চলে গেলেন মহান ভাষা আন্দোলনের নেত্রী বেগম মনোয়ারা রহমান (১৯৩৫-২০০৯)। আজ বিকেলে রাজশাহী মহানগরীর হেতেমখাঁ গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিলো ৭৪ বছর। এই মহিয়সী নারীর কর্মময় জীবনের কিছু অংশ ব্লগারদের জন্য তুলে ধরলাম।
১৯৫২ সাল।
ফেব্র“য়ারি মাস। আন্দোলনে উত্তাল দেশ। মায়ের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ঢাকার সাথে সাথে সংগ্রামমুখর রাজশাহী। এই আন্দোলনে বেগম মনোয়ারা রহমান নারীদের সংগঠিত করলেন আশাতিতভাবে। তিনি তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী।
রাজশাহীবাসী বায়ান্নর সেই ভাষা আন্দোলনে দেখেছিল এক অল্পবয়সী অগ্নিকন্যার সাংগঠিনক ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্বদানকারী ভাষাসৈনিক আবুল হোসেন, গোলাম আরিফ টিপু, আবু সাঈদ, আব্দুর রাজ্জাকসহ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেদিন রাজশাহী কলেজে নির্মিত হয় দেশের প্রথম শহীদ মিনার। যা এখানো জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি পায়নি।
নেতৃত্বের গুণ তাঁর বংশগত। রক্তেই মিশে আছে তার রাজনীতির রেনু।
তাঁর বাবা মাদার বখ্শ তখন একজন উপমহাদেশ খ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। বাবার কাছ থেকেই শিখেছেন রাজনীতি, মানবপ্রেম ও দেশপ্রেমের মূল মন্ত্র। রাজশাহী তথা গোটা উত্তরাঞ্চলের প্রগতিশীল রাজনীতির পুরধা, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেতা ও বঙ্গবন্ধু সরকারের রাজশাহী অঞ্চলের গভর্ণর জননেতা এম আতাউর রহমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৫৩ সালে। রাজনীতি করতে গিয়েই আতাউর রহমানের সাথে পরিচয় হয়েছিলো মনোয়ারা রহমানের। এই পরিচয় থেকেই ঘটে পরিনয়।
আতাউর রহমান ছিলেন জননেতা মাদার বখশের খুব প্রিয় রাজনৈতিক শিষ্য।
১৯৫২ সালের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে রাজশাহীতে মহিলাদের নিয়ে বের করেন অগ্নিশিখা মিছিল। সে সময় এই ব্যাতিক্রমধর্মী মিছিলের উদ্যোক্তা হিসেবে উপমহাদেশে বেশ আলোচিত হয়েছিল বেগম মনোয়ারা রহমানের নাম।
শুধু ভাষা আন্দোলনই নয়। মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন আন্দোলন ও সামাজিক কর্মকান্ডে নিঃশর্তভাবে অবদান রেখে গেছেন এই মহিয়সী নারী।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে জনগণকে উদ্বুদ্ধকরণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। বাংলাদেশে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রাজশাহীতে ১৯৫২ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত নেতৃত্ব দিয়েছেন বেগম মনোয়ারা রহমান। রাজশাহীতে সমাজসেবার ক্ষেত্রে বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছেন। বিশেষত নারী সমাজের উন্নয়ন, নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, বয়স্ক শিা, ও নিররতা দূরীকরণসহ নিঃস্বার্থভাবে সমাজসেবায় অনন্য অবদান রেখেছেন। তিনি স্বেচ্ছায় রক্তদান, গবাদি পশু ও মৌমাছি পালন কর্মসূচিতে নারীদের সম্পৃক্ত করে মানব কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
মহিলা শিল্প প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন গঠণমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দুঃস্থ অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া নারী সমাজ নানাভাবে উপকৃত ও লাভবান হয়েছে। ঘরে ঘরে গিয়ে অনুদান সংগ্রহ এবং আর্ত-মানবতার সেবায় প্রেরণ। উঠান বৈঠকের মাধ্যমে মা বোনদের উজ্জীবিত করেছেন।
তিনি রাজশাহী মহিলা শিল্প প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে কুটির শিল্পের মাধ্যমে বিগত৩৫ বছরে ৫হাজারের অধিক গরীব, দুঃস্থ ও অসহায় নারীদের সেলাই, বাটিক প্রিন্ট, এমব্রোডারি ও তাঁত শিল্প বিষয়ে প্রশিণের দ্বারা স্বনির্ভর করে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন এবং সেইসব নারী সমাজ জীবনে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন।
অবহেলিত নারী জাগরণের ক্ষেত্রে তিনি বিভিন্ন সময়ে ইস্যু ভিত্তিক নারী আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন এবং সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন।
তিনি আজীবন নির্যাতিত নারীদের পাশে থেকে নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালন করেছেন।
বেগম মনোয়ারা রহমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি রাজশাহী মহিলা শিল্প প্রতিষ্ঠানের আজীবন সম্পাদিকা (১৯৭৩-২০০৭), রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য (১৯৭৫-১৯৮০), রাজশাহী এসোসিয়েশনের মহিলা নির্বাহী পরিষদের সম্পাদিকা (১৯৮৫-২০০৫), শহর সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালনা পরিষদের সদস্য, (১৯৭৫-২০০৬), স্পন্দন সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদ রাজশাহীর সভানেত্রী (১৯৭৭-১৯৯০), মাদার বখ্শ স্মৃতি সংসদের সভানেত্রী (১৯৭৭-১৯৯৪), রাজশাহী সাধারণ গ্রন্থাগারের নির্বাহী পরিষদের সদস্য (১৯৮০-২০০০) ছিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।