আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমি কী হনু রে সিনড্রোম ও তার গপ্পো

জাদুনগরের কড়চা
উইকিপিডিয়াকে মোটামুটি একটা আন্তর্জাতিক চিড়িয়াখানা বলা যেতে পারে, নানা কিসিমের মানুষজন নানা মতলবে আনাগোনা করে এইখানে। আমার মতো বেকুব কয়জনায় মনের সুখে জ্ঞান যোগ করে, কিন্তু বিপুল পরিমান মানুষ ঐখানে আসে অন্য ধান্ধায়। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গলাবাজি, কিংবা জাতীয়তাবাদের ছড়াছড়ি তো আছেই, তার সাথে গোদের উপরে বিষফোঁড়ার মতো আছে, "আমি কী হনু রে" সিনড্রোমে (আকীহরে) আক্রান্ত ব্যক্তিরা। "আকীহরে" সিনড্রোমের মোদ্দা কথা হলো, নিজেই নিজেকে বিখ্যাত মনে করা, তার পর বিদ্যাসাগরের সেই অমৃত বাণীকে আক্ষরিক ভাবে নেয়া ("আপনা ঢাক আপনি বাজাইও। অপরকে দিলে ফাটাইয়া ফেলিতে পারে")।

এহেন আকীহরে রোগাক্রান্ত ব্যক্তিরা উইকিতে হাজির হয়, তার পর প্রথম সুযোগেই নিজের একটা জীবনী লিখে ফেলে। জীবনী নিবন্ধের ক্ষেত্রে উইকির বেশকিছু মাপকাঠি আছে। যেমন, লেখকদের ক্ষেত্রে নামকরা গণমাধ্যমে লেখকের লেখা নিয়ে একাধিক আলোচনা থাকলে, কিংবা লেখক পুরষ্কার পেয়ে বসলে, তারপর তাকে গুরুত্বপূর্ণ ধরা যায়। রাজনৈতিক পাতি নেতারা গুরুত্বপূর্ণ না, কিন্তু কোনো সংসদ বা অন্য পদে নির্বাচিত হলে সেটা গুরুত্বপূর্ণ। এসবের মধ্যেও অনেক ফাঁক বা গ্রে এরিয়া আছে।

তবে মোটামুটি ভাবে সাধারণ হিতাহিত কাণ্ডজ্ঞান থেকেই বোঝা যায়, কে আসলেই খ্যাতনামা, আর কে অখ্যাত। সমস্যাটা দাঁড়ায় যখন আকীহরে ব্যক্তিরা হাজির হয়। শুরুতেই এরা নিজের নামে একটা এন্ট্রি খুলে বসবে। "দ্রুত বিচার আইন" এর মতো উইকিতেও "দ্রুত অপসারণ" প্রক্রিয়া আছে, তার মাধ্যমে ট্যাগ করে দেয়া যায় হাবিজাবি এন্ট্রিগুলো (যেমন "আক্কাস একজন বাংলাদেশী ছাত্র। তার বাড়ি অমুক স্থানে।

ফুন লম্বর ০১৭-১২৩৪৫৬৭৮। " এরকম)। কিন্তু আকীহরে ব্যক্তিটি একটু চালাকচতুর হলেই ধরে ফেলবে, দ্রুত বিচারের খড়গ থেকে বাঁচতে হলে দুই একটা আসল/নকল "সূত্র" দিয়ে ফেলতে হবে। সেটা দিয়ে ফেললে আমলাতান্ত্রিকতায় আর ওটা দ্রুত অপসারণ করা যাবে না, যেতে হবে অপসারণ প্রস্তাবনা, অথবা অপসারণের ভোটে। ঐ অপসারণ ভোটের সময়ে একজন প্রস্তাব রাখে, আক্কাসের জীবনীটি অমুক নীতিমালার অধীনে অপসারণ করা হোক, আর বাকিরা আলোচনা করে একমত, অথবা "মানিনা" এই মতে।

অবশ্য যেকোনো মতের সপক্ষে বলতে হয়, কোন যুক্তিতে -- যুক্তি-ফুক্তি ছাড়াই "আক্কাসরে ভালা পাই তাই মানি না" এই রকম কথা বললে ঐটা আমলে আনা হবে না। ৫ থেকে ৭ দিন এই ভোটের পালা চলে তার পর একজন প্রশাসক সিদ্ধান্ত নেয়, হ্যাঁ নাকি না জয়যুক্ত হয়েছে, তার পর নিবন্ধ রাখা হয় বা মোছা হয়। বাংলাদেশের লোকদের জীবনী নিবন্ধগুলোর উপরে নজর রাখি, আগে উইকি কি এইটা মানুষে না বুঝলেও ইদানিং "সচেতনতা" বেড়ে গেছে, তাই এখন সপ্তায় না হলেও মাসে একটা দুইটা আকীহরে জীবনী যোগ হয়। বাংলাদেশী উইকিপিডিয়ানদের সংখ্যা বেশ কম, সেই সুযোগে আকীহরেরা নানা ভুজুং ভাজুং দেয়ার চেষ্টা করে, হাবিজাবি জিনিষকে "রেফারেন্স" বলে দাবী করে বসে। উদাহরণ দেয়া যাক, লন্ডনপ্রবাসী জনৈক ব্যক্তি (নাম বলবোনা) পেশায় সম্ভবত ব্যবসায়ী, আর শখ হলো মহাকাশ সম্পর্কে পড়া, নিজের পয়সায় একটা "উপন্যাস" ছাপিয়েছেন।

এই ব্যক্তির হঠাৎ আকীহরে রোগ পেয়ে বসলো, ব্যস, শুরু করে দিলেন নিজের নামে জীবনী। তাও আবার ছদ্মনামের একাধিক উইকি ইউজার অ্যাকাউন্ট থেকে (নাম আলাদা কিন্তু কাম দেখলেই বুঝি একই লোকের কাজ)। এই লোকের কাজ হলো বিভিন্ন থিওরি বের করা, তার পর দাবী করা সেই নাকি প্রথম ব্যক্তি যে ঐরকম থিওরি বের করেছে। বলাবাহুল্য, তার এইসব তত্ত্ব ছাপা হয়না কোনো গবেষণা জার্নাল কিংবা কনফারেন্সে, তার প্রকাশের ভেন্যু হলো বিভিন্ন নিউজগ্রুপ বা নিজের সাইট। বাংলাদেশের মিডিয়ার একটা সমস্যা আছে, বিজ্ঞান বিষয়ক অনেক কিছুকেই যাচাই বাছাই না করেই এরকম প্রতারকদের কথা ফাটিয়ে লিখে (বাঙালির কৃতীত্ব এরকম ধাঁচে, "নয়ন সুপারকম্পিউটার", "কচির শূণ্য থেকে বিদ্যুৎ দ্রষ্টব্য)।

তো, জনাব আকীহরে "জ্যোতির্বিদ" এরকম কিছু রিপোর্ট লিখিয়ে নিয়ে তার পর "বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিকাল অ্যাসোসিয়েশন"কেও পটিয়ে ফেললেন, তার পর কায়দা করে সেই সমিতির "অনারারি মেম্বার" হিসাবে "মর্যাদা" অর্জন করলেন। ব্যস, আকীহরে হিসাবে নিজের জীবনীতে ঐটাও ফাটিয়ে যোগ করে দিলেন, হাজার হলেও বিদেশী কারো পক্ষে নাসা আর বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিকাল অ্যাসোসিয়েশনের পার্থক্য করা কঠিন, তাই নাসার ফেলো আর বাস এর অনারারি ফেলোর পার্থক্য ধরতে না পেরে অপসারণের ভোটে জেতা যাবে সহজে, এই ধান্ধায়। সেবার অনেক কষ্টে সৃষ্টে এই আকীহরে "জ্যোতির্বিদ" এর ধাপ্পাবাজি প্রমাণ করতে পারা গেছিলো। -- গত সপ্তাহে আরেক আকীহরে এলো, তার অবশ্য পথ অন্য, সে হলো আকীহরে গায়ক। বাংলাদেশের সঙ্গীত ধারা সম্পর্কে আগে হালনাগাদ ছিলাম, ইদানিং দূরে থাকলেও এতো দূরে নাই যে বিশ্বকোষীয় কাউকে চিনবো না।

"জ্যা" আদ্যাক্ষরের এই গায়কের এন্ট্রি দেখে তাই ঘাবড়ে গেলাম, এমনই কি বয়স হলো যে এমন "বিখ্যাত" গায়ককে চিনি না!! এই আকীহরে আবার একগাদা পত্রিকার রেফারেন্স দিয়ে এসেছে তার ছদ্মনামের উইকি একাউন্ট থেকে। খোঁড়াখুড়ি শুরু করলাম, তার পর বেরুলো অন্য ঘটনা, ডেইলি স* নামের পত্রিকার একাধিক শাখা, উদীয়মান পাতা, আর জীবনধারা পাতায় ঐ আকীহরে গায়কের নামের উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু দুই আলাদা কলাম লেখকের লেখাতেই বিশাল এক প্যারাগ্রাফ হুবুহু মিলে যায়। পরে আরেক বাংলাদেশী উইকিপিডিয়ান নিয়াজ মোর্শেদ চৌধুরী জানালো, ঐ পত্রিকার এসব পাতায় সাধারণত স্কুল কলেজের ছাত্ররা লিখে থাকে, তাই সম্ভবত আকীহরের বন্ধু বান্ধব টাইপের কেউ চোথা অনুসারে লিখেছে। আকীহরে আবার নিজের "মাইস্পেইস" পাতাকেও "রেফারেন্স" টেনেছিলো, পরে বেরুলো ঐ বিশাল প্রশংসামূলক কথামালা আসলে তার নিজের মাইস্পেইসের আত্মজীবনী থেকে নেয়া। বলাই বাহুল্য, আকীহরে গায়কটির আত্মজীবনীও মানদন্ডে পাত্তা পায়নি, পটল তুলেছে ক'দিন আগে।

--- আকীহরেদের আপাতত ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে, কিন্তু এদের দৌরাত্ম ক্রমশ বেড়ে চলেছে। একসময় নিজের ওয়েবপেইজেই এদের আনাগোনা সীমিত ছিলো, কিন্তু এখন ফেইসবুকে ফ্যান ক্লাব নিজেরটা নিজেই খুলে বসা* থেকে শুরু করে উইকিতেও হানা দেয়া শুরু হয়েছে। আর তার উপরে বাংলাদেশের বাংলা পত্রিকাগুলো জব্বারীয় পুরানো কাগু-বাংলা নিয়ে বসে থাকাতে সার্চ করা সেখানে অসম্ভব, কাজেই কে আসলে বিখ্যাত, আর কে আকীহরে, তা বোঝা কষ্টকর। উইকির এটা একটা দূর্বলতা, তবে উল্লেখযোগ্যতার নীতিমালার কড়া প্রয়োগ, আর সবকিছুর রেফারেন্স প্রদান বাধ্যতামূলক করার মাধ্যমে আকীহরেদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা ওখানে করা হয়। অবশ্য অনেক সময়ে আকীহরেরা নানা ফ্যাসাদেও পড়ে যায়, যেমন আকীহরে জীবনী অপসারণের প্রস্তাবনাতে অনেক সময়েই ঐ ব্যক্তিটি কীরকম নগন্য তা নিয়ে বিশাল আলাপ হয়, এবং মোছার সপক্ষের লোকেরা নানা প্রমাণ হাজির করে।

গুগলের কল্যাণে এক সময়ে অনেক আকীহরের নাম দিয়ে সার্চ করলে এই সব মর্মান্তিক আলোচনাই চলে আসতো, বাস্তব জীবনে মাথা কাটা যাবার মতো সব কথা আকীহরেকে খোঁজা ব্যক্তিদের চোখে এসে যেতো। বিপুল সংখ্যক আকীহরের "মানহানী" হচ্ছে বলে উইকিকে মামলার ভয় দেখানোতে এখন আর ঐ আলোচনার পাতা গুলা গুগলকে দেখতে দেয়া হয় না। হাজার হলেও, আকীহরে সিনড্রোম বলে কথা ... সমালোচনা সহ্য করা, কিংবা নিজেদের আসল রূপের প্রকাশ সওয়াটা তাদের পক্ষে অনেক অনেক কঠিন ...
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।