আগের পর্বের জন্য Click This Link
এখলাসুদ্দিনের আজ মন ভালো নেই। সকাল থেকেই দিনটা খারাপ যাচ্ছে। অফিসের উদ্দেশে বের হয়েই রাস্তায় একটা রক্তাক্ত লাশ দেখেছেন। তিনি ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর মিনিট খানেক আগেই নাকি দুর্ঘটনাটা ঘটেছে। একটা বাস বেপরোয়া গতিতে চলতে গিয়ে লোকটার হতবুদ্ধির অবকাশে তাকে চাপা দিয়ে চলে গেছে।
দেখেই তার মনটা কেমন যেন হয়ে গেলো। এসব ঘটনায় সাধারণত তার কোনো অনুভূতি কাজ করেনা, আজ চোখের সামনে এরকম একটা লাশ দেখেছেন বলেই হয়তো খারাপ লাগছে।
কিন্তু এখলাসুদ্দিনের জন্য সারাদিনে আরো বিপত্তি অপেক্ষা করছে। অফিসের কাছে পৌঁছে দেখেন পিচ্চি রফিকের দোকান তখনও খোলা হয়নি। পাশে বিড়ি-সিগারেট নিয়ে বসে যে লোকটা সে বললো রফিকের নাকি কাল জ্বর জ্বর লাগছিলো, আজ বোধহয় সে কারণেই আসেনি।
‘কিন্তু এ তো বড়ই বিপদ হলো! আশেপাশে আর কোনো টং জাতীয় দোকানও নেই। নাস্তা করতে হলে আজ যেতে হবে অফিসের পাশের ‘ লাইলি-মজনু খাবার হোটেল’ এ। সে মুরোদ এখলাসুদ্দিনের নেই, তাই সকালের নাস্তা পর্বটা আজ তার সারা হলো না। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অফিসের দিকে পা বাড়ালেন। ভাবলেন, হলো না-ই বা নাস্তা, দুপুরে পুষিয়ে দেয়া যাবে।
আজ বুধবার। এদিন আবার সরওয়ার সাহেব মুড়োঘণ্ট নিয়ে আসেন। উনার স্ত্রী এই মুড়োঘণ্ট পদটা বেশ রাঁধেন। ভদ্রমহিলার রাঁধুনীশৈলি’র সাথে কোথায় যেন তার মায়ের রান্নার মিল আছে। তার মায়ের রান্না’র স্বাদ যে এখনো তার খুব ভালো মনে আছে তা নয়, কিন্তু তার কেন যেন এমনটা মনে হয়! ‘যাই হোক, আজ সরওয়ার সাহেবের ভাগ থেকেও মেরে দিতে হবে অর্ধেকটা।
‘ এই ভাবতে ভাবতে অফিসে ঢুকলেন এখলাসুদ্দিন।
কিন্তু অফিসে ঢুকেই তিনি দেখলেন সরওয়ার সাহেবের টেবিল ফাঁকা। ঘড়ি দেখলেন দেয়ালে, ৮টা বেজে ২৫ মিনিট। উনি তো প্রতিদিনই ঘড়ি ধরে ৮টা বাজার ৫ মিনিট আগে অফিসের বাউন্ডারিতে ঢুকে পড়েন, তবে আজ কি হলো? পাশের টেবিলের জামিল সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন এখলাসুদ্দিন। ‘আপনি খবর শোনেননি?গতকাল রাতে তো সরওয়ার সাহেব স্ট্রোক করেছেন।
অ্যাপোলো’তে আছেন। অবস্থা ক্রিটিকাল। মনে হয় বাঁচবেন না। আমরা তো আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে উনাকে দেখতে যাবো। এমডি স্যারও যাবেন।
আহা!...লোকটা আসলেই অনেক ভালো ছিলেন। অনেক মাই ডিয়ার একটা লোক ছিলেন......’ শেষ কথাগুলো এখলাসুদ্দিনের কানে বাজে না। তিনি কেমন যেন বিষন্ন হয়ে যান। কি হচ্ছে আজ? অনেক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন সরওয়ার সাহেবের ডেস্ক এর দিকে তাকিয়ে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের ডেস্কে বসে যান।
...তিনি নিজের ভাবনার সাথে যুদ্ধ করতে থাকেন। কাজে মন বসাতে পারেন না। দিনের শুরুতে একঘন্টা কাজের মধ্যেই তিনি চারবার হিসাব ভুল করে ফেলেছেন। বার বার মন চলে যাচ্ছে লাশটার ভাবনায়, পিচ্চি রফিকটা আজকে দোকান খোলেনি, ওর কথাও ভাবছেন তিনি। বার বার চোখ চলে যাচ্ছে পাশের ফাঁকা টেবিলটায়।
তিনি অনুভব করতে শুরু করেছেন, লোকটার জন্য তার মনে আসলে বেশ নমনীয় একটা জায়গা আছে! এতদিন এখলাসুদ্দিন সেটা বুঝতে পারেননি, আজ হঠাৎ বুঝতে পেরে যেন বিষন্ন হয়ে গেলেন। এসব আবেগ তো তাকে মানায় না!...তিনি তো খারাপ লোক! ... পাপী!...
‘আবু ফরহাদ মোহাম্মদ এখলাসুদ্দিন বিন শরীয়তুল্লাহ ...নিজের প্রায় ভুলে যাওয়া পুরো নামটার উচ্চারণ কানে যেতেই চমকে তাকান তিনি। এভাবে পুরো নামে তাকে একমাত্র তার নানা ডাকতেন। বলতেন,’তোর পরিচয় তোর পুরো নামে। একটা একটা নামের অংশ তোর পরিচয়ের এক একটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ মাত্র।
...আল্লাহ তাআলা’র যে একশ’ নাম, তার এক একটাতে তার এক একটা পরিচয় প্রকাশ পায়। আর সব মিলিয়ে তিনি এক, তিনি আল্লাহ!’ ‘শখ কইরা আপনের এত্ত বড় নামটা কেডায় রাখসিলো কন তো?...’ টাইপিস্ট হারুনের গলা শুনে এখলাসুদ্দিনের চমক ভাঙ্গে। তিনি বোকার মত তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, ‘হ্যাঁ?’...’কৈলাম আপনার এই ঢাকা টু কইলকাত্তা নাম কেডা রাখসিলো? এক নাম টাইপ করতেই তো এক লাইন শেষ!...’ বলে পান খাওয়া লাল দাঁত বের করে বিটকেলে হাসি হাসতে থাকে টাইপিস্ট হারুণ। এখলাসুদ্দিন দেখতে পারেন না এই লোকটাকে। বয়স কত হবে? ২৭-২৮! এই বয়সেই পান খেয়ে দাঁত বিশ্রী রকমের লাল করে ফেলেছে।
চুলে আবার স্টাইল করে, কি নাকি বলে’ স্পাইক’ !...এখলাসুদ্দিন তার কথার উত্তর দেয় না। ভাবেন, তার নাম কেন টাইপ করছে হারুণ? ‘আপনি এইখানে চাকরি করেন কয়দিন?’ আবার প্রশ্ন করে সে? ’২২ বছর’ আনমনে উত্তর দেয় এখলাসুদ্দিন। ‘হুমম...২২ বছরে তো অনেক কিছুই কইরা খাইসেন......এই জায়গারে তাইলে অনেক মিস করবেন......’ বলেই আবার বিটকেলে হাসি হাসতে থাকে হারুণ। এখলাসুদ্দিন হতবুদ্ধি হয়ে হারুণের দিকে তাকিয়ে থাকে...। কী টাইপ করছে সে? টারমিনেশন লেটার? এখলাসুদ্দিন বুকের বাম দিকে হঠাৎ চাপ অনুভব করেন।
তার মাথা ঘুরে আসে। টেবিলে মাথা নিচু করে বসে থাকেন তিনি।
......''কী হচ্ছে আজকে এসব??'' ভাবনারা ক্রমাগত মাথার ভেতর পায়চারি চালায়। ... পাপ ! পাপের শাস্তি ??
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।