিক্সচারযন্ত্র ব্যবহার করা হয়নি এবং সঠিক মাত্রায় কাঁচামাল মেশানো হয়নি।
এই কাজগুলো যাতে ভালোভাবে হয়, তার জন্য রাজউকের কাজ করা দরকার। প্রয়োজনে রাজউককে ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে বের করে এনে সম্পূর্ণ তদারকি সংস্থা হিসেবে দাঁড় করাতে হবে।

অথবা তদারকির কাজ পুরোপুরি নতুন কোনো সংস্থাকে দিতে হবে। তবে সরকারের হস্তক্ষেপ করা চলবে না। রাজউককে একটি স্বতন্ত্র নিয়ামক সংস্থা হিসেবে চলতে দিলেই এ ধরনের বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণ সহজ যাবে।
মোবাশ্বের হোসেন, সভাপতি, বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।